Site icon BnBoi.Com

বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা – সৈয়দ আবুল মকসুদ

বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা - সৈয়দ আবুল মকসুদ

০. ভূমিকা : বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা

উত্সর্গ

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
খাঁটি বাঙালি বুদ্ধিজীবীর প্রতিভূ

ভূমিকা

অবিভক্ত বাংলায় বাঙালি মুসলমান ছিল সংখ্যায় বেশি। অখণ্ড পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমান ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো জনগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে না। ভারতবর্ষে পার্শিরা সংখ্যায় অতি অল্প, কিন্তু তা তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে বাধা নয়। বাঙালি মুসলমান একই সঙ্গে আত্মঘাতী ও ভাগ্যহত। নিজেদের কৃতকর্মের কারণে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাকে বলা যায় আত্মঘাতী। অন্যের কারণে অথবা নিয়তির ফলে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে ভাগ্যহত। বাঙালি মুসলমান ভাগ্যবিড়ম্বিত তার নিজের স্বভাবদোষে, ভাগ্যচক্রে এবং অন্যের কারণেও। বারবার হয়েছে সে ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার। প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যখন সে একটু দাঁড়াবার চেষ্টা করেছে কোমর সোজা করে, তখনই তার ওপর এসেছে আঘাত, কোমর আর সোজা করতে পারেনি।

বাঙালি মুসলমান অগ্রসর ও দূরদর্শী নেতৃত্ব কোনোকালেই পায়নি। মুসলিম শাসক নবাবি আমলে নয়, ইংরেজ আমলে তো নয়ই, পাকিস্তানি আমলেও নয়। পাকিস্তানের চব্বিশ বছর ছিল বাঙালি মুসলমানের জীবনে একটি ক্রান্তিকাল অর্থাৎ একটি যুগ থেকে আর একটি যুগের মধ্যবর্তী সময়। যেকোনো পরাবৃত্তিকাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ যদি সঠিক ও বাস্তবসম্মত না হয়, তাহলে পরবর্তী সময়টি অর্থবহ হয় না। সেই সময়টিতে যদি সে বিভ্রান্তিতে ভোগে এবং সে তার বিশ্বাসে অটল না হয় তা হলে পরবর্তীকালে গঠনমূলক ভালো কিছু করা সম্ভব হয় না। তার জীবনে আসে ব্যর্থতা এবং সে আত্মপ্রবঞ্চনার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি শাসনামলের চব্বিশ বছরে বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ বহু ভুল করেছে, কিন্তু সে ভুল তাঁরা স্বীকার করেন না, তাই সে ভুলের খেসরাত তাকে এখন যে দিতে হচ্ছে তাই নয়, ভবিষ্যতে আরও মারাত্মকভাবে দিতে হবে।

এই বইয়ের লেখাগুলো দৈনিক যুগান্তরের সাময়িকীতে দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত হয়েছিল। সাময়িকী পাতার সম্পাদক জনপ্রিয় ছড়াকার জনাব রফিকুল হক দাদুভাই তাড়া দিয়ে লিখিয়েছেন। তিনি আমার অগ্রজপ্রতিম শ্রদ্ধাভাজন সুহৃদ, তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়ার অবকাশ নেই। পাঠকসমাজ থেকে অপ্রত্যাশিত অনুকূল সাড়া পাওয়া যায়। বই আকারে প্রকাশের জন্য তাগিদ দেন অনেকে। ডেইলি স্টার বুকস প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করে তখনই, কিন্তু আমার আলস্যে দেড় বছর দেরি হয়। রচনাগুলো বই আকারে প্রকাশ করতে যে দুই তরুণ কবি আমাকে অবিরাম তাগিদের ওপর রেখেছিলেন তাঁরা হলেন জুননু রাইন এবং ইমরান মাহফুজ। তারা আমার অতি স্নেহভাজন, সুতরাং তাদের ধন্যবাদ দিয়ে বিব্রত করা যায় না।

এই জর্নালধর্মী লেখাগুলোকে কোনো বিশেষ শ্রেণিতে ফেলা যাবে না। ছোট প্রবন্ধবিশেষ, গবেষণামূলক রচনার উপাদান এতে যথেষ্টই আছে। একটি সময়ের চিত্র পাওয়া যাবে। উপনিবেশ পরবর্তী পূর্ব বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি নিয়ে যারা কাজ করবেন, তাঁরা এগুলো থেকে তাঁদের প্রয়োজনমতো তথ্য ও উপাদান পেতে পারেন।

প্রতিটি রচনাই যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ, তেমনি একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্কও রয়েছে। তবে বিভিন্ন বিষয়ে লেখা বলে প্রতিটি স্বতন্ত্র রচনা হিসেবে দেখাই ভালো।

সৈয়দ আবুল মকসুদ
আজিজ এপার্টমেন্ট
ধানমন্ডি, ঢাকা। জানুয়ারি ২০১৯

০১. পূর্ব বাংলায় নবজীবনে যাত্রা শুরু

১৯৪৭-এর আগস্টে ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ১৯০ বছর পরে উপমহাদেশ থেকে বিদায় নেয়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের দু-তিন বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলার, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটি অংশের মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। অতি অল্প সময়ে এত বেশি পরিবর্তন পৃথিবীর আর কোনো জাতির মধ্যে ঘটেনি বলেই ধারণা করি। দীর্ঘকাল যাঁরা ছিলেন অনুদার ও রক্ষণশীল, তারা হয়ে গেলেন অনেকটা প্রগতিপন্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে নিষ্প্রাণ ঢাকা নগরী হয়ে ওঠে বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার একটি নতুন কেন্দ্র।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পটভূমি দীর্ঘ। তা কমবেশি সবাই জানে। এই এলাকার মানুষ বহুকাল ছিল অবহেলিত ও শোষিত-বঞ্চিত। দেশের অর্থনীতিও ছিল না তাদের হাতে, রাজনৈতিক ক্ষমতাও নয়। শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি-অর্থনীতি সবই কলকাতাকেন্দ্রিক। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা একটা পর্যায়ে পাকিস্তান-আন্দোলনে ঐকান্তিকভাবে অংশ নিয়েছিল মোটেই আবেগের বশে নয়– ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই। কৃষিজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানসমাজ জাতীয় অর্থনীতিতে অতুলনীয় অবদান রাখছিল। পাট চাষে ও পাটশিল্পে, যদিও পাটকলগুলোর মালিক ছিল অবাঙালি শিল্পপতিরা, পূর্ব বাংলার মানুষের অবদানই বেশি। চল্লিশের দশক নাগাদ এই অঞ্চলের সচ্ছল কৃষক ও একটি মধ্যস্বত্বভোগী জোতদার শ্রেণির সন্তানদের অনেকে কিছুটা উচ্চশিক্ষা নিয়ে সরকারি চাকরি-বাকরিতে ঢুকছিলেন। খুব উঁচু পদে না হোক, মোটামুটি সংখ্যার দিক থেকে বাঙালি মুসলমান সরকারি চাকরিতে যথেষ্টই ছিলেন। তাঁদের সন্তানেরাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে।

চল্লিশের শেষে এবং পঞ্চাশের শুরুতে যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পান, তাঁদের একটি অংশ পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে, সমাজে ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁরা অনেকে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ধারণ করেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা। তারা বামপন্থী ধারার সঙ্গে যুক্ত হন এবং আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস স্থাপন করেন। অর্থাৎ পঞ্চাশ দশকের শুরুতেই বাঙালি মুসলমান তরুণ-তরুণীদের অনেকের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। সবার অজান্তেই যেন ঢাকায় এক নীরব বিপ্লব ঘটে যায়। যাদের বাপ-চাচারা স্লোগান দিতেন ‘নারায়ে তকবির’; তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে আইপিটিএর গণসংগীত:

‘নওজোয়ান নওজোয়ান।
বিশ্বে এলো নওজোয়ান।’

অথবা নজরুলের–

‘ওড়াও ওড়াও লাল নিশান।
দুলাও মোদের রক্ত-পতাকা।
ভরিয়া বাতাস জুড়ি বিমান।
ওড়াও ওড়াও লাল নিশান।’

কিংবা নজরুলেরই

‘জাগো অনশন-বন্দী, ওঠরে যত
জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত।’

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই আন্তর্জাতিকতা ও বামপন্থার এই যে সূচনা, তার অর্থ এই ছিল না যে তারা পাকিস্তানকে অস্বীকার করছিল। বরং পাকিস্তানই করে দেয় তাদেরকে এক নতুন সুযোগ– খুলে দেয় আত্মবিকাশের দরজা। তবে তারা খুব সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ করেন, যতটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সময় প্রত্যাশা করেছিলেন তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছেন। সে জন্যই তারা উপলব্ধি করেন, আর্থসামাজিক মুক্তির জন্য তাঁদের আরও আন্দোলন ও লড়াই-সংগ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। সেই উপলব্ধি থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রামের প্রস্তুতি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একটি গোত্র নিজেদের অতি অসাম্প্রদায়িক, সম্পূর্ণ ষোলো আনা সেকুলার ও প্রবল প্রগতিশীল প্রমাণ করতে গিয়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে অবিরাম গালাগাল করতে থাকে। (যে তত্ত্ব জিন্নাহ নিজেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক দিন আগে ১৩ আগস্ট ১৯৪৭ বর্জন করেন এবং গণপরিষদে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন, পাকিস্তান হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ইসলামি রাষ্ট্র নয়, যেখানে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ধর্মের কোনো সম্পর্কই থাকবে না।) তারা একাত্তরে ইয়াহিয়া-টিক্কা-ফরমানের গণহত্যা ও বর্বরতার সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে এক করে ফেলেন। ১৯৯৬-র পর থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা যে একটি জঘন্য ব্যাপার ছিল, তা অব্যাহত বলা অনেকের মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। তবে এখন এমন অনেকে এসব বলছেন পাকিস্তান সরকার থেকে যারা সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে যাদের কোনো ভূমিকাই নেই। পাকিস্তান না হলে তাঁরা কলকাতায় কিংবা কোনো মফস্বল শহরে মর্যাদাহীন জীবন যাপন করতেন।

অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী একটি পরাবৃত্তিকালে বা ট্রানজিশনের সময় কিছু বিশেষ সুবিধা দাবি করে। ১৯৪৭-এর আগে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের– বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের মুসলমানদের –অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলার মুসলমানদের চেয়ে ভালো ছিল। উর্দুর মাধ্যমে তারা ধারণ করতেন সর্বভারতীয় সংস্কৃতি। বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত নিজস্ব সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক। ঐতিহ্যের অধিকারী, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, শিক্ষায় পিছিয়ে। তাদের ভূখণ্ডে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হতে চেয়েছিল। তাদের পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণ সেটাই। ওই ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে যে দোষ ছিল না, তা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলার মানুষ দ্বিতীয়বার প্রমাণ করেছে।

বাঙালির মহত্তম সৃষ্টিশীল প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ও সমস্যা নিয়ে ভেবেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বহু আগে, ১৯১১ সালে, তিনি লিখেছিলেন :

‘হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে যে একটি সত্য পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই। প্রয়োজন সাধনের আগ্রহবশত সেই পার্থক্য যদি আমরা না মানি তবে সেও আমাদের প্রয়োজন মানিবে না।

‘হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমানকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায়ক বলিয়া ডাকিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া মনে করি নাই, আনুষঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। যেখানে দুই পক্ষের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে সেখানে যদি তাহারা শরিক হয়, তবে কেবল ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বন্ধন থাকে যতদিন বাহিরে কোনো বাধা অতিক্রমের জন্য তাহাদের একত্র থাকা আবশ্যক হয়,–সে আবশ্যকটা অতীত হইলেই ভাগবাটোয়ারার বেলায় উভয় পক্ষেই ফাঁকি চলিতে থাকে।

‘মুসলমান এই সন্দেহটি মনে লইয়া আমাদের ডাকে সাড়া দেয় নাই। আমরা দুই পক্ষ একত্র থাকিলে মোটের উপর লাভের অঙ্ক বেশি হইবে বটে, কিন্তু লাভের অংশ তাহার পক্ষে বেশি হইবে কিনা, মুসলমানের সেইটেই বিবেচ্য। অতএব মুসলমানের এ কথা বলা অসঙ্গত নহে যে আমি যদি পৃথক থাকিয়াই বড়ো হইতে পারি তবেই তাহাতে আমার লাভ।’

[রবীন্দ্র রচনাবলী, ত্রয়োদশ খণ্ড, ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ, কলকাতা, পৃ. ১৭৯-৯২]

কংগ্রেসের সুবিধাবাদী ও এক শ্রেণির সাম্প্রদায়িকতাবাদী হিন্দু নেতাদের সঙ্গে যুক্তিবাদী রবীন্দ্রনাথের পার্থক্য এখানেই। তিনি অন্য সম্প্রদায়ের দুর্বলতা ও নিজের সম্প্রদায়ের দোষ দেখতে পেয়েছেন। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে যখন নতুন প্রদেশ হয় ১৯০৫ সালে, শ্রেণিস্বার্থে বিশেষ করে জমিদারি হারানোর শঙ্কায় রবীন্দ্রনাথও তার বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু বছর দেড়েকের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারেন ওই বিরোধিতা করাটা ভুল ছিল। তিনি নতুন প্রদেশবিরোধী আন্দোলন, যার প্রচলিত নাম বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, তা থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা নতুন প্রদেশ বাতিল না করা পর্যন্ত আদা নুন খেয়ে লেগে থাকেন। এবং ১৯১১-তে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করেন। উপরের উদ্ধৃত কথাগুলো তখনই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বেঁচে থাকলে এই কথাগুলোই পুনর্বার লিখতেন। তাঁর আয়ের উৎস সব জমিদারিই ছিল পূর্ব বাংলায়। সুতরাং, পূর্ব বাংলা পাকিস্তানে পড়ায় তিনি হতেন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। তখন তাঁর নিজের স্বার্থ ও বাঙালি মুসলমানের স্বার্থ –এই দুইয়ের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তিনি কোনটিকে প্রাধান্য দিতেন, তা নিয়ে অনুমান না করাই ভালো।

পূর্ব বাংলায় আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের বাধ্য করেছেন মহাসভা ও কংগ্রেস নেতারা। বাঙালি মুসলমান কস্মিনকালেও, ১৯৪০ সালের আগে, আলাদা রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করেনি। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা হিন্দুদের সঙ্গে একত্রে পাশাপাশি বাস করেছে এবং অনাগত শত শত বছরও তারা একসঙ্গেই থাকতে চেয়েছে। তারা যা চেয়েছে তা হলো তাদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা। এই দুটোর কোনোটাই প্রতিপক্ষ থেকে না পাওয়ায় তারা দাবি তোলে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার, যে রাষ্ট্রে তারাই হবে তাদের ভাগ্যবিধাতা। তারই পরিণাম পাকিস্তান এবং তারপর বাংলাদেশ।

 ০২. পূর্ব বাংলার পুনর্জন্ম

পূর্ব বাংলা, যাকে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর বলা হতো পূর্ব পাকিস্তান, ১৯৪৭ এর আগস্টে শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করে। শূন্য হাত কথাটি কথার কথা নয়। ঢাকা হলো পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী। পুরোনো শহর, কিন্তু দুই শতাব্দীর অবহেলায় তা প্রাণহীন। সমস্ত বাংলার সব সম্পদ গিয়ে জমা হতো কলকাতায়। কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে গিয়ে ঢাকাকে করা হয় হতশ্রী। প্রাণ বলতে ঢাকায় ছিল শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে সেই নীলক্ষেত রমনা এলাকায়, যা মূল ঢাকা শহর থেকে সামান্য দূরে এবং এক পাশে, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা হতো। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা হতো। বড় বড় পণ্ডিতেরা বাস করতেন নীলক্ষেত ও রমনায়।

ঢাকা আজ পত্রপত্রিকায় সয়লাব। শত শত দৈনিক, সাপ্তাহিক প্রকাশিত হচ্ছে। ষাটের দশক থেকেই পত্রপত্রিকা প্রকাশের প্রবণতা দেখা যায়। ষাটের দশকেই ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো কয়েকটি উন্নতমানের বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক। দৈনিক পাকিস্তান, পূর্বদেশ প্রভৃতি এবং দ্য পাকিস্তান অবজারভার, মর্নিং নিউজ এর মান কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, দ্য স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার পত্রিকা বা হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এর চেয়ে কম ছিল, তা বলা যাবে না। কিন্তু সেই ঢাকাতে ১৯৪৭ সালে কোনো দৈনিক পত্রিকা ছিল না। একটি বাংলা দৈনিকও ছিল না, একটি ইংরেজি দৈনিকও নয়। ঢাকাবাসীর তথা পূর্ব বাংলার মানুষের পত্রিকা পাঠের শখ মেটাতে হতো কলকাতার কাগজ দিয়ে। অর্থাৎ কলকাতার পত্রিকার বাজার ছিল ঢাকা ও বাংলাদেশ। কলকাতার দৈনিক কাগজ দিনেরটি দিনেই ঢাকায় ও চট্টগ্রামে পৌঁছাত। অবশ্য বিকেল হয়ে যেত। কলকাতা থেকে কাগজ ঢাকায় আসত কিছু বিমানে, বেশির ভাগই আসত ট্রেনে ও স্টিমারে।

সাতচল্লিশের পর পূর্ব বাংলার প্রথম দৈনিক প্রকাশিত হয় ঢাকা নয় চট্টগ্রাম। থেকে। তার নাম দৈনিক পাকিস্তান। স্বত্বাধিকারী ছিলেন কাজী বজলুল হক। সম্পাদক ছিলেন কবি আবদুস সালাম। সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক কাজী আফসারউদ্দীন আহমদ। দৈনিক পাকিস্তান ছিল চার পাতার পত্রিকা, কোনো দিন ছয় পাতা। আমাদের বাড়িতে তার কিছু কপি ছিল। এখনো দু-চার কপি সম্ভবত আছে। এই তো চল্লিশের দশকের পূর্ব বাংলার অবস্থা। যেখানে পত্রপত্রিকাই নেই, সেখানে উন্নত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা কীভাবে হবে?

