শ্ৰেষ্ঠী তৎক্ষণাৎ স্বয়ং সেই মহল্লায় গিয়ে সর্বজন সমক্ষে তদন্ত করলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে সোজা সুবেদারের বাড়ি গেলেন। সুবেদার তখন ইয়ার-বক্স(২) সহ গমগমন সেলেব্রেট করছিলেন। কিন্তু পূর্বপ্রতিজ্ঞা অনুযায়ী বেরিয়ে এসে সবকিছু শুনে সেপাই পাঠালেন মুদিদের ধরে আনার জন্য। সাক্ষী-সাবুদও যেন সঙ্গে সঙ্গে আনা হয়।
তদ্দণ্ডেই সুবেদারের সামনে সাক্ষীসাবুদ তদন্ত-তফতিশ হয়ে গেল। প্রমাণ হয়ে গেল সত্যই তারা বেশি দাম নিয়েছে।
সুবেদার হুকুম দিলেন, বড্ড বেশি ‘খেতে চেয়েছিল’ বলে মুদি দুটোর পেট কেটে ফেলা হোক। তাই করা হয়। নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেল।
সবাই যেন এই দৃষ্টান্ত থেকে সজাগ সতর্ক হুশিয়ার খবরদার হয় সেই উদ্দেশ্যে সুবেদার হুকুম দিলেন, শহরের সবচেয়ে উঁচু দুটো উটের পিঠে তাদের লাশ বেঁধে দিয়ে নগর-পরিক্রমা করা হোক।
সমস্ত রাত ধরে তাই করা হল।
এরপর ঐতিহাসিক যেন নিতান্ত সাদামাটা ডালভাতের কথা বলছেন, ওইভাবে মন্তব্য করছেন, ‘অতঃপর আর কেউ অন্যায্য মুনাফা করার চেষ্টা করেনি।’
(আমার হাতে যে পাণ্ডুলিপিখানা পৌচেছিল তাতে দেখি এ জায়গাটায় এ যুগের কোনও এক সুরসিক পাঠক লিখেছেন, ‘we are not surprised’)।
আমি আর কী মন্তব্য করব? রেশনিং, ফেয়ার-প্রাইস, নো চানস্ ফর হোডিং, তনুহূর্তে তদন্ত, তদ্দণ্ডে দণ্ড, জনগণকে হুঁশিয়ারি দেওয়া এসবই হয়ে গেল চোখের সামনে। অবশ্য আমি নিরীহ প্রাণী, পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করার আদেশ শুনলে আমার গা শিউরে ওঠে। তবে যারা দিনের পর দিন রেশন-শপের লাইনে দাঁড়িয়েছেন, চোখের সামনে কালো-বাজার এবং যাবতীয় অনাচার দেখেছেন, পুত্রকন্যাকে কচুঘেঁচু খাওয়াতে বাধ্য হয়েছেন এবং বিত্তশালীরা কী কৌশলে তোফা খানাপিনা করছেন সবিশেষ অবগত আছেন, তারা হয়তো উল্লাস বোধ করবেন। আমি আপত্তি করব না–কারণ পূর্বেই বলেছি, আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।
———
১. বাংলায় মোকদ্দমা বলতে মামলা, ‘কে’ বোঝায়। আরবিতে অর্থ অবতরণিকা। ‘কদম’ মানে পদক্ষেপ (‘কদম্ কদম্ বঢ়হায়ে যা’); মোকদ্দমা প্রথম পদক্ষেপ, অবতরণিকা; আবার প্রথম পদক্ষেপ বলে তার অর্থ মামলা রুজু করার প্রথম কদম– একদিক দিয়ে দেখতে গেলে লাতিনে যাকে বলে প্রিমা ফাশি কেস– কিন্তু বাংলায় এখন মোকদ্দমা বলতে পুরো কেসটাই বোঝায়।
২. বকসি বা বখ্শি (বখশিশ কথা একই ধাতু থেকে) অর্থ একাউন্টেন্ট জেনারেল, অডিটার জেনারেল ও ফৌজের চিফ পে-মাস্টার– এ তিনের সমন্বয়। কায়স্থরা প্রধানত এই দায়িত্বপূর্ণ চাকরি করতেন। প্রধান বা মীর বখ্শি নিয়োগ করতেন স্বয়ং দিল্লির বাদশা সালামৎ। আর সরাসরি নিয়োগ হতেন কাজী উল কুজ্জাৎ অর্থাৎ চিফ জাস্টিস, সদ-উস-সদর (সেই অঞ্চলে বাদশা সালামতের আপন-জমিজমা তদারকের জন্য, তথা কেউ নিঃসন্তান মারা গেলে তার সম্পত্তি অধিকার করতে)। সরকার= চিফ-সেক্রেটারি, কানুনগো= লিগেল রিমেমব্রেনসার পরে নিযুক্ত হতেন। বখশির কাছ থেকে টাকা পেয়ে ব্যবসায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে সামনের বাজারে হুণ্ডি কাটতো বলে সে বাজারকে ‘বখশি বাজার’ বলা হত। বখ্শি সরকার ইত্যাদি বড় বড় এডমিনিট্রেটিভ চাকরি প্রধানত কায়স্থরাই করতেন। ইংরেজ মোটামুটি এই পদ্ধতিই চালু রাখে।
