নাট্যশালা গম গম করছে। ওহ, সে কী অভিনয়! শুরুদেবকে দেখাচ্ছে দেবদূতের মতো। অজিনের চেহারা এমনিতেই খাপসুরত, এমন দেখাচ্ছে রাজপুত্রের মতো। গুরুমশাই জগদানন্দ রায়ের কী বেত্রাস্ফালন! আশ্রমে বেতের বেসাতি বিলকুল বে-আইনি। এ মোকায় জগদানন্দবাবু যেন হৃতোপবীত-দ্বিজ লুণ্ঠিত যজ্ঞোপবীত ফিরে পেয়েছেন। তাঁর কঠিনদর্শন মুখচ্ছবি ঈষৎ স্নিগ্ধতা ধরেছে।
মরিস সাহেব প্রবেশ করলেন রঙ্গমঞ্চে।
রাজা দিলেন ডাক।
মরিস সাহেব– হে ইন্দ্র, তোমার বজ্র কেন তৎপূর্বেই অবতীর্ণ হল না?
উৎকণ্ঠা, উত্তেজনায় মরিস বলে ফেলেছেন, ‘আ ডে শ।’
অট্টহাস্যে ছাদ যেন ভেঙে পড়ে। তিনি কিন্তু ওই একই উত্তেজনার নাগপাশে বন্ধ বলে সে অট্টহাস্য শুনতে পাননি।
সে সন্ধ্যার অভিনয়ের জন্য অধ্যাপক হিডজিভাই মরিসই পেয়েছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনন্দন। আমাদের বিবেকবুদ্ধি সেই আদেশই দিয়েছিল– খুব সম্ভব আডেশই।(১)
———- ১. মরিস সর্বদাই ঈষৎ বিষণ্ণ বদন ধারণ করতেন– খুব সম্ভব এটাকেই বলে ‘মেলানকলিয়া’। প্যারিস থেকে ফেরার পথে তিনি জাহাজ থেকে অন্তর্ধান করেন। আমার মতো আর পাঁচজন তার কারণ জানে না। শুনেছি, তিনি উইল করে তাঁর সর্ব বিশ্বভারতাঁকে দিয়ে যান।
‘আধুনিক’ কবিতা
‘সুশীল পাঠক—’
ছেলেবেলায় এ ধরনের সম্বোধন পড়ে হৃদয়ে বড় আনন্দ হত। মনে হত, কত মহান লেখক এই কালীপ্রসন্ন সিঙি, যিনি কি না মহাভারতের মতো বিরাট গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন, তিনি আমাকেই সম্বোধন করে বলেছেন! এটা যে নিছক সাহিত্যিক ঢং, বলার একটা আড়, সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতুম না। বিশেষ করে যখন আমার ধারণা হল– সেটা হয়তো। ভুল– যে দরদ-ভরা-কথা কয়ে যখন তিনি আমার সহানুভূতি আকর্ষণ করতে চান, তখনই ‘পাঠক’ বলে সম্বোধন করেন। এবং আরও বেশি করে ‘সহৃদয় পাঠক’ বলে সম্বোধন করতেন সিঙি মশাইয়ের মতো দরদী লেখককুল যখন তারা এমন কোনও অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে যেতেন, যেটার মোক্ষম মার বেশিরভাগ পাঠকই খেয়েছে। এ অধম প্রাচীনপন্থী। সে এখনও পাঁচকড়ি দে গোপনে পড়ে। এবং বটতলাতে কিছুক্ষণ হল একখানা ‘সচিত্র প্রেমপত্র’ কিনে সে বড় ভরসা পেয়েছে। যৌবনে ভাষার ওপর দখল ছিল না– এখনই-বা হল কই?– মরমিয়া প্রেমপত্র লিখতে পারত না বলে রায়ের ভাষায়, উনিশটি বার প্রেমেতে সে ঘায়েল করে থামল শেষে। আর ভয় নেই। এখন এই অমূল্য গ্রন্থ থেকে নকল করে ফিলিমস্টার থেকে মেয়ে-পুলিশ সকলেরই ‘সজল নয়নে হৃদয়-দুয়ারে ঘা’ দেওয়া যাবে। বইখানার প্রথম চার লাইন পড়লেই বুঝতে পারবেন, মাইকেল রবীন্দ্রনাথ এর থেকে কতখানি পিছিয়ে আছেন;
‘প্রিয়তমা চারুশীলা পিতৃগৃহে গিয়ে
আছে তো সুখেতে তুমি গোষ্ঠিজন নিয়ে?