পাকিস্তান যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তখন ঢাকায় মাত্র একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। কাগজটি অনেক পুরোনো। তার নাম দ্য ইস্ট বেঙ্গল টাইমস। খুব মানসম্মত সাপ্তাহিক নয়। সামান্যই ছাপা হতো। ঢাকার মানুষও ওটি না পড়ে কলকাতার কাগজই বেশি পড়তেন। ১৯৪৭-এর পরে অনেক শিক্ষিত ও বিত্তবান হিন্দুর মতো দ্য ইস্ট বেঙ্গল টাইমসের মালিকও কলকাতা চলে যান। তবে পত্রিকাটি চালু রেখে যান। দায়িত্ব দিয়ে যান তাঁর ছেলে ও ছেলের স্ত্রীকে। ডিক্লারেশন পরিবর্তন করে নতুন সম্পাদক হলেন তাঁর পুত্রবধূ কল্যাণী গুহ।

আমার আব্বার কাছে শুনেছি, নতুন স্বাধীন দেশ পাকিস্তানের মন্ত্রী ও আমলাদের দুর্নীতির কথা অল্প পরিমাণে দ্য ইস্ট বেঙ্গল টাইমসে প্রকাশিত হতো। মুসলিম লীগ সরকার তাতে পত্রিকাটির ওপর ক্ষিপ্ত হয়। আরও ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ তার মালিক ও সম্পাদক হিন্দু। নানাভাবে পত্রিকার সম্পাদিকা কল্যাণী গুহকে হয়রানি করতে থাকে সরকারি লোকজন। একপর্যায়ে মালিক পত্রিকা বন্ধ করতে বাধ্য হন। ঢাকায় কোনো পত্রিকার ওপর সেটাই প্রথম আঘাত। ইস্ট বেঙ্গল টাইমস কোনো লাভজনক কাগজ ছিল না। আট পৃষ্ঠার কাগজে কোনো দিন ১২ পৃষ্ঠার কাগজটির দু-একটি সংখ্যা আমি কাজী আনওয়ার-উল হকের বাড়িতে দেখেছি আশির দশকে।

স্বাধীন বাংলাদেশে আজ আমরা সুখী ও সমৃদ্ধ। সমস্ত আধুনিক উপকরণ আমাদের করায়ত্ত। মোটরগাড়ি আজ ঘরে ঘরে। কোনো পরিবারে একাধিক গাড়ি। উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীর পর্যন্ত দামি গাড়ি। চল্লিশের শেষ ও পঞ্চাশের শুরুতে ঢাকা ছিল নিষ্প্রাণ নগরী। কয়েক মিনিট পর ঢাকার রাস্তায় দেখা যেত একটি মোটরগাড়ি। উঁচুপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা চড়তেন ‘উইলি’ নামক জিপে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই শক্ত জিপ সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। যুদ্ধের পরে বিভিন্ন দেশে বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে প্রথম যেদিন আমি কোনো অফিসারের জিপে চড়ি, সে কি আনন্দ! আর ঢাকার রাস্তায় চলতে দেখেছি বেডফোর্ড কোম্পানির পিকআপ। তা-ও ব্যবহৃত হতো সরকারি কাজে। এখন বিভিন্ন প্রজেক্টের দামি গাড়িগুলো যেমন যথেচ্ছ ব্যবহৃত হয়, সেকালে তা সম্ভব ছিল না। যুগ্ম-সচিবের নিচে কারও গাড়ি ব্যবহারের সৌভাগ্য হতো না। তবে জেলা ও মহকুমা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার গাড়ি পেতেন।

পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় কোনো কোনো ভাগ্যবানের ছিল ব্যক্তিগত অস্টিন মিনি কার। ছোট্ট গাড়ি ইঁদুরের মতো ছুটত। অধিকাংশই কালো রঙের ছিল মরিচ মাইনর মোটরগাড়ি। অস্টিনের চেয়ে মরিচ সামান্য বড়। আর ছিল জার্মান কোম্পানির ফোক্সওয়াগান। ফোক্সওয়াগান দেখতে কাছিমের মতো। আদমজী বাওয়ানীদের দু-চারটি ছিল মস্ত বড় দামি গাড়ি। মার্সিডিজ বেঞ্জ বা ক্যাডিলাক। রাস্তায় তা দেখলে মানুষ দাঁড়িয়ে যেত। ঢাকায় সাধারণ মানুষের যাতায়াতের জন্য ছিল ছোট ‘টাউন সার্ভিস বাস।

শূন্যতা থেকে শুরুর কথা বলেছি। সত্যি আমাদের ছিল না কিছুই। ১৯৫৪ তে আমার আব্বার সঙ্গে আমি প্রথম ইডেন বিল্ডিংয়ে বা প্রাদেশিক সচিবালয়ে ঢুকি। আমাদের এক আত্মীয় নিচের পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর অফিস দেখতে যাব, খুবই উদ্দীপনা। নিশ্চয়ই সুন্দর সুসজ্জিত কিছু হবে, যা আমাদের থানার বড় দারোগার অফিসঘরের চেয়ে অনেক উন্নত। গিয়ে দেখি চার-পায়া এক বড় টেবিল। তার ওপর ফাইলপত্র এপাশে ওপাশে সাজানো। কিছু ফাইলপত্র মাটিতে হোগলাপাতার চাটাইয়ের ওপর রাখা। আলমারি ও র‍্যাকের অভাব। আমার আত্মীয়ের মাথার ওপর কোনো ফ্যান ছিল না। তালপাতার হাতপাখা তাঁর সম্বল। এক হাতে হাতপাখায় নিজেকে বাতাস করেন, আরেক হাতে ফাইলে নোট লেখেন। পাকিস্তানের প্রথম বছর দশেক অবস্থা ছিল এ রকম।

মনে আছে, ১৯৫৫-র বর্ষাকালে আব্বার সঙ্গে গিয়েছিলাম খাদ্যমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের অফিসে। মন্ত্রীর অফিস না জানি সে কি! বন্যা হচ্ছিল আমাদের এলাকায়। কিছু রিলিফ সামগ্রীর জন্য তদবির করতে আমার বাবা ও আরও দু-একজন মন্ত্রীর দপ্তরে যান। খুবই সাধারণ অফিসকক্ষ। এসি নেই। ফ্যান ঘুরছে মন্ত্রীর মাথার ওপর। এক সেট সোফা আর কয়েকটি কাঠের চেয়ার। খুব কালো। রঙের এক সেট ফোন মন্ত্রীর টেবিলে। আমি জড়সড় হয়ে একটি সোফার কোনায় বসি। নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে হয়। মন্ত্রীর অফিস, যেমন তেমন ব্যাপার নয়! সেকালে কলিংবেল ছিল ঘণ্টির মতো।

মধ্য-পঞ্চাশের তত দিনে অবশ্য ঢাকায় একাধিক বাংলা-ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের বাড়িতে ইত্তেফাঁকও থাকে, মর্নিং নিউজ থাকে। আমাদের পরিবারের একজন মর্নিং নিউজে কাজ করতেন বলে সেটি বিনা পয়সায় পাওয়া যেত। সকালবেলা খবরের কাগজ পড়ার জন্য অনেকেই ব্যাকুল হয়ে থাকত। সেকালে এক খবরের কাগজ একজন পড়ে অন্যকে তার বিষয়বস্তু বলতেন। সাধারণ। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে সচেতনতা। আন্তর্জাতিক খবরেও মানুষের কম উৎসাহ নয়। কোথায় কোরিয়ায় যুদ্ধ হচ্ছে বা অন্য কিছু হচ্ছে, মানুষ তা জানার জন্য সংবাদপত্রে চোখ রাখছে। বড় সুপারমার্কেট ছিল না। মুদি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বা চা-দোকানে বসে মানুষ পাকিস্তানের অবস্থা ও পৃথিবীর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে। সাধারণ মানুষ আলোচনা করে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে যা প্রাপ্য তা দিচ্ছে না। তাতে মন খারাপ করে, তা চেহারা দেখে বোঝা যায়।

তবে বাংলাবাজার বইপাড়াটি বহু পুরোনো। শত বছরের পুরোনো। বাংলাবাজার প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি ও প্রেসিডেন্সি প্রিন্টিং ওয়ার্কসের মালিক অনিলচন্দ্র ঘোষ ছিলেন আমার আব্বার বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী। বাড়ি মানিকগঞ্জে। তিনি ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতাসংগ্রামী। বাংলাবাজার প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি ও কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীনের আল হামরা লাইব্রেরিতে মাঝে মাঝে যেতাম। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে ভালো লাগত। বাংলাবাজার বইপাড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা যেতেন। তাদের কথাবার্তা শুনতাম। অনেক পরে বুঝতে পারি, পূর্ব বাংলার মানুষের পুনর্জন্ম হয়েছিল পঞ্চাশের শুরুতে।

পঞ্চাশের দশক ছিল বাঙালি মুসলমানের নতুন গন্তব্যে যাত্রার লক্ষ্যে প্রস্তুতির সময়। তবে সেই প্রস্তুতির সময়টির পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পারেননি শিক্ষিত মুসলমান। তাঁদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছিল আর ছিল না উপযুক্ত নেতৃত্ব। নেতৃত্বহীন জাতি বিভ্রান্তির গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খায়। বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম আরও মারাত্মক বুদ্ধিবৃত্তিক সততা আরও বেশি প্রয়োজন।

০৩. নতুন রাষ্ট্র : ভাষা সংস্কার কমিটি

পৃথিবীতে কোনো জাতিরাষ্ট্রই এক-জাতি-রাষ্ট্র নয়। এক ভাষাভাষী রাষ্ট্রও নেই বললেই চলে, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি আরব দেশ ছাড়া। ভারতের মতো পাকিস্তানও। ছিল বহুজাতিক রাষ্ট্র। বহু ভাষাভাষী মানুষের রাষ্ট্র। বহু ধর্মের মানুষের দেশ। জাতীয় সংহতি সব দেশেই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। হাজার মাইল দূরে দুই ডানাবিশিষ্ট পাকিস্তানের সংহতির জন্য প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্যের। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি সংহতির জন্য শুধু ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করতে চাইল। জাতীয় সংহতির জন্য ধম কোনো প্রধান উপাদান হতে পারে না।

মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ তাঁর এক রচনায় মওলানা মোহাম্মদ আকরম খার একটি লেখার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তাতে আকরম খাঁ লিখেছেন :

‘সকল দলেই চরমপন্থী আছে। (আমাদের বাঙালি মুসলমান) চরমপন্থীরা বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন, বাঙ্গলা শুধু আমাদের মাতৃভাষা নহে উহা আমাদের জাতীয় ভাষাও বটে।… নেশন বা জাতি সম্বন্ধে মোছলমানদের আদর্শ স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্রই মোছলেম জাতীয়তার বিশেষত্ব এবং মোছলেম জাতির রক্ষাকবচ। এ বিষয়ে আলোচনা করিবার সময় আমাদিগকে বিশেষ করিয়া স্মরণ রাখিতে হইবে যে, মোছলমানের জাতীয়তা বংশ, ব্যবসায় বা দেশগত নহে। মোছলমানের। জাতীয়তা সম্পূর্ণ ধর্মর্গত। বিশ্বের সব মোছলমান মিলিয়া এক অভিন্ন ও অভেদ্য জাতি। কোনো মহাদেশের কোনো দেশের বা কোনো প্রদেশের মোছলমানদিগের দ্বারা কথিত ভাষা সেই দেশের মোছলমানদিগের জাতীয় ভাষা বলিয়া গৃহীত হইতে পারে না। মোছলমানের জাতীয় ভাষা যে আরবি একথা ভুলিলে মোছলমানের সর্বনাশ হইবে। এই আরবি ভাষাই বিশ্ব মোছলমানের মিলনের একমাত্র অবলম্বন।’

[মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা-প্রীতি, ঢাকা,১৯৮০, পৃষ্ঠা. ৬২]

আকরম খাঁর এই বক্তব্য অনেক দিন আগের। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর আগে তিনি তাঁর এক লেখায়, যা মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন ছিল অখণ্ড বাংলা ও অখণ্ড ভারত। তিনি জানতেন না যে একদিন পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র হবে এই উপমহাদেশে এবং বাংলা ভাগ হয়ে তার এক অংশ হবে পাকিস্তানের। একটি প্রদেশ এবং আরেক অংশ হবে ভারতের একটি প্রদেশ।

পাকিস্তানের দুই অংশেরই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুদীর্ঘ কালের। এদিকে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেমন অতি প্রাচীন; তেমনি ওদিকে পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ প্রভৃতির সভ্যতা কয়েক হাজার বছরের। এই রাষ্ট্রের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নে দায়িত্বজ্ঞানহীন তৎপরতা শুরু করে।

১৯৪৯ সালের ৯ মার্চ সরকার ঘোষণা করে ‘ইস্ট বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ কমিটি’-পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি। উদ্দেশ্য, পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষার সরলীকরণ, সংস্কার ও প্রমিতকরণের প্রশ্ন বিবেচনা করা এবং বাংলা ভাষাকে নির্দিষ্টভাবে পূর্ব বাংলা এবং সাধারণভাবে পাকিস্তানের মানুষের প্রতিভা ও কৃষ্টির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা। এই কমিটি গঠন ছিল একেবারেই অপ্রয়োজনীয় একটি কাজ। নতুন রাষ্ট্রে অসংখ্য সমস্যা ছিল। সেসব জরুরি সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে বাংলা ভাষা সংস্কারে সরকারের তৎপরতার নিশ্চয়ই বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। পাকিস্তানের মানুষের প্রতিভা ও কৃষ্টি কথাটিতে তা পরিষ্কার। উর্দু, পাঞ্জাবি ও সিল্কি ভাষাও পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশেই প্রচলিত। সেগুলো সংস্কারের জন্য সরকারের মাথাব্যথা ছিল না। বাংলা ভাষা সংস্কারের উদ্বেগ অর্থহীন ছিল না, কারণ তার সঙ্গে জড়িত ছিল রাজনীতি-প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি।

ভাষা সংস্কার কমিটির সভাপতি করা হয়েছিল মুসলিম লীগের নেতা ও আজাদ পত্রিকার মালিক মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে, বাংলা ভাষার বিষয়ে যার কোনো জ্ঞান ছিল না। কমিটির সদস্যসচিব করা হয়েছিল কবি গোলাম মোস্তফাকে, তিনি তখন ছিলেন ফরিদপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি ছিলেন খুব ভালো কবি, কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানে তারও কোনো ব্যুৎপত্তি ছিল না। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মন্ত্রী ও লেখক হাবীবুল্লাহ বাহার, মন্ত্রী এ এম মালিক (একাত্তরে ইয়াহিয়া নিযুক্ত অধিকৃত বাংলাদেশের গভর্নর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (দিনাজপুর) মওলানা আবদুল্লাহ আলবাকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও দৈনিক আজাদ-এর সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, পুলিশের ডিআইজি সৈয়দ আবুল হাসনাত, মোহাম্মদ ইসমাইল, শিক্ষা বিভাগের উপসচিব মীজানুর রহমান, সিলেটের এমসি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এমাজউদ্দিন আহমদ, ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যক্ষ শাইখ শরফুদ্দীন, নওগাঁর ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যাপক আবুল কাসেম মোহাম্মদ আমুদ্দীন, চট্টগ্রাম আলাভিয়া প্রেসের মালিক জুলফিকার আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান গণেশচরণ বসু এবং ঢাকার জমিদার ও সমাজসেবক মোহিনী মোহন দাস। শহীদুল্লাহ ও গণেশ বসু ছাড়া কমিটির কোনো সদস্যের বাংলা ভাষাতত্ত্বে কোনো জ্ঞান ছিল না। তবে তাঁদের যা ছিল, তা হলো বাংলা ভাষাকে ইসলামি রূপ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। বাংলা ভাষা সংস্কারের জন্য গঠিত এই কমিটির সুপারিশ যারা করেছিলেন, তাঁদের আক্কেলের তারিফ করতে হয়।

অবশ্য পরে রাজশাহী কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান মুহম্মদ এনামুল হক এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজের বাংলার অধ্যাপক অজিত কুমার গুহকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরল-সোজা মানুষ গোলাম মোস্তফার কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন সম্ভব ছিল না, তাই তাঁকে বাদ দিয়ে শাইখ শরফুদ্দীনকে সদস্যসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকে বোঝা যায়, দুইজন হিন্দু সদস্য গণেশ বসু ও অজিত গুহের পক্ষে ওই ধরনের সাম্প্রদায়িক পরিবেশে কাজ করা সম্ভব ছিল না। তাই তাঁরা অপারগতা প্রকাশ করে কমিটির সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি নেন। ভাষা কমিটি সংখ্যালঘুদের মনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকবে। কারণ তারা দেখছিলেন, বাংলা ভাষা থেকে হিন্দু উপাদান বা লোকায়ত বাংলার উপাদান বাদ দিয়ে ইসলামি বা মুসলমানি উপাদান যোগ করাই হবে ওই কমিটির কাজ। মূল বিষয় বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার অপপ্রয়াস মাত্র। ওই অপপ্রয়াসে শহীদুল্লাহ ও এনামুল হকের মতো পণ্ডিতদের যুক্ত থাকা ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক। গণেশ বসু ও অজিত গুহের মতো তাঁরাও যদি কমিটি থেকে অব্যাহতি চাইতেন, সেটাই হতো উপযুক্ত কাজ। কিন্তু তারা যতটা না বিশ্বাস থেকে তার চেয়ে বেশি বিভ্রান্তি থেকে এবং সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। গণেশ বসু অব্যাহতি নিলে তার জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হরনাথ পালকে নেওয়া হয়।

পূর্ব বাংলার মানুষ চেয়েছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। সেই দিকেই সরকারের প্রাধান্য দেওয়ার কথা। কিন্তু তা না দিয়ে বাঙালির ভাষাকে ইসলামীকরণ, মুসলমানীকরণ, আরবি হরফে বাংলা লেখার সুপারিশ কিংবা রোমান হরফে বাংলা লেখার অপচেষ্টা চালাতে থাকে; যেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাংলা ভাষার সংস্কার করার জন্য।

আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে যেসব বাঙালি লেখক-শিক্ষাবিদ কেন্দ্রীয় সরকারের সুরে সুর মেলান, তাঁদের একজন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন। ১৯৪৯-এর ১৫ মার্চ, তিনি দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত এক লেখায় বলেন, ‘…আরবি হরফে বাংলা লেখা সম্ভব কি না সে প্রশ্নের আলোচনা আমরা করিব না; কারণ পূর্বেই বলিয়াছি যে, পূর্ব পাকিস্তানে এককালে আরবি হরফের প্রচলন ছিল এবং এখনও এলাকা বিশেষে ইহার প্রচলন রহিয়াছে। আরবি হরফে বাংলা লেখার অসুবিধার কথা যাহারা বলেন, তাহাদের যুক্তির অসাড়তা ইতিহাসই প্রমাণ করিয়া দিয়াছে। সপ্তদশ শতাব্দীর আলাওল যে বাংলা লিখিতেন উহাতে বেশ সংস্কৃত শব্দ ছিল। যদি আলাওলের পক্ষে সেই ভাষা আরবি হরফে লিখিতে কোনো অসুবিধা না হইয়া থাকে তবে এ যুগে নূতন করিয়া অসুবিধা হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নাই। [বশীর আলহেলাল, ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস, বাংলা একাডেমি,১৯৮৫, পৃ. ৬৩৩-৩৪]

সৈয়দ আলাওলের নিজের হাতের লেখা কোনো পাণ্ডুলিপি সাজ্জাদ হোসায়েন কোথাও দেখেছেন কি না তা তিনিই বলতে পারতেন, তবে তিনি বা তারও আগে আবদুল হাকিম এবং ওই সময়ের কবিরা নিশ্চয়ই বাংলা অক্ষরেই লিখেছেন। সেকালে মুসলমান কবিদের কেউ যদি আরবি হরফে বাংলা কবিতা লিখে থাকেন, এবং কেউ কেউ লিখেছেনও, সেটা তিন শ বছর পরে আবার বাংলা ভাষায় চালু করতে হবে, যখন বাংলা সাহিত্য বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি পেয়েছে, তা কোনো সুস্থ বা প্রকৃতিস্থ মানুষের পক্ষে ভাবা সম্ভব নয়। পাকিস্তান একশ্রেণির বাঙালি শিক্ষিত মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত করে দিয়েছিল। অল্পসল্প মাথা খারাপ নয়,বদ্ধ উন্মাদ করে দিয়েছিল একশ্রেণির বাঙালি মুসলমানকে। তবে তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য। সাধারণ মানুষ ওই সব অপতৎপরতাকে ঘৃণা করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন।

আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে ছিলেন যাঁরা, তাঁদের একজন সাংবাদিক সাহিত্যিক মুজিবর রহমান খাঁ। আবুল ফজলের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ১৯৪৯-এর ২ এপ্রিল, মুজিবর রহমান খাঁ বলেন :

‘মোছলেম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলনের দ্বারা আজ আমরা পাকিস্তান অর্জন করিয়াছি। আমাদের স্বাধীন পাকিস্তানের তমদ্দুন আন্দোলন হইবে আমাদের জাতীয় ভাবধারাকে সজীব করিয়া তোলার প্রয়াস। প্রথমত: জাতীয় পাকিস্তানি রাষ্ট্র ইহার অর্থ পাকিস্তানে এক রাষ্ট্রীয় ভাষা, এক রাজনৈতিক বন্ধন ও এক তমদ্দুন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাট ভৌগোলিক ব্যবধান রহিয়াছে; কিন্তু আমাদের পরস্পরের নিকটতম হওয়ার জন্য প্রয়োজন ঐক্য, মিলন, সংহতি এবং তমদ্দুনিক যোগাযোগ। ইহার জন্যই আরবি বর্ণমালা গ্রহণ প্রয়োজন।

‘বাঙ্গলা সাহিত্যে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিবঙ্গের মধ্যে একটি বিরোধ রহিয়াছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও মোছলেম লীগের বিরোধের ন্যায় বাংলাসাহিত্যেও মোছলমান ও হিন্দু সাহিত্যিকগণের মধ্যে একটা বিরোধ রহিয়াছে। …. বাঙ্গলা বর্ণমালা সংস্কৃত বর্ণমালার অপভ্রংশ এবং ইহা বহু ত্রুটিপূর্ণ। এজন্য বহু হিন্দু সাহিত্যিক ও পণ্ডিত বাঙ্গলা বর্ণমালাকে রোমান অক্ষরে রূপান্তরিত করিবার জন্য প্রস্তাব করিয়াছিলেন। সুসাহিত্যিক এবং ভারত সরকারের মন্ত্রী শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি নিজে প্রস্তাব করিয়াছেন বাংলা বর্ণমালাকে হিন্দি বর্ণমালায় রূপান্তরিত করিবার জন্য। যদি বাংলা বর্ণমালা হিন্দি বর্ণমালায় রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়, তবে বাংলা বর্ণমালা আরবিতে গ্রহণ করা কষ্টকর হইতে পারে না। …. সেই দিন নিকটবর্তী যেই দিন আরবি বর্ণমালায় বাংলা ভাষা এবং উর্দুর মিশ্রণে একটি মাত্র পাকিস্তানি ভাষার জন্ম হইবে।

‘হিন্দুস্থানের জাতীয়তাবোধ দৃঢ়তর করিবার জন্য হিন্দুস্থানি সরকার সমগ্র হিন্দুস্থানে এক ভাষা, এক বর্ণমালার নব হিন্দুস্থান গড়িতে অগ্রসর হইতেছে। আজ সমগ্র পাকিস্তানবাসী নিজেদের সাহিত্যকে আরবি অক্ষরে রূপান্তরিত করিতে চাহে। জাতি চাহে পর্বতের ন্যায় মজবুত ভিত্তিতে তাহাদের তমদ্দুনের প্রতিষ্ঠা। ইহাই জাতীয় আন্দোলন। আরবি অক্ষরে বাংলা বর্ণমালাকে রূপান্তরিত করিলে। বাংলাসাহিত্যের ক্ষতির তুলনায় লাভ হইবে শতগুণ বেশি।]

[আজাদ, ৯ এপ্রিল, ১৯৪৯]

এই জাতীয় লেখকের সততার পরিচয় পাওয়া যেত যদি তারা নিজেরা আরবি অক্ষরে বাংলা সাহিত্য রচনা করে দেখিয়ে দিতেন। তাঁরা সেই ব্যাপারে উপদেশ দিচ্ছেন যে বিষয়ের তারা চর্চা করেন না। তাঁদের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বাংলা সাহিত্যের লক্ষ কোটিগুণ ক্ষতি হতো।

০৪. আরবি, রোমান, বাংলা!

