সবিতা এতক্ষণ ধরে শুধু উল বুনে যাচ্ছিলেন। মাথা তুলে সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘এমনকি, চলার ধরনটি, গলার সুরও!’
মুখুজ্যে বললেন, ‘সেই বন্ধুটি যদি আজ এ-লোকে থাকত, তবে আজ আমার এ-দুর্দশা হত না! সে কথা থাক। মূল বক্তব্য এই : ঠাকুরমা প্লাস তামাম পরিবার, প্লাস সেই সখার পরিবার সবাইকে লুকিয়ে, বিস্তর ছলনা-জাল বিস্তার করে আমি ছেলেবেলা থেকে খেয়েছি ওর মায়ের তৈরি মুরগি-মটন। সে খেত আমাদের বাড়িতে নিশ্চিন্ত মনে। আপনি বোধ হয় জানেন না’।
‘বিলক্ষণ জানি, স্বর্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী– আপনার ঠাকুরমার পাড়ার লোক বাড়িতে দিশি-বিদেশি সবাইকে খাওয়াতেন। তার ছেলে, স্বর্গত বিনয়তোষ তিনিও নিষ্ঠাচারী ছিলেন। ঝাড়া আটটি বছর প্রতি রোববার, তাঁর সামনে বসে, তাঁর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন করেছি আমি, মুসলমান।’
ডাক্তার বললেন, ‘তার পর ঠাকুরমা মা আর সবাই গত হলেন। রইল ওই দোস্ত-ইয়ার-সখা বেদার-বখশ। একই বছরে দু জনায় ডাক্তারি পাস করলুম। ইতোমধ্যে আমার বিয়ে হয়েছে। সবিতা রাধে ভালো, কিন্তু তার মা তাকে বলে দিয়েছিলেন, অন্তত রান্নার ব্যাপারে বাপের বাড়ির ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে, স্বামী যেভাবে খেতে চায় ঠিক সেইভাবে খাওয়াবি।’ তাই সবিতা বেদারের মায়ের কাছ থেকে শিখল বিরিয়ানি থেকে ফালুদা, বুরহানি থেকে আওয়ান রুটি। অতএব স্যার, কাল দ্বিপ্রহরে এখানে একটু হবিষ্যান্ন করবেন–’ হেসে বললেন, ‘অবশ্যই, মোগলাই! আসলে কি জানেন, এই যে চোখের সামনে সবিতা উদয়াস্ত উল বোনে, এটা, It gets on my nerves! আর সবিতা একটি পারফেকট আর্টিস্ট। রন্ধনে। তার অনুশীলন নেই, রেওয়াজ নেই। আপনার শোক হয় না? আমার তো ওসব খাওয়া বারণ। নিজের জন্য–’
আমি সবিতার দিকে তাকিয়ে আমার মাকে দেখতে পেলুম; বাড়িতে কেউ না থাকলে মা হাঁড়ি পর্যন্ত চড়াত না। তেল-মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ত। আর এই সবিতা নাকি বিস্বাদ বিবর্ণ মাছসে, কপিসে, পাতলাসে পাতলা যেন কড়াই-ধোয়া-জল সুপ নামে পরিচিত গব্বযন্ত্রণা স্বামীকে খেতে দিয়ে নিজে গণ্ডার-গ্রাসে খাবে বিরিয়ানি, বুরহানি কাবাব-মুসল্লম!
আমি বললুম, ‘ফিনসে তওবা! তা-ও কখনও হয়! কিন্তু আমি একা-একা খাব? –কেমন যেন?’
