বললেন, ‘কেন! জানো না, যখন কোনো বিষয় টানাটানি করলে অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয় তখনই তাকে বলে ‘রেডুকৎসিয়ে আড আবসু-র্ডু-ম’।’
ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি। সোৎসাহে বললুম, হ্যাঁ হাঁ, রিডাকশিও এ্যাড এ্যাবসার্ডাম।’ একটুখানি গর্বের হাসিও হেসে নিলুম।
বাঁকা নয়নে তাকিয়ে বললেন, ‘কথাটা যখন লাতিন তখন ইংরিজি উচ্চারণ করছে। কেন? ইংরেজের মুখ না হলে তোমরা কোনো ঝাল খেতে পারো না বুঝি?’
‘সে কথা থাক। শোনো।
‘আসল কথা হচ্ছে বাঙাল দেখিয়ে দিল, মিষ্টি নামই যদি রাখবে। তবে যাও একট্ৰিমে। রাখো নাম ‘প্ৰাণনাথ’। তৎক্ষণাৎ প্রমাণ হয়ে গেল, মিষ্টত্বের দোহাই কত অ্যাবসার্ড।
‘এ দেখো না, মার্কিন জাতটা কি রকম অ্যাবসার্ড। কোনো ক্রমে সুনিপুণ হতে পারাটা অতীব প্রশংসনীয়। এতে সন্দেহ করবে। কে? কিন্তু এরও তো একটা সীমা থাকা দরকার। গল্প দিয়ে জিনিসটে বোঝাচ্ছি।
‘ব্রুকলিন ব্রিজ যখন বানানো হয় তখন দু’পাড় থেকে দু’দল লোক পুল তৈরি করে। মাঝ গাঙের দিকে রওয়ানা হল। এমনি চৌকশ তাদের হিসেব, এমনি সুনিপুণ তাদের কলকব্জা যে মধ্যিখানে এসে যখন পুলের দুদিকে জোড়া লাগল। তখন দেখা গেল এক ইঞ্চির আঠারো ভাগের উঁচু-নীচুর ফেরফার হয়েছে। তারিফ করবার মত কেরদানী, কোনো সন্দ নেই।’
‘পক্ষান্তরে আমার স্বর্ণভূমি চীনদেশে কি হয়? দুদল লোককে এক পাহাড়ের দুদিকে দেওয়া হয়েছিল সুড়ঙ্গ বানানোর জন্য। এদিক থেকে এনারা যাবেন, ওদিক থেকে ওনারা আসবেন। মধ্যিখানে মিলে গিয়ে খাসা টানেল।
‘কিন্তু কাৰ্যত হল কি? দেখা গেল, ডবল সময় চলে গেল তবু মধ্যিখানে দু’দলের দেখা নেই। তারপর এক সুপ্ৰভাতে দু দল বেরিয়ে এলেন দুদিকে। মধ্যিখানে মেলামেলি, কোলাকুলি হয়নি।’
আমি চোখ টিপে ইসারায় জানালুম, এ কি রঙ্গ বুঝতে পেরেছি।
তিনি বললেন, ‘আদপেই না। মার্কিনীরা সুনিপুণ, সেই নৈপুণ্যের প্রসাদাৎ তারা পেল কুল্ল একখানা ব্রিজ। আর আমরা পেয়ে গেলুম, ‘দুখানা টানেল। লাভ করে বেশি হ’ল বল তো।
তাই বলি অত্যধিক নৈপুণ্য ভালো নয়।
‘রেডুকৎসিয়ো আড আবসু্ররডুম!’।
রোগক্ষয়–শিক্ষালাভ
মানুষ যেমন বিষের ধুঁয়ো এটম বম বানিয়ে তার আপন ভাইকে অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে মারতে শিখেছে—ঠিক তেমনি এমন মানুষেরও অভাব নেই যাঁরা মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করার জন্য সমস্ত কল্পনাশক্তি, সর্বশেষ রক্তবিন্দু ক্ষয় করতে প্ৰস্তুত আছেন। কেন জানিনে, আজ হঠাৎ এঁদেরই একজনের কথা মনে পড়লো। এই প্ৰাতঃস্মরণীয় পুরুষের নাম মসিয়ো লুই ভোতিয়ে।