দীর্ঘ পরাধীনতার পর নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রটি কীভাবে গড়ে তোলা যায়, রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর কীভাবে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব, সে ব্যাপারে শিক্ষিত সমাজ আত্মনিয়োগ না করে, একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত ভাষাকে কীভাবে বিকৃত ও তছনছ করা যায়, তাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন একশ্রেণির উচ্চশিক্ষিত কবি-সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। যে সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ নিরক্ষর, যাদের দুই বেলা দু-মুঠো অন্নের সংস্থান করাই কঠিন, সেই সমাজে একটি নিতান্ত অনাবশ্যক ব্যাপারে মাথা ঘামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। তারা নিজেরা ছিলেন বিভ্রান্ত মানুষ, জনগণকেও বিভ্রান্ত করতে থাকেন।

যে ভাষার কবি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান, সে ভাষাভাষীর কোনো রকম হীনম্মন্যতা থাকার কথা নয়। সে ভাষার ভাব প্রকাশের ক্ষমতা অপার এবং তা যে লিপিতেই লেখা হোক, তা বৈজ্ঞানিক। বাংলার আগে যেসব ভাষার কবি-সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, সেগুলো হলো ফরাসি, জার্মান, নরওয়েজিয়ান, স্প্যানিশ, পোলিশ, ইতালিয়ান, ইংরেজি, সুইডিশ ও ডাচ। এসব ভাষার কাতারে স্থান পায় বাংলা। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও যে ভাষায় একজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র ও নজরুল ইসলাম আছেন, সে ভাষার মানুষের তো অহংকারের সীমা থাকার কথা নয়। সে ভাষার সংস্কার করা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই।

আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তন অথবা রোমান অক্ষরে বাংলা লেখার চিন্তা কারও মাথায় আসাটাই স্রেফ দুর্বুদ্ধি। ব্যক্তিবিশেষের দুর্বুদ্ধি হলেও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু যখন প্রস্তাবের পেছনে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি থাকে বা বিশেষ মতলব কাজ করে, তখন তা অতি নিন্দনীয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই নিন্দনীয় কাজটিই করেছেন একশ্রেণির প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিক এবং তাঁদের তাঁবেদার লেখক ও শিক্ষাবিদ।

পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হলেও তার একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক সত্তা ছিল-পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চল বা কেন্দ্র থেকে তা হাজার মাইল দূরে। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান বা সীমান্ত প্রদেশ পাশাপাশি ও অবিচ্ছেদ্য। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশও মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান ছিল এমন এক স্বতন্ত্র ভূখণ্ড, যার অধিবাসীদের ৯৯ ভাগ বাংলা ভাষায় কথা বলে। যে বাংলা ভাষার রয়েছে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। বাংলা সাহিত্য পৃথিবীর উন্নত সাহিত্যগুলোর একটি। বাংলা ভাষা বাঙালির গর্বের ধন। সে ভাষা নিয়ে ছেলেখেলা চলে না।

আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে একদিকে ছিল ধর্মীয় আবেগ (বরং বলা ভালো অর্থহীন ভাবাবেগ), অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতির খোঁড়া যুক্তি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১৫ মাসের মধ্যে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দেশের কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচিতে ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪৮। সম্মেলন উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। তিনি একজন বাঙালি। তিনি পাকিস্তানের শিক্ষাকে ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন এবং বাংলা। ভাষায় আরবি হরফ প্রচলনের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন, তার দ্বারা আঞ্চলিক ভাষাগুলির সংরক্ষণের কাজ সাধিত হবে। তা ছাড়া আরবি বর্ণমালা পাকিস্তানের। বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষাগত সামঞ্জস্য বিধানেও সহায়তা করবে।

[বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, দ্বিতীয় সংস্করণ, ঢাকা, ১৯৬৯, পৃ. ২৪৬]

শুধু একেবারে কথার কথানয়,মিশনারি উদ্দীপনানিয়ে শিক্ষামন্ত্রীশিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামীকরণ এবং বাংলা ভাষাকে আরবীকরণে অব্যাহত চেষ্টা চালাতে থাকেন। এবং তাঁকে সমর্থন করার মতো শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক বাংলার মাটিতে যথেষ্টই ছিলেন। দুই মাস পরে, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯, যখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন চলছে, তখন পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান শিক্ষা-উপদেষ্টা বোর্ডের দ্বিতীয় অধিবেশন। সেখানেও ফজলুর রহমান জাতীয় সংহতির যুক্তিতে আরবি হরফের পক্ষে ওকালতি করেন। দৈনিক আজাদে তাঁর ভাষণের যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তাতে তিনি বলেন, সহজে এবং দ্রুত যে হরফের মারফত ভাষা পড়া যায় সেই ভাষাই সবচাইতে ভালো। তিনি বলেন, কোন হরফটা ভালো তা। ঠিক করার পূর্বে একবার বিভিন্ন প্রদেশের হরফের বিচার প্রয়োজন। সিন্ধুর ভাষা হচ্ছে সিন্ধি, কিন্তু তার হরফ আরবি। পশ্চিম পাঞ্জাবের ভাষা উর্দু হলেও তার হরফ “নাস্তালিক”। সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের ভাষা পশতু হলেও হরফ বহুলাংশে আরবি। তার মতে,বাংলায় বহু সংযুক্ত অক্ষর এবং এর স্বরবর্ণের নানা চিহ্ন থাকায়। তা টাইপরাইটিং বা শর্টহ্যান্ডে ব্যবহার করা যায় না। আরবি হরফই সহজ। দ্রুত লিখন ও পঠনের পক্ষে সুবিধাজনক বলে আরবিকেই পাকিস্তানি ভাষার (বাংলাসহ) হরফ করা উচিত। আরবি হরফ প্রবর্তিত হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নিরক্ষরতা দূর করার পথ সহজ হবে।

আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে অকাট্য যুক্তিদানকারী মন্ত্রী মহোদয়কে যদি ওই সম্মেলনের কোনো শ্রোতা অনুরোধ করতেন যে আপনার বক্তৃতাটি আপনি আরবি অক্ষরে আমাদের লিখে দেন, তাহলে তিনি তা পারতেন কি? যা হোক, শুধু বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপও নেন। ১৯৫০ সালে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় পূর্ব বাংলার কয়েকটি জেলায় ১০টি কেন্দ্র খুলে সেখানে আরবি হরফে লেখা বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু হয়। সরকারি সূত্র জানায়, প্রত্যেক শিক্ষাকেন্দ্রে। ২৫ থেকে ৩৫ জন ছাত্র ৬ মাসের জন্য শিক্ষাগ্রহণ করতে আরম্ভ করেন। এই পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৪৯ সালে ৩৫ হাজার টাকা মঞ্জুর করে এবং ১৯৫০-এ তা বাড়িয়ে করা হয় ৬৭ হাজার ৭৬৪ টাকা। নতুন রাষ্ট্রে যেখানে অতি জরুরি ব্যাপারে অর্থের ছিল অভাব, সেখানে আরবি হরফে বাংলা লেখার জন্য এই অর্থের অপচয় ছিল অপরাধের শামিল। শিক্ষার্থীদের জন্য আরবি হরফে বাংলা ভাষার বইও ছাপা হয়েছিল। আরবি হরফে বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল।

[দ্রষ্টব্য : পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, পৃ. ২৫৭-৫৮]

আরবি প্রচলনের এই জোরজবরদস্তিমূলক চেষ্টার প্রতিবাদ করেছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটিরও একজন সদস্য ছিলেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, “উর্দু হরফের সাহায্যে বাংলা শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে অর্থ অপব্যয়ের কী মানে থাকতে পারে? আশ্চর্যের কথা,এর সঙ্গে পূর্ববঙ্গ সরকারের কোনো সম্পর্ক নাই। এই অর্বাচীন ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার এক লক্ষ টাকা ব্যয় করবেন। আমার আশঙ্কা হয় এটা বন্ধ না করা হলে সরকারি টাকার অপব্যয় করা হবে।

[ একই সূত্র, পৃ. ২৫৭-৫৮]

সরকারকে সমর্থন দেওয়ার মতো মানুষও ছিলেন পূর্ব বাংলায় অনেক। ১৯৪৯ সালের ২ এপ্রিল, চট্টগ্রামে ‘কেন্দ্রীয় সাহিত্য পরিষদ বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের বিষয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। আবুল ফজলের সভাপতিত্বে সেই অনুষ্ঠানে আজাদ সম্পাদক মুজিবর রহমান খাঁ বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক বিরাট ভৌগোলিক ব্যবধান রহিয়াছে, … আমাদের পরস্পরের নিকটতম হওয়ার জন্য প্রয়োজন ঐক্য, মিলন, সংহতি এবং তমদ্দুনিক যোগাযোগ। ইহার জন্যই আরবী বর্ণমালা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

[আজাদ, ৮ এপ্রিল ১৯৪৯]

নৈতিক বল থাকলে সরকারি চাকরি করেও স্বাধীন মতামত দেওয়া সম্ভব। সেই বিভ্রান্তির সময় সরকারি কলেজের শিক্ষক মোহাম্মদ ফেরদাউস খান The Language Problem of Today শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। ভাষাতত্ত্ব তার বিষয় নয়, তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। তিনি তাঁর ওই পুস্তিকায়, যা প্রকাশিত হয় জানুয়ারি ১৯৪৯-এ, বলেছিলেন, আরবি ও রোমান অক্ষরের চেয়ে বাংলা শ্রেষ্ঠ।

ফেরদাউস খানের এই মতামত সরকারি নেতা ও গোয়েন্দা বিভাগের লোকদের দৃষ্টিতে পড়ে। সরকারের বাইরের আরবিপন্থীদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার মধ্যে একজন বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আবুল কাসেম। তিনি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান এবং শিক্ষাসচিব এফ এ করিম ফেরদাউস খানের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর ভাষায়,’জনাব এফ এ করিম তার দফতরে আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই তিনি কিছুটা রুষ্ট স্বরে বললেন, “আপনি দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করছেন। পাকিস্তান সরকার বাঙলা ভাষার জন্য আরবি হরফ চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন আর আপনার পুস্তকটি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল ব্যবহার করছে।” আমি জবাব দিলাম, হরফ সমস্যার উপর যে তাত্ত্বিক গবেষণা আমি চালিয়েছিলাম বইটিতে তা-ই লিপিবদ্ধ করেছি। কোনো রকম রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তাতে নেই। আমাকে বিদায় দেওয়ার আগে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমাদের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী, যিনি বাঙলাভাষী তিনি নিজেও আরবী হরফ গ্রহণের সুপারিশ করে যাচ্ছেন। আপনার সাবধান থাকা উচিত। আমার ভয় হচ্ছিল, কারণ তিনি আমার জবাবদিহি দাবি করবেন। তিনি তেমন কিছুই করলেন না বরং Farsight ছদ্মনামে The Script Question শীর্ষক একটি পুস্তিকা রচনা করে আমার যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করলেন।

[মোহাম্মদ ফেরদাউস খান, জীবনের ঘাটে ঘাটে, ২০০১, পৃ. ৮৬-৮৭]

এর কিছুদিন পর ১৭ অক্টোবর ১৯৪৯, শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল রহমান চট্টগ্রাম সফরের সময় সার্কিট হাউসে ফেরদাউস খানকে দেখা করতে বলেন। তিনি লিখেছেন, আমি বুঝেছিলাম তিনি কী বলতে চান। আলাপের শুরুতেই তিনি বললেন, “হরফ সম্পর্কিত আপনার লেখাটা আমি পড়েছি, তবে আমি আপনার সাথে একমত নই।” আরবী হরফের পক্ষে তিনি তার যুক্তি পেশ করলেন, আমি আমার মন্তব্য তুলে ধরলাম, রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত আমাদের আলোচনা চলছিল তবে কোনো সময়ই তিনি উম্মা প্রকাশ করেননি। বিদায়ের সময় আমাকে বললেন, “দেখা যাচ্ছে এ বিষয়ে আমরা একমত হতে পারছি না, তবে আপনাকে একটা। অনুরোধ জানাব কীভাবে আরবী হরফ বাঙলার জন্য গ্রহণ করা যায়, সে সম্পর্কে আমাকে লিখে জানাবেন।” আমি জবাব দিয়েছিলাম তা জানাব,তবে শর্ত থাকবে যে এই ব্যাপারে আমার নাম যেন জড়ানো না হয়। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তাকে লিখে জানিয়ে দিলাম আর সেটি পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন এবং আমাকে কেন্দ্রীয় সরকারের কয়েকটি শিক্ষা কমিটিতে সদস্য করে নিয়েছিলেন।

[একই সূত্র, পৃ. ৮৭]

নৈতিক মনোবল ও সৎ-সাহস থাকলে কাউকে খুব বেশি সাহসী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সেদিন প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদেরা যে সাহসের অথবা দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে পারেননি, একজন তরুণ প্রভাষক তা দিয়েছেন। সেদিন যদি আরবিপন্থীদের প্রতিহত করা না যেত, তাহলে আজ আমাকে এই রচনাটাও লিখতে হতো আরবি হরফে অথবা উর্দুতে।

আরবি হরফপন্থীরা কখনো আশা ছেড়ে দেননি। এমনকি বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তপাতের পরেও তাঁদের অপতৎপরতা অব্যাহত থাকে। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়ে আসেন মালিক ফিরোজ খান নূন। তিনি ছিলেন পাঞ্জাবের অধিবাসী এবং মানুষ হিসেবেও অপেক্ষাকৃত সজ্জন ছিলেন, তবে বাঙালি জাতি সম্পর্কে তাঁর বিশেষ ধারণা ছিল না। তাঁর পত্নী ভিকারুন নিসা নূন বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। ফিরোজ খান নূনও আশা পোষণ করতেন যে আরবি অক্ষরে বাংলা লিখলে ভালোই হয়। কিন্তু বাংলায় গভর্নর থাকা অবস্থায় তিনি সমালোচনার মুখে পড়বেন এই ভয়ে বিশেষ কিছু বলেননি। বরং পরিস্থিতি আঁচ করে ঢাকায় বলেন, একটি জাতির উপর কোনো ভাষাই চাপাইয়া দেওয়া যায় না।… জোর করিয়া আরবী হরফ প্রবর্তন ভ্রমাত্মক হইবে।’

[ সংবাদ, ১৩ চৈত্র ১৩৫৯]

তাঁর স্বদেশে ফিরে গিয়েই তিনি সুর পাল্টান। লাহোরে গিয়ে তিনি যা বলেন, তা ছিল আর এক চাল। বাঙালীরা যদি আরবী হরফে বাংলা লিখিতে রাজী থাকেন, তাহা হইলে বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইলেও তাহার আপত্তি থাকিবে না।

[আজাদ, ১৬ চৈত্র ১৩৫৯]

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলা ভাষার শতকরা ৯০টি শব্দই ফারসি, উর্দু ও আরবি, এমনকি পাঞ্জাবি ভাষা হতে উদ্ভূত।’

তার এই প্রবল পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ হওয়া উচিত ছিল বাঙালি পণ্ডিতদের থেকে। তা কেউ না করলেও বাংলা ভাষার একজন তরুণ শিক্ষক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রতিবাদ করেন তাঁর এক নিবন্ধে। তিনি বলেন, আমরা জনাব নূন ও তার পেটোয়াদের চ্যালেঞ্জ করছি যে, কোনো মুসলমান ও বিদ্বান বাংলা লেখকের রচনা থেকে অন্তত দশ ভাগ আরবী, ফারসী শব্দ বার করে দিতে। [সাপ্তাহিক যুগের দাবী, ১১ এপ্রিল ১৯৫৩]। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রভাষক। তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘নূন সাহেবের এই অপচেষ্টার সহায়ক হচ্ছে কতকগুলি বিশ্বাসঘাতক ও এঁটো পাতাভোজী মীরজাফর ও মুষ্টিমেয় কয়েকজন ধর্মান্ধ অথচ কাণ্ডজ্ঞানহীন লোক।

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে একাত্তরে পাকিস্তানি আলবদর বাহিনীর হাতে শাহাদাতবরণ করতে হয়।

০৫. সাহিত্যপুরস্কার

অনেক উন্নত দেশেই সাহিত্য একাডেমি, একাডেমি অব লেটার্স, একাডেমি অব সায়েন্সেস প্রভৃতি রয়েছে। সেগুলো সেসব দেশের কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান সরকার শিল্প-সাহিত্যের উন্নয়নের লক্ষ্যে লেখক-বিজ্ঞানী-বুদ্ধিজীবীদের জন্য ওই জাতীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৫৪-র সাধারণ নির্বাচনের আগে এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট যে ২১ দফা অঙ্গীকার করে, তার ১৬ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল : ‘যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।

উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলা একাডেমির পুরোনো যে তিনতলা ভবন, যার নাম ‘বর্ধমান হাউস’, সেটি ছিল পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর (তখন বলা হতো প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী) সরকারি বাসভবন। তিনতলাটি তখন ছিল না। ওটি করা হয়েছে আশির দশকে, যখন ভবনটির সংস্কার করা হয়। ওটি মোটেই কোনো বিলাসবহুল বাড়ি নয়; কিন্তু রাজনীতির স্বার্থে বিরোধী নেতারা সেটাকেই ‘বিলাসের বাড়ি’ আখ্যা। দেন। যা হোক, যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ১৯৫৬ র ডিসেম্বরে যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার বাংলা একাডেমি উদ্বোধন করেন। ওই বছর একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন যৌথভাবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ও শহীদ বরকতের মা।

একালে অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হবে, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নেই; জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের দ্বারাই এটি প্রতিষ্ঠিত। বিশেষ করে, তখনকার প্রধান বিরোধী দল বাঙালি জাতীয়তাবাদী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অবদান সবচেয়ে বেশি। তার সঙ্গে ছিলেন বাম-প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর নেতারা।

বাঙালি জাতীয়তাবাদী যুক্তফ্রন্টের উত্থানে মুসলিম জাতীয়তাবাদী ওরফে পাকিস্তানবাদীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য মহফিল’ নামের একটি সংগঠন ১৯৫৮-র মে মাসে চার-দিনব্যাপী একটি সাহিত্য-সম্মেলনের আয়োজন করে চট্টগ্রামে। তার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন। ওই সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন জনৈক মৌলভী আবদুর রহমান এবং সম্পাদক মৌলভী নূরুল ইসলাম চৌধুরী।

[সাঈদ-উর রহমান, পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পৃ. ৪২-৪৬]

পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী যুক্তফ্রন্টের অভ্যুদয় ও প্রভাব বিস্তারের ফলে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পাকিস্তানি আদর্শ দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং বৃহত্তর বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির আদর্শের প্রসার ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তা থেকে জাতিকে রক্ষা করার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন ও শিল্পী জয়নুল আবেদিন বিভিন্ন অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এক প্রস্তাবে বাংলা একাডেমির মাধ্যমে উপযুক্ত সাহিত্য গ্রন্থের জন্য প্রতিবছর পুরস্কার প্রবর্তনের দাবি জানানো হয়।

বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রবর্তনের দাবিরক্ষণশীল ও মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের থেকে হলেও ওই দাবি বাস্তবায়নে উপকৃত হয়েছেন আধুনিক কবি-সাহিত্যিকেরাই বেশি। ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রবর্তিত হয়। তখন মুহাম্মদ এনামুল হক ছিলেন পরিচালক। সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ছয়টি শাখায় পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিটি শাখায় দুই হাজার টাকা ছিল পুরস্কারের মান। এ জন্য বাংলা একাডেমিকে ১২ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। সেকালের বাজারদর। হিসেবে দুই হাজার টাকা সামান্য নয়। ওই টাকায় ৩০ ভরি সোনা অথবা ১৩৫ মণ চাল কেনা যেত। প্রথম বছর কবিতায় ফররুখ আহমদ, ছোটগল্পে আবুল মনসুর আহমদ, নাটকে আশকার ইবনে শাইখ ও প্রবন্ধে মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ পুরস্কার পান। উপন্যাসে এমন একজন পুরস্কার পান, যাঁকে বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরা চিনতেন না। তার নাম আবুল হাসেম খান। কেন তিনি পুরস্কার পেয়েছিলেন, তা বোধগম্য নয়। শিশুসাহিত্যে পুরস্কার পেয়েছিলেন খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন ও গবেষণায় আবদুল্লাহেল কাফী।

