‘সূর্য অস্ত গেছে, চন্দ্রও অস্ত গেছে, অগ্নি নির্বাপিত (অর্থাৎ আগুন জ্বালিয়ে যে একে অন্যকে দেখব তার উপায় নেই), কথাও বন্ধ (অর্থাৎ চিৎকার করে ডাকবারও উপায় নেই)। তখন কোন জ্যোতি নিয়ে মানুষ (বেঁচে) থাকে, বলুন তো যাজ্ঞবল্ক্য?’
এবার সংস্কৃতটা শুনুন :
‘অস্তমিতি আদিত্যে, যাজ্ঞবল্ক্য, চন্দ্রমস্যস্তমিতে, শান্তেহগ্নৌ, শান্তায়াং বাচি, কিংজ্যোতিরেবায়ং পুরুষঃ?’
প্রচলিত মন্দাক্রান্তা বা শার্দুলবিক্রীড়িত ছন্দে এই অতুলনীয় সঙ্গীত-মন্দ্রিত-স্পন্দিত ছত্র বেঁধে দিলে কি প্রভু যিশুর ভাষায়, লিলিফুলের উপর তুলি নিয়ে রঙ বোলানো হত না?
এতেও যদি আপনাদের মন না ভরে তবে পড়ুন ইংরেজি অনুবাদে বাইবেল– রাজা দায়ুদের গান, সুলেমান বাদশার গীতি (সং অব সংজ, সং অব সলোমন)। সে তো গদ্যে এবং স্বয়ং বার্নার্ড শ বলেছেন, ওই সলোমনের গীতটি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা।
আবার আপনি যদি মুসলমান হন তা হলে তো কথাই নেই। আপনি জানেন প্রাক-পয়গম্বর যুগেও আরবদের ছিল বহু বিচিত্র ছন্দে, মিলের কঠোরতম আইনে বাঁধা অত্যুকৃষ্ট কাব্যসৃষ্টি। গদ্য ছিল না, কিংবা প্রায় না থাকারই মতো। তথাপি আল্লা-তালা। পয়গম্বরকে যে কুরানের বাণী পাঠালেন সে তো গদ্যে। অথচ আরবি-ভাষা নিয়ে যারা সামান্যতম চর্চা করেছেন তারাই শপথ করে বললেন, এঁর ছন্দোময় গদ্য যে কোনও বাধা কাব্যকে হার মানায়। পয়গম্বরকে যখনই তাঁর বিরুদ্ধপক্ষ কোনও মিরাকল (অলৌকিক কীর্তি) দেখাতে আহ্বান করত তখনই তিনি সবিনয়ে বলতেন, ‘আমি নিরক্ষর আরব। তৎসত্ত্বেও আল্লা-তালা আমার কণ্ঠ দিয়ে যে কুরান পাঠালেন তার কাছে কি আসতে পারে তোমাদের শ্রেষ্ঠতম কাব্য? এইটেই হল সবচেয়ে বড় মিরাকল।’
অতএব মডার্ন কবিরা যদি ছন্দ অস্বীকার করেন তবে আপনি চটেন ক্যান?
তৎসত্ত্বেও মডার্ন কবিতার দুশমনরা হয়তো বলবেন, তারা সুন্দর সুন্দর জিনিসের সঙ্গে বিকুটে সব জিনিসের তুলনা দেয়– যেমন তালগাছের ডগায় চাঁদ দেখে লিখলে, এ যেন আকাশের সুচিক্কণ সুমসৃণ তাল! কিংবা প্রিয়ার বিনুনি দেখে কবির মনে এল পানউলির দোকানে ঝোলানো অগ্নিমুখ নারকোলের পাকানো দড়ি– যার ডগায় লাগিয়ে আমি আকছারই বিড়ি ধরাই। সেই দড়ি হাওয়ায় দুলে কবির কুর্তা পুড়িয়ে দিয়ে পিঠে ছ্যাঁকা দিয়েছে, ঠিক তেমনি প্রিয়ার বিনুনি দেখা মাত্রই তাঁর বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।
এটা পড়ে তাজ্জব মানছেন কেন?