আমি তখন জিনীভায়। এক অচেনা ভদ্রলোক এসে আমার সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করলেন, লেজাঁয় তাঁর যক্ষ্মারোগীর সানাটোরিয়ামটি আমি যদি দেখতে যাই তবে তিনি অত্যন্ত খুশি হবেন। ফ্রান্স, জর্মনি, সুইটজারল্যান্ডে বিস্তর সানাটরিয়া দেখেছি, সর্বত্রই সব গুণীর মুখে একই কথা, যক্ষ্মার বিশেষ কোনো চিকিৎসা নেই, তবে রোগী যদি মনস্থির করে ফেলে যে, যমকে চোখের জলে নাকের জলে না করা পর্যন্ত সে মরবে না, অর্থাৎ বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে হিম্মৎ নামক অস্ত্রখানি দিয়ে তার সঙ্গে লড়াই দেবেই দেবে, তবে হয়ত, হয়ত কেন, নিশ্চয়ই সে বীরকে বাঁচাবার একটা চেষ্টা করাতে কিছুমাত্র আপত্তি নেই।’
আমি ডক্টর ভোতিয়েকে এ-কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি ভারী খুশি হলেন। বললেন, ‘আপনি যখন এ তত্ত্বটা জানেন আপনারই বিশেষ করে লেজাঁতে আসা উচিত।’ তবু আমার যেতে ইচ্ছা করছিল না; কারণ যক্ষ্মার হাসপাতাল দেখা কিছুমাত্র আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু ভোতিয়ে সেই শ্রেণীর লোক যাঁরা খানিকটে হোসে, খানিকটে যুক্তিতর্ক দিয়ে, খানিকটে অনুনয়-বিনয় করে গররাজি লোককে নিমরাজি নিজের পারে পটিয়ে টেনে নিয়ে যেতে পারেন। আমি খানিকটে ধস্তাধস্তি করেছিলুম, কিন্তু তখন যদি জানতুম যে ভোতিয়ে মুসসোলীন এবং লয়েড জর্জের কাছ থেকে আপন হাসপাতালের জন্য টাকা বাগাতে সমর্থ হয়েছেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপত্তি না করে সুবোধ ছেলেটির মত সুড়সূড় করে লেজ চলে যেতুম।
লেজাঁ যেতে হয় চেন-রেলওয়ে ধরে। এমনই ভয়ঙ্কর খাড়া পাহাড়ের উপর যক্ষ্মা সানাটরিয়ামগুলো বানানো হয়েছে যে সাধারণ ট্রেন, এমন কি মোটরও সেখানে পৌঁছতে পারে না।
হোটেল আছে; কিন্তু যখন নিতান্ত এসেই গিয়েছি তখন সানাটরিয়ামের ভিতর থাকলেই তো দেখতে পাবো বেশি।
মসিয়ো ভোতিয়ে, মাদাম, এমন কি বাচ্চা দুটো পর্যন্ত আমাকে দিল-খোলা অভ্যর্থনা জানালেন। বাচ্চা দুটোর বয়স ছয় আর আট। এদের জন্ম হয়েছে এই সানাটরিয়ামেই। তারা সুস্থ। শাঁখানেক যক্ষ্মরোগীর সঙ্গে তারা খায়-দায় খেলাধূলা গল্পগুজব করে-বাপ-মা’র তাতে কোনো ভয় নেই। আমিই তাহলে ডির্যাব কেন?
মসিয়ো ভোতিয়ে বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, যক্ষ্মা রোগটা ছেলেছোকরাদেরই হয় বেশি। বরং এ রোগটার সবচেয়ে বড় ডেরা খাটানো রয়েছে কলেজে কলেজে। কলেজের ছোকরারা এ রোগে মরেও সবচেয়ে বেশি। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক রোগী কিংবা নিতান্ত বাচ্চাকে বাঁচানো অনেক সহজ।
‘তার প্রধান-প্রধান কেন, একমাত্র কারণ, যক্ষ্মা হলেই তাদের পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। তারা তখন ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে। ভাবে, পড়াশোনা যদি নাই করতে পারলুম তবে দু’পাঁচ বৎসর পরে সেরে গিয়েই বা করব কি? খাবো কি? সংসারই বা পাতবো কি দিয়ে?