ঠিক এই জিনিসটেই আমরা অন্যান্য সাহিত্যিকের কাছে প্রত্যাশা করি। কারণ সাহিত্যিকের সঙ্গে ভাষার যে-পরিচয় হয় সেটা আদৌ শব্দতাত্ত্বিক বা ভাষাতাত্ত্বিকের মতো নয়। সে-ভাষা ব্যবহার করে নতুন নতুন সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে। তাই তার ভাষা সদা পরিবর্তনশীল। অত্যুত্তম গ্রন্থ লিখে ভাষাবাবদে আপামর জনসাধারণ তথা বৈয়াকরণিকের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেলেও লেখক তার পরবর্তী পুস্তকে সেই অনুমোদিত ভাষার পুনরাবৃত্তি করতে চায় না, রবীন্দ্রনাথের তুলনায়, আপনার মালের রিসিভার অব স্টোলেন প্রপার্টি হতে চায় না। তাই তাকে প্রতিদিন নিত্য নবীন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং সেখানে সে কোনও বৈয়াকরণিক, কোনও শব্দতাত্ত্বিকের সাহায্য পায় না। তাই, প্রাচীন লেখক যখন নতুন শব্দভাণ্ডার বচনভঙ্গি নিয়ে পুনরায় একখানা সার্থক গ্রন্থ লেখেন, তখন সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও শ্রীবৃদ্ধি হয়। এ কর্ম শব্দতাত্ত্বিক করতে পারেন না– অবশ্য তিনি যদি সাহিত্যিকও হন ও তার তত্ত্বগ্রন্থখানি সাহিত্যের পর্যায়ে তুলতে পারেন তবে অন্য কথা।
তাই ভাষার নব নব রূপ দেখাবার জন্য সাহিত্যিককেও এমেচারি শব্দতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হয়।
এবং শুধু সাহিত্যিকই না, যে-ব্যক্তিই জ্ঞান-বিজ্ঞান বা অন্য যে-কোনও চিন্ময় বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন, আলোচনা করেন, তাঁকেই কিছু-না-কিছু শব্দতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হয়। এই তত্ত্বটি হঠাৎ আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠল, মুসলমানদের সন্ত ইমাম আবু হানিফার বিরাট ন’ভল্যুমি গ্রন্থের একটি জায়গা পড়ে।
ইমাম আবু হানিফা শিষ্যসমাবৃত হয়ে প্রতি প্রাতে বসতেন মুসলিমধর্ম আলোচনায়। তার রায় লিখে রাখা হত তো বটেই, তাঁর প্রধান শিষ্যদের কেউ ভিন্ন রায় (মিনিট অব ডিসেন্ট) প্রকাশ করলে সেটিও সযত্নে পাশাপাশি লিখে রাখা হত।
একদা প্রশ্ন উঠল, ‘নগরে জুমার নমাজ অবশ্য পালনীয়; কিন্তু গ্রামে জুমার নমাজ হয় না’– এ-আদেশ শিরোধার্য করব কি না? ইমাম সাহেব, বললেন, ‘শিরোধার্য করা,–করার পূর্বে প্রথম দেখতে হবে “নগর” বলে কাকে, আর “গ্রাম” বলে কাকে?’ জনৈক শিষ্য বললেন, ‘অভিধান দেখলেই হয়।’ এবারে ইমাম যা বললেন, সেটি মোক্ষম তত্ত্বকথা– সর্বভাষাতে সর্বকালে প্রযোজ্য। তিনি বললেন, ‘কোষকার দেবে সাধারণ প্রচলিত অর্থ। পক্ষান্তরে আমরা ধর্মশাস্ত্রের অধ্যয়ন করে জনসাধারণের জন্য অনুশাসন প্রচার করি (অর্থাৎ আমরা theologians); থিয়োলজিয়ানের দৃষ্টিবিন্দু থেকে কোটা শহর– যেখানে জুম্মার নমাজ সিদ্ধ– এবং কোনটা গ্রাম যেখানে জুমার নমাজ অসিদ্ধ– তার শেষ বিচার তো আমাদের হাতে।’
অত্যন্ত খাঁটি কথা। যেমন ধরুন গরুর বাথান, যেখানে রাখালরা শীতকালে থাকে। সেটাকে হয়তো গ্রামের পর্যায়েও ফেলা যাবে না। কিংবা উত্তম মরূদ্যান পেয়ে হাজার লোকের কাফেলা (ক্যারাভান) কয়েক দিন বিশ্রাম করল। সেখানে জুম্মার নামাজ সিদ্ধ না অসিদ্ধ?