বাংলা একাডেমি পুরস্কার শুরুতেই অসন্তোষ ও বিতর্কের জন্ম দেয়। জসীমউদ্‌দীন সংগত কারণেই ক্ষুব্ধ হন। একাডেমি থেকে বলা হয়েছিল তিনি পুরস্কারের উর্ধ্বে, কিন্তু যুক্তিটি সমর্থনযোগ্য ছিল না। আরও বলা হয়েছিল তাঁর বয়স বেশি, অপেক্ষাকৃত তরুণদেরই এ পুরস্কার প্রাপ্য। এ যুক্তিও একেবারেই খোঁড়া। আবুল মনসুর আহমদ ও মোহাম্মদ বরকতউল্লাহর বয়স ছিল তার চেয়ে বেশি। জসীমউদ্‌দীন বাংলা একাডেমির ওপর সেই যে ক্ষুব্ধ হলেন, আমৃত্যু তাঁর সেই ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। তিনি বাংলা একাডেমিকে তার কোনো বই বা রচনাবলি প্রকাশের অনুমতি দেননি।

১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান কবিতায় আহসান হাবীব,উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,ছোটগল্পে মবিনউদ্দীন আহমদ,নাটকে নূরুল মোমেন,গবেষণায় মুহম্মদ আবদুল হাই ও শিশুসাহিত্যে হোসনে আরা। ১৯৬২-তে পেয়েছেন কবিতায় সুফিয়া কামাল, উপন্যাসে আবুল ফজল, ছোটগল্পে শওকত ওসমান, নাটকে মুনীর চৌধুরী, প্রবন্ধে আকবর আলী ও শিশুসাহিত্যে বন্দে আলী মিয়া। ১৯৭১ পর্যন্ত দেখা যায়, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তিতে প্রগতিশীল শিবিরের প্রায় কেউই বাদ যাননি। এবং প্রবীণ ও তরুণ মিলিয়েই দেওয়া হতো। প্রবীণদের মধ্যে পেয়েছেন। মুহাম্মদ এনামুল হক (১৯৬৪), মাহবুব-উল আলম (১৯৬৫), কাজী মোতাহার হোসেন (১৯৬৬), আ ন ম বজলুর রশীদ (১৯৬৭) প্রমুখ। অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে শামসুদ্দীন আবুল কালাম (১৯৬৪), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৬৫), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৬৬), সৈয়দ আলী আহসান ও আবদুল গাফফার চৌধুরী (১৯৬৭), আল মাহমুদ ও শওকত আলী (১৯৬৮), শামসুর রাহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও নীলিমা ইব্রাহীম (১৯৬৯), সত্যেন সেন, হাসান আজিজুল হক ও আনিসুজ্জামান (১৯৭০) এবং হাসান হাফিজুর রহমান, জহির রায়হান, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (১৯৭১) প্রমুখ।

ষাটের দশকে মাত্র একটি-দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে এমন অনেকে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। যত দিন জীবিত ছিলেন, ষাটের দশকের সব পুরস্কার মনোনয়ন কমিটির প্রধান ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ইসলাম, মুসলমান, পাকিস্তান,কায়েদে আজম প্রভৃতি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো, তবে সাধারণ বিষয়ের মানসম্মত বইয়ের লেখকেরাও পুরস্কার পেয়েছেন। একটি উপন্যাস সূর্য দীর্ঘল বাড়ী লিখেই আবু ইসহাক পুরস্কার পান (১৯৬৩)। আনিসুজ্জামানের দুটি গবেষণামূলক বই বেরিয়েছিল স্বাধীনতার আগে, দুটিই মুসলমানদের নিয়ে, তা হলো মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪) এবং মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯)। শওকত আলী ও হাসান আজিজুল হকও একটি-দুটি বই প্রকাশ করেই পুরস্কার পান। অপেক্ষাকৃত তরুণ ও আধুনিকদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।

বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়ার পেছনে যে সরকারি নীতির প্রভাব ছিল, তা বোঝা যায় একটি ঘটনায়। ষাটের দশকে বদরুদ্দীন উমরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারটি বই প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানি শাসনামলের সাম্প্রদায়িক পরিবেশে তাঁর বইগুলোর ভূমিকা ছিল অসামান্য। বইগুলো হলো সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬),সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭), সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৮) এবং পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তঙ্কালীন রাজনীতি (১৯৭০)। ষাটের দশকে স্বায়ত্তশাসনের জন্য উত্তাল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে বদরুদ্দীন উমরের এই গ্রন্থগুলো ছিল অসামান্য প্রেরণা। আজ বাংলাদেশ ভাষাসৈনিকে ভরে গেছে, একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিরোমন্থনে ক্লান্তি নেই একদল ভাষা আন্দোলন ব্যবসায়ীর এবং তাদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। অথচ বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত তাঁরা কী ভূমিকা পালন করেছেন, তার কোনো রেকর্ড নেই। বদরুদ্দীন উমরের পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তকালীন রাজনীতি প্রকাশের পর ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণার দিগন্ত উন্মুক্ত হয়। তিনি ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণার পথিকৃৎ।

চারটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশের পরও বাংলা একাডেমি অথবা অন্য কোনো পুরস্কার কমিটির দৃষ্টি এড়িয়ে যান তিনি। এখন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটি উচ্চারণ না করে যারা দিন শুরু করেন না, একাত্তরের আগে তারা ওই শব্দ এড়িয়ে যেতেন। বদরুদ্দীন উমরের মতো একজন পণ্ডিত যদি ইসলাম ও মুসলমান বা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ নিয়ে একখানা বই লিখতেন, ষাটের দশকে তিনিও একাধিক পুরস্কার পেতেন। ১৯৭২ সালে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়; কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। উপযুক্ত কাজটিই তিনি করেছিলেন। তিনি অবিচল প্রতিষ্ঠানবিরোধী।

পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ-কৃষক, শ্রমিক, ছোট চাকুরে, স্কুলশিক্ষক, তাঁতি, কামার, কুমার, জেলে প্রভৃতি শোষণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু সরকারের সঙ্গে সদ্ভাব ছিল যেসব কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পীর, তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ যা-ই হোক, তারা রাষ্ট্রীয় পদক-পুরস্কার যথেষ্টই পেয়েছেন। তারা সরকারি আনুকূল্যে অথবা সরকারি ডেলিগেশনের সদস্য হয়ে শুধু পশ্চিম পাকিস্তান নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। অধ্যাপক-লেখকেরা পাঠ্যপুস্তক লিখে উপার্জন করেছেন প্রচুর। পাঠ্যপুস্তক রচনায় মুনীর চৌধুরী ছিলেন শীর্ষে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বাংলা অনেকগুলো পাঠ্য সংকলনের তিনি সম্পাদক।

আইয়ুব সরকারের সাংস্কৃতিক নীতির যারা রচয়িতা ছিলেন, তাঁদের দু’একজন বাদে সবাই ছিলেন অবাঙালি উর্দুভাষী। তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন উচচপদস্থ সরকারি আমলা। তারা অনেকে পাকিস্তানে এসেছিলেন ভারতের পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশের সংস্কৃতিবান পরিবার থেকে। সংগীত, শিল্পকর্ম, সাহিত্যের কদর তারা বুঝতেন। তাঁরা উঠতি বাঙালি কবি-সাহিত্যিক শিল্পীদের পদক-পুরস্কার দিয়ে মর্যাদা দিতে চাইতেন। সেই সুযোগের ষোলো আনা সদ্ব্যবহার করেছেন পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা।

পুরস্কারের ক্ষেত্রে ষাটের দশক ছিল বাঙালি কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্য স্বর্ণকাল। শুধু বাংলা একাডেমি পুরস্কার নয়, সরকারি আনুকূল্যে প্রবর্তিত হয়েছিল আরও কয়েকটি মর্যাদাবান পুরস্কার, যেমন আদমজী পুরস্কার, দাউদ পুরস্কার, ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তান পুরস্কার, জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা পুরস্কার, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান পুরস্কার, ইউনেসকো সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতি। এসব পুরস্কারের কারণে উন্নতমানের সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা পান লেখকেরা।

০৬. ভাষার প্রশ্নে বাহাস

অত্যন্ত অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বাংলা ভাষা নিয়ে অনাবশ্যক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ করা টাকার সদ্ব্যবহার করার মতো লেখক-শিক্ষাবিদ পূর্ব বাংলায় যথেষ্টই ছিলেন। অবশ্য একই সঙ্গে বিভিন্ন অপপ্রয়াসের বিরোধিতাও করেছেন কেউ কেউ। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি তাদের ভাষার সংস্কার করেছেন সময়ের প্রয়োজনে। ভাষার লিপিও পরিবর্তন করা হয়েছে। আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুর্কি ভাষার লিপি পরিবর্তন করে রোমান হরফ চালু করেন। ভাষা মালয় ও ভাষা ইন্দোনেশিয়ায় রোমান হরফ প্রবর্তন করা হয়েছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ভাষা বাংলার মতো সমৃদ্ধ ছিল না। ওগুলো ছিল উপজাতীয় ভাষার মতো, ছিল না কোনো মানসম্মত সাহিত্য। বাংলা ভাষার ঐতিহ্য হাজার বছরেরও বেশি সময়ের এবং বাংলা ভাষায় সমৃদ্ধ সাহিত্য রচিত হয়েছে ৫০০ বছরের বেশি সময় যাবৎ। বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তনের চিন্তাটাই ছিল অনাবশ্যক এবং চরম আত্মঘাতী।

বাংলা ভাষা আরবি অথবা রোমান হরফে লিখলে পূর্ব বাংলার বাংলা সাহিত্য অন্য দেশের বাংলা সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত যে তা-ই নয়, অতীতের বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে রচিত হতো দূরত্ব। সে এমন এক দূরত্ব, যা বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যকেই ক্ষতি করে দিত এবং সে ক্ষতি হতো অপূরণীয়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশ দখল করে ইংরেজদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর বিদেশি শাসকেরা বাংলাসহ ভারতীয় ভাষার হরফ পরিবর্তন করে ইংরেজি বা রোমান অক্ষরে লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। আঠারো শতকের শেষ দিকে স্যার উইলিয়াম জোন্সসহ প্রধান প্রধান ইংরেজ’ কর্মকর্তা ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখার উদ্যোগ নেন। তাদের সে উদ্যোগ ইংরেজদেরই অনেকে সমর্থন করেননি। তবে তখন তার শক্ত বিরোধিতা করারও তেমন কেউ ছিলেন না। পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা চাইলে বাংলা দেশে ইংরেজি চালু করতে পারতেন। কিন্তু তার পরিবর্তে ইংরেজ প্রশাসনের লোকেরাই বাংলা শেখেন এবং খ্রিষ্টান ধর্মযাজকেরা বাংলা গদ্যের বিকাশে ভূমিকা রাখেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কেউ কেউ রোমান হরফে বাংলা লেখার পক্ষে যুক্তি দেন যে বাংলা ভাষায় যুক্তাক্ষর বেশি, যা টাইপরাইটারে লিখতে অসুবিধা এবং রোমান হরফ বাংলার চেয়ে দ্রুত পড়া ও লেখা সম্ভব। আর যে যুক্তিটি দেওয়া হয় তা হলো, রোমান হরফে বাংলা বিদেশিদের পক্ষে শেখা সহজ হবে ইত্যাদি। এসব যুক্তি খণ্ডন করে মোহাম্মদ ফেরদাউস খান তাঁর ‘The Language Problem of Today’ এবং পরে একটি প্রবন্ধে বলেন যে, চীন ও জাপানের শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নতির পথে তাদের জটিল লিপি কোনো বাধা হয়নি। তিনি আরও বলেন, বাংলা যুক্তাক্ষর কোনো সমস্যা নয়।

[মোহাম্মদ ফেরদাউস খান, ‘হরফ সমস্যা’, বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, প্রথম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, ১৩৬৪]

সুখের কথা যে পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা কমিটি ১৯৪৯ সালে যে সমীক্ষা চালায়, তাতে ৩০১ জন উত্তরদাতার মাত্র ১৮ জন রোমান হরফের পক্ষে মত দেন এবং বাংলা অক্ষর বজায় রাখার পক্ষে মত দেন ১৮৭ জন। তবে যদি আরও বেশি বা অধিকাংশ উত্তরদাতাই রোমান হরফের পক্ষে মত দিতেন, তাহলেই কি লিপি পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য হতো?

প্রায় ১০ বছর ধরে অল্পবিস্তর রোমান ও আরবি হরফ চালুর বিষয়টি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আলোচিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা কমিশন ১৯৫৭-তে বয়স্কদের শিক্ষা কার্যক্রমে রোমান হরফ ব্যবহারের প্রস্তাব করেছিল। ব্যাপারটি হাস্যকর। বয়স্করা বাংলা ভাষা পড়বেন এক অক্ষরে আর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়বে অন্য হরফে, তার পেছনে কোনো যুক্তি ছিল কি?

পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে, সামরিক শাসন জারির আগেই, রোমান অক্ষর প্রচলনের আয়োজনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ধ্বনিতত্ত্ববিদ মুহম্মদ আবদুল হাই তার এক প্রবন্ধে বাংলার পক্ষে লেখেন :

‘সম্প্রতি রোমান হরফে বাংলা লিখবার একটা ধুয়া উঠেছে। কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ রোমান হরফে বাংলা লেখা প্রচলন করবার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। …যদি বাংলা লিপিতে বাংলাভাষা লেখার কোনো ব্যবস্থা না থাকত কিংবা আজই যদি প্রথমবারের মতো বাংলাভাষা লেখার উপায় উদ্ভাবন আমাদের শিক্ষাবিদদের করতে হতো তা হলে শুধু রোমান কেন, জীবজন্তুর ছবির সাহায্যে কিংবা আরবি অক্ষরেও বাংলা লিখবার সোপারেশ তারা করতে পারতেন। ..কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য বলতে পারি না, গত হাজার বছর ধরে বাংলা লিপিতে বাংলাভাষা লেখা হয়ে আসছে। ফলে বাংলা লিপি বাংলাভাষার ধ্বনির বাহক হিসেবে ক্রমে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। …এখানে বাংলা লিপির বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব এই যে তা অত্যন্ত ধ্বনিভিত্তিক।’ [মুহম্মদ আবদুল হাই, ‘রোমান বনাম বাংলা হরফ, (সমকাল), ২য় বর্ষ, ৮ম সংখ্যা, এপ্রিল ১৯৫৯]

দেশের প্রধান ধ্বনিতাত্ত্বিক অধ্যাপক হাই তাঁর প্রবন্ধে আরও বলেন, ‘…বাংলা হরফ বর্জন করে একেবারে রোমান হরফ গ্রহণ করবার যারা সুপারিশ করেছেন তারা দেশজোড়া Confusion-এর কথা ভেবে দেখেছেন কি? বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বিচার করলে রোমান হরফের তুলনায় বাংলা হরফ যে অনেক বেশী বৈজ্ঞানিক তা সহজেই প্রতিপন্ন হয়। তার কারণ প্রত্যেকটি ধ্বনির জন্য বাংলায় একটি হরফ আছে। “ক” লিখলে “ক” ধ্বনি ছাড়া আর অন্য কিছু উচ্চারণ আমরা করি না এবং কোনো জায়গায় “ক” অনুচ্চারিতও থাকে না। … বাংলা অক্ষর শুধু যে ধ্বনিমূলক (Phonetic) তা নয়, তার চেয়েও এর বড় সুবিধা হলো এই যে, এর স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ একটি করে অক্ষর বা syllable-কে ধারণ করে রয়েছে। …ফলে একটি হরফের সাহায্যে বাংলায় একটি পূর্ণ অক্ষর বা syllable প্রকাশ করা সম্ভব হয়।

বিশিষ্ট ধ্বনিতাত্ত্বিক ও ভাষাবিজ্ঞানী আরও বলেন, বাংলাভাষার ধ্বনিবোধক বাংলা প্রতিলিপি ব্যবহারে এমন “econom” রোমানে তো দূরের কথা পাক ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে অন্য কোনো লিপিতে আছে কিনা সন্দেহ। তা ছাড়া বাংলার যুক্তাক্ষরগুলো ধ্বনির প্রতিলিপি হিসেবে লিপি ব্যবহারের economy-র দিক থেকে বিস্ময়কর শৃঙ্খলাজাত এবং আশ্চর্য রকমের বিজ্ঞানভিত্তিক।

বাংলা ভাষার এত উপযোগিতা ও বাংলা একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ভাষা হওয়া সত্ত্বেও কেন তা সংস্কারের প্রশ্ন ওঠে এবং সমর্থন করেন বাংলাভাষী শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা, তার পেছনে শাসকশ্রেণির যে দুরভিসন্ধি ছিল, তা যেকোনো সাধারণ বুদ্ধির মানুষও উপলব্ধি করতে পারে। মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে পাকিস্তানীকরণ ও ইসলামীকরণ। ১৯৪৯-এর মার্চে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নেতৃত্বে গঠিত পূর্ববঙ্গ ভাষা কমিটিতে যারা ছিলেন, তাঁরা সবাই ছিলেন রক্ষণশীল ও পাকিস্তানবাদী। ওই কমিটিতে নামেমাত্র রাখা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক গণেশচন্দ্র বসু ও ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিক মোহিনী মোহন দাসকে। ওই কমিটিতে থাকতে গণেশচন্দ্র অস্বস্তিবোধ করেন। তিনি অব্যাহতি চাইলে তার জায়গায় বাংলা বিভাগেরই প্রভাষক হরনাথ পালকে নেওয়া হয়। কমিটির অন্যদের সঙ্গে পালও ছিলেন বেমানান। তিনিও কিছুদিন পর অপারগতা প্রকাশ করেন। তখন একজন হিন্দুকে রাখা প্রয়োজন, তাই জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক অজিত কুমার গুহকে তার জায়গায় যুক্ত করা হয়।

মোহিনী মোহন দাস ছিলেন অতি ভালো মানুষ এবং অসাম্প্রদায়িক। মুসলমানদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে আগ্রার আধ্যাত্মিক সাধক হজরত সেলিম চিশতির নাতি চিশতি বেহেশতির মাজার জরাজীর্ণ হয়ে গেলে মোহিনী দাস তা সংস্কার করে পুনর্নির্মাণ করেন। তাঁকে রাখা হয়েছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে। বছরখানেকের মধ্যে তিনি মারা গেলে তাঁর জায়গায় অম্বিকাঁচরণ দাস নামের একজন শিক্ষা কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে ভাষা-সংস্কৃতির কমিটিতে সংখ্যালঘুদের মতামতের কোনো মূল্যই ছিল না। পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যে কোনো মূল্য নেই, তা ভাষাকে কেন্দ্র করে সরকারের আচরণেই স্পষ্ট হয়ে যায়।

যা হোক, রোমান হরফে বাংলা লেখা কারা সমর্থন করেন, সে সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নেয়। সে মতামত জরিপ করা হয় প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে। যেমন প্রশ্ন : পাকিস্তানে (বাংলা ও উর্দু ভাষাতে রোমান হরফ আপনি অনুমোদন করেন কি? এই প্রশ্নের উত্তরে মুহাম্মদ এনামুল হক লিখিত জবাব দেন:

‘ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে এ প্রস্তাব অযৌক্তিক এবং জাতি হিসেবে পাকিস্তানীদের জন্যে এ আত্মঘাতী। এ প্রস্তাব গ্রহণ করলে আমরা লাভবান হবো যৎসামান্য কিন্তু জাতির উন্নতির সহায়ক এমন অনেক কিছুই আমরা হারাবো।

কেন রোমান অক্ষর প্রচলন হবে আত্মঘাতী ও অযৌক্তিক, তার ব্যাখ্যায়। এনামুল হক বলেন :

‘(ক) পাকিস্তানের মত রাষ্ট্রে যেখানে বহুসংখ্যক ধর্ম, ভাষা এবং হরফ বিদ্যমান তার জাতীয় ঐক্যের কথা চিন্তা করা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু তা অবাস্তব। বর্তমান পৃথিবীর বহুধর্মাবলম্বী এবং বহুভাষাভাষী রাষ্ট্রগুলি আজ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে যে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকদের সমন্বয়ে এক রাষ্ট্র বা এক জাতি গড়ে তোলা সম্ভব। পক্ষান্তরে এক ধর্মাবলম্বী এবং এক ভাষাভাষী লোকেরাও পৃথক পৃথক রাষ্ট্রের নাগরিক। (খ) কোনো বিশেষ হরফ বহুভাষাভাষী কোনো রাষ্ট্রে ভাষাগত ঐক্য আনতে পারে না। ভাষা না জানলে শুধু শুনে অথবা কোনো বিশেষ হরফে পড়ে তা কারো বোধগম্য হবে না। একই হরফে দুটি বা তারও বেশী ভাষা লেখা হলে, তা পড়তে পারলেও ভাষাজ্ঞান না থাকলে কারো ভাষাগত বুৎপত্তি কিছুমাত্র বাড়বে না। … (ঙ) মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলি রোমান। হরফ গ্রহণ না করলে, ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান তা করতে পারে না, করা উচিতও নয়।’

