এই পুণ্য বঙ্গভূমিতে শতাধিক বর্ষ ধরে দুটি দল আছে। রামমোহন বনাম সতীদাহের দল, বিদ্যাসাগর বনাম নিরস্তু উপবাসের দল, রবীন্দ্রনাথ বনাম– তা সে যাই হোক। সেই দল চেষ্টা করেছিলেন শরৎচন্দ্রকে নেতা বানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে অতিষ্ঠ করে তুলতে। তাঁরা মাষা পরিমাণ কৃতকার্য হয়েছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখা গেল শরৎচন্দ্র দলের বাইরে। শরৎচন্দ্র যেমন ‘দত্তা’র ‘রাসবিহারী’ চরিত্র আঁকেন, ঠিক তেমনি ‘নারীর মূল্য’ও লিখতে জানেন। (আশা করি বলার প্রয়োজন নেই যে শরৎচন্দ্র এই অমূল্য গ্রন্থ কঁদাবার জন্য লেখেননি; পাঠক, আপনি সে বই পড়ে কী ভেবেছেন সঠিক বলতে পারব না; আমার মনে হয়েছে, আমি যেন দু গালে চড় খাচ্ছি এবং জানি যখন এ-ই আমার প্রাপ্য তাই আমি তখন কঁদিনি– কারণ কাঁদবার হক্কও সঞ্চয় করতে হয়।)
এদিকে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘অন্ধভক্তে’র দল ডেকে আন্ বললে যাঁরা বেঁধে আনে– (যদিও আমি রবীন্দ্র-শিষ্য হিসেবে শপথ করে বলতে পারি, তিনি ডেকে আনতেও বলেননি) লাগলেন শরৎচন্দ্রের পিছনে। তার জের আজও চলেছে। অবশ্য এস্থলে আমি করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে নিবেদন করি, পূর্বোল্লিখিত অধ্যাপক এ-‘দলে’র না-ও হতে পারেন। তিনি হয়তো তার স্বাধীন ধর্মবুদ্ধি অনুযায়ী তার বক্তব্য বলেছেন।
কিন্তু এসব বৃথা বাক্য। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একটি ‘তুলনাহীনা’ কবিতা লিখতে লিখতে হঠাৎ লিখেছেন, ‘বৃথা বাক্য থাক’। গুরুবাক্য স্মরণে এবং সেই নীতি অনুযায়ী আমারও মন তাই এতক্ষণ ধরে বৃথা বাক্য ভুলে গিয়ে শুধু আঁকুবাকু করছে, মেজদার স্মরণে– যিনি দুর্দান্ত শীতের রাতে লেপের ভিতর কচ্ছপটির মতো শুয়ে আছেন আর শ্রীকান্ত তাঁর জন্য পাতা উল্টে দিচ্ছেন, হঠাৎ ব্যাঘ্ররূপী ‘বউরূপী’র আবির্ভাব, ভিরমি কাটলে পর মেজদা ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার’– ইতোমধ্যে খড়ম পেটাতে পেটাতে (আহা, কী সুন্দর ছবিটি!) কটুবাক্য, ‘খোট্টার ব্যাটারা কাঁঠাল পাকা দিয়া’– এবং সর্বশেষে পিসিমা’র সাতপাকের সোয়ামির প্রতি অত্যন্ত প্র্যাকটিক্যাল সময়োপযোগী সদুপদেশ– কাটা ন্যাজটি ভবিষ্যতের সুব্যবহারার্থে তরিবৎ করে তুলে রাখার জন্য সেকালে বোধ হয় ভাগলপুরে ব্যাঙ্কে ভলটের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু সাবধান! আমাকে সর্বক্ষণ সচেতন হয়ে থাকতে হবে যেন ফাঁদে পা না দিই;– শরৎচন্দ্র যে বাংলা দেশকে হাসিয়েছেন তার উদ্ধৃতি দেবার প্রলোভন সম্বরণ না করলে বর্তমানে যাদের হাতে শরৎ-গ্রন্থাবলির কপিরাইট তাঁরা আমাকে জেলে পুরবেন– পাতার পর পাতা নিছক পুনর্মুদ্রণ তাঁরা বরদাস্ত করবেন কেন? অথচ আমার বক্তব্য তো স্পষ্টতম হবে, যদি আমি একটিমাত্র বাক্যব্যয় না করে নিছক উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি দিয়ে যাই।
