সত্যলাভের জন্য তৃষ্ণার্ত জন যুগে যুগে বিদেশে গিয়েছে, বিধর্মীর কাছে গিয়েছে। পয়গম্বর বলেছেন, ‘জ্ঞানলাভের জন্য যদি চীন যেতে হয় তবে সেখানে যেয়ো, বলা বাহুল্য, তাঁর আমলে চীন দেশে কোনও মুসলমান ছিলেন না এবং তাই ধরে নিতে পারি বিধর্মী ‘কাফেরে’র কাছ থেকে জ্ঞানসঞ্চয় করতেও তিনি আপত্তিজনক কিছু পাননি।
কিন্তু এই যে ‘ফরেন’ যাওয়ার হিড়িক আরম্ভ হল প্রায় শ’খানেক বছর আগে এবং স্বরাজ পাওয়ার পর কিমাশ্চর্যমতঃপরম এখনও বাড়তির দিকে, তার বেশিরভাগই ছিল “ইস্টাম্বো’ নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে পেটকে এলেমে ভর্তি করার জন্য নয়। পাঠান এবং মোগল রাজারা এ দেশেই বাস করতেন, এইটেই তাঁদের মাতৃভূমি, কাজেই বিদেশের ইস্টাম্বোর প্রতি তাঁদের কোনও অহেতুক মোহ ছিল না– যদিও বিদেশাগত হুনুরি গুণীকে তারা আদর করে দরবারে স্থান দিতেন। কিন্তু ইংরেজ কলকাতায় বসেও চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে থাকত লন্ডনের দিকে, Kedgeree (কেজরীঃ– খিচুড়ি– কৃশর, কৃশরান্ন?) খাওয়ার সময় চিন্তা করত আল্লায় মালুম কিসের!
অতএব সেখানে থেকে যদি কপালে একটি ‘ইস্টাম্বো’ মারিয়ে নিয়ে আসা যায় তবে পেটে আপনার এলেম গজগজ করুক আর নাই করুক, আপনি ‘ফ্রেশ ফ্রম্ ক্রিস্ট্রিয়ান হোম’, আপনিও এখন গোরা রায়। তাই স্বরাজ লাভের পরও।
অদ্যাপিও সেই খেলা খেলে গোরা রায়।
দিবাভাগে মন্দ ভাগ্যে তার মার খায়।
১৬।১০।৬৫
———-
১. কথাটা জর্মনে hell, কিন্তু বাংলায় আমি ‘হেল’ না লিখে হাল কেন লিখলুম সে বিষয় নিয়ে সুদূর ভবিষ্যতে আলোচনা করবার আশা রাখি। কারণ জনৈক পত্ৰলেখক ইটিকে আমার ‘হিমালয়ান ব্লান্ডার’ পর্যায়ে ফেলেছেন।
অনুবাদ সাহিত্য
কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, অনুবাদ যে অনুবাদ সেটা স্বীকার করতে প্রকাশক, সম্পাদক, স্বয়ং লেখকেরও কেমন যেন একটা অনিচ্ছা। কেন, এ প্রশ্ন শুধাতে একজন প্রকাশক সোজাসুজি বললেন, ‘বাঙালি অনুবাদ পড়তে ভালোবাসেন না, তাই অসাধু না হয়ে যতক্ষণ পারি ততক্ষণ তথ্যটা চেপে রাখি।’ কিছুকাল পূর্বে আমিও একটি বড় গল্প অনুবাদ করি ও তার প্রথম বিজ্ঞাপনে সেটি যে অনুবাদ সে কথা প্রকাশিত হয়নি। আমি সেই সম্পাদককে বেনিফিট অব ডাউট দিয়ে মনকে সান্তনা দিচ্ছি এই বুঝিয়ে যে দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনে এই গাফিলতি মেরামত করা হবে। ওই সময়ে আমারই সহকর্মী (কারণ দু জনাই দেশ-সেবক এবং তিনি অন্যার্থেও) শ্ৰীযুত বিদুর ওই নিয়ে কড়া মন্তব্য করে যা বলেন তার নির্যাস, যত বড় লেখকই হোন না কেন, তিনি যদি অনুবাদ-কর্ম করেন তবে সেটা যেন পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়। অতিশয় হক কথা। তবে এটা আমি গায়ে মাখছিনে, কারণ আমি ‘যত বড়’ কেন অ্যাটটুন বড় লেখকও নই। আমি বরঞ্চ গোড়াতেই চেয়েছিলুম যে ফলাও করে যেন বলা হয়, এটি অনুবাদ। এবং সেই মূল প্রখ্যাত লেখকের অনুবাদ প্রসাদাৎ তার সঙ্গ পেয়ে আমি কিছুটা খ্যাত হয়ে যাব—‘রাজেন্দ্র সঙ্গমে, দীন যথা যায় দূর তীর্থদরশনে।’