কিন্তু তার পূর্বের একটি ঘটনা চিরকাল ধরে আমার ও আমার সতীর্থদের চিত্তে কৌতুকরস এনে দেবে, প্রতিবার সেটার স্মরণে।
গুরুদেব শারদোৎসবের মোহড়া নিচ্ছেন। তিনি স্বয়ং, দিনুবাবু– এমনকি জগদানন্দবাবুর মতো রাশভারী লোক– অজিন ঠাকুর এঁরা সব অভিনয় করবেন। এক প্রান্তে বসে আছেন শুষ্কাস্য বিবদন মরিস সাহেব। আমি হোমটাসক না করলে তাঁর মুখে যে বিষণ্ণতা আসত তিনি যেন তারই গোটাদশেক ‘হেলপিং’ নিয়েছেন। মোহড়ার শেষে দিনুবাবু কাঁচুমাচু হয়ে গুরুদেবকে অনুরোধ জানালেন, মরিস সাহেবকে ড্রামাতে একটা পার্ট দিতে।
গুরুদেবের ওষ্ঠাধর প্রান্তের মৃদুহাস্য সবসময় ঠাহর করা যেত না। এবারে গেল। কিন্তু ইতোমধ্যে সব পার্টেরই বিলিব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। গুরুদেব বললেন, ‘ঠিক আছে। একে শ্রেষ্ঠীর পার্ট দিচ্ছি।’ হয় মূল নাটকে শ্ৰেষ্ঠীর পার্ট আদৌ ছিল না, ওইটে মরিস সাহেবের জন্য ‘ইসপিসিলি’ তৈরি হয় কিংবা হয়তো তখন মাত্র বড় বড় পার্টগুলোর বণ্টনব্যবস্থা আছে।
তা সে যা-ই হোক, শ্রেষ্ঠীর অভিনয় করবেন ‘নটরাজ’ মরিস– শাস্ত্রী মশাই তাঁর নাম দিয়েছিলেন মরীচি (ব্রহ্মার পুত্র, কশ্যপের পিতা ও তিনি সূর্যকিরণও বটেন)––মরিসও সগর্বে কাঁচা-হাতে সেই নামই সই করতেন। এবারে শুনুন, পার্টটি কী?
রাজা : ওগো শ্ৰেষ্ঠী!
শ্ৰেষ্ঠী : আদেশ করুন, মহারাজ!
রাজা : এই লোকটিকে হাজার কার্যাপণ গুনে দাও।
শ্ৰেষ্ঠী : যে আদেশ!
ব্যস্! ওইটুকু! আমার শব্দগুলো ঠিক ঠিক মনে নেই, কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে মরিসকে ওই পাঁচটি শব্দ বলতে হবে, গুরুদেব সায়েবের বাংলা উচ্চারণ সম্বন্ধে বিলক্ষণ ওকিবহাল ছিলেন বলে। কিন্তু মরিস সাহেব বেজায় খুশ, জান্ তররর — ড্যামগ্ন্যাডে– হোক না পার্ট ছোট, তাতেই-বা কী? বলেননি স্বয়ং গুরুদেব, ‘The rose which is single need not envy the thorns which are many?’ কিন্তু এইবারে শুরু হল ট্রবল। গুরুদেবের ভাষাতেই বলি, মরিসকে শুতে হল কন্টকশয্যায়, গোলাপ-পাপড়ির আচ্ছাদিত পুষ্পশয্যায় নয়– যদিও থর্ন মাত্র একটি। গুরুদেব যতই বলেন ‘আদেশ করুন, মহারাজ’ মরিস বলেন, ‘আডেস করুন, মহারাজ।’ মহা মুশকিল! মরিস আপন মরীচ-তাপে ঘর্মাক্তবদন। শেষটায় গুরুদেব বরাত দিলেন দিনুবাবুকে, তিনি যেন সাহেবের ‘ত টর জট ছাড়িয়ে দেন। আফটার অল– তিনিই তো খাল কেটে কুমির এনেছেন; বিপদ, এক্সকিউজ মি– বিপডটা টাঁরই টৈরি।
মরিস সাহেব ছন্নের মতো হয়ে গেলেন। সেই প্রফেট জরথুস্ত্রের আমল থেকে কোন পার্সি-সন্তান এই ‘তো’ ‘ট’য়ের গর্দিশ মোকাবেলা করেছে– এই আড়াই হাজার বছর ধরে যে আজ এই নিরীহ, হাড্ডিসার মরিস বিদেশ-বিভুঁইয়ে একা একা এই’ ত’য়ের তাবৎ ‘দ’য়ের দানব আই মিন ডানব, টাবড ডানবের সঙ্গে লড়াই দেবে?’
