এরপর পাগলা রাজা মুহম্মদ তুগলুক এই কচ্ছের রানের কাছে মার খান।
ফার্সি ঐতিহাসিক লিখেছেন ‘তগী’, ফার্সিতে ‘ঠ’ ধ্বনি নেই– শব্দটা বোধ হয় তাই ‘ঠগী’। সেই তগী মধ্য-পশ্চিম ভারতে লুটতরাজ আরম্ভ করে। বাদশাহি ফৌজ বারবার তার বিরুদ্ধে অভিযানে বেরিয়ে বারবার বিফলমনোরথ হয়ে দিল্লি ফিরে আসেন। মুহম্মদ রেগে টঙ। বললেন, ‘আমি স্বয়ং যাব।’
একটা সামান্য ডাকুর বিরুদ্ধে স্বয়ং হুজুর যাবেন!
না, যাবই।
হুজুর স্বয়ং আসছেন জেনে তগী আহমদাবাদ পালাল। হুজুর বললেন, চল আহমদাবাদ। পারিষদরা মহা অসন্তুষ্ট। সেই সুদূর আহমদাবাদ– দিল্লি থেকে কতদিনের রাস্তা! হুজুর কিন্তু গোঁ ছাড়লেন না। আহমদাবাদে পৌঁছলে পর জানা গেল, তগী পালিয়েছে কাঠিয়াওয়াড়ে। হুজুর বললেন, ‘চল কাঠিয়াওয়াড়’। কিন্তু তখন বর্ষা নেমে গিয়েছে। এবং শ্রান্তি-ক্লান্তিতে হুজুরের হল জ্বর। কী জ্বর, আমি বর্ণনা থেকে বুঝতে পারিনি। ম্যালেরিয়া খুব সম্ভব নয়। ম্যালেরিয়া বোধ হয় এ-দেশে পরে এসেছে। তা সে যাই হোক, হুজুর তামাম বর্ষাকালটা আহমদাবাদে জ্বরে ধুকে। ধুকে রোগা দুবলা হয়ে গেলেন। কিন্তু বর্ষা-শেষেও গো ছাড়লেন না– তাঁকে যে পাগলা রাজা বলা হত সেটা প্রধানত তার গোর জন্যই চললেন কাঠিয়াওয়াড়। তগী পালাল কচ্ছে। হুজুর গেলেন কচ্ছ। তগী পালালো কচ্ছের রানের উপর দিয়ে সিন্ধুদেশে। সে ডাকাত রানের কোথায় কী, জানে সেখানে একাধিক বার আশ্রয় নিয়েছে। তদুপরি সে তো আর বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাচ্ছে না; তার দানাপানির আর কতটুকুই-বা দরকার।
এবার পারিষদরা তারস্বরে প্রতিবাদ জানালেন। গজনীর মাহমুদ বাদশা যে রানে কী রকম নাজেহাল হয়েছিলেন সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। সঙ্গে ছিলেন রাজসভার সরকারি ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনী (ইনি ‘দিল্লি দূর অস্ত’-এর সাধু নিজামুদ্দীন আউলিয়া ও কবি আমির খুসরুর নিত্যালাপী বন্ধু ছিলেন); তিনিও নিশ্চয়ই প্রাচীন ইতিহাস কীর্তন করেছিলেন। তদুপরি তুগলুক নিজে ছিলেন সুপণ্ডিত। ইতিহাস ভূগোল উত্তমরূপেই জানতেন। কিন্তু হিটলার যদিও অত্যুত্তমরূপেই নেপোলিয়নের রুশ-অভিযান ও তার মারাত্মক ফলাফল সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং যদিও তাঁর সেনাপতিরা তাকে বারবার রুশ অভিযান থেকে নিরস্ত থাকতে উপদেশ দেন, তবুও তিনি সেই কর্মটি করেছিলেন। এখানেও তাই হল। তুগলুক নিরস্ত হলেন না।
কচ্ছের রানে বাদশা মুহম্মদ তুগলকের কী নিদারুণ দুরবস্থা হয়েছিল, তার বর্ণনা একাধিক ঐতিহাসিক দিয়েছেন। আজ আমার আর ঠিক মনে নেই, তার সৈন্য এবং ঘোড়া খচ্চরের ক-আনা বেঁচেছিল, আর ক-আনা মরেছিল।