আর্তনাদ করে বললেন, ‘আপনি বিশ্বাস করতে পারেন না, রান্নাঘর থেকে সবিতার রেওয়াজের গন্ধ আমার নাকে আসবে– আচ্ছা, আপনি না-হয় আড়ালেই খাবেন, শুধু আমি পদগুলো কম্পোজ করে দেব। আপনাকে এ-নিমন্ত্রণ সাহস করে জানালুম, আপনি যত্রতত্র খান শুনে। নইলে–’
আমি বললুম, ‘ডাক্তার, আমি জানি আপনাদের অনেকক্ষণ ধরে কথা বলা বারণ। কাল সকালের রোদ সেরেই আসব। দুপুরে খাব।’
সবিতা রাস্তা অবধি নেমে এসে বললেন–মাথা নিচু করে, প্রায় হাতজোড় করে, ‘এই দু বছর ধরে আমরা এখানে আছি। এই প্রথমবার তিনি পুরো আধঘণ্টা ধরে খুশিতে আনন্দে সময় কাটালেন। আপনি দয়া করে আসতে ভুলবেন না। বড় ডাক্তার বলেছে, উনি ফুর্তিতে থাকলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন। আমি ওঁকে বাঁচাতে চাই। আপনি আমার প্রতি দয়া করুন–’
হঠাৎ ধপ করে রাস্তার পাশে হাঁটু গেড়ে আমার পায়ের উপর তার মাথা ঠুকে দিল। এত দুঃখের ভিতরও আমি দেখলুম, বন্যার জলের মতো একমাথা গোছা গোছা গাদা গাদা কালো চুল ঘোমটার বাঁধ সরিয়ে আমার দুই গোড়ালির হাড় পেরিয়ে, মাঝ-হাঁটু অবধি ছাপিয়ে দিল। এ-চুল আমি দেখেছি, অতিশয় শৈশবে, আজ মনে হয়, যেন আধাস্বপ্নে, যেন কুয়াশার ভিতর দিয়ে, আমার মায়ের মাথায়।
সতীসাধ্বী যুবতীকে স্পর্শ করা গুনাহ্। জাহান্নামে যাক গুনাহ্!
দু-হাত দিয়ে তাকে তুলে ধরলুম। বললুম, ‘মা! ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখো।’
সীমন্তিনী বললে, ‘আমি আল্লাকে ইয়াদ করি’।
১৩/১১/৬৫
হিডজিভাই পি মরিস
একদা ‘স্ট্র্যানড’ পত্রিকা একটি নতুন ধরনের অনুসন্ধানের সূত্রপাত করে সাহিত্যের মহা মহা মহারথীদের শুধোয়, তাঁরা সর্বজন-সম্মানিত, সর্বশিক্ষিতজনের অবশ্যপাঠ্য কোন কোন পুস্তক যে কোনও কারণেই হোক, পড়ে উঠতে পারেননি। উত্তরে এমন সব তথ্য আবিষ্কৃত হল যাকে ‘মোহনে’র ভাষায় লোমহর্ষক বলা যেতে পারে; যেমন, কথার কথা কইছি– বার্নার্ড শ পড়েননি অলিভার টুইস্ট, কিংবা মনে করুন–রবীন্দ্রনাথ পড়েননি ‘একেই কি বলে সভ্যতা’?
কাজেই বিখ্যাত সাহিত্যিকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে এই অখ্যাত সাহিত্যসেবক তাঁরা যেন তড়িঘড়ি শ্রীযুক্ত বিশী মহাশয়ের শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে বইখানা পড়ে নেন।
এই পুস্তকে ‘কাব্যের উপেক্ষিত’ জাতীয় দু-চারটি চরিত্রের উল্লেখ করে বিশী মহাশয় বহু প্রাক্তন শান্তিনিকেতনবাসীদের সাধুবাদ পেয়েছেন। তাঁদেরই একজন হিডজিভাই মরিস্।
তাঁর পুরো নাম হিডজিভাই পেস্তনজি মরিসওয়ালা। গুজরাতিদের প্রায় সকলেরই পারিবারিক নাম থাকে; যেমন গাঁধী, জিন্না (আসলে ঝিঁড়া ভাই), হটিসিং ইত্যাদি। পার্সিদের অনেকেরই ছিল না বলে কেউ কেউ তাঁদের ব্যবসার নাম পারিবারিক নামরূপে গ্রহণ করতেন। যেমন ইঞ্জিনিয়ার, কন্ট্রাক্টর ইত্যাদি। এই নিয়ে পার্সিরা ঠাট্টা করে একটি চরম দৃষ্টান্ত দেন– সোডা-ওয়াটারবটলওপনারয়ালা!
বোম্বাইয়ের পতিত পরিবার বিখ্যাত। এঁরা ফরাসি ‘পতি’ (Petit) ফার্মে কাজ করতেন বলে প্রথমে পতিতওয়ালা ও পরে পতিত্ নামে পরিচিত হন। ঠিক সেইরকম মরিস কোম্পানিতে কাজ করে আমাদের অধ্যাপক মরিসওয়ালা পরে শুধু মরিস নামে বোম্বাই অঞ্চলে নাম করেন।