ইতোমধ্যে কী আশ্চর্য, কী তিলিস্মাৎ– একটি ওমেদার পর্চাটি পাওয়া মাত্রই সেটি গড়গড়িয়ে পড়ে গেল, আদ্যন্ত! যেন তার প্রিয়ার আড়াইশ’ নম্বরি প্রেমপত্র।
***
ইন্টারভ্যু শেষে লাঞ্চ। সরকারি লাঞ্চকে আমি বলি লাঞ্ছনা। অবশ্য সর্বোচ্চ মহলে নয়। সেখানে লাঞ্চের অজুহাতে আপনার জন্য পেলেটে করে রোলস-রইস গাড়ি আসতে পারে তন্বঙ্গী পরী-পয়করী চালিতা। ড্রাইভারিণীটি ফাউ, থ্রোন ইন্ ফর গুড মেঝার!
পালাবার চেষ্টা করার সময় ধরা পড়লুম সেই পঞ্চ-কুশন-মর্দন মহাজনের হাতে! বললেন, ‘হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ, আপনাদের ওই স্পেশালিস্টটি আপন ওমেদারকে একটু ভালো করে রিহার্সেল করালেন না কেন? ও যদি সাতবার ঢোঁক গিলত, এগারোবার হোঁচট খেয়ে খেয়ে চিরকুটটির কবিতা পড়ত, তবে হয়তো, আমাদেরও বিশ্বাস জন্মত, সে ওই কবিতাটি ইতোপূর্বে কখনও দেখেনি।’
৩০।১০৬৫
———- ১. আমার যদ্দুর
এমেচার ভার্সস স্পেশালিস্ট
সব ব্যাপারেই আজকাল: স্পেশালিস্ট। সেদিন মার্কিন মুলুকে এক স্পেশালিস্টই আবিষ্কার করেন যে শোভাযাত্রা, বয়কট বা ধর্মঘটে যারা কালো ঝাণ্ডা তুলে হই হই করে, তাদের অনেকেই ভাড়াটে। এ তত্ত্ব আমাদের কাছে নতুন নয়; দিল্লিতে থাকাকালীন স্বর্গত অশ্বিনী গুপ্ত আমাকে দিল্লিতে যে ‘হাঙার স্ট্রাইকে’র জন্য প্রতিষ্ঠান আছে, যিনি হাঙার স্ট্রাইক করবেন তার জন্য শামিয়ানা, তাকিয়া-বালিশ, নির্জলা না হলে নিম্বুপানি– তদভাবে জিন্ (যদি তিনি মদ্যপ হন), কারণ বলতে গেলে একমাত্র জিনই সহজলভ্য কড়া ড্রিঙ্কের ভিতর জলের রঙ ধরে, আহারাদি, হ্যাঁ, আহারাদিই বলছি কারণ লুকিয়ে লুকিয়ে হাঙার স্ট্রাইকার যদি খেতে চান তবে গভীর রাত্রে তার সুব্যবস্থা– সেদিকে আমার ভোঁতা দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এবং যিনি আজও এ-প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি মার্কিনি স্পেশালিস্ট নন, নিতান্ত দিশি মাল– এবং সর্বোপরি তিনি ‘এমেচার’!
এসব তো মস্করার কথা– যদিও দুটোই ডাহা ইমানসে সত্য। তবে দিল্লির প্রতিষ্ঠানটি নাকি ‘সদাচার কদাচারে’র উৎপাতে ইদানীং বড়ই উৎপীড়িত (‘তংগ আ গয়ে’); তার অর্থ অবশ্য এ-নয় যে ‘হাঙার স্ট্রাইক’ করার কারণের কিংবা/এবং অকারণের অজুহাত অছিলার অভাব ঘটেছে কিংবা ‘হাঙার’-এর হাঙরদের ক্ষুধানিবৃত্তি ঘটেছে– আসল কারণ ওটা নাকি রেশন্ড হয়ে গিয়েছে, অর্থাৎ ‘লুকিয়ে হাঙার স্ট্রাইক’, ‘ফাস্ট আনটু ডেথ’ এসব করতে হলে সেগুলো এখন করবেন সরকার স্বয়ং! আনাড়ি এমেচারদের হাতে আর এসব টপ প্রায়োরিটির বস্তু ছেড়ে দেওয়া যায় না। দেশ-বিদেশে বড্ড বেইজ্জতি হয়। আইরল্যান্ডের কে যেন ম্যাকসুইনি না কী যেন নাম, সে নাকি বাষট্টি বা বিরানব্বই দিন নাগাড়ে উপোস মেরেছিল– এমতাবস্থায় ভারত যদি বাহান্ন দিনের রেকর্ড দেখায় তবে সেটা হবে সত্যই ‘শরমকি’ ঘুড়ি ‘লজ্জাকি, ঔর আফসোস–’ থুড়ি পশ্চাত্তাপকি বাৎ!
