তা সে কেকই হোক আর খানদানি মদই হোক– রাসপুতিন তার বীভৎস অভ্যাসমতো সে-বস্তু খেয়ে গেলেন প্রচুরতম পরিমাণে, এবং তাজ্জব কী বাৎ! তার কিছুই হল না। চোখের পাতাটি পর্যন্ত নড়ল না। আমার সুস্পষ্ট মনে আছে এস্থলে অধ্যাপকও আপন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘মাই বয়! দেয়ার উয়োজ ইনাফ পয়জন টু নক অফ সিকস্ বুলজ’। অর্থাৎ ওই বিষে ছ’টা আস্ত বলদ ঘায়েল হয়! কিন্তু রাসপুতিন নির্বিকার! ইউসুপফরা জানতেন না, রাসপুতিনকে ইতোপূর্বে একাধিকবার বিষপ্রয়োগে হত্যা করার চেষ্টা নিষ্ফল হয়। ম্যাজিশিয়ানরা যে রকম ব্লেড খায়, রাসপুতিন ঠিক সেইরকম হরেক জাতের বিষ খেতে তো পারতেনই, হজমও করতেন অক্লেশে।
ষড়যন্ত্রকারীরা পড়লেন মহা ধন্দে। তাঁদের সব প্ল্যান ভণ্ডুল।
তখন ইউসুপফ অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের ফিসফিস করে বললেন, ‘এ রকম সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। আমি ওকে গুলি করে মারব’।
পিছন থেকে ঠিক ঘাড়ের উপর, অর্থাৎ সবচেয়ে মারাত্মক জায়গায়, এক্কেবারে কাছে এসে ইউসুপ গুলি ছুড়লেন। রাসপুতিন রক্তাক্ত দেহে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন।
সে তো হল। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা এখন সম্মুখীন হলেন এক সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত নতুন সমস্যার। জখমহীন মৃতদেহ যত সহজে হস্তান্তর করা যায়, রক্তাক্ত দেহ নিয়ে কর্মটা তো অত সহজ নয়। এখন কী করা কর্তব্য সেটা স্থির করার জন্য দলের আর যারা সন্দেহ না জাগাবার জন্য পার্টিতে যোগ না দিয়ে উপরের তলায় অপেক্ষা করছিলেন তাঁদের সঙ্গে ইউসুপফাদি যোগ দিলেন। তার পূর্বে তিনি লাশটা টেনে টেনে সেলারে (মাটির নিচে কয়লা এবং আর পাঁচটা বাজে জিনিস রাখার গুদোম) রেখে এলেন। পাছে হঠাৎ কেউ ডাইনিংরুমে ঢুকে লাশটা আবিষ্কার করে ফেলে।
স্থির হল, রাসপুতিনের লাশ ইউসুপফের বাড়ির কাছে নেভা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হবে। সেটা ডিসেম্বর মাস।(৫) নেভার উপরকার জল জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। সেইটে ভেঙে লাশ ভেতরে ঢুকিয়ে গায়েব করে দেওয়া কঠিন কর্ম নয়।
এইবার সবাই হলেন যাকে বলে বজ্রাহত! এবং ভুলবেন না, এদের অধিকাংশই ফৌজের আপিসার।(৬) এঁদের কাউকে হকচকাতে হলে রীতিমতো কস্ত করতে হয়, আর মৃত্যুভয়? ছোঃ!
তা নয়! সবাই সেলারে ঢুকে দেখেন, রাসপুতিনের লাশ উধাও! ঘাড়ের সবচেয়ে মারাত্মক জায়গায় গুলি খেয়ে যে-লোকটা পড়ে গিয়ে মরল, সে যে শুধু আবার বেঁচে উঠল তাই নয়, আপন পায়ে হেঁটে বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে গেল!
অবশ্য এ-কথা ঠিক, ইউসুপ সেলারের দরজা বাইরের থেকে তালাবদ্ধ করেননি, এবং খামোকা বেশি লোক যাতে না জানতে পারে তাই সে রাত্রে অধিকাংশ চাকর-বাকরকে ছুটি দিয়ে রেখেছিলেন।
রাসপুতিন যদি এখন কোনও গতিকে জারিনার কাছে পৌঁছে সব বর্ণনা দেন এবং নিশ্চয়ই তিনি করবেন বলে ইউসুপফের অবস্থাটা কী?