[সমকাল, এপ্রিল ১৯৫৯]

এনামুল হক পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শের বিরোধী ছিলেন না। যেকোনো সাধারণ বুদ্ধির মানুষই এনামুল হকের এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এক যুগ বাংলা ভাষার ‘সংস্কারে’র নামে এ জাতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। শুধু কেন্দ্রের অবাঙালি সরকার যদি এই সংস্কারের মতলব করত, তাহলে ছিল এক কথা, বাংলা ভাষা আরবি হরফে বা রোমান অক্ষরে লেখার বুদ্ধি বহু বাঙালি বুদ্ধিজীবীরও মস্তিষ্কপ্রসূত। বাঙালি শিক্ষিত সমাজের একটি গোত্র চিরকাল শাসকশ্রেণির অন্ধ অনুগত হিসেবে সহযোগিতা দিয়ে এসেছে। শাসকদের অন্যায্য তৎপরতার বিরোধিতা না করে সহযোগিতা করেছে জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে। তবে যারা সরকারের সহযোগী ছিলেন না, অরাজনৈতিক ভাবাপন্ন কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক শিক্ষাবিদ, তাঁরাও বাঙালি সংস্কৃতির স্বার্থবিরোধী অপতৎপরতায় সাবলীলভাবে বিরোধিতা করেননি। বাংলা ভাষা নিয়ে যখন সূক্ষ্ম ও স্থূল দুই রকম ষড়যন্ত্রই চলছিল, তখন প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

দুটি কারণে রোমান হরফে বা আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার পরিকল্পনাকে উৎসাহিত করা হয়। এক. বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরণ এবং দুই. পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে যেন পূর্ব বাংলার সাহিত্যের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় কারণটি ছিল রাজনৈতিক এবং প্রথমটি ছিল ধর্মীয়। সমর্থন ছিল বহু বাঙালি লেখক ও বুদ্ধিজীবীর।

 ০৭. সেপ্টেম্বর যুদ্ধ : বাঙালি কবি-সাহিত্যিক

এক

কোনো দেশের লেখক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তির সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটে যুদ্ধবিগ্রহ অথবা ওই রকম কোনো দুর্যোগ বা বড় ঘটনার সময়। ১৯৬৫-র সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৭ দিন এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যখন যুদ্ধ বাধে, তখন দলমত-নির্বিশেষে দেশরক্ষাটাই সবার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, কেউই বৈদেশিক শক্তির পক্ষ নিতে পারে না। নিলে তাকে বলা হবে দেশদ্রোহী, যা সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পঁয়ষট্টির পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময়ও বিরোধী দলের নেতারা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের সরকারের পাশে থাকেন। তাঁর আহ্বানে সবাই তাকে সমর্থন দেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা ভাসানী, আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, সুফিয়া কামাল, আবুল হাশিমসহ প্রায় সব প্রধান কবি-সাহিত্যিক সরকারকে নৈতিক সমর্থন দেন।

আইয়ুব-মোনায়েম ছিলেন শেখ মুজিবের প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তারা যখন সব রাজনৈতিক নেতাদের একটি বৈঠকের আমন্ত্রণ জানান তাতেও সবাই যোগ দেন। মওলানা ভাসানী সভা-সমাবেশ নিয়ে ঢাকার বাইরে ব্যস্ত থাকায় ওই বৈঠকে অংশ নিতে পারেননি, শেখ মুজিব যোগ দিয়েছিলেন। দলীয় নেতাদের থেকে জানা যায়, মোনায়েমের সঙ্গে বসতে ভাসানী অনিচ্ছুক ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রাইব্যুনালের কাছে শেখ মুজিব তাঁর জবানবন্দিতে বলেছিলেন :

‘১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে যে সকল রাজনীতিবিদ ভারতীয় আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন আমি তাঁহাদের অন্যতম। সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পূর্ণভাবে সমর্থন করার জন্য আমি আমার দল ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই।… যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে আমি প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করি এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও সাহায্য করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই। যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রদেশ ভ্রমণকালে আমি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ আমন্ত্রিত হইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি।’

[বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড]

তাসখন্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ১৭ দিন পর যুদ্ধ থেমে গেলেও পাকিস্তানের পত্রপত্রিকা ও রেডিওতে ভারতবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত থাকে অনেক দিন। সে অস্বাভাবিক নয়। ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধের পর বহু বছর চীনের বিরুদ্ধে ভারতীয় পত্রপত্রিকা অব্যাহত লিখেছে। দেশ পত্রিকায় লেখা হতো ‘ড্রাগনের দাঁতে বিষ’ শিরোনামে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে শান্তি স্থাপন করেন। কিন্তু পাকিস্তানের কবি সাহিত্যিকেরা এমন গল্প-কবিতা-নাটক-প্রবন্ধ প্রভৃতি লিখতে থাকেন, যাতে শুধু ভারতের সমালোচনা নয়, প্রকাশ পায় সাম্প্রদায়িকতা– যেন যুদ্ধটা হয়েছে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে। হিন্দুবিরোধী লেখা লিখে পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিকেরা কেন্দ্রীয় সরকারের আনুকূল্য পেয়েছেন অনেক দিন। আইয়ুব খান বাঙালি কবি সাহিত্যিকদের পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রণাঙ্গন ঘুরে এসে হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছিলেন তাঁর সফরনামা সীমান্ত শিবিরে, যা দৈনিক পাকিস্তানে (পরে দৈনিক বাংলা) ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। আইয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে ঘুরিয়ে দেখতে যাদের নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ উচ্ছ্বসিত সফরনামা লিখেছেন।

রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে তখন একটি রম্য অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো, যা শ্রোতারা উপভোগ করলেও তাতে প্রচারিত হতো হিন্দুবিদ্বেষ। প্রবাসী হিন্দুদের সব সম্পত্তি সরকার অধিগ্রহণ করে এবং তাঁর নাম দেওয়া হয় ‘শত্রুসম্পত্তি’, যে আইনের অভিশাপ থেকে হিন্দুরা আজও মুক্তি পাননি। হিন্দু লেখকদের মুসলমান ও ইসলামবিরোধী রচনার অংশবিশেষ রেডিও থেকে সম্প্রচারিত হতো, যদিও যুদ্ধটা মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের ছিল না, ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের। হিংটিংছট’ অনুষ্ঠানে গুরু-শিষ্যের সংলাপে সম্প্রচারিত হতো জীবন্তিকা। তাতে অংশ নিতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য যা-ই হোক, তার মান খারাপ ছিল না। চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে একটি পুঁথিপাঠের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো, পাঠ করতেন বেলাল মোহাম্মদ।

যুদ্ধ-পরবর্তী কয়েক মাসে প্রধান কবিদের অনেকেই বহু দেশাত্মবোধক গান লেখেন, যা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। যেমন ফররুখ আহমদ জিন্নাহকে স্মরণ করে লিখেছিলেন :

তুমি চেয়েছিলে মুক্ত স্বদেশ ভূমি
তুমি চেয়েছিলে এ বিরান মাঠে
ফসলের মৌসুমী।

শামসুর রাহমানের একটি গান একসময় খুবই গীত হতো :

কালের সে তিমিরে দিল কে আলোর পায়রা
কার সে আভাসে এসেছে আলোর পায়রা।
মহিমার ইংগিত জানা নেই।
পঙ্কিল পথে যেতে মানা নেই,
জানি তবু বাতাসে ভেসেছে
আলোর পায়রা।

আহসান হাবীবের একটি গান এ রকম :

নতুন স্বপ্ন সুষমা জড়ানো
আমরা এনেছি নতুন দিন।
আমরা এনেছি নব জীবনের
নতুন প্রভাত রাঙা রঙিন ॥
আমরা এনেছি নতুন আকাশে নীল বিথার
বেঁধেছি নতুন সুরে জীবনের ছিন্ন তার,
নব গৌরবে জাগে নতুন ফসল নয়া জমীন।

যুদ্ধের সময় আহসান হাবীব লিখেছিলেন সৈনিকদের উদ্দেশে :

দুর্গম এ যাত্রা পথের
কোনো বাঁধা মানবো না
না না না।

আহসান হাবীব গীতিকার ছিলেন না। কিন্তু তখন বেশ কিছু গান লিখেছেন। তাঁর আরেকটি গান :

এলো রে ভয়ের পাখায় পাড়ি দেবার দিন
এলো রে,
জীবনে এলো আবার নতুন জোয়ার
নতুন ভোরে।

তালিম হোসেন লিখেছিলেন বেশ কিছু গান, যেমন–

না, না, না, দুশমনকে দেব না ছুঁতে সীমানা
সইব না সইব না দানবের হানা–।

সিকান্দার আবু জাফর লিখেছিলেন :

নয় নয় আমাদের কোনো সংশয় নয়
আমাদের কারো চোখে মৃত্যুর ভয় নয়।

শামসুর রাহমানের একটি গান ছিল এ রকম :

আজ নয় দ্বিধা, আজ নয় কোনো শোক,
অগ্নিশপথে জ্বলে অগুনিত চোখ?
শুধতেই হবে মাতৃভূমির ঋণ।

যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৬ সেপ্টেম্বর। যুদ্ধ নিয়ে অনেক কথাশিল্পী গল্পও লিখেছেন, কাব্যনাট্য লিখেছেন, কবিতা-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে প্রচুর। সৈয়দ শামসুল হকের একটি গল্পের নামই ‘৬ই সেপ্টেম্বর’– তাতে তিনি ওই দিনের মানুষের অনুভূতি তুলে ধরেছেন। তখন তাঁর গদ্যের ভাষা ছিল অপেক্ষাকৃত কম অলংকারবহুল ও সরল। গল্পটির আরম্ভ এ রকম :

‘জাতির জীবনে দুর্যোগ আসে অভিশাপ হিসেবে নয়, অগ্নিপরীক্ষার পরম মুহূর্ত হিসেবে। সে মুহূর্ত বারবার আসে না, কিন্তু তার স্মৃতি সর্বমুহূর্তের। নব নব উপলব্ধি আর উদ্বোধনে সে স্মৃতিচারণ জাতীয় জীবনে অমূল্য হয়ে থাকে।

‘সেপ্টেম্বরের ছ’ তারিখ-সোমবার-ঢাকা। এটা ছিল নির্মল ঝরঝরে দিন। রোদ ছিল-গ্রীষ্মের তাপ ছিল বাতাসে। দু’এক টুকরো সাদা মেঘ, তাছাড়া আকাশ ছিল নীল। স্কুল-কলেজে বেরিয়ে পড়েছে ছেলেমেয়েরা। অফিস আদালত বসেছে। দোকানপাট খুলে গেছে। স্টেশনে ট্রেন এসেছে। সদরঘাটে দূর গ্রাম থেকে মোটর লঞ্চ বয়ে নিয়ে এসেছে যাত্রী। বাস চলেছে রৌদ্র-ঝলসিত পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানীতে কর্মের চাঞ্চল্য। জীবনের স্পন্দন অনুভব করা যাচ্ছিল যে কোনো দিনের মতো সেদিনও-সেপ্টেম্বরের ছ’ তারিখ।

‘কেবল একটি ব্যতিক্রম। সকালে দশটায় খবর পাওয়া গেল, পিআইএ-র যে বিমান করাচী থেকে ঢাকা আসছিল, তা করাচীতে ফিরে গেছে। ভারতের ওপর দিয়ে পিআইএ-র বিমান চলাচল নিষিদ্ধ হয়ে গেছে আজ সকাল থেকে। আকস্মিক অপ্রত্যাশিত এই ছোট খবরের পেছনে যে কি গুরুতর কারণ লুকিয়ে ছিল, ঢাকার মানুষ তখনও তা জানতে পারেনি।

‘সেদিন করাচী থেকে পিআইএ-র বিমানে যারা ঢাকা আসছিলেন, তাদের মধ্যে সদ্য বিদেশ প্রত্যাগত একজন ছাত্রও ছিলেন। তার বৃদ্ধ পিতা পিআইএ-র অফিসে টেলিফোন করে বিমান না আসার অশুভ সংবাদ পেলেন। দীর্ঘ দু’বছর পরে ফিরে আসছে তাঁর ছেলে। সেদিন তিনি অতি ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে নিজে বাজারে গিয়েছিলেন, ছেলের জন্য বিশেষ রান্না হবে-তার সওদা করতে। তার মন শংকিত হয়ে উঠল। দিশেহারা হয়ে তিনি টেলিফোন করলেন এক দৈনিক পত্রিকার দফতরে। যা শুনলেন –তা তাঁকে স্তম্ভিত-হতবাক করে দিল। ভারত বিনা যুদ্ধ ঘোষণায় আজ ভোরে লাহোরে আক্রমণ করেছে। ওয়াজিরাবাদে একটি দাঁড়ানো যাত্রীবাহী রেলগাড়ির ওপর ভারতীয় বিমান বোমা বর্ষণ করেছে। পত্রিকা দফতর থেকে আরও জানা গেল, প্রেসিডেন্ট আজ দুপুর দেড়টায় জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দিচ্ছেন।

‘স্নেহপরায়ণ পিতা, যারা বাৎসল্য ভরা চোখ তাকিয়েছিল পুত্রের আগমন পথের দিকে, সেই চোখে জ্বলে উঠল আগুন। ভারতের এ আক্রমণ-পৃথিবীর ইতিহাসে এক তুলনাহীন চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতার নজির।…

‘ততক্ষণে সারা শহরে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এই সংবাদ। ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে জাতি। কি দুঃসাহস এই পররাজ্য লোভী হিংস্র বর্বর ভারতের। একে একে হায়দ্রাবাদ, জুনাগড়, মানভাদার, গোয়া দখল করে কাশ্মীরের জনসাধারণের প্রতি দেয়া ওয়াদা খেলাফ করে পায়ের নিচে তাদের পিষে মারবার ঘৃণ্য আয়োজন করেও ক্ষুধা মেটেনি ভারতের। সে এখন পাকিস্তানের পবিত্র ভূমিতে তার নখর বিদ্ধ করেছে। দুপুর দেড়টার অনেক আগে থেকেই যেখানে যত রেডিও সেট ছিল, সবগুলো ঘিরে দাঁড়াল মানুষ। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে-ক্রোধ প্রশমিত করে-হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে রেডিও সেটের চারপাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে পথচারী, কুলি, মজুর, ব্যবসায়ী, কেরানি, অফিসার, ছাত্র, শিক্ষক। যে যে কাজে আছে, সব এই মুহূর্তে তুচ্ছ হয়ে গেছে। কান পেতে রয়েছে কখন প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন।

‘বেজে উঠল জাতীয় সঙ্গীত। জনতা দাঁড়ালো আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে। যারা তখনও এসে পৌঁছুতে পারেনি-তারা দ্রুত পায়ে বাড়িয়ে তুলল ভীড়। পথের মোড়ে মোড়ে পান দোকানের সেটের চারপাশে পঞ্চাশ একশ-দু’শ করে তোক দাঁড়িয়ে আছে। অফিসে সেদিন অফিসারের কামরায় তিল ধারণের জায়গা নেই। বাড়িতে বাড়িতে রান্না ফেলে মা-বোনেরা হলুদ মাখা হাতে রেডিও সেটের সামনে এসেছে। যে ছোট ছেলেটা খেলা ছাড়া আর কিছু বোঝেনা-সেও বড়দের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে উৎকর্ণ হয়ে। প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ শোনা গেল—”আমার প্রিয় দেশবাসী, আজ দশ কোটি পাকিস্তানির জন্য অগ্নিপরীক্ষার সময় এসেছে।” জনতা শুনল পাকিস্তানের ওপরে ভারতের অতর্কিত আক্রমণের কথা। মুহূর্তে রচিত হয়ে গেল জ্বলন্ত ইতিহাস-যখন প্রেসিডেন্ট বললেন, “লাহোরের নির্ভীক বীর জনসাধারণ সর্বপ্রথম শত্রু মোকাবিলা করার সুযোগ পেয়েছে। শত্রুদের চরম আঘাত হানতে পেরেছে বলে ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম অমর হয়ে থাকবে। আর তার পরমুহূর্তেই প্রেসিডেন্ট উচ্চারণ করলেন, “পাকিস্তানের দশ কোটি মানুষের হৃদয়ে ‘লা-ইলাহা-ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, এই ধ্বনি স্পন্দিত। ভারতের কামান চিরতরে স্তব্ধ না করা পর্যন্ত দশ কোটি পাকিস্তানি বিশ্রাম গ্রহণ করবে না।”

‘৬ই সেপ্টেম্বর ঠিক প্রথাগত গল্প নয়– আলেখ্যবিশেষ। বর্ণনায় বাস্তব প্রতিফলিত হয়েছে। পাক্ষিক এলান-এ প্রকাশিত সৈয়দ শামসুল হক রচনাটি শেষ করেছেন এভাবে :

‘প্রেসিডেন্টের ভাষণ শেষে আবার বেজে উঠল জাতীয় সঙ্গীত। জনতা তখনও অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ নতুন দৃপ্ত, মহীয়ান মনে হচ্ছে, এই সুর। তাঁর প্রতিটি ধ্বনি যেন ডাক দিচ্ছে-”জাগো জাগো জাগো।” বলছে “এগিয়ে যাও, আমি তোমার স্বদেশ, আমি তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, আমাকে রক্ষা করো, শত্রুকে আঘাত হানো।” জাতীয় সঙ্গীতের শেষ ধ্বনি বাতাসে মিলিয়ে গেল। ধীরে ধীরে জনতা চলতে লাগল। ফিরে গেল যে যার কাজে, যে যার গন্তব্যের দিকে। আকাশে প্রখর রৌদ্র, তাদের পদক্ষেপে প্রতিজ্ঞার ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে। আমরা সে দিন বিশ্বের এক মহান দৃশ্য দেখেছি। আমরা দেখেছি, যে জনতা রেডিওর চারপাশে ভীড় করে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের এক আশ্চর্য রূপান্তর। এক কঠিন স্বাজাত্য চেতনা, স্বদেশ প্রেরণা আর দুর্জয় সাহস তাদের প্রত্যেককে উন্নততর একেকটি সজীব মানুষে পরিণত করে দিয়ে গেছে ৬ সেপ্টেম্বর।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে লেখকেরা এ জাতীয় লেখাকে অস্বীকার করেন অথবা গোপন করে যান। কলকাতা সফরে গিয়ে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন কে কত বেশি ভারতপ্রেমিক ও অসাম্প্রদায়িক ছিলেন।

দুই

পঁয়ষট্টিতে যুদ্ধটা বেধেছিল পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে, রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন দুই দেশের সব বাহিনীর সদস্যরা, পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতায় ছিলেন দুই দেশের রাজনৈতিক নেতা ও কূটনীতিকেরা। কোনো মৃত ব্যক্তি কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। ওই যুদ্ধের পুরো দুই যুগ আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গত হন। তাঁর পরলোকগমনের ছয় বছর পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের নাগরিক। সাতচল্লিশ-পূর্ব উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের যেকোনো কিছুর অভিন্ন উত্তরাধিকারী ভারত ও পাকিস্তান। লালন শাহ হোন বা আবদুল লতিফ ভিটাই হোন, কিংবা গালিব, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, নজরুল দুই রাষ্ট্রেরই সম্পদ। দুই দেশেরই উর্দুভাষীদের প্রিয় কবি গালিব ও ইকবাল এবং উপমহাদেশের বাংলাভাষীদের পরম প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। এ নিয়ে কোনো রকম প্রশ্ন তোলাই, বিশেষ করে তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে বিবাদ করা নিতান্তই মূর্খ।

