ড্রাইফুসের প্রতি নষ্টাধম ফরাসি মিলিটারি মদমত্ত হয়ে যে অবিচার করে তার প্রতিকারের জন্য তাঁর সতীসাধ্বী স্ত্রী প্যারিসের বড় বড় রাজনৈতিক শক্তিধর শাসক সম্প্রদায়ের দ্বারে দ্বারে গিয়ে করুণ আর্তনাদ করেছে। কিন্তু সে বেচারি তো আমাদের তুলনাহীনা’ লেখিকা আশাপূর্ণা নয়। শেষটায় চরম দীনজন যেরকম ভিক্ষুকের কাছে ভিক্ষা চায়, ঠিক সেইরকম সে গেল সাহিত্যিক এমিল জোলার কাছে। তাঁর তখন বয়স হয়ে গিয়েছে। তিনি মাফ চাইলেন। শেষটায় বেচারি তার কাগজপত্র জোলার টেবিলে ফেলে রেখে চলে গেল।
এই পৃথিবীর পরম সৌভাগ্য সে রাত্রে জোলার কোনওকিছু করার ছিল না।
এটা-ওটা নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ সেই রমণীর কাগজপত্র চোখে পড়ল।
অলস-ভরে পড়া আরম্ভ করে বুড়ো হঠাৎ সোজা হয়ে বসল– তার পর গেল ক্ষেপে! তখন লিখল ‘জ্যাকুজ (Jaccuse) আই একুজ’। ‘ফরাসি সরকারকে আমি একুজ করি।’
তার পর কী হল সেটা বলতে গেলে ওই বইখানা ছাড়িয়ে আরও দু খানা বই লিখতে হয়।
মনে নেই, ক’বছর নির্বাসনের কারাযন্ত্রণা ভোগ করে ‘কাঁদানো’র লেখক জোলার কৃপায় ড্রাইফুসের প্রতি সুবিচার হল।
শেষ কথা : বহু বহু প্রকৃত লেখক, ‘চোখের জলের লেখক’ নন কিংবা শুধু ‘হাসাবার’ লেখক নন। দুই-ই।
তবে কে কোথায় হাসবে, কে কোথায় কাঁদবে, বলা কঠিন। সেই “অরক্ষণীয়া” মেয়েটি যখন পড়ি-মরি হয়ে ‘সেজেগুজে’ কনে দেখবার পক্ষের সামনে বেরুতে যাচ্ছিল তখন একটি ছোট মেয়ে হাসি থামাতে না পেরে বলেছিল, পিসিমা সং সেজেছে।
আমি গ্যাগা। আমি ষোল বছর বয়সে কেঁদেছিলুম।
৪।১২/৬৫
———-
১. যে-কোনও কারণেই হোক, বন্ধুবর নাম উল্লেখ করলেন না, আমিও শুধোইনি।
২. বিদ্যেসাগর ছদ্মনামে হাস্য– বরঞ্চ বলা উচিত ব্যঙ্গরসও করে গেছেন। কিন্তু তাঁর খ্যাতি সেজন্য নয়। বস্তুত তাঁর সেসব ছদ্মনামে লেখা পুনরায় ‘আবিষ্কৃত’ হয় বছর বিশ-ত্রিশ পূর্বে।
ছাত্র বনাম পুলিশ
০১.
‘দেখি! বের কর অভিজ্ঞান-পত্র- আইডেনটিফিকেশন কার্ড!’
কী আর করে বেচারি– দেখাতে হল কার্ডখানা। নামধাম ঠিকানা তো রয়েইছে, তদুপরি রয়েছে বেচারির ফোটোগ্রাফ, তার নিচে ছোকরার দস্তখত, এবং দুটোর দু কোণ জুড়ে য়ুনিভার্সিটির ট্যাম্প। হোমিওপ্যাথিক পাসপোর্ট আর কী!
হায় বেচারা! যখন য়ুনিভার্সিটিতে প্রবেশ করার ওক্তে সগর্বে কর্তৃপক্ষের সম্মুখে ফোটোগ্রাফের নিচে দস্তখত করেছিলে তখন কি জানত এটা ‘দস্তখত’ নয়, এই ‘কুকর্ম’, করে তার ‘দস্ত’ (হাত) ‘ক্ষত’ হয়েছিল– এ ‘পান’টি আমার নয়, বিদ্যেসাগর মশাইয়ের। তাঁর প্রোতেজে মাইকেল পান করতেন প্রচুর, স্বয়ং বিদ্যেসাগর ‘পান’ করতেন অত্যল্পই।
প্রাগুক্ত সরস প্রেমালাপ হচ্ছিল জর্মনির কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং পুলিশম্যানে (চলতি জৰ্মনে ‘শুপো’)। ছোকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাত দুটোর সময় কাকর ছুড়ছিল একটি বিশেষ জানালার শার্সিকে নিশান করে, এবং যেহেতু তৎপূর্বে– অর্থাৎ শনির সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দুটো অবধি চেন-স্মোকারদের মতো অ্যাট্টুখানি, মানে ইয়ে, ওই যাকে বলে বিয়ার পান করেছিল বলে তাগটা স্বভাবতই টালমাটাল হয়ে পাশের যার-তার জানালার শার্সির উপর পড়েছিল। অবশ্য একথা অবিসম্বাদিত সত্য যে, সে কাপুরুষের মতো শুপোর হাতে আত্মসমর্পণ করেনি– আপ্রাণ পলায়ন-প্রচেষ্টায় নিষ্ফল হয়ে তবে ধরা পড়ে।
ব্যাপারটা সবিস্তার কী?
