তা সে যাই হোক, আমাকে ন’সিকে ইমপ্রেস করে হকচকিয়ে দেবার পর ওমেদারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাকিটা কও কী? “Or to take arms against a sea of-” বাকিটা বলে যাও তো?’
কালো চামড়ার তৈরি সর্বোৎকৃষ্ট স্প্রিং-সম্বলিত, পঞ্চাধিক ক্যুশনবিজড়িত গভীর আরামকেদারার তলা থেকে তিনি হাস্যরসের তুফানে ওঠা-নাবা করতে করতে বার বার বলেন, ‘তার পর কী, go on! ইউ সেড ইউভ রেড হ্যামলেট against a sea of troubles– আরও সাহায্য করলুম তোমাকে। বাকিটা বলে যাও!’ আবার তিনি সোফাতে বৃন্দাবনের রসরাজসুলভ হিন্দোল-দোলে দুলতে লাগলেন।
আমি তাজ্জব! বেচারি ওমেদার এসেছে ফার্সি ভাষায় মেস্টারির চেষ্টায়। আঁ পাসাঁ, বেচারি একটুখানি ইংরেজি শিখেছিল বটে, কিন্তু সেইটেই তার ফর for, সেইটেই তার piece de resistance, সেইটেই তার বলতে গেলে, কিছুই নয়– ইংরেজির মাধ্যমে ফার্সি পড়াতে গেলে যতখানি ইংরেজি জানবার প্রয়োজন তার চেয়েও সে বেশি জানে সেটা তো ইতোমধ্যে তার কথাবার্তাতেই প্রমাণ হয়ে গেছে। তা সে যাকগে। ওমেদার বেচারি তো ঘেমে-নেমে ঢোল। আমি তখন তার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললুম, ‘ওরকম নার্ভাস হবেন না। আপনি কতখানি ইংরেজি জানেন না-জানেন তার গুরুত্ব সামান্যই। ওটা আপনি ভুলে যান। এবারে চলুন ফার্সিতে। সেইটে কিন্তু আসল। ওই যে আপনার সামনে ফার্সি বই কয়েকখানি রয়েছে তারই যে কোনও একখানা থেকে কয়েক লাইন পড়ুন– প্রথম আপন মনে চুপে চুপে, পরে আমাদের শুনিয়ে। অনুবাদ? না, না, অনুবাদ করতে হবে না। আপনার পড়ার থেকেই তো বুঝে যাব, আপনি ফার্সি বোঝেন কি না। আর যেটা পড়বেন তার দু-একটা শব্দ আপনার জানা না থাকলে কোনও ক্ষতি নেই। সবাই কি আর সব ফার্সি শব্দ জানে? তা হলে দুনিয়াতে অভিধান লিখত কে, পড়ত কে? তা সে যাক। আমার আর কোনও প্রশ্ন-ট্রশ্ন নেই।’
এবারে ছেলেটার– হ্যাঁ, আমার ছেলের বয়সী– মুখে শুকনো হাসি ফুটল; একটুখানি ভর্সা পেয়েছে। সেই হ্যামলেটওলা লোকটিও আসলে কিন্তু মানুষ ভালো। পাঁচটা কুশন দুলিয়ে ঠাঠা করে হেসে উঠলেন। বললেন– তাঁরই হ্যামলেটের স্মরণে ‘জন্টিস্ ডিলেড হয়নি। হা হা, হা হা।’
ছেলেটি সুন্দর উচ্চারণে গড় গড় করে ফার্সি পড়ে গেল। কাশ্মিরি ব্রাহ্মণসন্তান; এবং পরে দেখা গেল, আরও হিন্দু ওমেদার ছিল। ফার্সি আবহাওয়াতে আপন ঠাকুন্দার কাছে লেখাপড়া শিখেছে। চেয়ারম্যান বললেন, ‘আপনি এখন যেতে পারেন!’ ছেলেটি সবাইকে মুসলমানি কায়দায় সেলাম জানালে, আমার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার একটু শুকনো হাসি হাসতে গিয়ে থেমে গেল– কী জানি ওটা ঠিক হবে কি না, যদি ওতে করে নম্বর কাটা যায়। আমি মনে মনে বললুম’ মারো ঝাড়ু, স্লা নোকরি ওর উসকি ইন্টারভ্যু পর।