ভারতের আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথের গান যত সম্প্রচারিত হতো, সে তুলনায় রেডিও পাকিস্তান ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কেন্দ্র থেকে কম হতো। তবে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা ও অন্যান্য কেন্দ্র থেকে সকালে ও সন্ধ্যায় রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশিত হতো। পঞ্চাশের দশকে বিলকিস নাসিরুদ্দিন, মালেকা আজিম খান, আফসারী খানম, ফরিদা বারী মালিক প্রমুখ রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ষাটের দশকে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন আরও অনেকে– নারী ও পুরুষ শিল্পী। সাধারণত যিনি সকালে গাইতেন তিনিই সন্ধ্যায়ও রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করতেন। যুদ্ধের সময় অলিখিতভাবে সরকার নির্দেশ দেয় রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন বন্ধ করতে। বিষয়টি সে রকমভাবে কেউ খেয়াল করেনি বা করলেও তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন বোধ করেনি। যুদ্ধের মতো জরুরি অবস্থায় অনেক কিছুই মানুষ মেনে নেয়। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরও যখন কয়েক মাস রবীন্দ্রসংগীত সম্প্রচার বন্ধ থাকে, তখন সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে বিষয়টি আলোচ্য হয়ে ওঠে। এর মধ্যে আসে পঁচিশে বৈশাখ, সেদিন খুব সামান্য রবীন্দ্রসংগীত ঢাকা, চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত হয়, কিন্তু সেটাও শাসকশ্রেণির বিরক্তির কারণ ঘটায়। ১৯৬৭ র জুনে বিরোধী দলের সদস্যের প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন জাতীয় পরিষদে বলেন, পাকিস্তানের কালচারাল ভ্যালুজের বা পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী রবীন্দ্রনাথের গান রেডিওতে সম্প্রচারিত হবে না। তিনি সেই সঙ্গে এ কথাও যোগ করেন যে শুধু রবীন্দ্রসংগীত নয়, যেকোনো গান, যা পাকিস্তানের নীতি-আদর্শের পরিপন্থী, তা প্রচার বন্ধ থাকবে। কেন্দ্রের যোগাযোগমন্ত্রী খান আবদুস সবুর খানও ওই ধরনের মন্তব্য করেন।

শুধু পাকিস্তানের নয়, যেকোনো রাষ্ট্রেরই আদর্শের পরিপন্থী কোনো কিছুই সে দেশের সরকারি প্রচারযন্ত্র থেকে প্রচারিত হবে না, সেটা সাধারণ বুদ্ধির কথা। ভারত রাষ্ট্রের আদর্শের পরিপন্থী কোনো কিছু আকাশবাণী থেকে যদি সম্প্রচারিত না হয়, তাতে ভারত সরকার ও আকাশবাণী কর্তৃপক্ষকে দোষ দেওয়া যায় না। আকাশবাণী থেকে নজরুলের হামদ্-নাত্ নয়, কীর্তন ও শ্যামাসংগীতই প্রচারিত হতো, তাতে বলার কী থাকতে পারে। এদিকে পাকিস্তান রেডিও থেকে শ্যামাসংগীত নয়, নজরুলের ইসলামি গান ও হামদ-নাত পরিবেশিত হতো, তা নিয়ে বাগবিতণ্ডা করা অর্থহীন। পাকিস্তান-ভারত বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে টানাটানি ছিল পাকিস্তানের নেতাদের নির্বুদ্ধিতা ও গভীরতম সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রকাশ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমনকি ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বিপুল রবীন্দ্রসাহিত্যের কোথাও একটি শব্দও নেই। বরং তাঁর হিন্দুসমাজে তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।

সরকারি বেতারে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার সীমিতকরণ বা বন্ধের সংবাদে সবচেয়ে ক্ষুব্ধ হন জসীমউদ্‌দীন। তিনি কমলাপুরে তার ‘পলাশবাড়ীতে আমন্ত্রণ জানিয়ে কয়েকজন প্রবীণ লেখক-বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের মধ্যে বিজ্ঞানী মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদাও ছিলেন। ড. খুদাও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা করে জসীমউদ্‌দীন এক বিবৃতিতে বলেন :

‘…রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষীদের নাড়ির বন্ধন। কোনো সরকারি আইনের সহায়তায় সে বন্ধন ছিন্ন করা যাবে না। পূর্ব বাংলার বেতার থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার বন্ধ হলে জনগণ রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য আকাশবাণী শুনবে।’

লক্ষ করার বিষয়, প্রথাগত বিবৃতির চেয়ে জসীমউদ্‌দীনের এই বিবৃতির বক্তব্য ছিল কিছুটা ভিন্ন। অল্প কথায় সরকারকে ঘায়েল করা হয় এবং সরকারি নীতিনির্ধারকদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া হয় যে তোমাদের রেডিও কেউ শুনবে না, তার পরিবর্তে তোমাদের শত্রু ভারতের বেতারই বাংলাদেশের মানুষ শুনবে এবং সে শোনা তোমরা বন্ধ করতে পারবে না।

একই দিনে ১৮ জন কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রসংগীত প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে এক বিবৃতি দেন। তারা বলেন :

‘…রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সঙ্গীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষ্ণতা দান করেছে, তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। সরকারি নীতিনির্ধারণের সময় এই সত্যের গুরুত্বকে মর্যাদা দান করা অপরিহার্য।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা, কাজী মোতাহার হোসেন, সুফিয়া কামাল, জয়নুল আবেদিন, এম এ বারী, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, খান সারওয়ার মুরশিদ, সিকান্দার আবু জাফর, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।

বক্তব্যটি এসেছিল যেহেতু মন্ত্রী বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মুখ থেকে, শাহাবুদ্দীন ছিলেন একজন মুসলিম লীগের নেতা, তাই অন্যান্য দলের রাজনৈতিক নেতাদের থেকেই প্রতিক্রিয়া আসা উচিত ছিল। কিন্তু বাঙালি রাজনৈতিক নেতারা নিশুপ রইলেন, যার অর্থ মৌনতাসূচক সম্মতি। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে। দলের নেতাদের মধ্যে যারা বাইরে ছিলেন, তাঁদের কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রস্টেট অপারেশন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেন, রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ওপর আঘাত। রোগশয্যা থেকে তিনি এক বিবৃতিতে বলেন: তথ্যমন্ত্রী শাহাবুদ্দীন ঘোষণা করেছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত ইসলাম ও পাকিস্তানের ঐতিহ্যপরিপন্থী বিধায় আর বেতার ও টেলিভিশন মারফত পরিবেশিত হবে না। কিছুদিন পূর্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সবুর খানও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনুরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তাঁদের এই বক্তব্য পাকিস্তান সরকারের মনোভাবের প্রকাশ কিনা, ইহাই সরকারের নিকট আমার জিজ্ঞাস্য।

‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্য-সাহিত্য, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস ও সঙ্গীতের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে নতুন গৌরবে অভিষিক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের অবদান সার্বজনীন। ইসলাম সত্য ও সুন্দরের ঘোষণা করেছে। এই সত্য ও সুন্দরের। পতাকাকে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই, যারা ইসলামের নামে রবীন্দ্রনাথের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছেন তারা আসলে ইসলামের সত্য ও সুন্দরের নীতিতে বিশ্বাসী নন। তাই আমি এই দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের এই প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’

[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৮ জুন ১৯৬৭]

১৮ লেখক-কবি-শিক্ষাবিদের বিবৃতি এবং ভাসানীর বিবৃতির পরই ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, মোহাম্মদ মোহর আলীসহ পাঁচজন অধ্যাপক এক বিবৃতিতে বলেন, তাঁদের ওই বিবৃতিতে ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে এবং তা পাকিস্তানবিরোধী প্রচারে ব্যবহৃত হতে পারে। তারা বলেন, ‘বিবৃতির ভাষায় এই ধারণা জন্মে যে, স্বাক্ষরকারীরা বাংলাভাষী পাকিস্তানি ও বাংলাভাষী ভারতীয়দের সংস্কৃতির মধ্যে সত্যিকারের কোনো পার্থক্য রয়েছে বলে স্বীকার করেন না। বাংলাভাষী-পাকিস্তানিদের সংস্কৃতি সম্পর্কে এই ধারণার সঙ্গে আমরা একমত নই।’

[দৈনিক পাকিস্তান, ২৯ জুন ১৯৬৭]

সরকারি নীতির সমর্থনে আরও ৪০ জন কবি-সাহিত্যিকের বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তাতে তাঁরা বলেন, রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই উক্তির প্রতিবাদ করতে আমরা বাধ্য এই কারণে যে, এই উক্তি স্বীকার করে নিলে পাকিস্তানি ও ভারতীয় সংস্কৃতি যে এক ও অবিচ্ছেদ্য এ কথাই মেনে নেয়া হয়।

ওই বিবৃতিতে যে ৪০ জনের স্বাক্ষর ছিল, পরবর্তীকালে জানা গেছে, তাদের সবাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সই করেননি, কেউ করছেন অনুরোধে, কেউ চাকরি বাকরি রক্ষার স্বার্থে চাপে পড়ে। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে প্রভাবশালী ছিলেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁ, বিচারপতি আবদুল মওদুদ, মুজিবর রহমান খা, কবি বেনজীর আহমদ, কবি ফররুখ আহমদ, কবি আহসান হাবীব, কাজী দীন মোহাম্মদ, আ ন ম বজলুর রশীদ, আশরাফ সিদ্দিকী, হাসান জামান প্রমুখ। বিবৃতি প্রকাশের পরদিন আহসান হাবীব, তিনি তখন প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এর সাহিত্য সম্পাদক, তার এক ভায়রা জিয়াউল হকের কমলাপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আমি সেখানে ছিলাম। তিনি খুবই বিব্রত বোধ করেন। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মাত্র দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। তার একটির লেখক ছিলেন অনিলচন্দ্র ঘোষ এবং অন্যটির আ ন ম বজলুর রশীদ। তাঁর রবীন্দ্রসংগীত বিরোধিতার কারণ থাকতে পারে না। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রধারার একজন কবি ও রবীন্দ্রপ্রেমিক। তখন তিনি ছিলেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের বাংলা সাহিত্যের প্রফেসর। স্বাক্ষর না করে সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি ছিলেন একজন সরল-সজ্জন প্রকৃতির মানুষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রকাশিত হয় বজলুর রশীদের জীবনবাদী রবীন্দ্রনাথ নামের একটি বড় বই।

খুব বড় প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব ছাড়া সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। পূর্ব বাংলায় ব্যবহারিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথিকৃৎ মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের বা সায়েন্স ল্যাবরেটরিজের পূর্বাঞ্চলের পরিচালক ছিলেন। সরকারি বাংলা উন্নয়ন বোর্ডেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে তাঁর ভূমিকা ছিল শক্ত। তাঁর পুত্রবধূ খালেদা মঞ্জুর-ই-খুদা ছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলসংগীত শিল্পী। সেকালে শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রায় কেউই সৎসাহসের পরিচয় দিতে পারেননি। সেদিক থেকে আমরা ব্যতিক্রম দেখেছি রাজনীতিবিদ ও ইসলামি চিন্তাবিদ আবুল হাশিম, তাঁর পুত্র বদরুদ্দীন উমর এবং Islamic Culture and Philosophy শীর্ষক অসামান্য গ্রন্থের লেখক দর্শনতত্ত্ববিদ অধ্যক্ষ সাইঁদুর রহমানকে। অধ্যক্ষ সাইঁদুর রহমান প্রকাশ্যেই সিন্ধু হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি কায়ানির মতো হাস্যরস করে আইয়ুব সরকারের সমালোচনা করতেন। অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি কথা উল্লেখ করতে হয়। বাম প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের নানাভাবে সাহায্য করতেন তিনি। ন্যাপের এলিফ্যান্ট রোডের অফিস নির্মাণের সময় শুধু নগদ অর্থ নয়, ঠিকাদারদের থেকে ইট-সিমেন্ট জোগাড় করে দিয়েছেন অধ্যক্ষ সাইঁদুর রহমান এবং ডাক্তার এম এ ওয়াদুদ। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরাও তাদের আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হননি। স্বৈরশাসনের সময় সেটা কম সৎসাহসের কাজ নয়।

রবীন্দ্রসংগীতের বিরোধিতায় যারা সরকারকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাঁদের নানাভাবে কটাক্ষ করে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে। তাতে তাদের কেউ কেউ কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলার মতো সাহস তাদের ছিল না। বাঙালি লেখক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটি শ্রেণির নিজেদের অধিকতর প্রগতিশীল বলে জাহির করার একটি প্রবণতা রয়েছে। গত ৪৫ বছরে রবীন্দ্রবিরোধিতার প্রসঙ্গটি অব্যাহত উচ্চারিত হচ্ছে।

তিন

পাঞ্জাবের শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ধারণা ছিল, পাকিস্তানের জন্য দরদ শুধু তাঁদেরই; বিশেষ করে জনসংখ্যার দিক থেকে রাষ্ট্রের বৃহত্তর অংশ পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের ভালোবাসা দেশের জন্য বিশেষ নেই; তারা ভুলে থাকতে চাইতেন যে সত্য তা হলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জনগণের ভোটে এবং সেই ভোটারের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাঙালি মুসলমান। শুধু মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং পাঞ্জাবি রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের কৃতিত্ব নয়। তাই পাকিস্তানি শাসকেরা গভীর দেশপ্রেম থেকে একাত্তরে গণহত্যা ঘটিয়ে ‘অ দেশপ্রেমিক’ বাঙালিদের রক্তে সয়লাব করেন বাংলার পলিমাটি। পাকিস্তানের অসামরিক নেতা ও বীর জেনারেলদের প্রয়োজন ছিল মাটির– মানুষ নয়।

পাকিস্তানের সেনাপতিদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, তারা গ্রিক আলেকজান্ডার এবং মঙ্গলীয় দিগ্‌বিজয়ী চেঙ্গিস খাঁর চেয়ে বড় বীর। তাদের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এমন শক্তি কোনো দেশের নেই। যুদ্ধ ছিল তাদের কাছে প্রিয় জিনিস। ভারতের সঙ্গে ১৯৪৭-এ জন্মলগ্নেই একবার যুদ্ধ হয়ে গেছে। নতুন রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক উন্নতি ও জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের বিষয়টিই প্রাধান্য পাওয়ার কথা, যুদ্ধবিগ্রহ করে শক্তি ক্ষয় উন্নয়নের পথে বড় বাধা। কয়েক মাস ধরেই দুই দেশের প্রস্তুতি বা । পাঁয়তারা চলছিল। শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান না করে বাধিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধ। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫। সত্যি সত্যি কে কাকে প্রথম আক্রমণ করে, তা কোনো দেশের ভাষ্য থেকেই জানা যাবে না, বিধাতা বলতে পারেন।

কোনো দেশ আক্রান্ত হলে অথবা নিজেই যুদ্ধ বাধিয়ে দিলে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য সরকারকে সহযোগিতা বা সমর্থন দেওয়া। পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত না হলেও পূর্ব বাংলার মানুষও বিপন্ন বোধ করে এবং সরকারের পাশে থাকে। বাঙালি লেখক-সাংবাদিক-শিক্ষাবিদ সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা দেবেন। সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তাঁদের ভাষা এবং সাম্প্রদায়িক শাসকশ্রেণির নেতাদের ভাষা একই রকম হবে, সেটা স্বাভাবিক নয়। যুদ্ধ নিয়ে সব দেশেই কবি-সাহিত্যিকেরা লেখালেখি করেন। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে মহৎ সাহিত্য রচিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়, ১৯৬২-তে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরা প্রচুর লিখেছেন। কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় একটি লেখার শিরোনাম ছিল “ড্রাগনের দাঁতে বিষ’, বহুদিন আমরা সেটা পড়েছি।

যুদ্ধ হয়েছিল ১৭ দিন। দৈনিক পাকিস্তান-এর সহকারী সম্পাদক কবি হাসান হাফিজুর রহমান ‘এ মুহূর্তে লেখকবর্গ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছিলেন :

‘পবিত্র মাতৃভূমি রক্ষার সংগ্রামে শরীক হওয়া মাত্রই আমাদের লেখকবৃন্দও এক মহান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হয়ে উঠলেন। জাতির বীর্যবত্তা এবং অমিত তেজ আমাদের চেতনায় আন্দাজ মাত্র ছিল, সে ত এখন বাস্তবে সত্য হয়ে উঠল, জ্বলন্ত নিদর্শন রূপে দীপ্ত দৃষ্ট হয়ে উঠল। আর সেই সঙ্গে প্রবহমান সুপ্রাচীন শৌর্যের অন্তর শক্তি যা আমরা ধারণ করছি বলে একটা সুপ্ত আশ্বাস মাত্র ছিল, তা বর্তমানের প্রগাঢ় উদ্দীপনায় প্রবল বিশ্বাসে পরিণত হল, পরীক্ষিত হতে উত্তীর্ণ হয়ে উঠল আমাদের মনে।…

‘আমাদের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনে তাই এই উদ্দীপ্ত বর্তমান মহত্তম ঘটনা। এতে আমরা আমাদের অন্তর্জগৎ দেখেছি, আমাদের সম্প্রসারণের পূর্ণতার ব্যাপ্তিও দেখেছি। প্রথমত আমরা জানতে পেলাম আমাদের প্রতিরোধ শক্তি অজেয়। দ্বিতীয়ত ন্যায় ও নীতির জন্য আমাদের ত্যাগের মজ্জাগত শক্তি রয়েছে। নির্যাতিতের সপক্ষে দাঁড়াবার সাহস আমাদেরকে যে কোন বিপদের সম্মুখেও অটল থাকার প্রেরণায় অনিঃশেষ, অকুতোভয়। তৃতীয়ত, মাতৃভূমির মর্যাদা ও মানুষ হিসেবে আমাদের আত্মসম্মানবোধ আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয়।… এই সবই একটি বীর জাতির গুণাবলী। আমাদের এই মহৎ জাতীয় পরিচয় আজ দ্ব্যর্থহীন স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করল।

‘কোন মহৎ ঘটনা ছাড়া একটি জাতি নিজেকে পুরোপুরি চিনতে পারে না। নতুনভাবে জানতে পারে না, সম্পূর্ণ আত্মোপলব্ধি তার ঘটে না। বর্তমান বিপদকে এক মহৎ ঘটনাই বলব। কারণ, এর ফলে আমরা রাষ্ট্রিক দিক থেকে যেমন নিঃসন্দেহে এক বহুমুখী বিজয়ের সম্মুখীন হয়েছি, তেমনি এ আমাদের আত্মিক জগতের বহুমুখী সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। আমাদের লেখকবর্গ এই আত্মিক সম্ভাবনার রূপায়ণের প্রবর্তনার এবং প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।’

যুদ্ধের মধ্যে এবং যুদ্ধের পরে বহুদিন বাংলাদেশের প্রধান কবি-সাহিত্যিকেরা লেখালেখির মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেমের আবেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেননি মাত্র পাঁচ বছর পরে পাকিস্তান সরকার ও তাদের সেনাবাহিনী হবে বাঙালির জঘন্য দুশমন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমস্ত বীরত্বের প্রকাশ ঘটবে নিরপরাধ বাঙালির রক্তলেহনে। অক্টোবর ১৯৬৫-তে বাংলা একাডেমির পরিচালক (তখনো মহাপরিচালক পদটি সৃষ্টি হয়নি) কবীর চৌধুরী লিখেছিলেন :

‘শান্তিকামী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যখন অতর্কিত সশস্ত্র আক্রমণ করে সাম্রাজ্যবাদী হিন্দুস্তান পাক-ভারতের সেপ্টেম্বর যুদ্ধ তার ওপর চাপিয়ে দিল তখন পাকিস্তান অপূর্ব শৌর্য ও বীরত্বের সঙ্গে সে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছে। সকল রণাঙ্গনে শত্ৰু পিছু হটে গেছে এবং প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি বরণ করেছে। অবশ্য পাকিস্তানের দিক থেকে সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। সব সমস্যার মূল সেখানে, অর্থাৎ জম্মু ও কাশ্মীরী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার যতদিন পর্যন্ত বাস্তব ব্যবস্থায় কার্যকরী না হয় ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তান এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রত্যাশা করতে পারে না। তার অতীত ইতিহাস দিয়ে বিচার করলে এ সিদ্ধান্ত অবধারিত হয়ে পড়ে যে, হিন্দুস্তানের মতো জঘন্যতম প্রতিবেশী কল্পনা করাও দুষ্কর। সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের যুদ্ধ বিরতি চুক্তি মেনে নেবার পরও হিন্দুস্তান ক্রমাগত সে চুক্তি লংঘন করে চলেছে, যুদ্ধ বিরতি সীমারেখা অতিক্রম করে তার সামরিক ক্রিয়াকলাপ প্রসারিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আমরা যথাসাধ্য ধৈর্য ও বিবেচনার পরিচয় দিয়ে চলেছি কিন্তু বেশীদিন আমাদের এরকম একতরফা শান্তি প্রচেষ্টা চলতে পারে না। আমাদের বীর। জোয়ানরা, দেশের সর্বস্তরের প্রতি মানুষ, আজ হিন্দুস্তানের সমরলিন্সাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেবার দৃঢ়সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। আবার যদি বৃহত্তর সংগ্রাম জ্বলেই ওঠে, পাকিস্তান তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এই সত্যটিকে অন্তরের মধ্যে সুস্পষ্ট উপলব্ধি করেই আমাদের বলতে হবে যে, সেপ্টেম্বরের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এই কথাটিকে মনে রেখেই আমাদের সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধের আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণায় ব্রতী হতে হবে।’

[কবীর চৌধুরী, ‘যুদ্ধ ও আমাদের নবচেতনা’, এলান, অক্টোবর ১৯৬৫]

সেপ্টেম্বর যুদ্ধ নিয়ে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের লেখাগুলো, প্রশংসামূলক বিশ্লেষণধর্মী নয়। যুদ্ধে শুধু পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর শৌর্য-বীর্যের প্রকাশ ঘটেছে এবং ভারতীয় বাহিনী বিপর্যস্ত হয়েছে– এই বক্তব্যে বস্তুনিষ্ঠ নেই। কবীর চৌধুরী তার ওই প্রবন্ধে বলেন :

