৫. রাসপুতিনের মৃত্যুদিবস ১৫।১৬ ডিসেম্বর ১৯১৬ বলা হয়, আবার ৩০ ডিসেম্বরও বলা হয়। তার কারণ অর্থডক্স রুশ ক্যালেন্ডার ও কন্টিনেন্টের প্রাচীন ক্যালেন্ডারে ১৩১৪ দিনের পার্থক্য।
৬. অধ্যাপক আমাকে গল্পচ্ছলে একদা বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে রাশান অফিসারদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা (প্যাস্টাইম) ছিল প্রচুর মদ্যপানের পর লটারিযোগে দু জন অফিসারের নাম স্থির করা। তারপর একজন একটা ঘরে ঢুকে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থান বেছে নিয়ে ঘরের সব আলো নিভিয়ে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকবে অন্য অফিসার, হাতে সবচেয়ে ছোট সাইজের পিস্তল নিয়ে। প্রথম অফিসার আশ্রয়স্থল থেকে কোকিলের মতো ডাক ছাড়বে, “ক”; অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে সেই অন্ধকারে সুদ্ধমাত্র ধ্বনির ওপর নির্ভর করে পিস্তল মারবে। তখন সেই অন্ধকারে ‘শিকার জায়গা বদলাবে, কিন্তু “কু” ডাক না ছাড়া পর্যন্ত পিস্তল মারা বারণ। কতক্ষণ পরে দু জনের পার্ট বদলায়, আমার মনে নেই।
সাবিত্রী
দক্ষিণ ভারতের একটি সানাটরিয়ামে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে যেতে হয়েছিল। ব্যামো গোড়াতেই ধরা পড়েছিল বলে কে খারাপ হতে পায়নি। আমাকেও তাই কোনও প্রকারের সেবা-শুশ্রূষা করতে হত না। হাতে মেলা সময়। তাই কটেজে কটেজে– এসব কটেজে থাকে অপেক্ষাকৃত বিত্তশালীরা, আর বিরাট বিরাট লাটের একাধিক জেনারেল ওয়ার্ড তো আছেই– ডাক্তাররা সকালবেলাকার রোগী-পরীক্ষার রোদ সেরে বেরিয়ে যাবার পরই আমি বেরুতাম আমার রোদে। বেচারাদের অধিকাংশকেই দিনের পর দিন একা একা শুয়ে শুয়ে কাটাতে হয় বলে কেউ তাদের দেখতে এলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুখ যে কীরকম খুশিতে উজ্জ্বল এবং যে-ক’টি ফোঁটা রক্ত গায়ে আছে, সব কটি মুখে এসে যেত বলে রাঙা হয়ে যেত, সেটা সত্যই অবর্ণনীয়।
করে করে প্রায় সব্বাইকেই আমি চিনে গিয়েছিলুম— তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীই বেশি।
একটি কটেজে আমি কখখনো যাইনি, ডাক্তার ভিন্ন আর কাউকে কখনও যেতেও দেখিনি। রোগীর পাশে সর্বক্ষণ দেখা যেত একটি যুবতী– বরঞ্চ তরুণী-ঘেঁষা যুবতী বললেই ঠিক হয় মোড়ার উপর বসে উলের কাজ করে যাচ্ছেন; তাই বোধ হয় কেউ তাঁদের বিরক্ত করতে চাইত না।
একদা রোঁদ শেষে, পথিমধ্যে হঠাৎ আচমকা বৃষ্টি। উঠলুম সেই কটেজটাতেই।
যুবতীটি ধীরে ধীরে মোড়া ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে অতি ক্ষীণ ম্লান হাসি হেসে বললেন, ‘আসুন, বসুন। কী ভাগ্য বৃষ্টিটা নেমেছিল। নইলে আপনি হয়তো কোনওদিনই এ-কটেজে পায়ের ধূলি দিতেন না।’