কিন্তু তিনি অতশত ভাবেননি– অন্যদের জবানি তাই। তাঁরা বলেন, তিনি পাগলের মতো পিস্তল হাতে নির্জন রাস্তায় ছুটতে ছুটতে হঠাৎ দেখেন, চতুর্দিকের সেই শুভ্র শুভ্রতাময় বরফের ভিতর দিয়ে টলতে টলতে রাসপুতিন এগিয়ে যাচ্ছেন। রক্তক্ষরণও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এবার ইউসুপ আর কোনও চান নিলেন না। পিস্তলে যে কটা গুলি ছিল সবকটা ছুড়লেন তার ঘাড়ের উপর। তার পর সবাই মিলে তাঁকে টেনে নিয়ে নেভা নদীর উপরকার জমে যাওয়া বরফ ভেঙে লাশটা ঢুকিয়ে ঠেলে দিলেন ভাটির দিকে।
কিন্তু জারিনা সে দেহ উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। চার্চেরই মতো একটি বিশেষ উপাসনাগারসহ নির্মিত চেপলে তার দেহ সযত্নে গোর দেওয়া হল একটি রমণীয় পার্কের ভিতর। মহারানি প্রতি রাতে যেতেন সেই গোরের পাশে, নীরবে অঝোরে অশ্রুবর্ষণ করার জন্য, রাসপুতিনের আত্মার সদগতি কামনা করে।
২২।১।৬৬
———-
১. এ’র উল্লেখ শ্রীযুক্ত প্রভাত মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্র জীবনী’তে করেছেন; আমিও ‘দেশে-বিদেশে’ বইয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করেছি।
২. স্বয়ং স্বামীজী নাকি বলেছেন, “যে ভগবান আমাকে এ দুনিয়ায় একমুঠো ভাত দেয় না, সে নাকি মৃত্যুর পর আমাকে স্বর্গরাজ্য দেবে—Why, even an imbecile would not believe it; much less I!” তবে এটা প্রক্ষিপ্তও হতে পারে। তবু এ কথা অতিশয় সত্য, তিনি এই পৃথিবীতেই স্বর্গরাজ্য স্থাপনা করতে চেয়েছিলেন। বঙ্কিম নাকি বলতেন, মানুষকে ভগবান হতে হবে, আর তিনি নাকি বলতেন, মানুষকে মানুষ হতে হবে।
৩. সে অত্যাচার-সংবাদে কাতর হয়ে তলস্তয় ‘রেসারেকশন’ বই লিখে, টাকা তুলে এদের অনেককে কানাডা পাঠিয়ে দেন।
৪. এই কনফেশন বা পদস্খলন স্বীকারোক্তি একাধিক ধর্মে প্রচলিত আছে। এদেশে জৈনদের ভিতর সেটি নিষ্ঠা সহকারে মানা হয়, এবং এরই নাম পর্যষণ। তবে আমাদের যতদূর জানা, পর্যষণ বৎসরে মাত্র একবার হয় এবং সম্প্রদায়ের সকলেই সেটা একই সময়ে করেন বলে বর্ষার শেষে সেটা পৰ্বদিবস রূপে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ শ্রমণরাও বর্ষাকালে পর্যটন নিষিদ্ধ বলে কোনো সংঘে আশ্রয় নিয়ে বর্ষাযাপন-শেষে পাপ স্বীকারোক্তি করে পুনরায় পর্যটনে নেমে পড়েন। মুসলমানরা হজের সময় করে থাকেন, এবং মৃত্যু আসন্ন হলে তওবা করেন। তওবা’ শব্দার্থে ‘প্রত্যাবর্তন’। অর্থাৎ তওবাকারী আপন পাপ সম্বন্ধে অনুশোচনা করে ধর্মমার্গে প্রত্যাবর্তন করল।