‘আহা, চটো কেন? তার পর সাড়ম্বর স্থাপিত হয়, “জম্বুদ্বীপ-সমন্বিতা সমুদ্র—” যাকগে যাক, আমার নামটা ঠিক মনে নেই, ওই “কলচর” “মলচর” নিয়ে কী যেন একটা প্রতিষ্ঠান, আর চৌধুরী হলেন তার “সর্বাধিকারী” “মহাস্থবির” না কী যেন একটা।… কিছুদিন পর ইতোমধ্যে অবশ্য প্ল্যানমাফিক দু-দশখানা ভালো-মন্দ-মাঝারি “কলচরল” বই “জম্বুদ্বীপসমন্বিত–“ দুচ্ছাই আবার ভুলে গেলুম প্রতিষ্ঠানের নামটা– বই বেরিয়েছে। সর্বাধিকারী চৌধুরী প্রতিষ্ঠানের কর্তাকে বোঝালেন–
(ক) ঋগ্বেদের যেসব অনুবাদ গত এবং এই শতকে ইংরেজি-বাংলা-ফরাসি-জর্মনে বেরিয়েছে, সেগুলো ইতোমধ্যে বিলকুল বেকার ঔট অব ডেট হয়ে গিয়েছে, (খ) একটি নতুন অনুবাদ দরকার, (গ) সেটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে হলে বড় বড় পণ্ডিতদের সাহায্য নিতে হবে, (ঘ) এবং তাঁদের দক্ষিণা এবং ছাপা বাবদ লাগবে আশি হাজার টাকা।
আমি তাজ্জব মেনে বললুম, ‘কী বললে, আশি হাজার টাকা? বল কী! ‘
‘বিলক্ষণ! আশি হাজার টাকা! ব্যাপারটা হল গিয়ে, ওই যে প্রতিষ্ঠাতা পলিশিয়ান কলচরড হতে চান, তিনি শেয়ারবাজার, টেভয় টিন থেকে ওমরা তুলো, শিবরাজপুর মেঙ্গানিজ সব বোঝেন, কিন্তু কিন্তু বড় বড় পণ্ডিতদের তেজিমন্দি বাবদে বিলকুল না-ওয়াকিফহাল। ঢেলে দিলেন টাকাটা। তার পর বেরুতে লাগল কিস্তিতে কিস্তিতে বেদের নবীন ইংরেজি অনুবাদ! যে রকম আমাদের হরিবাবুর বাংলা কোষ বেরিয়েছিল। উত্তম প্রস্তাব! কিন্তু, ব্রাদার, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি এই দগ্ধ সংসারে কোথায়? হঠাৎ পুণার এক পণ্ডিত আমাদের কলচর-প্রতিষ্ঠাতার কাছে এসে উপস্থিত হয়ে অনুবাদের খুনিয়া খুনিয়া সব ভুল দেখাতে লাগলেন। যেমন মনে কর– কথার কথা কইচি, আমি তো ওখানে ছিলুম না– “রবিকর” অনুবাদে হয়েছেন, “সূর্য যে খাজনা দেন” কিংবা “রাজকর” অনুবাদে হয়েছেন “রাজা যে রশ্মি দেন”। এ রকম বিকুটে বরবাদ অনুবাদ কেন হল কিছুই বোঝা গেল না। সামান্যতম বৈদিক ভাষা যে জানে সে-ও তো এরকম ভুল করবে না। হ্যাঁ, আলবৎ, ‘ক্রন্দসী’ ‘রোদসী’ ধরনের অচলিত শব্দ নিয়ে সাতিশয় সাধু মতান্তর হতে পারে, কিন্তু এ ধরনের আকাট, বর্বর– রহস্যটা তবে কী?’
আমিও সময় দিয়ে বললুম, ‘রহস্যটা তবে কী?’
