আমি শুধালুম, “নিরক্ষর জন গির্জায় ধর্মোপদেশ দেয় কী প্রকারে?”
বললেন, “আশ্চর্য! রাসপুতিন যে কী মাথার ঘাম পায় ফেলে কুল্লে আড়াই আউন্স বাইবেল গলাধঃকরণ করতে পেরেছিলেন সে না হয় পড়োনি, তাই জানো না। নিচ্চেভো– অর্থাৎ কুছ পরোয়া নেহি। সেই আড়াই আউন্স বাইবেল ডাইলুট করে তিনি মহারানি জারিনা মায় জার প্রাসাদ জয় করলেন। তাঁকেও নাম সই করতে হলে ঘেমে নেয়ে কাঁই হতে হত।
আর এরই উলটো দিক– অর্থাৎ ভালোর দিকের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ খুঁজতে হলে অন্তত তোমাকে তো আর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু অবধি মাকু মারতে হবে না। তোমার নবী পয়গম্বর তো ছিলেন সম্পূর্ণ নিরক্ষর! তা সে যাক্ গে।
সে রোববারে পাদি সায়েবের সারমন বা বক্ততার বিষয়বস্তু ছিল ইহুদিরা কী অন্যায়ভাবে প্রভু যিশুকে ক্রুশের উপর খুন করল। এ বিষয়ে বক্তৃতা শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব পাদ্রিই দেন। তফাৎ শুধু এইটুকু যে, শিক্ষিত পাদ্রি জানেন, প্রভু যিশু ক্রুশের উপর থেকে তার হত্যাকারীদের ক্ষমা করে গিয়েছিলেন। তাই তিনি বক্তৃতা দেবার সময় সতত সতর্ক থাকেন, অজ্ঞ খ্রিস্টানগণ যেন উত্তেজিত হয়ে ইহুদি নির্যাতন আরম্ভ না করে। কিন্তু ওই যে রুশ পাদ্রির কথা বলছিলুম, তিনি সেদিন উঠেপড়ে লেগে গিয়েছেন, কী প্রকারে মূঢ় জনতাকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তোলা যায়। অবশ্য তার জন্য অত্যধিক বাগ্মিতাশক্তির কোনও প্রয়োজন নেই কারণ রুশ দেশে আবহমান কাল থেকে ইহুদিবৈরিতা বংশানুক্রমে চলে আসছে। কাজেই সারমন শেষেই বিক্ষুব্ধ চাষিরা একজোট হয়ে ধাওয়া করল মাঠের অন্য প্রান্তের খাস ইহুদি গ্রামটার দিকে। দূর থেকে তাদের চিত্তার হুঙ্কার শুনে ইহুদিরা ব্যাপার কী জানবার জন্য গ্রাম থেকে বেরিয়ে এল। তাদের চিৎকারে তখন পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে ‘খুন করব, ব্যাটাদের খুন করে রক্ত দিয়ে রক্তের দাদ নেব! ’
সবাই একে অন্যকে চেনে। তাই ইহুদি গাঁওবুড়ারা করজোড়ে শুধালে, ‘আমরা কী অপরাধ করেছি যে আমাদের খুন করবে, এতকাল ধরে পাশাপাশি গ্রামে বাস করছি—’
উত্তেজিত জনতা বললে, ‘চালাকি রাখো। তোমরা আমাদের প্রভুকে খুন করেছ, তার দাদ আমরা নেবই নেব।’
যেন পরদিনের ঘটনা! লেভি গল্প বলা ক্ষান্ত দিলেন। কারণ হঠাৎ পিটির পিটি করে বৃষ্টি নামল। এই পোড়ার দেশে মনসুন নেই বলে বারো মাসের যে কোনও দিন আচমকা বৃষ্টি নামে। আমি বললাম, ‘চলুন, হার ডক্টর, ট্রাম শেড-এ আশ্রয় নিই।’
বললেন, “ছোঃ! কিসসু জানো না। ইহুদিরা ছাতা কেনে না কেন, তার খবর রাখো? খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, ইহুদিরা এমনই দুর্দান্ত চালাক যে, বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে জামাকাপড় বাঁচিয়ে দিব্য চলাফেরা করতে পারে। তার পর কী বলছিলুম? সেই রুশ ইহুদিদের কথা। তারা ছিল সত্যই চালাক! চট করে ভেবে নিয়ে দেখলে, ওই সব জড়ভরত কেরেস্তান রুশদের বোঝানো হবে অসম্ভব, ঘটনাটা ঘটেছে দু হাজার বছর পূর্বে, রুশ দেশে নয়– বহু দূর-দুরান্তের প্যালেস্টাইনে– যারা মেরেছিল, তারা সেই দেশ ছেড়ে কবে কোন আদ্যিযুগে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সর্বত্র, বিয়ে করেছে জাতেবেজাতে– এখন যাদের ঠ্যাঙাতে যাচ্ছ–”
আমি বললুম, “বুঝেছি। খেলেন দই রমাকান্ত, বিকারের বেলা গোবদ্দন!”
লেভি বললেন, “লাখ কথার এক কথা!”
অতএব ইহুদি ডাঙরিয়ারা হন্তদন্ত হয়ে বললে, ‘ইহুদিরা প্রভু যিশুকে না হক খুন করেছিল, এ তো অতিশয় সত্য কথা–বিশ্ব-সংসার জানে। কিন্তু ভাই, তোমরা করেছ ভুল। আমরা, এ গাঁয়ের লোক, ওঁকে মারিনি– তা কখনও পারি! মেরেছে–’ বলে আঙুল দিয়ে দেখালে পাশের গাঁ। বলল, ‘মেরেছে ওই ও–ই গাঁয়ের ইহুদি রাস্কেলরা। বুঝলে তো ভায়া?” বলে লেভি গম্ভীর হয়ে গেলেন।’
আমি একগাল হেসে বললাম, “যা শত্রু পরে পরে। কিন্তু গল্পটা তো সে রকম ঝাঁঝালো না –আপনার সেদিনকার রাব্বি, জানালার শার্সি আর আয়নাতে তফাৎ নিয়ে গল্পটার মতো?”
লেভি বললেন, “ক্যারেকটারিস্টিক গল্পের ফানকশন হচ্ছে কোনও বিশেষ জাত বা শ্রেণি বা যা-ই হোক না কেন, তার ক্যারেকটার, তার বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা। ভেড়ার বাচ্চা আর নেকড়ে বাঘের মতো তর্কাতর্কি নিয়ে যে গল্প ঈশপ লিখেছেন সেটাতে ঝাঁঝ কোথায়? কিন্তু গল্পটা সাতিশয় ক্যারেকটারিস্টিক– অর্থাৎ ভেড়া আর নেকড়ের ক্যারেকটার ওতে চমৎকার ফুটে উঠেছে– নইলে গল্পটা দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ল কী করে, আর এত যুগ ধরে বেঁচে আছেই-বা কী করে? আমি রুশ ইহুদিদের সম্বন্ধে যে গল্প বললুম– গল্প না হয়ে সত্য ঘটনাও হতে পারে সেটা কিন্তু সর্ব-ইহুদিদের সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। বিপদকালে তারা এক হতে তো জানেই না, বরঞ্চ নিজেকে বাঁচাবার জন্য জাতভাই অন্য ইহুদিকে বিসর্জন দিতেও তার বাধে না।”
আমি বললুম, “উঁহু।”
“মানে?”
আমি বললুম, “আমার দেশ বাংলার উত্তর প্রান্তে এক শ্রেণির ব্রাহ্মণ আছেন, তাঁদের সম্বন্ধে বলা হয়, স্বার্থ থাক আর নাই থাক তারা একে অন্যের সাহায্য কস্মিনকালেও করেন না। একটা নদী পেরুবার সময় নাকি পর পর পাঁচজন ব্রাহ্মণ একটা পাথরে ঠোক্কর খান, কিন্তু কেউই পরের জনকে হুঁশিয়ার করে দেবার প্রয়োজন বোধ করেননি। শেষটায় একজন যখন ‘বাপ রে’ বলে অন্যদের সাবধান করে দিলে, তখন তারা সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বললেন, ‘ব্যাটা নিশ্চয়ই আমাদের শ্রেণির ব্রাহ্মণ নয়।’ তখন ধরা পড়ল, সত্যি সে অন্য শ্রেণির ব্রাহ্মণবর্ণচোরা আঁবের মতো এদের সঙ্গে মিশে এদেরই একজন হতে চেয়েছিল। গল্পটা আপনারই সংজ্ঞা অনুযায়ী খুবই ক্যারেকটারিস্টিক বটে, কিন্তু আমার মনে এ বাবদ একটা ধোঁকা রয়ে গেছে।”