ঐতিহাসিক উপন্যাসের নাকি এখন জোর কাটতি। আবার একাধিক জন বলছেন, এগুলো রাবিশ। পাঁচজনের মতো আমি আবার হতভম্ব।
কিন্তু এতে করে আমার ব্যক্তিগত উপকার হয়েছে। বছর পঁচিশেক পূর্বে আমাকে বিশেষ কারণে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ও মারাঠা শক্তির অভ্যুদয় নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। সে যুগের প্রায় সব কেতাবপত্রই ফার্সিতে। বহু কষ্টে তখন অনেক পুস্তক যোগাড় করেছিলুম। তার কিছু কিছু এখনও মনে আছে। মাঝে মাঝে আজকের দিনের কোনও ঘটনা হুবহু ‘শেষ মোগলদের’ সঙ্গে মিলে যায় এবং লোভ হয় সেদিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। কিন্তু সে সব কেতাবপত্র এখন পাই কোথায়? স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করলে হয়তো ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে।
কিন্তু ওই ঐতিহাসিক উপন্যাসই এক্ষণে আমার পরিত্রাণ এনে দিয়েছে। ধরে নিন, আমি ঐতিহাসিক উপন্যাসই লিখছি।
.
মারাঠারা যখন গুজরাত সুবা (বা সুবে অর্থাৎ প্রদেশ, প্রভিন্স) দখল করে তার রাজধানী আহমদাবাদে ঢুকল তখন সেখানকার দেওয়ান (প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী) মুহাফিজখানার (আর্কাইভস-এর) তাবৎ কাগজপত্র বাড়ি নিয়ে গিয়ে গুজরাত-কাঠিয়াওয়াড়ের একখানা প্রামাণিক ইতিহাস লেখেন। বইখানি তিনি দিল্লির বাদশা-সালামৎ মুহম্মদ শাহ বাদশাহ রঙ্গিলাকে ডেডিকেট করেন। ইতিহাসের নাম ‘মিরাৎ-ই-আহমদী’। পুস্তকের মোকদ্দমায়(১) তিনি বাদশা সালামৎকে উদ্দেশ করে বলেন, যে রাজনীতি অনুসরণ করার ফলে দিল্লির বাদশারা গুজরাতের মতো মাথার-মণি প্রদেশ হারালেন সে নীতি যদি না বদলানো হয় তবে তাবৎ হিন্দুস্তানই যাবে। সেই নীতির প্রাথমিক স্বর্ণযুগ, ক্রমবিকাশ ও অধঃপতন তিনি সেই ইতিহাসে ধারাবাহিক লিপিবদ্ধ করেছেন।
সেই ইতিহাস থেকে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে লিখছি– তাই আবার বলছি ভুলচুক হলে ধরে নেবেন, এটি ঐতিহাসিক উপন্যাস।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে একবার পর পর কয়েক বৎসর ধরে গুজরাতে বৃষ্টি না হওয়ার ফলে ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দলে দলে লোক আহমদাবাদ পানে ধাওয়া করে; সেখানে যদি দু মুঠো অন্ন জোটে। অগণিত পিতামাতা তাদের পুত্র-কন্যাকে দাস-দাসীরূপে বিক্রয় করে দেয়। গুজরাতি মেয়েরা যে টাকা-মোহর ফুটো করে অলঙ্কার হিসেবে পরে সেগুলো পর্যন্ত বিক্রয় করে দেয়। বিস্তর লোক উপবাসে মরল।