(১) কিংবা কালিদাস রঘুবংশের অবতরণিকায় যে কথা বলেছেন–বজ্র কর্তৃক মণি সছিদ্র হওয়ার পর আমি সুতো সুরুৎ করে বেতলিফ উৎরে যাব।
এবং এ-স্থলে এটাও স্মরণ রাখা উচিত, কালিদাস বা মধুসূদন কেউই বাল্মীকির আক্ষরিক কেন, কোনও প্রকারেরই অনুবাদ করেননি। সম্পূর্ণ নিজস্ব মৌলিক কৃতিত্ব দেখিয়েও এরা অতখানি বিনয় দেখিয়েছেন। মডার্ন কবিতা যে আমার পিত্তি চটিয়ে দেয়, তার অন্যতম কারণ এঁদের অনেকেরই অভ্রংলিহ দম্ভ। ‘আধুনিক’ গাওয়াইদের কণ্ঠেও সেই সুর শুনতে পাই। আর মডার্ন পেন্টাররা কী করেন–অন্তত তাঁদের দু জনার ব্যবহার সম্বন্ধে তো অনেক কথাই বেরিয়েছে।
কিন্তু সেকথা থাক। আমার প্রশ্ন, অনুবাদ পড়তে বাঙালি ভালোবাসে না কেন?
আমার কিন্তু কথাটা কেন জানি বিশ্বাস করতেই ইচ্ছে যায় না।
বাংলাভাষার কচিকাঁচা যুগে কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাভারতের অতি বিশুদ্ধ আক্ষরিক অনুবাদ করেন। আজ পর্যন্ত যে তার কত পুনর্মুদ্রণ হল তার হিসাব হয়তো আজ বসুমতীই দিতে পারবেন না। পাঠকদের শতকরা ক-জন নিছক পুণ্য-সঞ্চয়ার্থে এ অনুবাদ পড়েছে। এমনকি রাজশেখর বসুর অনুবাদও– যদিও একটি বারো বছরের ছেলেকে বলতে শুনেছি, ‘ওই বসুমতীরটাই ভালো। বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেখা– ধীরেসুস্থে পড়া যায়। রাজশেখর বাবুরটায় বড় ঠাসাঠাসি।’ ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ ‘বত্রিশ সিংহাসন’ এ যুগের ছেলেমেয়েরাও তো গোগ্রাসে গেলে। (বিষ্ণুশর্মার ‘পঞ্চতন্ত্রে’র আরবি অনুবাদ ইরাক থেকে মরক্কো পর্যন্ত আজও আরব্য রজনীর সঙ্গে পাল্লা দেয়।) ঈশান ঘোষের জাতক জনপ্রিয় হওয়ার পূর্বেই বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল– (পরম পরিতাপের বিষয় যে এখনও তার পুনর্মুদ্রণ হল না) অথচ তার থেকে নেওয়া বাচ্চাদের জাতক তাদের ভিতর খুব চলে। জ্যোতি ঠাকুরের সংস্কৃত নাটক ও ফরাসি কথাসাহিত্যের অনুবাদ এককালে বিদগ্ধ বাঙালিই পড়ত। ওদিকে এসবের বহু পূর্বে আলাওল অনুবাদ করলেন– যদিও আক্ষরিক নয়—জয়সী’র ‘পদুমাবৎ’। এবং তার পরপর বেরুল ‘ইউসুফ-জোলেখা’, ‘লায়লী-মজনু’ ইত্যাদি। মোল্লার বাড়িতে এবং পুব-বাংলার খেয়াঘাটে, বটতলায় এখনও তাদের রাজত্বের অবসান হয়নি; ওদিকে কাশীরাম, কৃত্তিবাস। ‘আরব্যোপন্যাস’, ‘হাতিমতাই’, ‘চহারদরবেশ’ ঊনবিংশ শতাব্দীতেই বাংলা দেশে নাম করেছে। তার পর ‘রবিনসন ক্রুসো, ‘গালিভার্স ট্রেভল’ এবং ফরাসি থেকে ‘লে মিজেরাবল’ এদেশে কী তোলপাড়ই-না সৃষ্টি করল।