রাজা শূদ্রকের ‘মৃৎ-শকটিকা’ পড়েননি? জর্মনরা সংস্কৃতের সমজদার এস্তেক গ্যোটে হাইনে সংস্কৃত না জেনেও ভারতীয় নাট্যের স্মরণে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করতেন। শূদ্রকের এই নাটকটি জর্মন ভাষাতে ক’বার যে ভিন্ন ভিন্ন রসিকজন দ্বারা অনূদিত হয়েছে বলা কঠিন, ক’বার যে জর্মনিতে মঞ্চস্থ হয়েছে সেটা বলা তার চেয়েও কঠিন। সেটা নাট্যে আছে, ক্ষুধিত সূত্রধার বাড়ি ফেরার সময় গভীর দুশ্চিন্তায় মগ্ন–বাড়িতে তো চালডাল কিছুই নেই, গৃহিণী কি আদৌ রন্ধন করতে পেরেছেন? বাড়ি ঢুকেই সূত্ৰধার সানন্দে সবিস্ময়ে দেখেন, সাদা মাটির উপর লম্বা লম্বা কালো কালো আঁজি আঁজি দাগ–কালিমাখা হাঁড়ি মাটিতে ঘষে ঘষে গৃহিণী সাফসুৎরো করেছেন। অতএব ধূম দেখলে যে রকম বহ্নির উপস্থিতি স্বীকার করতেই হয়, হাঁড়ি পরিষ্কার করা হয়ে থাকলে রান্নাও যে হয়েছে সে বিষয়ে কী সন্দেহ? সূত্রধার তখন সোল্লাসে উপমা দিয়ে বললেন, ওহো! সাদা মাটির উপর এই কালো কালো আঁজি যেন তুষারধবলা গৌরীর ললাটে কৃষ্ণাঞ্জনতিলক!
কী মারাত্মক গদাময় হাঁড়িকুঁড়ি, মাটিতে সেগুলো ঘষার ফলে নোংরা কালো আঁজির সঙ্গে শিবানী গৌরীর অসিত তিলকের তুলনা! এ যে রীতিমতো হেরেসি, এ হেন তুলনা চার্বাকের বেদ-নিন্দার চেয়েও ধর্মঘ্ন কটু-ভাষণ।
এরপরও আপনি আপত্তি করে বলবেন মডার্ন কবিতা ন দেবায় ন ধর্মায়?
বুদ্ধিমান তথা না-ছোড়-বান্দা পাঠক, আমি বিলক্ষণ জানি, আপনার প্রধান আপত্তি কোনখানে ছোটখাটোগুলো উপস্থিত না হয় বাদই দিলুম। আপনি বলবেন ওদের কবিতা পড়ে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনে। আমো পারিনে– ধাপ্পা না মেরে হক্ক কথাই কই। সে তো আপনার দোষ, আমার দোষ। আপনি আমি পয়সাওয়ালার ছেলে হয়ে জন্মালে সত্যকার অপটুডেট chic, dernier cri, লেটেস্ট মডেলের হাইয়ার এডুকেশন পেতুম; আপনি, আমি, আমরা নিদেন যদি অধ্যাপক হতুম, তারও নিদেন যদি আমরা তাদের শিষ্য হবার সুযোগ পেতুম, তবে তো আজ এ প্রশ্ন তুলতুম না। কিন্তু এহ বাহ্য।
‘বুঝতে পারিনে’ কথাটার অর্থ কী? আপনি ভৈরবী বা পূরবী শুনে যদি রস না পান তবে কি গায়ককে প্রশ্ন শুধান, ‘ভৈরবীর অর্থ আমায় বুঝিয়ে দাও?’ আরও সহজ দৃষ্টান্ত দিই। পদ্মাবক্ষে আপনি সূর্যোদয় দেখে মুগ্ধ হলেন, মাঝি হল না। সে যদি আপনার তন্ময় ভাব দেখে শুধোয়, ‘কত্তা, সূযযি তো উঠলেন, কিন্তু আপনি এমন বে-এক্তেয়ার হলেন কেন? এ সূযজি ওঠাতে কী আছে আমাকে বুঝিয়ে দেন’ তা হলে আপনি কী বোঝাবেন? তাজমহল দেখে হাকসলি মুগ্ধ হননি, কিন্তু তিনি তো গাইডকে এ প্রশ্ন শুধোননি,’ তাজমহলের অর্থ আমায় বুঝিয়ে বল’। কিংবা ভরতনাট্যম দেখে আপনি যদি ‘অর্থ’ বুঝতে চান, তবে হয়তো অভিনয়াংশের অর্থ আপনাকে বোঝানো যাবে কিন্তু বিশুদ্ধ নাট্যরসের (যেমন যন্ত্রসঙ্গীতের) অর্থই-বা কী, আর বোঝাবেই-বা কে? চিত্রে একদা লোকে কোনও বস্তুর সঙ্গে তার সাদৃশ্য দেখে কিছুটা অর্থ পেত কিন্তু এখন কুবিজ, দাদাইজমে কেউ সাদৃশ্য খোঁজে না, অর্থও খোঁজে না। কাঠের একটা গুঁড়ি নিয়ে বিখ্যাত ভাস্কর ছ মাস ধরে প্রাণপণ খাটলেন; প্রদর্শনীর মধ্যকক্ষে সেটি স্থাপিত করে তলায় নাম লিখলেন কাঠের একটা খুঁড়ি। কাঠের গুঁড়ি, কাঠের গুঁড়ি; ভৈরবী, ভৈরবী। তার আবার অর্থ কী?