হিটলার বক্তৃতা-গর্জনও রুদ্রের তাণ্ডব নৃত্যতুল্য প্রলয়ঙ্কর, কিন্তু সেটাকে অত সহজে বিশ্লেষণ করা যায় না। সেটাও কলাসৃষ্টি এবং সেটি য়পপ-মার্কার চেয়ে লক্ষগুণে কার্যকরী। কড়া পাক।
দু জনার মুখে একই জিগির : ইহুদিকুল সর্বনেশে। এদের সমূলে বিনাশ করতে হবে।(২)
কিন্তু দু জনের মনের ভিতর দু প্রকারের যুক্তি। য়পপের বিশ্বাস, ইহুদিরা সর্ব ব্যাপারেই সাতিশয় ধুরন্ধর। এদের সঙ্গে ‘নর্ডিক আর্যরা’ অর্থাৎ জর্মনরা কিছুতেই পাল্লা দিতে পারবে না। পক্ষান্তরে হিটলার এটা মানতে পারেন না– জান্ কবুল। তাঁর মতে, এই বসুন্ধরায় যে-কটা ডাঙর ডাঙর জাত, গোষ্ঠী, বংশ–যা খুশি বলুন, ইংরেজিতে Race–জর্মনে Rasse–তার মধ্যে ‘আর্য’ রেস সর্বোত্তম। এবং সেই আর্য রেসের ভিতর সর্বোত্তমেরও সর্বশ্রেষ্ঠ জর্মনির নর্ডিক, নীল চোখ, ব্লন্ড (সোনালি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে রুপালি– যেটাকে বলা হয় প্রাটিনাম ব্লন্ড) চুলধারী ‘আর্য’ রেস। ইহ-বিশ্বের সর্ববাবদে তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্পন্ন শক্তিমান যুবার শরীরেও যেমন ক্যানসার দেখা দিতে পারে, ঠিক তেমনি জর্মন সমাজে এসে ঢুকেছে ইহুদি গোষ্ঠী। এবং ছারপোকার মতো ভার্মিন। ছারপোকা বেশি বুদ্ধিমান না মানুষ বেশি বুদ্ধি ধরে, এ প্রশ্ন বুদ্ধিমান মানুষ তুলবে না–বুদ্ধিমান বা মূর্খ ছারপোকা তুলবে কি না, সেটা হিটলার বলেননি।
য়পপ বললেন, ‘এটা হল তুলনা। তুলনা যুক্তি নয়।’
ফ্যুরার বললেন, ‘তুলনা মাত্রই তিন ঠ্যাঙের উপর দাঁড়ায়। টায়-টায় যুক্তির স্থান নিতে পারে না সত্য, কিন্তু আপন বক্তব্য জোরদার ও প্রাঞ্জল করার জন্য, তুলনার ব্যবহার করেছেন। সর্বগুণীজ্ঞানীই।’
য়পপ বললেন, ‘তর্কস্থলে মেনে নিলুম।’ গ্যোবলস্ বড়ই প্রভুভক্ত ছিলেন। নইলে প্রভুর আত্মহত্যার চব্বিশ ঘন্টার ভিতর তাঁর ছ’টি শিশু পুত্রকন্যাদের ডাক্তার দিয়ে খুন করিয়ে সস্ত্রীক আত্মহত্যা করবেন কেন?(৩) বললেন, ‘তাই সই। কিন্তু আমি আপনাকে হাতেনাতে দেখিয়ে দেব, ইহুদিরা অন্তত ব্যবসার ক্ষেত্রে আর্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধি ধরে।’
‘কোনও ক্ষেত্রেই না।’
‘বাজি ধরুন।’
‘বিলক্ষণ! কত?’
‘এক লাখ।’
‘গেমাখট– পাক্কি বাৎ।’
দু জনাতে ছদ্মবেশে বেরোলেন। তার জন্য বেশি বেগ পেতে হয় না। এমনিতেই ঠোঁটকাটা বার্লিন-ককনিরা বলত ফ্যুরারের চুল নেবে পড়ে কপাল ঢাকেনি অকল্পনীয়; আর গ্যোবলস্ এক লহমার তরে বকর বকর বন্ধ করেছে– এটা ততোধিক অবিশ্বাস্য। হিটলার তাই চ্যাটচেটে পমেটম দিয়ে যেন প্রায় ভৈরবচণ্ডীর মতো চুড়ো-খোঁপা বাঁধলেন– এবারে আর চুল খসে পড়ে, কপাল ছাপিয়ে চোখ এস্তেক ঢেকে দেবে না। ব্যস্, এতেই হয়ে গেল ছদ্মবেশ। আর য়পপ? তিনি বললেন, তিনি প্রতি দশ মিনিটে মাত্র একটি সেনটেনস বলবেন। এ-রকম বিকট চুপচাপ লোককে কে চিনবে য়পপ বলে!