উঁহু! এটা শেষ নয়, এটা আরম্ভ মাত্র। ছেলেটির সেলামপর্ব শেষ হওয়ার পূর্বে আমার সঙ্গে দ্বিতীয় স্পেশালিস্টটি বললেন, ‘একটু বসুন’–এবং সঙ্গে সঙ্গে আপন পকেট থেকে একটি চিরকুট বের করে তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘পড়ুন’।
হায় বেচারা ক্যান্ডিডেট! ভেবেছিল তার গব্বযন্তনা শেষ হল। এখন এ আবার কী ফাঁসি! বেচারি পর্চাখানির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। স্পেশালিস্ট দশ সেকেন্ড অন্তর অন্তর গুতোচ্ছেন, ‘পড়ুন। পড়ছেন না কেন?’ ছেলেটি হোঁচট ঠোকর খেতে খেতে খানিকটা পড়ল। স্পেশালিস্ট বললেন, ‘অনুবাদ করুন।’ রাম পাঁঠা! পড়ার কায়দা থেকেই তো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে পাঠ্যবস্তু তার এলেমের বাইরে, তবে স্যাডিস্টের মতো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা কেন।
ছেলেটা নড়বড়ে পায়ে বেরিয়ে গেল।
আমি পৰ্চাটির জন্য স্পেশালিস্টের দিকে হাত বাড়ালুম। তিনি ‘কুছ নহি, কুছ নহি’ বলে সেটি পকেটে পুরে নিলেন। দুসরা ক্যান্ডিডেট এল। এবারে হ্যামলেটের বদলে গ্রে’র কবিতা। সর্বশেষে আবার ওই অভিনয় সেই পর্চা নিয়ে। আমি স্পেশালিস্টের উদ্দেশে মনে মনে বললুম, ‘তুমি ব্যাটা খোট্টা মুসলমান, আম্মো হালা বাঙাল পাঁতি ল্যাড়ে! দেখাচ্ছি তোমাকে।’ এবারে ক্যান্ডিডেট পর্চাটি যেই ফেরত দিতে যাচ্ছে অমনি, তৈরি ছিলুম বলে, আমি সেটা নিয়ে নিলুম। ওমা! যত পড়ি, আগা-পাস্তালা ঘুরিয়ে দেখি, ততই কোনও মানে ওৎরায় না। ইতোমধ্যে আরেক ওমেদার এসে গেছে এবং চসার না পৌন্ড কী যেন আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। আমার দৃষ্টি ওই পর্চাটির দিকে নিবদ্ধ।
ইয়াল্লা! অব্ সমঝলন বা। যে দু লাইন কবিতা ছিল সেটা অনেকটা আমাদের
হরির উপরে হরি
হরি বসে তায়
হরিকে দেখিয়া হরি
হরিতে লুকায়!
‘হরি’ শব্দের কটা মানে হয়, আমি সত্যই জানিনে– কান ছুঁয়ে বলছি। কিন্তু ছিঃ। কারও বাংলা জ্ঞানের পরীক্ষা যদি নিতান্তই নিতে হয় তবে এই ধরনের ‘জামাই-ঠকানো’ কবিতাই কি ন্যায্যতম, প্রশস্ততম!!
কিন্তু এহ বাহ্য।
পরে, অন্তত আমি বুঝতে পারলুম দই খাচ্ছেন কোন রমাকান্ত আর বিকার হচ্ছে কোন গোবদ্দনের।
দু-একটি পাকা মেম্বরও হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাপারটা কী। লেখাপড়ায় এক-একটি আস্ত বিদ্যাসাগর বলেই ওঁদের নাসিকায় থাকে সারমেয়বিনিন্দিত গন্ধসন্ধানী অন্ধিসন্ধি।
ক্যান্ডিডেটের পরে ক্যান্ডিডেট– কেউ ভালো, কেউ মন্দ, কেউ মাঝারি, সংসারে যা হয়–ইন্টারভ্যু স্বয়ংবরে আমাদের মতো ইন্দুমতীর সামনে স্বপ্রকাশ হলেন। কিন্তু সবাই মার খেলেন, ওই পর্চাটুকুর সামনে, ওই চিরকুটটি সব্বাইকার ওয়াটারলু।