কচ্ছের রান
ঐতিহাসিক উপন্যাস নিয়ে কথা হচ্ছিল। আর বলছিলুম, এতে করে আমার বড্ডই উপকার হয়েছে। ইতিহাস নিজেকে মাঝে মাঝে পুনরাবৃত্তি করে। চোখের সামনে যখন তাই কোনও কিছু একটা ঘটে, তখন স্মৃতিপথে আসে প্রাচীন দিনের ওইরকম কোনও একটি ঘটনা। প্রথম যৌবনে কোনও এক প্রাচীন ইতিহাসে পড়েছি। সে বই এখন আর পাব না। একে ফার্সিতে লেখা, তদুপরি, বইখানা হয়তো সে ভাষার পুস্তকের মাঝেও দুপ স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করলে হয়তো ঐতিহাসিকের প্রতি অবিচার করা হবে।
ইতোমধ্যে ঐতিহাসিক উপন্যাস এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কেউ যদি ত্রুটিবিচ্যুতি দেখিয়ে দেয় তবে নিঃশরমে বলব, আমি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছি।
গুজরাতের ইতিহাস ‘মিরৎ-ই-আহমদী’র কথা হচ্ছিল। বইখানা লেখা হয়, নাদির শাহ যখন ভারতবর্ষ লণ্ডভণ্ড করে যান মোটামুটি সেই সময়। এ পুস্তক গ্রন্থকার আরম্ভ করেছেন জৈন সাধু মেরুতুঙ্গাচার্যের সংস্কৃতে লেখা গুজরাতের প্রাক্-মুসলিম যুগের ইতিহাসের(১) সারাংশ নিয়ে, তার পর আছে গজনীর সুলতান মাহমুদ(২) কর্তৃক সোমনাথ আক্রমণ।
সুলতান মাহমুদ এমনিতে বলতেন, তিনি কাফিরের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন, কিন্তু সিন্ধুদেশ সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে মুসলমান অধিকারে। সে দেশ কী করে আক্রমণ করা যায়? সুলতান বললেন, ‘সিন্ধুদেশের মুসলমানরা যদিও কাফির নয়, তবু কাফির-তুল্য তারা হেরেটিক; অতএব আক্রমণ করা যায়।’
তা সে যাই হোক, তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল কাঠিওয়াড়ের সোমনাথ মন্দিরের বিরাট ধনভাণ্ডার লুণ্ঠন করা। সেটা সিন্ধুদেশ জয় না করে হয় না।
কিন্তু তার পরই আসে কচ্ছের রান। সেটা অতিক্রম করা সিন্ধু-বিজয়ের চেয়েও কঠিন। মাহমুদের সাঙ্গোপাঙ্গ তাঁকে নিরস্ত করার চেষ্টা দিয়ে নিষ্ফল হলেন।
কচ্ছের রান অতিক্রম করতে গিয়ে মাহমুদের ফৌজের অসংখ্য সৈন্য ও অশ্ব তৃষ্ণায় প্রাণ হারাল। চোরাবালিতেও অনেক। তখনকার দিনের ঐতিহাসিকরা তার জন্য গাইডকে জিম্মেদার করেছেন; সে নাকি বিশ্বাসঘাতকতা করে। কিন্তু মাহমুদকে বাধ্য হয়ে ওই পথেই ফিরে যেতে হয়েছিল। মাহমুদ ছিলেন ল্যান্ডল (অর্থাৎ যে দেশের সঙ্গে সমুদ্রের কোনও সংস্পর্শ নেই) দেশের লোক–হিটলারের মতো।(৩) তাই দ্বারকা থেকে নৌবহর যোগাড় করে ‘ঠাট্টা’ (করাচির কাছে প্রাচীন বন্দর) যাবার সাহস করেননি।