অত্যুত্তম ফরাসি ও লাতিন শেখার পর না জানি কোন যোগাযোগে তিনি শান্তিনিকেতন পৌঁছে সেখানে অধ্যাপনা আরম্ভ করেন।
দুটো বিষয়ে তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি– সেন্টিমেন্টাল এবং আদর্শবাদী। আমার আশ্চর্য লাগত, কারণ অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে যেসব গুজরাতি ছেলেরা এবং পাঠিকারা অপরাধ নেবেন না, মেয়েরাও শান্তিনিকেতন আসে, তারা পর্যন্ত টাকা আনা পাই হিসাব করত; শুনেছি, ছাত্রেরা আকছারই আদর্শবাদী হয়। (নইলে অত নিঃস্বার্থ ট্রাম-বাস পোড়ানোর সকর্মটা করে কে? কিন্তু এ সম্বন্ধে আর কথা নয়। হক কথা কইলে পুলিশ ধরবে।) তাই গুজরাতি মরিস সাহেবের আদর্শবাদ আমাকে বিস্মিত করেছিল।
সামান্য বাংলা শেখার পরই মরিস সাহেবের প্রেম উপচে পড়ল রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি এবং তিনি সম্মোহিত হলেন,
“তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার” শুনে।
অন্যত্র আলোচনা করেছি, ভারতের বাইরে কোনও ভাষাই ‘ত’ এবং ‘ট’-র উচ্চারণে পার্থক্য করে না; এমনকি ভারতীয়দের ভিতর যাদের গায়ে প্রচুর বিদেশি রক্ত তাঁরাও এ দুটোতে গুবলেট করেন। উদাহরণস্থলে, গুজরাতের বোরা সম্প্রদায় এখানকার রাধাবাজারে এদের ব্যবসা আছে–ব্রহ্ম উপত্যকার আসামবাসী ও পার্সি সম্প্রদায়।
তাই মরিস সাহেবের উচ্চারণে ছত্র দুটি বেরুতো;
“টাহাটে এ জগটে ক্ষটি কার
নামাটে পারি যডি মনোভার।”
আমরা আর কী করে ওঁকে বোঝাই যে ‘ত’ ‘দ’-এর অনুপ্রাস ছাড়াও গুরুদেবের গান আছে।
মরিস সাহেব নতুন বাংলা শেখার সময় যে না বুঝে বিশীদাকে ‘বেটা ভূত’ বলেছিলেন, তার চেয়েও আরও মারাত্মকতম উদাহরণ আমি শুনেছি। তিনি আমাদের ফরাসি শেখাতেন এবং শ্রদ্ধেয় বিধুশেখর, ক্ষিতিমোহন এবং আরও কিছু অধ্যাপকও তাঁর ক্লাসে যেতেন। আমার হাসি পেত তখন গুরু মরিস ছাত্র বিধুশেখরকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন ও ছাত্র বিধুশেখর তাঁকে ‘তুমি’ বলে। একদিন হয়েছে, ফরাসি ব্যাকরণের কী একটা কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফেলেছেন অধ্যক্ষ বিধুশেখর। মরিস সাহেব বললেন, ‘চমৎকার! শাস্ট্রী মশায়, সট্যি, আপনি একটি আস্টো ঘুঘু।’
শাস্ত্রী মশাইয়ের তো চক্ষুস্থির! একটু চুপ করে থাকার পর গুরু, গুরু– যদ্যপি ছাত্র, তথাপি গুরু-কণ্ঠে শুধালেন, ‘মরিস, এটা তোমাকে শেখালে কে?’
নিরীহ মরিস বোধ হয় কণ্ঠনিনাদ থেকে বিষয়টার গুরুত্ব খানিকটে আমেজ করতে পেরে বললেন, ‘ডিনডা (দিনদা, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর)। উনি বলেছেন ওটার অর্ট “অসাডারণ বুডডিমান।” টবে কি ওটা ভুল?’