তৎসত্ত্বেও এমেচারকে ঠেকানো যায় না– বারট্রান্ড রাসূলের মতো নিরহঙ্কার লোক পর্যন্তও চেষ্টা দিয়ে হার মেনেছেন।(১) স্বয়ং রবি ঠাকুর এই এমেচারি কর্মে বড়ই সুখ পেতেন। আমি তামা-তুলসী স্পর্শ করে একশ’বার কিরে কাটতে রাজি আছি, তাঁকে মধ্যমশ্রেণির হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বললে তিনি সেটাকে কবিতায় নোবেল প্রাইজ পাওয়ার চেয়ে লক্ষণে শ্রাঘনীয় বলে মনে করতেন। ঠিক তেমনি স্পেশালিস্ট সত্যেন বোস তাঁকে দিলেন টুইয়ে– বিজ্ঞান শিখতে হয়, সে-ও না হয় বুঝি শেখাতে! অর্থাৎ ‘মেস্টারি’ করতে। তা হলে পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজন। বাজারে যেগুলো মেলে সেগুলো লিখেছেন বটে বিশেষজ্ঞরা– একশ’বার মানি– কিন্তু যে বাংলাভাষায় লিখেছেন সেটা, ওই যে ফরাসিতে বলে, ‘ইলজ এক্ৰিভ ফ্রাঁসে কমলে ভাশ এস্পানিয়োল’–তেনারা ফরাসি লেখেন স্প্যানিশ গাইয়ের মতো।(২) রবি ঠাকুর আর যা করুন, তাঁর বাংলাটা অন্তত বোধগম্য হবে। থাক না দু-পাঁচটা ভুল এদিক ওদিক। সেগুলো মেরামত করার জন্য তো ওই হোথায় সত্যেন বোস বসে।
যৌবনে রবীন্দ্রনাথ একদিন শব্দতত্ত্ব নিয়ে তর্কাতর্কির দায়ে মজে যান। বৃদ্ধ বয়সে বোধ হয় সুনীতিবাবু এবং/কিংবা গোসাঁইজির প্ররোচনায়– তাবৎ বাংলাভাষাটা নিয়ে খুব একচোট তলওয়ার খেলা দেখিয়ে দিলেন। আহা সে কী স্বচ্ছ সুন্দর তরল ভাষা– যেন বোতল থেকে তেল ঢালা হচ্ছে। কে বলবে, বিষয়বস্তু নিরস শব্দতত্ত্ব– হুস হুস করে পাতার পর পাতা সিনেমার ডেলি ক্যালেন্ডারের পাতার পর পাতা ওড়ার মতো পেরিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দুম করে সম্বিতে ফিরে আসবেন। এমেচার আর্টিস্ট যেন লাজুক হাসি হেসে ঘন ঘন করতালির মধ্যিখানে শেষ বক্তব্য নিবেদন করছেন। কী বলছেন? বলছেন, তিনি শব্দতাত্ত্বিক নন– নিতান্ত এমেচার– তাই খুব সম্ভব হেথা হোথা বিস্তর গলদ থেকে যাবে।
তার পর তিনি যে মুষ্টিযোগের শরণ নিয়েছেন সেইটে তিনি কালিদাসের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেটা তার শক্তি (fort)-ও বটে, দুর্বলতাও যদি অপরাধ না নেন– বটে, কিন্তু এস্থলেও তিনি যে-তুলনাটি ব্যবহার করেছেন সেটি উপমা কালিদাসস্যকেও হার মানায়। তিনি বলছেন, ‘কোনও কোনও বিখ্যাত রূপশিল্পী শরীরতত্ত্বের যথাতথ্যে ভুল করেও চিত্রকলায় প্রশংসিত হয়েছেন (যেমন সেজানের ওয়েস্ট কোট-পরা ছোকরাটির হাত আজানুলম্বিত না বলে আগুলফ-লম্বিত বললেই ঠিক হয় কিন্তু তৎসত্ত্বেও ছবিটি রসে ভর্তি যাকে আজকের দিনে রসোত্তীর্ণ’ বলা হয়, ঠিক তেমনি কবির ভাষা সম্বন্ধে এ-বইয়ে দুই-পাঁচটি ভুল বা অর্ধসত্য পরিবেশিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এসব ভুল মেনে নিয়েও দেখা যায় এরকম তুলনাহীন প্রবন্ধ হয় না।’ কারণ তথ্য-পরিবেশনে অসম্পূর্ণতা থাক আর না-ই থাক, সবসুদ্ধ মিলিয়ে প্রবন্ধটি বাংলা ব্যাকরণ (খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ– বাংলার ছদ্মবেশ পরে সংস্কৃত ব্যাকরণ নয়।) এবং খাঁটি বাংলা অলঙ্কার নিয়ে এক অভূতপূর্ব রচনা। যেমন তিনি বলছেন, চলতি বাংলাতে শুরুচণ্ডালী এখন আর দোষের মধ্যে গণ্য নয়।