‘সব কিছুর আগে যে কথা ধরা পড়েছে তা হলো এই যে, এই পাক-ভারতের সেপ্টেম্বর যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমরা পাকিস্তানের সত্যিকার শক্তি ও সম্ভাবনার স্বরূপ আবিষ্কারে সমর্থ হয়েছি। জাতির জীবনে সংকট মুহূর্তও যে মাঝে মাঝে অভাবিত শুভ ও কল্যাণের বীজ বহন করে আনতে পারে তার প্রমাণ রয়েছে বিগত সংগ্রামের। ফলাফলের মধ্যে। পাকিস্তানের সামরিক শক্তি সম্পর্কে আমরা বরাবরই শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাবান ছিলাম; এবং এবারকার যুদ্ধ যে আমাদের সেই শ্রদ্ধা ও আশাকে পূর্ণ করেছে তাই নয়, তাকে বহু গুণ ছাড়িয়ে গেছে। সংখ্যায় তার চাইতে দশগুণ বেশি সৈন্যের মোকাবিলা করেছে পাকিস্তান, তবু শত্রু সৈন্যকে তারা বারবার ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে, পিছনে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে, চরম বিপর্যয় বরণ করতে বাধ্য করেছে। গত মহাযুদ্ধে মেসোপটেমিয়ার মরু প্রান্তরে আল-আমীনের রোমেল ও মন্টগোমারীর বাহিনীর মধ্যে যে বিরাট ও প্রচণ্ড ট্যাঙ্ক যুদ্ধ সংঘটিত হয় তার চাইতেও ভয়ঙ্কর ট্যাঙ্ক সংঘর্ষ হয়েছে এবার শিয়ালকোটের রণপ্রাঙ্গণে। হিন্দুস্তান তার সাঁজোয়াগাড়ীর সংখ্যাধিক্যের অহমিকায়– প্রচুর সৈন্য-সমাবেশ করে এই সেক্টরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল, কিন্তু আমাদের সিংহবিক্রম জোয়ানদের সামনে তাদের সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। এই যুদ্ধেই তাদের ট্যাঙ্ক বাহিনীর অপূরণীয় ক্ষতি ঘটে, হিন্দুস্তানের সামরিক শক্তির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধে যে অপূর্ব বীরত্ব, মৃত্যুঞ্জয়ী সাহস ও আশ্চর্য রণনৈপুণ্য প্রদর্শন করেছে তা আমাদের ইতিহাসে চিরদিন সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।

আমরা তখন তরুণ লেখক। লক্ষণীয় যে, ষাটের তরুণ লেখকেরা পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ নিয়ে মোটেই মাতামাতি করেননি। প্রবীণ সব লেখকই ওই যুদ্ধকে পাকিস্তানের সংহতির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করেন। নবীন লেখকদের অনেকেই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যকেই বড় করে দেখতেন। রাষ্ট্রে বৈষম্য টিকিয়ে রেখে সংহতি সম্ভব নয়। ওই লেখায় কবীর চৌধুরী আরও বলেছিলেন :

‘সংখ্যাগুরু হিন্দুস্তানের সামরিক বিপর্যয় ও সংখ্যালঘু পাকিস্তানের শক্তি মত্তার অবিসংবাদিত পরিচয় শুধু এশিয়ার নয়, আজ সমগ্র বিশ্বের কাছে একটি চরম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর জন্য সব প্রশংসা পরম করুণাময় আল্লাহর, যার অপার অনুগ্রহেই আমাদের সত্য ও ন্যায়ের যুদ্ধ সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে।

‘এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি। সে হচ্ছে সংকট মুহূর্তে পাকিস্তানের আশ্চর্য জাতীয় চেতনার উন্মেষ– এক অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য, ইমান ও শৃঙ্খলার অভিব্যক্তি। সাধারণ ও স্বাভাবিক অবস্থায় দেশের ভেতর নানা প্রশ্নে আমরা বিভিন্ন মতবাদের প্রকাশ দেখেছি; তর্ক, মতানৈক্য, আলোচনা ও সমালোচনা আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের স্বাভাবিক অঙ্গ হিসেবেই আমরা লক্ষ্য করেছি। একটি স্বাধীন, জীবন্ত এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেইটিই ছিল সঙ্গত ও স্বাভাবিক। মূল লক্ষ্য ও আদর্শের প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সেইসব মতানৈক্য ও বিভেদ প্রশ্রয় পেতো। অন্তত তাই ছিল আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু সে বিশ্বাস যে কতখানি সত্য ও যথার্থ এবারকার অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে জাতি তার অবিস্মরণীয় প্রমাণ দিল। সাম্রাজ্যবাদী হিন্দুস্তানের নির্লজ্জ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সারা পাকিস্তান, পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত, এক বজ্র কঠিন ঐক্য বন্ধনে একত্রিত ও সংঘবদ্ধ হল। নিজেদের আভ্যন্তরীণ প্রশ্নের সকল রকম তুচ্ছ বিবাদ-বিসম্বাদ বিস্মৃত হয়ে সারা জাতি হিন্দুস্তানের বর্বর আক্রমণ প্রতিহত করবার দৃপ্ত শপথ নিয়ে জীবনপণ করে রুখে দাঁড়াল। খাইবার থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত সর্বত্র দেখা গেল এক আশ্চর্য মৈত্রীর বন্ধন, সে বন্ধনের পশ্চাত্যে মূল সূত্রটি অত্যন্ত সহজ অথচ ইস্পাতের মতো কঠিন। তা হল, আমরা পাকিস্তানি, পাকিস্তান আমাদের প্রাণাপেক্ষা প্রিয় মাতৃভূমি, এই দেশের সেবায় আমরা সর্বস্ব দান করতে শুধু প্রস্তুত নই, উন্মুখ।…

‘এক আশ্চর্য সংহতি ও ঐক্য দেশের সর্বস্তরের মানুষকে আজ উদ্দীপিত করেছে। শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শিল্পপতি, শ্রমিক, চাষী, ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবাই নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা বিস্মৃত হয়ে দেশের ডাকে গভীর ব্যগ্রতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন; কোনো রকম সরকারি নির্দেশের জন্য তাঁরা অপেক্ষা করেননি; নিজেরাই নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ করে সৃষ্টিশীল গঠনমূলক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। যে নবচেতনার স্রোত সারা দেশে প্রবাহিত হল, তারই ফসল হিসেবে সৃষ্টি হলো কত নতুন গান, কবিতা, নাটক ও অন্যান্য রচনা।

[কবীর চৌধুরী, ‘যুদ্ধ ও আমাদের নবচেতনা’ এলান]

যুদ্ধ হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে, পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হয়নি। সেটাও খুবই তাৎপর্যের ব্যাপার। এই প্রদেশের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। তারা পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলমান সৈনিকদের বীরত্বগাথাকেই উপজীব্য করেন তাদের লেখায়। যুদ্ধের সঙ্গে ইসলামেরও কোননা সম্পর্ক ছিল না, যুদ্ধ হয়েছিল এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের –এক ধর্মের সঙ্গে আরেক ধর্মের নয়।

সেদিন বাঙালি মুসলমান কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, শিক্ষাবিদ প্রমুখের লেখায় যে আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছিল, তা কি মিথ্যা ছিল? তা কি কৃত্রিম ছিল? সে প্রশ্নের জবাব শুধু সেই লেখকেরাই দিতে পারবেন।

চার

যেকোনো যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে প্রপাগান্ডা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। সে কাজটি সরকারের প্রচার বিভাগই করে থাকে। কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদেরও ভূমিকা থাকে, কারণ জাতীয় নিরাপত্তা সবার ওপরে। বহু ব্যাপারে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে; কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে দ্বিমত থাকে না কোনো নাগরিকেরই। ৬৫-র পাকিস্তান-ভারত সেপ্টেম্বর যুদ্ধে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণ ছিল অনেকটাই রণাঙ্গনের সৈনিকদের মতো। যুদ্ধ-পরবর্তীকালের একটি লেখা থেকে বোঝা যায়, তখন আমাদের লেখকেরা কী ভূমিকা পালন করেছিলেন :

‘মুখে গণতন্ত্রের মুখোশ, কণ্ঠে শান্তির সুললিত বুলি, গায়ে পরম বৈষ্ণবের নামাবলী, সাম্রাজ্যবাদী ভারত পূর্বাহ্নে যুদ্ধ ঘোষণা না করেই সন্তর্পণে আক্রমণ করল পাকিস্তানের পাকভূমি। আন্তর্জাতিক চুক্তিকে উপহাস করে লাহোর জিমখানায় চা পান করবার মোহে অন্ধ হয়ে ভারতের ট্যাংকবাহিনী আক্রমণ করল পশ্চিম। পাকিস্তানের রাজধানী লাহোর। কিন্তু ভারতের এই সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধি ও হীন আক্রমণকে ব্যর্থ করে দিয়ে পবিত্র মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে বজ্রের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিয়ে রুখে দাঁড়াল পাকিস্তানের বীর সেনানী। জলে-স্থলে আকাশে বীর সেনানীরা শত্রুর হামলাকে পর্যুদস্ত করল। ইতিহাসে তাদের বীরত্বের গাথা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হল।

‘ভারতের এই তস্কর সুলভ আক্রমণের প্রতিবাদ জানাতে সেদিন শুধু বীর সৈনিকদের কামানই গর্জে উঠেছিল না, প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল খাইবার থেকে টেকনাফের প্রতিটি জনপদ। সবাই এক সঙ্গে এক কণ্ঠে গর্জে উঠল, শক্রকে ধ্বংস করতেই হবে। রণাঙ্গনে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের বীর সৈনিকরা, তেমনি দেশপ্রেমিক লেখক ও কবিদের লেখনী হয়ে উঠল ক্ষুরধার। কামানের মতো তাদের লেখনীও আগুন ছড়াল। আর সেইসব রচনা শিল্পীর অন্তরের উত্তাপে প্রাণস্পর্শী সুরে বেজে উঠল কণ্ঠে কণ্ঠে।

[মোবারক হোসেন খান, ‘রক্ত-লেখা’]

দেশবাসীকে স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত করা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকা দোষের কিছু নয়, বরং খুব বড় গুণ। কিন্তু আমাদের কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো কথা বলতেন না। যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত ছিল। কবি-লেখক-সাংবাদিকেরা শুধু সেনাবাহিনীর বীরত্বগাথাকেই তুলে ধরেছেন। লেখক-শিল্পীদের মধ্যে আত্মতৃপ্তিও ছিল খুব বেশি। ওই প্রবন্ধে সে কথাই বলা হয়েছে :

‘আমাদের সেনাবাহিনীর বীরত্বের সঙ্গে আমাদের দেশের কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও শিল্পীরা যে অভূতপূর্ব দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ইতিহাসের এক উজ্জ্বল ও গৌরবময় অধ্যায় রচনা করলেন তা ভবিষ্যৎ দেশবাসীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।’

বাঙালি জাতির নিয়তির নির্মম পরিহাস, মাত্র পাঁচ বছর পর ওই পাকিস্তানি সেনারাই আঘাত হানে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি লেখক, সংগীতশিল্পী, কবি ও বুদ্ধিজীবীর ওপর। অসংখ্য কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দালাল আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের হাতে পাশবিক নির্যাতনে শহীদ হন একাত্তরে। ভারতীয় বাহিনী তখন বাঙালির মিত্রবাহিনী।

পঁয়ষট্টিতে সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া তমদ্দুন মজলিশের তৎপরতা ছিল সবচেয়ে বেশি। তারা কয়েক মাস ঘন ঘন সভা-সমাবেশ করেছে। কখনো আলোচনা সভা করেছে বাংলা একাডেমিতে। সেখানে খ্যাতিমান বৃদ্ধ-বুদ্ধিজীবীরাই অংশ নিতেন। যুদ্ধের পরেও তারা ‘সমর সাহিত্য’ রচনার ওপর জোর দিয়েছেন। বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এক ‘জঙ্গি সাহিত্য সভা’য় সভাপতিত্ব করেন একাডেমির পরিচালক সৈয়দ আলী আহসান। বক্তারা পূর্ব বাংলার ‘সাহিত্যের ধারা বীররসে উজ্জীবিত’ করে প্রবাহিত করার উপদেশও দেন।

ওই সময় কবি-লেখকদের প্রায় সবাই কম-বেশি দেশপ্রেমমূলক লেখা লিখেছেন। পরিমাণে যারা সবচেয়ে বেশি লিখেছেন, তাঁদের একজন হাসান হাফিজুর রহমান, পাকিস্তানি ‘সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রশ্নে তিনি নানা পরামর্শ দেন। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পরে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের প্রশ্নে’ নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। আমাদের সাহিত্যে যাতে পাকিস্তানি জাতির বহুমুখী জীবনচেতনার প্রকাশ ঘটে, সে কথাও বলেন। যুদ্ধের পরেও তাদের আবেগ থেকে যায়, সে জন্য তাঁদের রচনার ভাষাও ঝরঝরে নয়, আবেগে অস্পষ্ট। হাসান হাফিজুর রহমানকে বলতে দেখি ‘সমগ্র জাতির ভেতরে এক অবিচ্ছিন্ন ঐক্য-শিহরণ সঞ্চার করা লেখকদের দায়িত্ব। যুদ্ধের পরে যেসব লেখক-সাংবাদিককে পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গন ও আজাদ কাশ্মীর ঘুরিয়ে আনা হয় হাসান ছিলেন তাঁদের একজন। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন তিনি তার সীমান্ত শিবির বইতে।

দেশপ্রেম ও কাশ্মীর নিয়ে কবিতা লিখেছেন প্রধান প্রায় সব কবিই। তাঁদের মধ্যে আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, তালিম হোসেন, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দিন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। দুই মাসে তালিম হোসেন লিখেছেন অনেক কবিতা। হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর এক দীর্ঘ কবিতায় বলেন :

আকাশের বিদ্যুতে দেখি স্বদেশের অন্য এক রূপ
অনিন্দ যুগ ধূপ
জনে জনে মনে মনে প্রদীপ্ত প্রগাঢ় উৎসুক্য
পুঞ্জিত সাহসে আজ ছড়ায় প্রবাল সখ্যে
বিপদে বিপন্ন নয় দেখে মুখ অজেয় অপার
বরাভয়ে শক্রজয়ী অকাতর স্বদেশ আমার।

[‘বিপদে বিপন্ন নও’]

পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিরোধ ও যুদ্ধ যেহেতু কাশ্মীর নিয়ে, তাই আমাদের কবিদের রচনার অন্যতম প্রধান উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায় কাশ্মীরও। ওই সময় প্রকাশিত ফররুখ আহমদের একটি সনেট এ রকম :

শহীদের খুন-রাঙা রুধিরাক্ত মাটির জান্নাত,
বর্বর পশুর বন্য অত্যাচার বিধ্বস্ত কাশ্মীর
আজাদীর স্বপ্ন দেখে দীর্ঘদিন, দীর্ঘতর রাত;
আবদ্ধ জিঞ্জির বেয়ে ঝরে তার শহীদি রুধির।
জাফরানের স্বপ্ন তার ধূলিস্নান রক্তাক্ত সগ্রামে
শান্তির পসরা তার চূর্ণ হলো সুতীব্র সংঘাতে,
সেই জেহাদের সঙ্গে মুমিনের মন ওঠে-নামে;
উদগ্র ব্যাকুল চিত্ত তার সঙ্গে শোণিত ঝরাতে।
তার আজাদীর দাম দিতে আজ সগ্রাম উৎসুক
প্রতি মুমিনের মন –শহীদ মৃত্যুর বিনিময়ে,
শৃংখলিত জীবনের কারাবন্ধে একাগ্র উন্মুখ
নিপীড়িত জনমন মুক্তি চায় ব্যাকুল হৃদয়ে।
শহীদের খুন-রাঙা বন্দিনী যে জান্নাত মাটির
স্বপ্নে দেখে আজাদীর;-অত্যাচার বিধ্বস্ত কাশ্মীর।

[কাশ্মীর]

যুদ্ধের সময় শামসুর রাহমান একটি ছোট কাব্যনাটক লিখেছিলেন, সেটিরও বিষয়বস্তু কাশ্মীরে যুদ্ধ। পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকার হাডিয়ারা নামক একটি গ্রামে এক মসজিদের ইমাম সাহেবের কথা পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হয়। ‘পাকিস্তানের ওপর হিন্দুস্থানের আচমকা হামলার দুর্যোগ-মুহূর্তে হাডিয়ারা গ্রামের মসজিদের ইমাম দুশমনদের সামনে মরদে-মোমিনের মতোই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং হানাদার বর্বর দুশমনদের হাতে অবশেষে শাহাদত্বরণ করেন। সেই পুণ্যকাহিনী বিবৃত হয়েছে এই কাব্য-নাট্যে। শামসুর রাহমানের কোনো কাব্যগ্রন্থে কাব্য নাটকটি আগে প্রকাশিত হয়নি। পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করে আমি তাঁকে কাব্য নাটকটি দিয়েছিলাম। ‘তিনটি গোলাপ’ শীর্ষক কাব্য নাটকটির আরম্ভ এ রকম:

ইমাম :
কী নিবিড় শান্তি চতুর্দিকে রক্ত গোলাপের মতো
ফুটে ওঠে ভোর আর বাতাসে ছড়ায় সুরভি অনেক পাখিদের গানে।
হৃদয় ঝংকৃত হয়। রাত্রি ছিঁড়ে সকালকে ডেকে আনে রোজ
মোরগের ডাক– হে রাম্বুল আলামীন আমাকে দিয়েছো ঠাঁই তোমার এ ঘরে।
প্রাণের চেয়েও প্রিয় এ ধূলিকণা, বুঝি তাই
এই মাটি মেখেছি তো চোখে বুকে, করেছি চুম্বন
পরম পবিত্র জেনে, ধুয়েছি সিঁড়ির ধাপ, রৌদ্রে বৃষ্টি মাখা
এই যে মিনার সেও ছুঁয়েছে হৃদয়
দূর নীল আসমানে ওড়ে কবুতর এক ঝাঁক–
মহানন্দে, আন্দোলিত পত্র গুচ্ছে, ফলে ফুলে
তোমারই মহিমা মূর্ত। বহুদিন পর
কাল রাতে স্বপ্নে আমি দেখেছি তো তিনটি গোলাপ, দেখেছি হৃদয়ে
তিনটি গোলাপ ফুটে উঠেছিলো স্বর্গীয় বিভায়।
কে ওখানে দাঁড়িয়ে একাকী?

গ্রামবাসী :
আমি এ গাঁয়ের লোক, মাঝে মাঝে আসি
এখানে নোয়াতে মাথা খোদার এ ঘরে

ইমাম :
জামাত হয়েছে শেষ, সূর্যের সোনালি আলো হয়েছে প্রখর;
অবশ্য খোদার ঘর খোলা সর্বদাই, দ্বিধাহীন আসুন করুন এবাদত।

গ্রামবাসী :
ধন্যবাদ, তবে আমি আসিনি এখন
বন্দেগির পুণ্যলোকে মগ্ন হতে, আজ শুধু এ মুহূর্তে এসেছি জানাতে
কিছু কথা, আপনি কি শুনেছেন কিছু?

