লেভি বললেন, “তুমি দেখি হেরোডকেও হেরোড শেখাতে চললে অর্থাৎ যারে বলে গুরুমারা বিদ্যেতে ওস্তাদ হয়ে উঠছ। বুঝিয়ে বল।”
আমি বললাম, “যে ব্রাহ্মণ শ্রেণির গল্পটি আপনাকে বললাম, তাঁরা যে অতিশয় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরেন, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, এবং বুদ্ধিমান জীব মাত্রেই ঐক্যে বিশ্বাস করে। তাই আমি বহুকাল ধরে পর্যবেক্ষণ করে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলুম, এঁরা একে অন্যকে খুবই সাহায্য করে থাকেন– যে রকম ফ্রিমেসনরা একে অন্যের প্রতি বড়ই সদয়– কিন্তু সে সাহায্যটি করেন অতিশয় সঙ্গোপনে। এবং অন্য শ্রেণির ব্রাহ্মণরা যাতে করে এ-তত্ত্বটি আবিষ্কার না করতে পারেন, তাই তারা নিজেরাই বাজারে একাধিক কামুফ্লাজ গল্প ছেড়েছেন এই মর্মে যে, তাদের ভিতর মারাত্মক ঐক্যাভাব। তাই আমার মনে হয়, আপনি যে গল্প দিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন, ইহুদিরা সবদ্ধ হয় না, সেটা স্বয়ং ইহুদিরাই তৈরি করেছেন, খ্রিস্টানদের সন্দেহ না জাগানোর জন্য।”
ইহুদি আর স্কচম্যানের একটা মহৎ গুণ–তাদের নিয়ে কেউ রসিকতা করলে সেটা তারা উপভোগ করতে পারে। লেভি আমার সত্য-সিদ্ধান্ত শুনে হেসে বললেন, “এটা আজ খানা-টেবিলে আমি পেশ করব। দেখি, ঠাকুন্দা-বাবা কী বলেন। কিন্তু জানো, এর থেকে একটা গুরুতর সমস্যায় উপনীত হওয়া যায়। তুমিই সেদিন প্রশ্ন করেছিলে, ইহুদিরা যে প্যালেস্টাইনে ‘হোম’ বানাতে চায়, সেটা ভালো না মন্দ? আমি বলেছিলুম, সময় এলে আলোচনা করা যাবে। তাই এ-স্থলে প্রশ্ন শুধানো যায়, পৃথিবীর সব ইহুদি এই হোম চায় কি না? এই দাবির পিছনে কি তারা ঐক্যবদ্ধ? তোমার প্যারা কবি হাইনে একদা এই আন্দোলনের সঙ্গে ঠিক ঠিক বলতে গেলে ওই আন্দোলনের আলোচনাচক্রের সঙ্গে সংযুক্ত হন। কিন্তু কিছুদিনের ভিতরই তিনি সে-চক্র থেকে নিজেকে মুক্ত করে ফেলেন। তার থেকে অবশ্য এটা বলা চলে না, প্যালেস্টাইনে ইহুদি হোম নির্মাণের ব্যাপারে তার কোনও ঔৎসুক্য ছিল না। আসলে ব্যাপারটা অন্য ধরনের; সংখ্যালঘুদের ভিতর একরকম লোক থাকে, যারা আপন সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র গণ্ডির ভিতর নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায় না– তারা ভাবে, বাড়িতে বাপ-ভাই তো সে-গণ্ডি বানিয়ে রেখেছেনই, বাইরে গিয়েও তাদেরই জাতভাইদের সঙ্গে মিশে কী লাভ? আমার মনে হয়, হাইনের বেলা হয়েছিল তাই।” তার পর হঠাৎ রাস্তার উপরই থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমার দেশে তুমিও তো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক। তুমি দেশে কাদের সঙ্গে মেলামেশা কর?” উত্তর দেবার পূর্বেই তিনি বললেন, “এ বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা চলতে পারে, অতএব এটা এখন মুলতুবি থাক, কারণ বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি।”