য়পপেরই প্রস্তাবমতো দু জনাতে ঢুকলেন এক পাঁচমিশিলি খাঁটি আর্য দোকানে। চাইলেন একটা টি-সেট। দোকানি একটি রমণীয় ট্রের উপর সবকিছু সাজিয়ে সামনে ধরল। গ্যোবলস তো তাঁর মুণ্ডটি ডান থেকে বাঁয়ে, ফের বাঁ থেকে ডাইনে নাড়িয়ে নির্বাক প্রশস্তি শুনিয়ে দিলেন। তার পর হঠাৎ যেন মনে পড়ল ওইরকম ভাবখানা করে বললেন, ‘কিন্তু আমার যে-দোস্তকে আমি এই জন্মদিনের সওগাৎটা দেব তিনি তো ন্যাটা; আপনাদের কাছে কি লেফট-হ্যান্ডারদের জন্যে কোনও টি-সেট আছে?’ হিটলার বললেন, ‘হুঁ।’ ভদ্র আর্যসন্তান আমাদের দোকানি তো বেবাক বে-বাক– অবাক। ‘লেফট-হ্যান্ডারস টি-সেট?’ সে আবার কী গব্বযন্ত্রণা রে বাপু! বাপের জন্মে নাম এস্তেক শোনেনি। অনেকক্ষণ ঘাড় চুলকে, বিস্তর আন্দেশা করে আপসা-আপসি করে সবিনয় জানালে, তার কাছে নেই।
হিটলার দিলদরাজ আদমি। একগাল হেসে বললেন, ‘মাখটনিকস, মাখটনিকস– বিলক্ষণ, বিলক্ষণ! তাতে এসে-যায় না। আমরা অন্য দিন দুসরা জিনিসের জন্য আসব’খন– খাসা দোকানটি কিন্তু! কী বল হ্যার ডক্– থুড়ি! ঔফ বিডার জেএন! গুটে নাখট! আসি তবে। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ।’
এবারে য়পপ প্রভুকে নিয়ে ঢোকালেন এক ইহুদির দোকানে।
দোকানি ছিল না। তার চোদ্দ বছরের ছেলে ছুটে এসে অদৃশ্য স্যামপুতে (কথাটা আজকাল বড়ই ‘ফেশিনিবিল’ হয়েছে; আম্মো ব্যাভার করতে চাই) হাত কচলাতে কচলাতে একবারের জায়গায় তিন-তিনবার বলে বসল, ‘য়ুটন ময়েন, য়ুটন ময়েন, য়ুটন ময়েন (গুটন মর্গেনের অর্ধশিক্ষিত’ উচ্চারণ), মাইনে হেরেন!’
উত্তরে হিটলার বিড়বিড় করে কী একটা বললেন, ঠিক ঠাহর করা গেল না। দক্ষিণে কোনও কোনও ব্রাহ্মণ নাকি একদা রাস্তায় (‘সড়ক’ ‘সরকে’ বা ‘সরণিতে’–ওহ! কী স্টর্ম ইন এ টি ‘সেট’!) বেরোলে চিৎকার করতেন, অস্পৃশ্য যেন সরে যায়, তার ছায়া যেন ওঁর গায়ে না পড়ে–তবে এদের পঞ্চাশ বা ষাট লক্ষকে বামুন গ্যাস চেম্বারে(৪) খুন করে পুড়িয়েছে একথা কখনও শুনিনি। অতএব হিটলার যে ইহুদি ছোকরাকে হেল-ফোলো– উয়েল-মেট (hail-fellow-well-met) করেননি, সেটা স্পষ্টই বোঝা যায়। ইহুদি ছোকরা কাঁচুমাচু হয়ে বললে, ‘আমার বলে দেওয়া উচিত, সরকারের হুকুম, কোনও “আর্য” যদি ইহুদির দোকানে ঢোকেন তবে দোকানদার যেন তাঁকে সতর্ক করে দেয়, এটা ইহুদির দোকান, এখানে কেনাকাটা করলে আর্যই দায়ী। সাইন-বোর্ডেও স্পষ্ট করে লেখা আছে, আপনারা হয়তো লক্ষ করেননি।’