শাস্ত্রী মশাই শুধু ঈষৎ কঠিন কণ্ঠে বললেন, ‘আচ্ছা, আমি দিনেন্দ্রনাথকে বোঝাব।’
দিনুবাবু নাকি বিদেশিকে ভাষা শেখাবার সময় কর্তব্যবোধহীন চপলতার জন্য বেশ কিছুটা ভালোমন্দ শুনেছিলেন শাস্ত্রী মশাইয়ের কাছ থেকে।
ওই সময় প্যারিস থেকে অধ্যাপক সিলভাঁ লেভি সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে আসেন। উভয়েই একাধিকবার বলেন, মরিস সাহেব উল্লেখ না করা পর্যন্ত তারা কখনও বিশ্বাস করতে পারেননি, ফ্রান্স না গিয়ে মানুষ কী করে এরকম বিশুদ্ধ ফরাসি শিখতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে বড়ই কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে রলাঁর ‘যিশুজীবনী’ পড়ান।
এ বই আমার মহদুপকার করেছে এবং করছে।
বলা বাহুল্য এই সরল সজ্জন যুবা পণ্ডিতটি সকলেরই হৃদয়ে স্থান পেয়েছিলেন। গুরুদেবের তো কথাই নেই, মরিস সাহেব ঋষিতুল্য দ্বিজেন্দ্রনাথেরও অশেষ স্নেহ পেয়েছিলেন। বড়বাবু বিদেশি পণ্ডিতদের সঙ্গে বাক্যালাপ কালক্ষয় বলে মনে করতেন; বলতেন, ‘এরা সব তো জানে কোন শতাব্দীতে প্রজ্ঞাপারমিতা কিংবা একাক্ষরপারমিতা প্রথম লেখা হয়, প্রথম ছাপা হয়। ওসব জেনে আমার কী হবে? তার চেয়ে নিয়ে আস না ওদের। কোনও একজন, যে কান্টের দর্শন সমর্থন করতে পারে, আর আমি নেব বিরুদ্ধ মতবাদ, কিংবা সে নেবে বিরুদ্ধ মতবাদ, আমি নেব কান্টপক্ষ–তার যেটা খুশি’; মরিস সাহেব তাঁকে তখন অনুনয়-বিনয় করে সম্মত করাতেন বিদেশি পণ্ডিতকে দর্শন দিতে। অবশ্য দু-মিনিট যেতে না যেতেই বড়বাবু সব ভুলে গিয়ে কোনও কিছু অন্য তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় তন্ময় হয়ে যেতেন। আমাদের মতন ছেলে-ছোকরাদের কিন্তু তাঁর কাছে ছিল অবাধ গমন। আমার মনে পড়ত খ্রিস্টের কথা; তিনি যেহোভার মন্দির থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিস্তর তথাকথিত কুলাঙ্গার ভিআইপি-কে, এবং আদেশ দিতেন ‘লেট দি চিলড্রেন কাম্ আনটু মি’!
বস সাহেব প্রথমটায় সম্মত ছিলেন না; আর সকলের চাপাচাপিতে তিনি প্যারিসের সরবনে গিয়ে ডক্টরেটের জন্য প্রস্তুত হতে রাজি হলেন।
প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তার সঙ্গে আমার অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা। আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করাতে আমি দুঃখ প্রকাশ করলুম। তিনি বললেন, ‘তুমি এখন বড় হয়েছ; জর্মনিতে ডক্টরেট করবে। আমিও এখানে তাই করছি। আমরা এখন এক-বয়েসি।’ আমার বয়েস তখন চব্বিশ, তাঁর বত্রিশ। তার পর আমাকে রেস্তোরাঁয় উত্তমরূপে খানদানি ডিনার খাওয়ালেন। বিনয় এবং সঙ্কোচের সঙ্গে পরের দিন বললেন, ‘তোমাকে ভালো করে এন্টারটেন করতে পারলুম না। তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, আমার এ মাসের টাকাটা এখনও দেশ থেকে আসেনি।’ আমি তারস্বরে প্রতিবাদ জানালুম। বহু বৎসর পরে ওই সময়কার এক প্যারিসবাসী ভারতীয়ের কাছে শুনতে পাই মরিস সাহেব অন্যান্য দুস্থ ভারতীয় ছাত্রদের টাকা ‘ধার’ দিয়ে মাসের বেশিরভাগ দেউলে হওয়ার গহ্বর-প্রান্তে পড়ি পড়ি করে বেঁচে থাকতেন। আসলে তাঁর পরিবার বিত্তশালী ছিল।… তাঁর সঙ্গে এই আমার শেষ দেখা। কিন্তু এখনও তার সেই শান্ত সংযত প্রসন্ন বদনটি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।