অতি সরল। জর্মন ছাত্রছাত্রী ডিগ্রি লাভের পূর্বের তিন বৎসর ভূতের মতো খাটে। কিন্তু শনি-সন্ধ্যা থেকে রবির সকাল পর্যন্ত দল বেঁধে ‘পাবে’ বসে প্রেমসে বিয়ার পান করে। এবং যেহেতু বাড়াবাড়ি না করলে খ্রিস্টধর্ম মদ্যপান সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য করে না, তাই কোনও কোনও ধর্মানুরাগী ছেলে তোর সাতটার ‘মেস’-এ (উপাসনায়) যোগ দিতে যায় ‘পাব’ থেকেই, সোজা গির্জার দিকে– শনির সন্ধ্যা থেকে রবির ভোর ছটা সাড়ে ছ’টা অবধি বিয়ার পান করার পর। অবশ্যই মত্তাবস্থায় নয়– তবে ইংরেজিতে যাকে বলে ঈষৎ মডলিন।
তা সে যাক। এ লেখকের বিষয়বস্তু পুলিশ বনাম স্টুডেন্ট (স্টু’ডেন্ট’ বলতে জর্মনে একমাত্র য়ুনিভার্সিটি স্টুডেন্টই বোঝায়– স্কুলবয়কে বলে ‘শ্যুলার’)। এই দুই দলের মধ্যে হামেহাল অবশ্য সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত এবং বিশেষ করে শনি দিনগত রাতে– একটা অঘোষিত বৈরিতা বিরাজ করছে, য়ুনিভার্সিটি সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে। আমি যা নিবেদন করতে যাচ্ছি তার ঐতিহাসিক পটভূমিটি কিন্তু কিংবদন্তিমূলক, অর্থাৎ পুরাণ জাতীয়। সেইটুকু সয়ে নিন। তার পরই মাল।
আমরা সকলেই জানি কতকগুলো উপাধি মানুষের নামের অচ্ছেদ্য অংশ : যেমন (১) রেভারেন্ড, (২) কর্নেল, (৩) ডক্টর (শুধু চিকিৎসক অর্থে নয়; যে কোনও বিষয়ে পিএইচডি, ডিএসসি জাতীয় ডক্টরেট পাস করা থাকলে)। প্রথম শ্রেণির উপাধিগুলো বিধিদত্ত, দ্বিতীয়গুলো রাজদত্ত এবং তৃতীয়গুলো য়ুনিভার্সিটিদত্ত।
রাজাতে-চার্চে লড়াই বহু যুগ ধরে চলেছে। এ লড়াইয়ে শেষের দিকে এলেন য়ুনিভার্সিটি। তার পূর্বে শিক্ষা-দীক্ষার ভার ছিল প্রধানত পাদ্রিদের হাতে। কিন্তু মহামতি লুথারের আন্দোলনের ফলে বহু পিতা পুত্রকে আর ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ যাজক সম্প্রদায়ের কাছে মানসিক, হার্দিক এমনকি আধিভৌতিক উন্নতির জন্য পাঠাতে চাইলেন না। এছাড়া আরও বিস্তর কারণ ছিল, কিন্তু সেগুলো এস্থলে অবান্তর না হলেও নীরস। মোদ্দা কথা, চার্চ ও রাজার লড়াইয়ের মধ্যিখানে য়ুনিভার্সিটিগুলো তক্কে তক্কে রইল আপন আপন স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীনতা-স্বরাজ লাভের জন্য। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল লুথারপন্থী এবং তাদের মূল নীতি ছিল অনেকটা—‘যখন পোপের “গুরু-বাদ” ত্যাগ করে স্বয়ং স্বাধীনভাবে বাইবেল পড়তে চাও, এবং তদ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একমাত্র স্বাধীন চিন্তার ওপর নির্ভর করে জীবন যাপন করতে চাও, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীনতা, (অটোনমাস ইন্ডিপেনডেন্ট)–নইলে তারা স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন বিচার-বিশ্লেষণ করবে কী প্রকারে?’