বাউমশূল আলের শেষ প্রান্তে ছোট্ট একখানা ছিমছাম তেতলা বাড়ি।
ল্যাচ-কি দিয়ে দরজা খুলে বললেন, “স্বাগত জানাই তোমাকে। মঙ্গল হোক, জয় হোক তোমার। তোমার বংশধর যেন অসংখ্য হয় ॥”
২১/৫/৬৬
গাড়োলস্য গাড়োল
আদরের ডাক-নাম য়প বা ইয়প– সারা দেশটা জুড়ে তোলা-নাম হ্যার ডক্টর ইয়োজেপ (য়পপ) গ্যোবলস, রাষ্ট্রের প্রপাগান্ডা মন্ত্রী, রাজধানী বার্লিনের গাও-লাইটার (অঞ্চলাধিকারী) এবং ফ্যুরার অ্যাডলফ হিটলারের শেষ জুয়োখেলার পাশা যখন ব্লাঙ্কো মেরে মেরে যাচ্ছে, তখন সর্বাত্মক, টোটাল ওয়ারের জন্য কুল্লে তাগৎ ‘ইকট্টে’ করার জন্য সর্বাধিকারী। পার্টির ব্রেন-বাক্সো। শত্রু-মিত্র সবাই এক সুরে বলেছেন, ‘হ্যাঁ, প্রপাগান্ডা কারে কয়, সে-বস্তু দেখিয়ে গেছে ওই ব্রেন-বাক্সোটা।’ বাক্সোটির এক দিক দিয়ে ঢুকত সাদামাটা তথ্য, হাফ-তথ্য, ডাহা মিথ্যে, ঘৃতলবণতৈলতণ্ডুলবস্ত্রইন্ধন বেরিয়ে আসত অন্যদিক দিয়ে। এক-একখানা চাঁছাছোলা, নিটোল, অব্রণ, অনিন্দনীয় কলাসৃষ্টি! দাঁড়ান, এই ‘কলাসৃষ্টি’ রহস্যটা একটু গুছিয়ে বলতে হয় কারণ এ বাবদ তাবৎ টেকনিক্যাল টার্ম একমাত্র ফরাসির মারফত প্রকাশ করা সম্ভব। তদুপরি গ্যোবলস্ সায়েবের দিলের দোস্ত থেকে জান-এর দুশমন্তক, স্বীকার করেছেন, ভোঁতা হোঁৎকা টিউটন নাৎসি পাঁঠাদের ভেতর ওই গ্যোবলসই ছিলেন একমাত্র জিনিয়াস, যাঁর স্কন্ধে বিরাজ করত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মস্তিষ্ক-কুণ্ডলী পরিপূর্ণ লাতিন মাথা– তাই তাঁর লিখন-কথন উভয়েতেই ছিল, ফরাসিসুলভ ফটিক স্বচ্ছতা।(১) এ-কলাসৃষ্টিকে অ্যভর দা’র বলা যেতে পারে, মাস্টার পিস অব আর্ট বললে ঠিক ঠিক মানেটা ওত্রায় না। অবুজে দা’র শব্দসমষ্টি আমি শুনেছি; এটা বোধ হয় morale-এর মতো ইংরেজিতে চালু ভেজাল ফরাসি মাল (আমরা যেরকম কলকাত্তাই উর্দুতে ‘একঠো’ দুঠো’র ভেজাল বরাব্বর ব্যবহার করে আসছি!)– অর্থ, যে কলাসৃষ্টি কোনও কাজে লাগে না, যেমন ‘পাপিয়ে মাশে’তে তৈরি কাশ্মিরি-ফুলদানি-পারা সৃষ্টিছাড়া বস্তু, যেটাতে ফুল রাখা যায় না বটে, কিন্তু দেখতে খাসা। গ্যোবলস্ সায়েবের বেতার বক্তৃতা বা সম্পাদকীয় প্রবন্ধ বিলকুল বেকার নয়– টায়-টায় কাজে লাগত। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে তিনি টলস্টয়কে নিশ্চয়ই পরম আপ্যায়িত করতে পারতেন; পার্থক্য মাত্র এইটুকু যে, টলস্টয় তাঁর কলা দ্বারা নির্মাণ করতেন স্বর্গরোহণের সোপান, য়পপ নির্মাণ করতেন রসাতলের খাড্ডায় সবচেয়ে নিপতিত হওয়ার তরে অত্যুত্তম পিচ্ছল সানুপ্রদেশ। আর ইহুদিকুলের কল্যাণার্থে গ্যাস-চেম্বার!