‘ওই কলচরকামী প্রতিষ্ঠাতা বেদবেদান্ত বাবদে বেকুব হতে পারেন, কিন্তু তিনি “ইঁদুরের গন্ধ পান”–শয়তানির শ্বাস পান। নইলে সাদা-কালো-গেরুয়া বাজার কনট্রোল করছেন বৃথাই। তিন দিন যেতে না যেতে স্বয়ং চৌধুরীই এসে যা বললেন তার থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, তিনি কি ভারতীয়, কি ফরাসি, কি ইংরেজ, কি জর্মন কোনও পণ্ডিতকেই অনুবাদ-কর্মে নিযুক্ত করেননি। তাবৎ কর্ম করিয়েছেন একটি দুঃস্থা জর্মন রমণীকে দিয়ে। সে বেচারি সংস্কৃতের এক বর্ণ জানে না– বেদের ভাষা মনোজের ভাষায় কহঁ কহাঁ মুল্লুকে! সে স্রেফ জর্মন পণ্ডিত গেল্টনার-কৃত কয়েক বৎসর পূর্বে প্রকাশিত বেদের অনবদ্য জর্মন অনুবাদ ইংরেজিতে অনুবাদ করে গেছে। মেয়েটি ভালো জর্মন জানে বটে, কিন্তু তার ইংরেজি কাঁচা। কিন্তু সেইটেই মূলতত্ত্ব নয়। আসল বিপদ হয়েছে, বেদের অনেক বস্তু অস্পষ্ট, রহস্যময়, দ্ব্যর্থক কেন– বই অর্থসূচক। সেগুলো জর্মন পণ্ডিত গেল্টনারও করেছেন সন্তর্পণে, ‘আবছা-আবছা’ রেখে, –যেন সান্ধ্যভাষায়। এ নারী তাই তার অনুবাদে –আদৌ সংস্কৃত জানে না বলে–রবিকর, রাজকর, নরকর, হাতির কর (কথার কথা কইচি!) গুবলেট করে বসেছে। তখন পরিষ্কার হল রহস্যটা।
‘তস্য বিগলিতাৰ্থ, চৌধুরী দশ-বিশজন পণ্ডিত লাগিয়ে, তাদের ন্যায্য দক্ষিণা দিয়ে অনুবাদ করাননি। মেমসাহেবকে দিয়ে কম্মটি করিয়ে নিয়েছেন।
‘আরও, অর্থাৎ– এবং সেখানেই অর্থ’, মেমসাহেবকে তিনি দিয়েছেন এক হাজার টাকা, ছাপার খরচা বাদ দিয়ে তিনি পকেটস্থ করেছেন সত্তর হাজার টাকা! হল?’
***
চৌধুরী এখন ফটকা-বাজারে ভালো পয়সা কামায় ॥
৬।১১।৬৫
———-
১. চলন্তিকা বলেন সজ্ঞান থেকে সেয়ানা। বড়বাবু বলেন, শ্যেনদৃষ্টি রাখে যে জন তার থেকে শেয়ানা, শ্যানা।
আধুনিকা
থেকে থেকে ‘মর্ডান’ মেয়েদের বিরুদ্ধে খবরের কাগজে নানা জাতের চিঠি বেরোয়। সেগুলোর মূল বক্তব্য কী, তার সবিস্তার বয়ান দেবার প্রয়োজন নেই এবং সেগুলো যে সর্বৈব ভিত্তিহীন সে-কথাও বলা যায় না। হালে পাড়ার বুড়োরা আমাকে দফে দফে মডার্নিদের ‘কুকীর্তি’র কাহিনী কয়ে গেলেন। সেই সুবাদে আমার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল।
ত্রিশ বছর আগেকার কথা। তখনও এদেশে ‘পেট-কাটা’ ‘নখরাঙানো’ মডার্নিদের আবির্ভাব হয়নি, এ তো জানা কথা, কিন্তু ‘মর্ডান’ মেয়ে সর্বযুগে সর্বদেশেই থাকে। আমার মনে হত, সে যুগের মডার্নতম দেখা যেত চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দি জাহাজে। এরা ওইসব অঞ্চলের ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়েথদের মেয়ে– তবে বৈদ্যই বেশি– কলকাতায় আসত-যেত কলেজে পড়বে বলে। এক-একটির চেহারা ছিল অপূর্ব। তন্বী, শ্যামাঙ্গী, স্বাস্থ্যবতী– আপন আনন্দে থার্ড ক্লাস ডেকের যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়, চায়ের স্টলে বসে খেতেও ওদের বাধে না। প্রাচীনরা ওদের দিকে একটু বাঁকা নয়নে তাকালেও একথা আমি কিছুতেই স্বীকার করব না, ওরা বেহায়া বা বেশরম ছিল।