এ সময়ের একটি ঘটনা ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন। রোগে জীর্ণ দুর্বল দেহ নিয়ে ঘোড়ার উপরে বসে মুহম্মদ তুগলুক ধুঁকতে ধুঁকতে এগোচ্ছেন। এমন সময় তিনি ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনীকে ডেকে পাঠালেন– কাউকে ডেকে না পাঠালে হুজুরের কাছে যাবার কারও অনুমতি ছিল না। বরনী কাছে এলে তুগলুক তাকে বললেন, ‘আচ্ছা বরনী, তুমি তো জানো আমি আমার প্রজাদের কতখানি ভালোবাসি। আমি যে-সব ফরমান-হুকুম জারি করেছি সে তো একমাত্র তাদেরই মঙ্গলের জন্য। তবে তারা একগুঁয়েমি করে আমার আদেশ অমান্য করে কেন?’ তার পর শুধোলেন, ‘আচ্ছা বরনী, তোমার কি মনে হয়, আমি বড় কড়া হাতে শাসন করেছি, প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত শাস্তি দিয়েছি? তবে কি এখন আমার উচিত আরও ক্ষমা-দয়ার সঙ্গে শাসন করা?’
বরনী লিখেছেন, ‘এই শেষকালে যদি হুজুর হঠাৎ তার নীতি বদলান তবে হয়তো আরও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে ভেবে আমি নীরব থাকাটাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করলুম।’
এদিকে দিল্লিতে বসে তুগলুকের প্রধানমন্ত্রী পড়েছেন মহাবিপদে। হুজুরের কোনও খবর নেই। রান থেকে তো দূত পাঠানো যায় না, যে দিল্লি আসবে। দূত আর তার পার্টি পথে জল পাবে কোথায়? পিছনপানে অবশ্য মৃত্যু, সম্মুখ দিকে তবু বাঁচবার আশা আছে। কাজেই দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে, হুজুরের কোনও খবর নেই। প্রধানমন্ত্রীর ভয়, খবরটা রটে গেলে তুগলুকের কোনও আত্মীয় বা অন্য কোনও দুঃসাহসী রাজা মরে গেছেন, এই সংবাদ রটিয়ে কিছু সৈন্যসামন্ত যোগাড় করে দিল্লির তখতে না বসে যায়। রাজকোষ তখন তার হাতে এসে যাবে এবং ফলে সে আরও সৈন্য সংগ্রহ করে নেবে। হুজুর যখন ফিরে আসবেন তাঁর সঙ্গের সৈন্যদল পরিশ্রান্ত ক্লান্ত। হুজুর তখন লড়াই দেবেন কী করে? প্রধানমন্ত্রী তখন শুরু করলেন স্রেফ ধাপ্পা। হুজুর রোজ সকালে যে ঝরোকায় দাঁড়িয়ে দেখা দিতেন সেখানে প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে বলতেন, বড় আনন্দের বিষয়, আজও হুজুরের চিঠি পেয়েছি। হুজুর বহাল তবিয়তে আছেন। শিগগিরই রাজধানীতে ফিরে আসছেন। তার পর আঙ্গরখার (অঙ্গরক্ষা) ভেতরের জেল থেকে বোগাস চিঠি বের করে, গভীর সম্মানের সঙ্গে সেটি চুম্বন করে উচ্চকণ্ঠে সেটি পড়ে শোনাতেন– আগাগোড়া নিছক গুল! তার পর আরও সসম্মানে চিঠিখানা চুম্বন করে পকেটে রেখে দিতেন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ধাপ্পা, গুল, থিয়েডারি সব কুছকা এলেম পেটে ধরতে হয়।
ওদিকে অশেষ ক্লেশ ভুঞ্জে হুজুর সিন্ধুনদের তীরে এসে পৌঁছলেন। তগীর কী হল আমার মনে নেই। পৌঁছেই হুজুর দিল্লি-পানে ঘোড়সওয়ার রওনা করলেন। তারা দিল্লি পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রীর ধড়ে জান এল।