গুজরাত সুবার সুবেদার (গভর্নর কিন্তু বর্তমান গভর্নরের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা ধরতেন এবং দেওয়ানের সঙ্গে একজোটে প্রদেশ চালাতেন) তখন আহমদাবাদের সবচেয়ে ধনী শ্রেষ্ঠীকে পরামর্শের আমন্ত্রণ জানালেন। এইসব শ্ৰেষ্ঠীরা প্রধানত জৈন, এবং স্মরণাতীত কাল থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করে করে বহু অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন (বর্তমান দিনের শ্রেষ্ঠী কস্তুরভাই লালভাই, হটিসিং এই গোষ্ঠীরই লোক)।
সুবেদার সেই শ্ৰেষ্ঠীকে শুধালেন, দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্য কিছু করা যায় কি না। শ্ৰেষ্ঠী বললেন, মালওয়া অঞ্চলে এবারে প্রচুর ফসল ফলেছে, সেখানে গম-চাল পাওয়া যাবে। তবে দুই প্রদেশের মাঝখানে দারুণ দুর্ভিক্ষ। মালবাহী গাড়ি লুট হবে। অতএব তিনি দুই শর্তে দুর্ভিক্ষ-মোচনের চেষ্টা করতে পারেন : ১. সুবেদার নিরাপদে মাল আনানোর জন্য সঙ্গে গার্ডরূপে ফৌজ পাঠাবেন, ২. মাল এসে পৌঁছলে সুবেদার-শ্ৰেষ্ঠীতে মিলে যে দাম বেঁধে দেবেন মুদিরা যদি তার বেশি দাম নেয় তবে তদ্দণ্ডেই তাদের কঠোর সাজা দেবার জিম্মাদারি সুবেদার নেবেন। সুবেদার সানন্দে সম্মতি দিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য শ্রেষ্ঠী সুবেদারের কাছে থেকে অর্থ-সাহায্য চাননি।
বাড়িতে এসে শ্রেষ্ঠী বংশানুক্রমে সঞ্চিত অর্থ, অলঙ্কার-জওহরা বের করলেন, স্ত্রী-কন্যাকে তাদের অলঙ্কার পর্যন্ত খুলে দিতে বললেন।
সেই সমস্ত ঐশ্বর্যভাণ্ডার নিয়ে শ্রেষ্ঠীর কর্মচারীরা সুবেদারের ফৌজসহ মালওয়া পানে রওনা দিলেন। কিছুদিন পরেই মুখে মুখে আহমদাবাদে রটে গেল, মাল পৌঁছল বলে। পথে লুটতরাজ হয়নি।
সেইসব গম ধান ও অন্যান্য শস্য যখন আহমদাবাদে পৌঁছল শ্ৰেষ্ঠী তার একাধিক হাভেলি– বিরাট চক-মেলানো বাড়ি, একসঙ্গে গোষ্ঠীর বহু পরিবার একই বাড়িতে বসবাস করতে পারে–খুলে দিয়ে আঙ্গিনার উপর সেসব রাখলেন। তার পর সুবেদারের সঙ্গে হিসাব করলেন, কী দরে কেনা হয়েছে, রাহ-খর্চা (ট্রান্সপোর্ট) কত পড়েছে এবং তা হলে এখন কী দর বেঁধে দেওয়া যায়? সুবেদার বললেন, ‘আর আপনার মুনাফা?’ শ্ৰেষ্ঠী বললেন, ‘যুগ যুগ ধরে মুনাফা করেছি ব্যবসা বাণিজ্যে! এ ব্যবসাতে করব না। যা খর্চা পড়েছে সেই দর বেঁধে দিন। মুদির সামান্য লাভ থাকবে।’ দাম বেঁধে দেওয়া হল।
এবারে শুনুন, সবচেয়ে তাজ্জবকী বাৎ! শ্রেষ্ঠী শহরের তাবৎ মুদিদের ডেকে পাঠালেন এবং কোন মুদি কটা পরিবারের গম যোগায় তার শুমারি (গণনা) নিলেন। সেই অনুযায়ী তাদের শস্য দেওয়া হল। সোজা বাংলায় আজকের দিনে একেই বলে রেশনিং। এবং তার সঙ্গে গোড়াতেই ব্যবস্থা, যাতে হোর্ডিং না হতে পারে। এবং ফেয়ার প্রাইস।
আহমদাবাদের চতুর্দিকে আনন্দোচ্ছ্বাস। ইতোমধ্যে শ্রেষ্ঠীর চর এসে জানালেন অমুক মহল্লার দু জন মুদি ন্যায্যমূল্য থেকে এক না দুপয়সা বেশি নিয়েছে।