মরিস ছন্নের মতো আশ্রমময় ঘুরে বেড়ান দৃষ্টি কখনও হেথায় কখনও হোথায়, আর ঠোঁট দুটি বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। আমি বললুম, ‘নমস্কার, স্যার।’ সম্বিতে এসে বললেন, ‘আ! সায়েড (সৈয়দ))’ ও হরি! এখনও ‘সায়েড’! তবে তো আডেশ এখনও মোকামে কায়েম আছে, রাজাদেশেরই মতো– ‘শোনো টো ঠিক হচ্ছে কি না “আডেশ করুন, মহারাজ”।’ আমি সন্তপ্ত চিত্তে চুপ করে রইলুম। বার দশেক আডেশ আডেশ করে বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়ে এগিয়ে গেলেন।
একটা ডরমিটরি-ঘরের কোণ ঘুরতেই হঠাৎ সমুখে মরিস– বিড়বিড় করছেন ‘আডেশ আডে’। রেললাইনের কাছে নির্জনে ‘আডেশ–!’ দূর অতি দূর খোয়াইয়ের নালা থেকে মাথা উঠছে সায়েবের, আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। চন্দ্রালোকে, খেলার মাঠে মরিস, আসন্ন উষার প্রদোষে শ্মশানপ্রান্তে কার ওই ছায়ামূর্তি? মরিস। হিন্দি কবি সত্যি বলেছেন, গুরু তো লাখে লাখে, উত্তম চেলা কই। আশ্রমের ছেলেবুড়ো এখন সবাই সায়েবের শুরু।
এস্তেক শিশু-বিভাগের কানাই, সাগার কেউ বাদ পড়েনি। পড়ে থাকলে তাদের দোষ। সবাইকে টেস্ট করতে অনুরোধ করেন তার আডেশ আডেশানুযায়ী হচ্ছে কি না। ইতোমধ্যে এক সন্ধ্যায় মোহড়া শেষে দিনুবাবু গুরুদেবকে ভয়ে ভয়ে অনুরোধ জানালেন, আদেশের বদলে অন্য কোনও শব্দ দিতে, যেটাতে “ত” “দ” নেই। গুরুদেব বললেন, না; মরিসকে “ত” “দ” শিখতেই হবে।’
এরপর দ্বিতীয় পর্ব। হঠাৎ সক্কলের সামনে একদিন বেরিয়ে গেল “আদেশ” অত্যুত্তম ‘দ’ সহ। আমি ‘ইয়াল্লা’ বলে লম্ফ দিলুম। কেউ ‘সাধু সাধু’, কেউ-বা কনগ্রাচুলেশন বললেন, কিন্তু হা অদৃষ্ট! আমরা বন থেকে বেরুবার পূর্বেই হর্ষধ্বনি করে ফেলেছি! সায়েব পরক্ষণে আডেশ-এ ল্যাপস করেছেন। তার পর তাঁর ক্ষণে আসে ‘দ’ ক্ষণে ‘ড’। কলকাতার বাজারে মাছ ওঠা-না-ওঠার মতো বেটিঙের ব্যাপার। এই করে করে চলল দিন সাতেক। সম্মুখে আশার আলো।
এরপর তৃতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্বের মতো এটাও অপ্রত্যাশিত। সায়েব এখন চাঁচাছোলা, ভোরবেলার নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক শিশিরবিন্দুর ন্যায় ‘দ’ বলতে পারেন। পয়গম্বর জরথুস্ত্র এবং তাঁর প্রভু আহুর মজদাকে অশেষ ধন্যবাদ!
আমরাও আমাদের সঙ্কটটা ভুলে গেলুম। মোহড়ায় প্রতিবার ঋষি মরীচি বৈদিক পদ্ধতিতে ‘দ’ উচ্চারণ করেন।
মরিস সাহেব স্টেজে নামলেন পার্সি দস্তুর বা যাজকের বেশ পরে। সবকিছু ধবধবে সাদা। শুধু মাথার টুপিটি দাদাভাই নোরজি স্টাইলের লেটার বস্ প্যাটার্নের কালোর উপর সফেদ বুট্টাদার। গুরুদেব এই বেশই চেয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা পার্সিরা বাপু এ দেশের শ্রেষ্ঠী। তোমরা যা পরবে তাই শ্ৰেষ্ঠীর বেশ।’