কী মিষ্টি গলা! আর সৌন্দর্যে ইনি রাজরানি হওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু সে কী শান্ত সৌন্দর্য। গভীর রাত্রে, ক্ষীণ চন্দ্রালোকে, আমি নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে দেখেছি এই শান্ত ভাব– দিক্-দিগন্ত জুড়ে। আমরা প্রাচীন যুগের বাঙালি। চট করে অপরিচিতার মুখের দিকে তাকাতে বাধোবাধো ঠেকে। এঁর দিকে তাকানো যায় অসঙ্কোচে।
রোগীও সুপুরুষ, এবং এই পরিবেশে খাটে শুয়ে না থাকলে বলতুম, রীতিমতো স্বাস্থ্যবান। শুধু মুখটি অস্বাভাবিক লালচে যেন গোরা অফিসারের মুখের লাল।
স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে হেসে বললেন– গলাটা কিন্তু রোগীর– ‘রোজ চারবেলা দেখি আপনাকে এ-পথ দিয়ে আসতে-যেতে। পাশের কটেজে শুনি আপনার উচ্চহাস্য। শুধু আমরাই ছিলুম অস্পৃশ্য! অথচ দেখুন, আমি মুখুজ্যে বামুন–’
আমি গল্প জমাবার জন্য বললুম, ‘কোন মেল? আমার হাতে বাঁড়ুজ্যে ফুলের মেল একটি মেয়ে আছে।’
এবারে দু জনার আনন্দ অবিমিশ্র। এ লোকটা তা হলে পরকে ‘আপনাতে’ জানে! তিমুহূর্তে জমে গেল।
খানিকক্ষণ পরে আমি বললুম, ‘আপনারা দু জনাই বড় খাঁটি বাংলা বলেন, কিন্তু একটু যেন পুরনো পুরনো।’
মুখুজ্যে বললেন, ‘আমি ডাক্তার অবশ্য এখন অবস্থা “কবরাজ! ঠেকাও আপন যমরাজ।” তা সে যাকগে! আসলে কি জানেন, আমরা দুজনাই প্রবাসী বাঙালি। তিনপুরুষ ধরে লক্ষ্ণৌয়ে। আমার মা কাশীর, ঠাকুরমা ভট্টপল্লীর। সেই ঠাকুরমার কাছে শিখেছি বাংলা– শাস্ত্রীঘরের সংস্কৃতঘেঁষা বাংলা। সেইটে বুনিয়াদ। সবিতা আমাদের প্রতিবেশী। আমার ঠাকুরমার ছাত্রী। আমরা দু জনা হুবহু একই বাংলা পড়েছি, শিখেছি, বলেছি। তবে ম্যাট্রিক পর্যন্ত উর্দু শিখেছি বলে মাঝে মাঝে দু-একটি উর্দু শব্দ এসে যায় আমার ভাষাতে, সবিতার না। আপনার খারাপ লাগে?’
আমি প্রতিবাদ করে বললুম, ‘তওবা, তওবা! আমি বাঙালি মুসলমান; আমরা ইঁওহী দু-চারটে ফালতো আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করি।’
পাশ ফিরে, আপন দুই বাহু আমার দিকে প্রসারিত করে দিলেন। আমি আমার হাত দিলুম। দু হাত চেপে ধরে, চোখ বন্ধ করে, গভীর আত্মপ্রসাদের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বাঁচালেন। আপনি মুসলমান?’
আমি একটু দিশেহারা হয়ে চুপ করে রইলুম।
জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি যত্রতত্র খান এখানে? ডাক্তার হিসেবে বলছি, সেটা কিন্তু উচিত নয়।’
আমি বললুম, ‘আমি যত্রতত্র যা-তা খাই, এবং ভবিষ্যতেও খাব। অপরাধ নেবেন না।’
‘বাঁচালেন!’ এবারে আমি আরও দিশেহারা। আমি তার পরামর্শ অমান্য করছি দেখে তিনি খুশি!
‘বাঁচালেন! জানেন, প্রথম দিনই আপনার চেহারা দেখে, অদ্ভুত সাদৃশ্য লক্ষ করলুম আমার এক মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে।’
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমায় বলিনি, সবিতা?’