তর্কস্থলে স্বীকার করছি কাঁদানো সহজ। হাসানো কঠিন। টেকো ভদ্রলোক তাঁর বাদবাকি কুলে আড়াইগাছা চুল দিয়ে মাথার সামনের দিকের চালটা যেন খড় দিয়ে ছাওয়ার নিষ্ফল প্রচেষ্টা করেছেন– তাই দেখে রকে বসে আমার তিন ভাগনে যে শ্রোমীয়’ টিপ্পনী কাটলে সেটি অনায়াসে অলিম্পিকে পাঠানো যায় এবং সেটি আমি ঘরের ভিতর থেকে স্পষ্ট শুনতে পেলুম। কিন্তু, হায়, ওদের সঙ্গে যোগ দিতে পারলুম না, কারণ, সরলতম কারণ, আমার আপন টাকটি– থাক, বৃথা বাক্য থাক। কিন্তু ঠিক ওই সময় অন্য একটি ভদ্রলোক রাস্তা। দিয়ে যাবার সময় রক্ থেকে যদি শব্দ আসত, ‘আহা বেচারা, কাল রাত্রে তার ছেলেটি–জানিস, কী হয়েছে?’–বাকিটা শুনতে পেলুম না বলে হেঁকে শুধালুম, ‘কেন রে, কী হয়েছে?’ ‘টাইফয়েডে একটা চোখ গেছে।’ আমি তখন রকেরই একজন হয়ে গেলুম।
কিংবা সরলতর উদাহরণ দিই।
ওই বৈঠকখানায়ই বসে আছি। বাড়ির বউঝিরা রান্নাঘরে ফিসফিস করে গালগল্প করতে করতে– রাধে মেয়ে কি চুল বাঁধে না হঠাৎ সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। আমি যত গ্যাগা-ই হই না কেন, উঠে শুধাব না, ‘হ্যাঁ বউমা, তোমরা হাসছিলে কেন?’
কিন্তু তারা যদি হঠাৎ একসঙ্গে ডুকরে কেঁদে ওঠে তবে আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে জানতে চাইব তারা এরকম ধারা হঠাৎ কেঁদে উঠল কেন? অর্থাৎ হাসি একে অন্যের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যায়, কান্না কাছে টেনে আনে।
***
শরৎচন্দ্র ‘চোখের জলের লেখক’? আর বিদ্যাসাগর? বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের সময় তিনি যেসব ব্যঙ্গ-পি করেছেন, তখন আমরা ঠাঠা করে হেসেছি?– না? তার শকুন্তলা’ পড়তে পড়তে আমি হেসেই গড়াগড়ি! রবীন্দ্রনাথের হাস্যরস নিশ্চয়ই অত্যন্ত অপ্রচুর ছিল। নইলে তিনি লিখবেন কেন, কেহ দুঃখ পায় ইহা তিনি (শ্ৰীকণ্ঠবাবু) সহিতে পারিতেন না– ইহার কাহিনীও তাঁহার পক্ষে অসহ্য ছিল। এই বালকদের কেহ যখন কৌতুক করিয়া তাহাকে পীড়ন করিতে চাহিত তখন বিদ্যাসাগরের “সীতার বনবাস” বা “শকুন্তলা” হইতে কোনও একটি করুণ অংশ তাঁহাকে পড়িয়া শোনাইত, তিনি দুই হাত তুলিয়া নিষেধ করিয়া অনুনয় করিয়া কোনওমতে থামাইয়া দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িতেন।
আশ্চর্য! আমি তো গ্রন্থ দু খানা পড়ে হেসেই কুটিকুটি! তবে হ্যাঁ, আমি পূর্বেই স্বীকার করেছি আমি গ্যাগা।
সাহিত্যিক বিদ্যাসাগর মশাইকে লোকে চেনে তার চোখের জলের বইয়ের জন্য। অবতার বিদ্যাসাগরকে বাঙালি চেনে তিনি মানুষের চোখের জল মুছিয়ে দিতেন বলে। বিদ্যাসাগর মশাই দুটোই পারতেন। কিন্তু সবাই তো তা পারে না। সমাজের অত্যাচার-অনাচার দেখে সত্য সাহিত্যিক মানুষকে কাঁদায়। তাদের ভেতরে যাঁরা সত্যকার মানুষ তখন তাঁদের অনেকেই সেসব অনাচারের বিরুদ্ধে নাঙ্গা তলওয়ার নিয়ে জেহাদ ঘোষণা করে। কারণ আমাদের অধিকাংশই জড়। সাহিত্যিক স্পর্শকাতর। সে যখন করুণ বর্ণনা দিয়ে আমাদের কাদায়, তখন আমাদেরই মতো জড়ভড়তদের কেউ কেউ ওই সম্বন্ধে সচেতন হয়।(২)