ইমাম সাহেব বলছেন, থিয়োলজিক্যাল অর্থে কোনটা গ্রাম, আর কোনটা শহর, তার সংজ্ঞার (definition-এর) জন্য কোষকার তো আসবে আমাদেরই কাছে।
ঠিক তেমনি আইনজ্ঞ পণ্ডিতরা সংজ্ঞা দেন কোনটা crime, আর কোনটাই-বা tort; তবে তো কোষকার সেটা তার অভিধানে লিপিবদ্ধ করে। সে তো আর বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রত্যেকটিতে বিশেষজ্ঞ নয় যে, নিছক আপন বুদ্ধির ওপর নির্ভর করে প্রত্যেক শব্দের সংজ্ঞা দেবে, বর্ণনা দেবে, প্রতিশব্দ দেবে।
ঠিক এই জিনিসটি বাংলা দেশে এখনও আরম্ভ হয়নি।
সবাই তাকিয়ে আছেন কোষকারের দিকে। সে পরিভাষা বানিয়ে দেবে। আর সে বেচারি তাকিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা, আইন ইত্যাদির পণ্ডিতদের দিকে। তাঁরা সংজ্ঞা দেবেন এবং তাঁদের অধিকাংশই শব্দ বা ভাষাতাত্ত্বিক নন, সে বাবদে নিতান্তই এমেচার–তবে তো কোষকার সেগুলো লিপিবদ্ধ করবে–
২৬।২।৬৬
———
১. এ বাবদে তাঁর বিদকুটে রায়; সর্ব পণ্ডিত যখন কোনো তত্ত্ব একবাক্যে স্বীকার করে নেন, তখন তুমি এমেচার সেখানে ফপরদালালি করতে যেয়ো না। আর যেখানে তারাই একমত হতে পারছেন না সেখানে তুমি নাক গলাতে যাও কোন দুঃসাহসে? এর বিগলিতাৰ্থ : তুমি এমেচার ঠোঁট দুটি সেলাই করে বসে থাকো। এমনকি কেউ যদি বলে, Fine Weathereh? তুমি হ্যাঁ না। বলতে পারবে না। তুমি ওয়েদারের জানো কী? প্রথম গ্রিনিজকে শুধোবে আবহাওয়ার দফতরে। তারা যদি বলে ফাউল’ তবে ফাউল– তা তুমি যেখান থেকে কথা বলছ সেখানে থাক না মলয় পবন আর সূর্যাস্তের লালিমায় রঙিন গোলাপি আকাশ! এস্তেক তোমার নাম যদি অতুল’ হয় তবে তোমার বিপদ প্রত্যাসন্ন। শিশির ভাদুড়ী বলতেন অ (ঘর-এ যে অ’ উচ্চারণ), আর রবি ঠাকুর বলতেন ‘ওতুল’– কিন্তু তিনিও আবার ‘ওতুলনীয়’ না বলে বলতেন ‘অতুলনীয়’। অর্থাৎ বারট্রান্ড রাসলের অনুশাসন মানলে তোমাকে নাম বদলে ‘মাকাল-টাকাল’ কিছু একটা ‘দশদিশি নিরদ্বন্দ্বা’ নাম রাখতে হবে।
২. আমার টায়-টায় মনে নেই তবে রাজশেখর লেখেন, ‘নেত্রজনের উপস্থিতিতে অসিতলীনের উপর কুলহরনীর প্রতিক্রিয়া’ শুনে মনে হয় সক্কলের সজাগ দৃষ্টির সামনে (এখানে পাঠক আমার তরফ থেকে একটা ভদ্রজনোচিত গলাখাকারি অনুমান করে নেবেন। ধন্যবাদ!) কোনো বেহেড় বেলেল্লাপনা। উঁহু, আপনার পাপ মন, পাঠক, আপনার পাপ মতি। এর অর্থ হচ্ছে আবার বলছি টায়-টায় মনে নেই– The reaction of chlorine (কুলহরনীর) on actylene (অসিতলীন) where nitrogen (নেত্রজন) is present.
ঐতিহাসিক উপন্যাস
কলকাতায় এসে শুনতে পেলুম, বর্তমানে নাকি ঐতিহাসিক উপন্যাসের মরসুম যাচ্ছে। আশ্চর্য লাগল। বঙ্কিম আরম্ভ করলেন ঐতিহাসিক উপন্যাস দিয়ে, রবীন্দ্রনাথ লিখলে সামাজিক কিঞ্চিৎ রোমান্টিক-ঘ্যাঁষা-উপন্যাস, শরৎচন্দ্র লিখলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিয়ে, তারাশঙ্কর তথাকথিত নিম্ন সম্প্রদায় নিয়ে। এরপর আবার হঠাৎ ঐতিহাসিক উপন্যাস কী করে যে ডুব-সাঁতারে রিটার্নজার্নি মারলে ঠিক বোঝা গেল না। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি; কাজেই আর পাঁচজনের মতো হতভম্ব হতে আমার কোনও আপত্তি নেই।