তুমি মোর জীবনের সর্বোকৃষ্ট ধন।
তুমি মোর হৃদয়ের শান্তিনিকেতন।’
জানি, জানি– বাধা দেবেন না, জানি আপনারা বলবেন, এই মডার্ন যুগে এসব পণ্য অচল। কিন্তু আপনারা কি এ তত্ত্বটাও জানেন না যে, ফ্যাশন হর-হামেশা বদলায় এবং আকছারই প্রাচীন যুগে ফিরে যায়? পিকাসসো ফিরে গেছেন প্রাগৈতিহাসিক গুহাবাসীর দেয়াল-ছবিতে, অবনঠাকুর মোগলযুগে, নন্দলাল অজন্তায়, যামিনী রায় কালীঘাটের পটে। কাব্যে দেখুন, দুর্বোধ্য মালার্মে-র্যাঁবো যখন অনুবাদের মারফৎ ইংলন্ডও জয় করে বসে আছেন, তখন হাউসম্যান লিখলেন সরল প্রাঞ্জল ‘শ্ৰপশার ল্যাড’। বলা হয়, ইংলন্ডে কবির জীবিতাবস্থায় তাঁর একখানা বইয়ের এত বিক্রির অন্য উদাহরণ নেই। কোনও ভয় নেই। বাংলা দেশের মডার্ন কবিতাও একদিন ‘পাখি সব করে রবে’র অনবদ্য শাশ্বত ভঙ্গিতে লেখা হবে।
আমি মডার্ন কবিতা পছন্দ করিনে, তাই বলে মডার্ন কবিতার কোনও ‘রোজোঁ দেত্রর’ রিজন ফর এগজিসটেনস্ অর্থাৎ পুচ্ছটি তার উচ্চে তুলে নাচাবার ‘রোজোঁ রিজন’, ন্যায্যহকক নেই এ কথা কে বলবে।
প্রথমেই নিন মিলের অত্যাচার। এবং এই মিলটা আমাদের খাঁটি দিশি জিনিস নয়। সংস্কৃতের উত্তম উত্তম মহাকাব্যে, কাব্যে মিল নেই। যদিস্যাৎ থাকে, তবে সেটা আকস্মিক দুর্ঘটনা, প্রায় কবির অনিচ্ছায় ঘটেছে, সংস্কৃতে প্রথমে মিল পাই– আমার জানা মতে মোহমুগরে। এবং তিনিও সেটা বহিরাগত ভাষা থেকে নিয়েছিলেন, এমত সন্দেহ আছে। সংস্কৃতের সহোদরা ভাষা গ্রিক-লাতিনে কি মিল আছে? এ দেশেই দেখুন উর্দু তার জননী সংস্কৃত ভাষা থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছে, জোব্বাজাব্বা পরে প্রায় মুসলমান হয়েছে (প্রায় বললুম কারণ এখনও বহু হিন্দুর মাতৃভাষা উর্দু; উর্দু কবি সম্মেলনে তারা সম্মানিত সক্রিয় অংশীদার। কিন্তু, পণ্ডিত নেহরু, তেজবাহাদুর সপ্র ইত্যাদির মাতৃভাষা ছিল উর্দু), তথাপি আজও উর্দুতে বিনা মিলে দোঁহা রচনা করা হয়, সংস্কৃত সুভাষিতের অনুকরণে। ‘মিল’ শব্দটা কি শুদ্ধ সংস্কৃত? সংস্কৃতে একে বলে ‘অন্ত্যানুপ্রাস্’-স্পষ্ট বোঝা যায়, বিপদে পড়ে মাথায় গামছা বেঁধে ম্যানুফেকচার্ড এরজাৎস মাল। অতএব যদি মডার্ন কবিরা সে বস্তু এড়িয়ে চলেন তবে পাঠক তুমি গোসসা কর ক্যান? ওঁরা তো মাইকেলেরই মতো আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য পুনর্জীবিত করছেন। এই যাবনিক ম্লেচ্ছাচারের যুগে সেটি কি চাট্টিখানি কথা!
তার পর ছন্দ? ছন্দহীন কবিতা হয় না, আপনাকে বলেছেন কোন অলঙ্কার-শাস্ত্রের গোসাই? উপনিষদ পড়েছেন? তার ছন্দটি কান পেতে শুনেছেন? ছন্দে-বাঁধা কবিতা আসতে পারে তার কাছে? বস্তুত বেদমন্ত্রে ছন্দ মেনে মেনে হয়রান হয়ে ঋষিকবি উপনিষদে পৌঁছে কি যুগপৎ তার আধ্যাত্মিক ও কাব্যিক মোক্ষ লাভ করলেন না? এ অধম অশিক্ষিত তথাপি গুণীজনের কাছে শোনা উপনিষদের একটি সামান্য সাদামাটা প্রশ্ন নিন: