হুজুর আর কচ্ছের রান ধরে দিল্লি ফিরলেন না। স্থির হল, নৌকায় করে সিন্ধু উজিয়ে উজিয়ে তারই উপনদী দিয়ে লাহোর পৌঁছবেন। উত্তম ব্যবস্থা। ইতোমধ্যে রোজার মাস বা রমজান এল। হুজুর বললেন, ‘উপোস করব।’ আমীর-ওমরাহ বললেন, ‘হুজুর একে অসুস্থ, দুর্বল, তদুপরি ভ্রমণকালে উপবাস করা ইচ্ছাধীন– কুরান শরীফের আদেশ।’ হুজুর তেড়ে বললেন, ‘যে মুসাফিরিতে (ভ্রমণে) তকলিফ হয় আল্লাতালা সেইটের কথাই বলেছেন। আমরা তো যাচ্ছি আরামসে নৌকায় শুয়ে শুয়ে। আমি উপোস করবই।’ পুনরায় গোঁ। তর্ক করবে কে? মুহম্মদ তুগলুকের সঙ্গে শাস্ত্র নিয়ে তর্ক করবার মতো এলেম কারও পেটে ছিল না। (আরেক ধনুর্ধর পণ্ডিত ছিলেন ঔরঙ্গজেব)।
কয়েকদিন পরে ধরা পড়ল একটি চমৎকার মাছ। কিন্তু এ জাতের মাছ দিল্লিবাসীরা কখনও দেখেননি। তারা বললেন, ‘যে মাছ চিনিনে সেটা খাব না।’ হুজুর বললেন, ‘কুরান, হদীস কোনও শাস্ত্রে ও-জাতীয় মাছের বর্ণনা দিয়ে খেতে যখন বারণ করা হয়নি তখন আমি ইটি খাবই।’ আবার গোঁ।
খেলেন! দারুণ তেলওলা মাছ ছিল। হুজুরের শরীরও ছিল রোগা, রানের ধকলে দুর্বল। পেট ছাড়ল। কিছুতেই বন্ধ হয় না। বোধ হয় তৃতীয় দিনে হুজুর ইন্তিকাল করলেন, অর্থাৎ পটল তুললেন।
ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন লিখলেন, এই প্রকারে হুজুর তার অবাধ্য প্রজাকুলের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে রক্ষা পেলেন; প্রজাকুলও হুজুরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বাঁচল!
***
আমি বঙ্গসন্তান। মাছের নামে অজ্ঞান। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, বাদশা-সালাম কী মাছ খেয়ে শহিদ হলেন!
বরনী, মিরাৎ দিয়েছেন মুসলিম চান্দ্র মাসের হিসাবে তুগলুকের মৃত্যুদিবস। তার থেকে কোন ঋতুতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ধরা যায় না। বিস্তর ক্যালেন্ডার ঘেঁটে যোগবিয়োগ করে বের করলুম ঋতুটি।
আমার এক সিন্ধি দোস্ত আছেন; ইতিহাসে তাঁর বড়ই শখ। তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁকে শুধালুম।
তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, পাল্লা মাছ।
***
গঙ্গা উজিয়ে যেটা আসে বা আসত, সেটা ইলিশ– হিলসা। নর্মদা উজিয়ে ওই মাছটা যখন আসে তখন ব্রৌচের (broach ভৃগুকচ্ছ) লোক এটাকে বলে মদার, পার্সিরা বলে বিম্। সিন্ধু উজলে এই মাছকেই বলে পাল্লা।
অনেকেই অনেক কিছু চড়ে স্বর্গে যান; ঐরাবত, পুষ্পকরথ, কত কী? শাহ-ইন-শাহ বাদশা-সালামৎ মুহম্মদ তুগলুক শাহ ইলিশ চড়ে স্বর্গে গেলেন। স্বর্গে যাবেন না তো কোথায় যাবেন? ইলিশ খেয়ে যে প্রাণ দেয় সে তো শহিদ–মার্টার!
———–
১. সংস্কৃত বইখানার নাম আমার মনে পড়ছে না, বোধ হয় ‘প্রবন্ধ চিন্তামণি’।
২. মাহমুদ ও মুহম্মদ দুই ভিন্ন নাম। যে রকম হাসন, হুসেন ও হাস্সান (সুহরাওয়ার্দী) তিনটি ভিন্ন ভিন্ন নাম।
৩. ফ্রান্স জয়ের পর হিটলার ইংলন্ড আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এর নাম অপারেশন ‘সি লায়েন’ (সমুদ্ৰসিংহ, ‘জে ল্যোয়ে’) কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা বাতিল করে দেওয়া হয়। তার বহুবিধ কারণ নিয়ে নানা গুণী নানা আলোচনা করেছেন। অন্যতম কারণ বলা হয়, হিটলার ল্যান্ডল দেশের লোক ছিলেন বলে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে আভুআ করতেন। গ্রিস জয় করার পর তিনি তাই মাদ্বীপ আক্রমণ ক্রমাগত পিছিয়ে দিয়ে ভুল করেন। ফলে রমেলও পুরো সাহায্য পেলেন না। এ-দেশের মোগল-পাঠান রাজাদের বেলাও তাই। নৌ-বাহিনীর সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল না বলে তারা ইংরেজকে অবহেলা করেন। ফলে ভারতবর্ষ সমুদ্রপথে বিজিত হয়।
কবিগুরু ও নন্দলাল
রসাচার্য নন্দলাল বসুর জীবন এমনই বহু বিচিত্র ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, তিনি এতই নব নব অভিযানে বেরিয়েছেন যে তার পরিপূর্ণ পরিচয় দেওয়া অতি কঠিন, শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। তদুপরি তিনি যে পরিচয় দিতে দিতে যাবেন তাঁর সর্বরসসৃষ্টিতে অপর্যাপ্ত কৌতূহল ও সে রস আস্বাদ করার মতো অপ্রচুর স্পর্শকাতরতা থাকার একান্ত, অত্যন্ত প্রয়োজন। মানবসমাজে নন্দলাল ছিলেন স্বল্পভাষী তথা আত্মগোপনপ্রয়াসী– তার নীরবতার বর্ম ভেদ করে তাঁকে সর্বজন সম্মুখে প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা, সে প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় শৈলী ও ভাষার ওপর অধিকার এ-যুগে অত্যল্প আলঙ্কারিকেরই আছে। আমাদের নেই; আমরা সে দুঃসাহস করিনে।
আমরা তাঁকে চিনেছি, গুরুরূপে, রসসৃষ্টির জগতে বহু বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সতত রত স্রষ্টারূপে এবং কবিগুরুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিষ্য ও কর্মীরূপে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বভারতীতে প্রধানত পণ্ডিতদেরই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন– আচার্য বিধুশেখর, ক্ষিতিমোহন, অ্যানড্রুজ, কলিন্স, শ্যামের রাজগুরু, উইনটারনিস, লেভি, গোস্বামী নিত্যানন্দ, জগদানন্দ ইত্যাদিকে। এঁদের কেউই রসস্রষ্টা ছিলেন না, এমনকি যে দিনেন্দ্রনাথ সঙ্গীতে, কাব্যে অসাধারণ সৃজনশক্তি ধরতেন তিনি পর্যন্ত তাঁর নিজস্ব সৃজনশক্তির দ্বার রুদ্ধ করে সব ক্ষমতা নিয়োজিত করেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের রক্ষণাবেক্ষণ কর্মে। একমাত্র নন্দলালই এই পরিপূর্ণ পাণ্ডিত্যময় বাতাবরণের মাঝখানে অপ্রমত্ত চিত্তের আপন সৃষ্টিকর্মে নিয়োজিত ছিলেন।
রবি-নন্দ সম্মেলন যে মণিকাঞ্চন সংযোগ। এ তত্ত্ব অনস্বীকার্য যে রস কী, চিত্রে প্রাচীগাত্রে তথা দৃশ্যমান কলার অন্যান্য মাধ্যমে তাকে কী প্রকারে মৃন্ময় করা যায় এ-সম্বন্ধে নন্দলাল তাঁর গুরু অবনীন্দ্রনাথের কাছে উৎকৃষ্টতম শিক্ষাদীক্ষা লাভ করেন। তাই নন্দলাল শান্তিনিকেতনে আগমন করার পূর্বেই বঙ্গদেশ তথা ভারতে সুপরিচিত ছিলেন ও পশ্চিমের বহু সদাজাগ্রত রসিকজনের মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু কবিগুরুর নিত্যালাপী সখা, সহকর্মী ও শিষ্যরূপে শান্তিনিকেতনে আসন গ্রহণ করার পর তাঁর চিন্ময়ভুবন ধীরে ধীরে সমৃদ্ধতর হতে লাগল ও রবীন্দ্রাহত পণ্ডিতমণ্ডলীর সংস্পর্শে এসে তিনি এমন সব বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হলেন যেগুলো সচরাচর আর্টিস্টকে আকৃষ্ট করে না। একটি মাত্র উদাহরণ নিবেদন করি; দ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা সম্বন্ধে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন, বিশ্বভারতীর সাহিত্যসভায় তথা অন্যান্য জ্ঞানচক্রে শতাধিকবার আলোচনা করেছেন, তর্কবিতর্ক উদ্বুদ্ধ করেছেন। ১৯২১ থেকে পূর্ণ কুড়িটি বৎসর এসব সম্মেলনে নন্দলাল উপস্থিত থাকতেন, কিন্তু আমি তাঁকে কখনও (১৯২১-২৬) এ সবেতে অংশগ্রহণ করতে দেখিনি।