ইমাম :
কেন কী হয়েছে? আমি তো জানি না কিছু–
পড়ে থাকি এখানেই এক কোণে একা,
কারো সাতে পাঁচে মন যায় না সহজে।

গ্রামবাসী :
শত্রুরা দিয়েছে হানা আমাদের গ্রামে, আমাদের প্রিয় হুদায়রা
হয়েছে আক্রান্ত আজ, শত্রুর ভীষণ ক্রুর থাবা পড়েছে মাটির বুকে, শকুন
ফেলেছে ছায়া শান্তি ছাওয়া ঘরে।
গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে লোক, হয়েছে হুকুম–
চলুন না আপনিও যাবেন এখন শত্রুরা পড়বে এসে কিছুক্ষণ পরে।

ইমাম :
শত্রুরা দিয়েছে হানা আমাদের গ্রামে?
লোকজন যাচ্ছে চলে? যাক, সব যাক,
আমি তো যাবো না ভাই। এই মসজিদ ছেড়ে আজ
বলুন কোথায় যাবো? জীবনের অনেক বছর কাটিয়েছি
এর ধূলিকণা মেখে সর্বাঙ্গে আমার।
এখন কোথায় যাবো? না, না, কিছুতেই পারবো না যেতে।

সোরিশ কাশ্মীরির একটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী, তার শিরোনাম ‘সালাম পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গনে বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বের প্রশংসা করা হয়েছিল কবিতাটিতে। কবিতাটির শুরু এ রকম :

দেখেছি তাদের আমি কোষমুক্ত তরবারি যেন,
তাদেরে প্রণতি আজ
হে বাংলার আগ্নেয় যৌবন,
তোমাদের সালাম, সালাম ॥
তাদের অমিত তেজ, বীর্য চির তারুণ্য আভায়
ঝলমল, যেন চিরন্তন
তাদের অশনি ভরা কণ্ঠে শুধু ওই বজ্র ভেরী
প্রতিশোধ, চাই প্রতিশোধ।
তাদেরে প্রণতি আজ
হে বাংলার আগ্নেয় যৌবন
তোমাদের সালাম সালাম।
আঘাতে আঘাতে পর্যুদস্ত শত্রুসেনা
হানাদার বৈরী ভারতীয়–
মরণ বরণে, উল্লসিত কণ্ঠে তার বজ্র ভেদী ধ্বনি
আল্লাহু আকবর।
লাহোর রক্ষায় তারা পরাক্রান্ত বাহু
হয়েছে জাতির কাছে চির-বরণীয়।
হে বাংলার আগ্নেয় সন্তান
তোমাদের সালাম, সালাম।

একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ও সেনাপতিদের নিয়ে ‘জল্লাদের দরবার’, ‘চরমপত্র’ প্রভৃতি হাস্যরসমূলক রচনা সম্প্রচারিত হতো, তেমনি পঁয়ষট্টিতে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে নানা রকম কৌতুক হতো ভারতকে নিয়ে। যেমন ফতেহ লোহানীর একটি কৌতুক রচনা, যার শিরোনাম ‘হিন্দুস্থানের পাঁচালী’। সেই পাঁচালীর নমুনা এ রকম :

প্রথমে বন্দিনু আমি সেই বিধাতারে,
অপার করুণা যার বিশ্ব চরাচরে।
এবার নমিনু আমি মোর বাপমায়
লভেছি জনম আমি যাদের কৃপায়।
এমন করিয়া স্মরণ যত গুরুজনে
জানাই সালাম যত সুধী জনগণে।
শোনো ভাই শোনো সবে শোনো দিয়া মন,
ভারত পাঁচালী তবে করহ শ্রবণ।
নয়ন মুদিয়া শোনো সুধা কর পান,
ভজেন লোহানী তবে ভারতের গান ॥

ধুয়া : আহা বেশ বেশ—

ভারত তাহার নাম কুহকিনী ভূমি
ভূগোলেতে জানি তাহা পড়িয়াছ তুমি।
অহিংসা বাণী যত বড় বড় বাত–
ছলনায় কত করে মহারথী কাত ॥

ধুয়া : আহা বেশ বেশ

… … …

তাকায়ে দেখ না দাদা প্রভুদের দিকে
পাঠায়ে তোমারে রণে তারা হাসি মুখে–
ঘরে বসে ছাড়ে বুলি গরম গরম–
প্রাণের বয়ান দিয়ে তুমি যে খতম।
ছেড়ে ছুঁড়ে ঘরে যাও, না হও বাতুল,
ঘরে বসে বাঁচা বাপু বামনের কূল।
যবনের হাতে মরে ফল কিরে ভাই,
মরে শুধু ভূত হবি আর গতি নাই।
সব শেষে খাঁটি কথা গোপনে জানাই–
হাতিয়ার ফেলে বল, তাই তাই তাই।
হাততালি দিয়ে বল, তাই তাই তাই ॥

ধুয়া : আহা বেশ বেশ…

[পুবালী, ভাদ্র, ১৯৭২)

পাঁচ

প্রচারমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সব কালের সব দেশের শাসকদের অভিন্ন নীতি। পাকিস্তান যুগে গণমাধ্যম বলতে ছিল সংবাদপত্র, রেডিও পাকিস্তান এবং একমাত্র টেলিভিশন মাধ্যম পাকিস্তান টেলিভিশন ঢাকা। ১৯৬৫-র সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পরে পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টিতে পড়ে বেতারের ভূমিকা এবং কী করে তাকে পুরোপুরি সরকারি দলের নীতির বশবর্তী করা যায়। বিশেষ করে, ভারতবিরোধী প্রচারণাকে আরও জোরদার কীভাবে করা সম্ভব তার উপায় খুঁজে বের করা। যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার মাসখানেক পরেই কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন ঘোষণা করেন, সরকার বর্তমান বাস্তবতায় একটি নতুন বেতার নীতি প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, আকাশবাণী থেকেও পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণা ব্যাপকভাবে চলছিল। সেগুলো বাংলাদেশের শ্রোতারা শুনতেন। তাতে সত্য-মিথ্যা নানা বিষয় সম্প্রচারিত হতো। নোংরামি তাতে কম থাকত না।

১৯৬৫-র অক্টোবরে শাহাবুদ্দিন তার এক বক্তৃতায় বলেন, “রেডিও পাকিস্তানে ভারত হইতে প্রচারিত শত্রুতামূলক প্রচারণার পাল্টা কর্মসূচীর প্রচার অব্যাহত রাখা উচিত। সরকার অতি দ্রুত তার নয়া বেতার নীতি ঘোষণা করে। সেই বেতার নীতিতে অনেকগুলো নির্দেশনা ছিল। তার একটি এ রকম :

‘নাটকের অনুষ্ঠান আরও বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং ফসল তোলার গান, জিপসি গান, মৌসুমি গান, মুসলিম দেশসমূহের সংগীত, মহান মুসলিম গীতিকারদের জীবনী ও সংগীত ও অন্যান্য আকর্ষণীয় সংগীতানুষ্ঠান প্রচার করিতে হইবে। নৈরাশ্যবাদী গজল এবং গান পরিহার করিয়া প্রাণবন্ত ও উদ্দীপনাময় সংগীত অথবা নাটকীয় আবৃত্তি হিসাবে তেজোদ্দীপক কবিতা পেশ করিতে হইবে। নজরুল, ইকবাল ও অন্যান্য জাতীয় কবিদের সংগীত প্রচারের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হইবে।

এ ধরনের নির্দেশ দেওয়া ছিল শিল্পী ও কর্মকর্তাদের হাত-পা বেঁধে দেওয়ার শামিল। নৈরাশ্যবাদী গজল ও গানের সংজ্ঞা কী? এই সংজ্ঞা হিসেবে নজরুলের

গানগুলি মোর আহত পাখির সম
লুটাইয়া পড়ে তব পায়ে প্রিয়তম।

কিংবা

বিদায়-সন্ধ্যা আসিল ঐ
ঘনায় নয়নে অন্ধকার।
হে প্রিয়, আমার যাত্রাপথ
অশ্রু-পিছল করো না আর।

অথবা

আনো সাকি শিরাজী আলো আঁখি-পিয়ালায়।
অধীর করো মোরে নয়ন-মদিরায়।

প্রভৃতি রেডিও-টেলিভিশন থেকে সম্প্রচার করা যাবে না। শুধু প্রচারিত হবে ‘বীর-রসে উজ্জীবিত’ করার মতো গান। কিন্তু নজরুল ভারতীয় বাঙালি মুসলমান ছিলেন, পাকিস্তানের ‘জাতীয় কবি’ ছিলেন না।

এই জাতীয় আরও অদ্ভুত ফরমান-সংবলিত নীতিমালা তখন ঘোষিত হলো। এই নীতিমালা সমগ্র পাকিস্তানের জন্য প্রযোজ্য হলেও মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শ্রোতারা। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বাংলা অনুষ্ঠানে পূর্ব বাংলার শ্রোতা প্রভাবিত হতে পারে, সেই শঙ্কা থেকেই এই ‘নয়া বেতার নীতি’। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, এই নীতিমালা ঘোষণার প্রতিবাদে অথবা এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে আমাদের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা একটি শব্দও বলেননি। তারা এটা মেনে নিলেন।

ফওজিয়া খান রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে ১৯৬৭-তে একটি গীতি-বিচিত্রা প্রচার করেন। তাতে ধারাবিবরণীতে তিনি বলেন, ‘আমাদের আজাদ ওয়াতান যেন আল্লারই দান। দেশের মাটির তরে এ দেশের প্রতিটি মানুষ উৎসর্গকৃত প্রাণ। জান দিয়ে হলেও দেশের মান ফিরিয়ে আনবার জন্যই যেন জন্মেছে এ দেশের লক্ষ কোটি নরনারী।’ [এলান]

শিক্ষিত বাঙালি অনেকেই সেদিন মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ‘আজাদ ওয়াতান’ বলতেই পছন্দ করতেন। যে শব্দ দুটি বাঙালি কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য মনে হতো। ওই ‘গীতি-বিচিত্রা’য় পরিবেশিত হয়েছিল যে গানটি, তা কবি হাবিবুর রহমানের রচনা : ‘আমাদের এই পাক আজাদ ওয়াতান/ দুনিয়ার জান্নাত আল্লার দান।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাত্র এক-দেড় বছর আগেও এসব গান রচিত ও পরিবেশিত হতো বেতারে। ফররুখ আহমদের একটি গানও ছিল খুবই প্রচলিত :

আজাদ ওয়াতান, স্বাধীন পাকিস্তান
মজলুমানের মঞ্জিল মহীয়ান।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের একনায়কত্বের সময় দেশে শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, অবকাঠামো প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অগ্রগতি হয়েছিল, কিন্তু জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করা হয়। বাম প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের অনেকেই কারারুদ্ধ হন। এমনকি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সবচেয়ে। সোচ্চার আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে একটির পর একটি মামলা দিয়ে নাজেহাল করা হচ্ছিল। তারপর তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে প্রায় মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। দেশের লেখক-শিক্ষাবিদেরা এসবের। প্রতিবাদ না করে তাঁরা মৌলিক গণতন্ত্র ও নতুন বেতার নীতি বা প্রপাগান্ডা নীতির প্রশংসাই করতে থাকেন। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের পতনের মাত্র চার মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম, স্বাধীনতার পর পাকিস্তানকে যিনি বিরামহীন গালাগালি করতেন, এক প্রবন্ধে আইয়ুব সরকারকে পরামর্শ দিয়ে লেখেন :

‘বর্তমান বিশ্বে যে কোনো ক্ষেত্রে সাফল্যের একটি মস্ত বড় সোপান প্রচারকার্য। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক সর্বক্ষেত্রেই আজ প্রচারের মাধ্যমে কেউ বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে, আর কেউ বা এর অভাবে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে।…

‘প্রচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম বেতার। আজকাল এখান থেকে নিয়মিত মৌলিক গণতন্ত্রের উপদেশ দেয়া হয়ে থাকে।… পল্লী অঞ্চলের মৌলিক গণতন্ত্রীদের সহায়তায় আলোচনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে। ঘন ঘন এ ধরনের সভা সমিতি ডাকলে নিশ্চয়ই গ্রামবাসীদের সাড়া পাওয়া যাবে।’

[নীলিমা ইব্রাহীম ‘সমবায় ও প্রচারকার্য’, দৈনিক পাকিস্তান, ৩ নভেম্বর ১৯৬৮]

আইয়ুব ক্ষমতা গ্রহণের এক দশক পূর্তি উপলক্ষে ১৯৬৭-র শেষ দিক থেকেই ব্যাপক প্রচারাভিযান শুরু করে সরকার। তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘উন্নয়নের দশ বছর’। সেটা যেকোনো সরকারই করতে পারে। আইয়ুব স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছিলেন বাঙালি বিদ্বৎসমাজের। ময়মনসিংহ মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ আজিজন নেসা (তমঘা-ই-কায়েদে আজম) লিখেছিলেন :

‘উন্নয়ন দশকের পটভূমিকায় দেখা যায়, জাতি তখন অনিশ্চয়তার পথে অগ্রসর হচ্ছিল। শঙ্কিত জনসাধারণ আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, কে দেখাবে আলো? কোন পথে চলব? একদিকে মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত, অন্যদিকে বিপর্যস্ত দেশ নানা সমস্যার সম্মুখীন। দেশ ও জাতির এই চরম দুঃসময়ে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে এগিয়ে এলেন নির্ভীক অকুতোভয়, একনিষ্ঠ, দুর্জয় মনোবলের অধিকারী এক নেতা ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান। বিহ্বল, মোহগ্রস্ত জাতিকে উদাত্ত আহ্বানে জাগিয়ে তুললেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শাসনভার গ্রহণ করে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শাসনব্যবস্থার সনাতন কাঠামো ভেঙে আনলেন এক নববিপ্লব। শুধু শাসনব্যবস্থায় নয়, যা অসুন্দর, অসার্থক, অকল্যাণকর তা দৃঢ়চিত্তে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে দূর করে আহ্বান করলেন সুন্দর, সার্থক ও কল্যাণকে। তাই কল্যাণের মঙ্গলালোকে উদ্ভাসিত হলো চারদিক, সূচিত হলো শুভ পদধ্বনি।…

‘প্রেসিডেন্ট শাসনভার গ্রহণ করেছেন তা আজ এক দশক পূর্ণ হতে চলেছে। এই এক দশকের মধ্যে সারা দেশে এক নজিরবিহীন ও অভূতপূর্ব উন্নয়ন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। প্রেসিডেন্টের কর্তব্যপরায়ণতা প্রতিটি মানুষকে স্পর্শ করে সজীব করে তুলেছে। যে দিকে তাকানো যায় চোখে পড়ে কাজ আর কাজ। গোটা দেশটাই যেন হঠাৎ এক সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছে। কেউ আর আলস্যভরে আয়েশী জীবনযাপনের অবকাশ পাচ্ছে না। তামাম দেশটা এমনি কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে তা কেউ কি দশ বছর আগে ধারণা করতে শিখেছিল। একজন কিন্তু শিখেছিলেন তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে, দূরদৃষ্টি ও মননশীলতা দিয়ে। তিনি আর কেউ নন, আমাদের প্রিয় প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান।

[‘প্রদেশে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতি, দৈনিক পাকিস্তান, ৩ নভেম্বর, ১৯৬৮]

এই স্তৃতিমূলক লেখা প্রকাশের এক মাস পরেই আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু করেন মওলানা ভাসানী এবং দুই মাসের মধ্যে ঘটে গণঅভ্যুত্থান। আইয়ুব পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি যার হাতে ক্ষমতা দেন, তিনি মানবজাতির ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যাকারী।

আইয়ুব প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্র, যা সর্বজনীন ভোটাধিকারের পরিপন্থী, যার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ সংগ্রাম করছিল, তার প্রশংসা করে প্রচুর লেখালেখি হয়েছিল। কবি, কথাশিল্পী, প্রবন্ধকার ও শিক্ষাবিদ অনেকেই মৌলিক গণতন্ত্রের প্রশংসা করে লিখেছেন। সেকালের একজন খ্যাতিমান লেখক ও শিক্ষাবিদ জহুরুল হক লিখেছিলেন :

‘.. জাতির ইতিহাসের এক অত্যন্ত জরুরি মুহূর্তে ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের আবির্ভাব ঘটেছিল।

‘দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের স্তূপীকৃত আবর্জনা অপসারণ করে নুতনকে ও নির্মলকে নির্মাণ করে তোলার ব্রত তিনি গ্রহণ করেছিলেন।’

[জহুরুল হক, রাষ্ট্রপ্রথার বিবর্তন ও মৌলিক গণতন্ত্র, পাকিস্তানী খবর, পাকিস্তান দিবস সংখ্যা, ২৩ মার্চ ১৯৬৮, পৃ. ৩৯]

কেউ কেউ অনুরোধেও হয়তো-বা লিখে থাকবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেখার দায় লেখকেরই। মোহাম্মদ বরকতউল্লাহর মতো সৎ ও মননশীল ব্যক্তিত্ব এক নিবন্ধে লিখেছিলেন:

‘মৌলিক গণতন্ত্রের যে আদর্শ বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছেন, তাতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত ও পূর্ণ হওয়ার সুযোগ রয়েছ যথেষ্ট।… ক্রমশ যোগ্যতর মানুষ সদস্য হয়ে হয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলে আসছে এবং গণতান্ত্রিক আদর্শকে পূর্ণভাবে রূপায়িত করতে এগোচ্ছে। ইহাই বর্তমান সরকারের আশা ও বিশ্বাস। ইহার চাবিকাঠিও জনগণেরই হাতে। তারা যদি ভোট দেবার সময় যোগ্য লোকদিগকে বাছাই করে ইউনিয়ন কাউন্সিলে পাঠায় তা হলে সমস্ত ঠিক হয়ে যাবে।’

[পাকিস্তানী খবর, ২৩ মার্চ ১৯৬৮]

যিনি ছিলেন আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিজগতের অভিভাবকতুল্য, সেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পল্লী তথা, দেশ উন্নয়নে এর [মৌলিক গণতন্ত্রের] উপকারিতা সম্বন্ধে’ লিখেছিলেন, এই গণতন্ত্রের এখনও শৈশব অবস্থা। কাজেই ভবিষ্যতেই আমরা তার পূর্ণ বিকাশ দেখতে আশা রাখি। যেমন ছেলে বড় হলে তবে তার ষোলআনা গুণ প্রকাশ পায়। … তারা নামাজ-রোজা প্রভৃতি ধর্মকার্যের জন্য উপদেশ দিয়ে, এবং যারা তা মানে না, তাদের জন্য সামাজিক শাসনের বিধান করে পাকিস্তানকে আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারেন। …এমন অনেক কাজ রয়েছে, যা মৌলিক। গণতন্ত্রের কল্যাণে আমরা সম্পাদন করতে পারি, যাতে করে একদিন এ দেশে government of the people, by the people, for the people অর্জন করা। সম্ভব হয়ে ওঠে।

[পাকিস্তানী খবর, ২৩ মার্চ ১৯৬৮]

মানুষ চাইছিল সর্বজনীন ভোটাধিকার ও সংসদীয় গণতন্ত্র, পরোক্ষ ইলেকটোরাল কলেজের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়। এসব প্রপাগান্ডায় মানুষ বিরক্ত হয়ে ওঠে এবং তিন মাস পরে গণরোষে আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হন।

 ০৮. আত্মপ্রতারণা

রাষ্ট্র একটি বাস্তবতা, কল্পলোকের কোনো বস্তু নয়। রাষ্ট্রের নীতি-আদর্শের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্য থাকতেই হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রটিও ছিল এক বাস্তবতা। তারও ছিল নিজস্ব নীতি-আদর্শ। শাসকেরা তার ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চাইতেন। নাগরিকেরা তার প্রতি অনুগত ছিলেন। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের সব নাগরিকই ছিল পাকিস্তানি, যদিও জাতিসত্তার দিক থেকে তাদের প্রায় ৯৮ শতাংশ ছিল বাঙালি, অবশিষ্টদের কেউ ছিল চাকমা, সাঁওতাল, গারো, হাজং, মণিপুরি, ত্রিপুরা প্রভৃতি। তবে ৯৯ শতাংশের বেশি মানুষ ছিল বাংলাভাষী।

বহু শতাব্দী বাঙালি– বাঙালি মুসলমান ছিল অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত। একপর্যায়ে তারা অর্থনৈতিকভাবে পড়ে পিছিয়ে এবং শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের দূরত্ব সৃষ্টি হয় প্রায় অনতিক্রম্য। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনে তারা শিকার হয় চরম বৈষম্যের। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে স্বশাসনের স্পৃহা জাগে। কৃষি অর্থনীতিতে বাঙালি মুসলমান কৃষকশ্রেণির বিপুল অবদান থাকা সত্ত্বেও তারা জমিদার-জোতদার-মহাজনদের শোষণের শিকার হয়। তাই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপিত হলে বাঙালি মুসলমান অপার আগ্রহ ও আশা নিয়ে তার সমর্থন করে। তাদের ভোটেই প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান। তাদের প্রত্যাশা ছিল পাকিস্তান হবে একটি শোষণমুক্ত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক রাষ্ট্র।

লাখ লাখ হিন্দু পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে চলে যাওয়ার পরও পূর্ব পাকিস্তানের এক-চতুর্থাংশ মানুষ ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী। বাঙালি সংস্কৃতি ছিল হিন্দু মুসলমান প্রভৃতি সব ধর্মাবলম্বীর সমন্বিত সংস্কৃতি। সব ধর্মের উপাদান নিয়ে হাজার বছরে গড়ে উঠেছে সেই সংস্কৃতি। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় যত কথাই বলুন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লগ্নে গণপরিষদে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে ভাষণ দেন, তাতে পাকিস্তান একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে বলেই ঘোষণা দেন। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না বলেই তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। স্বাধীনভাবে যে যার মতো ধর্ম পালন করবে, স্বাধীনভাবে কেউ যাবে মসজিদে, কেউ মন্দিরে, কেউ গির্জায়, কেউ প্যাগোডায় অথবা অন্য কোনো উপাসনালয়ে; তাতে রাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্র চলবে গণতান্ত্রিক বিধি অনুসারে। জিন্নাহ এ কথা বললেও সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের নেতারা পাকিস্তানকে ‘এসলামি জমহুরিয়াহ’ বানাতে চাইলেন। সে জিনিসটি যে কী –তা দেশের মানুষ জানত না। শাসকশ্রেণির মধ্যে পূর্ব বাংলার বাঙালি নেতা অনেকে ছিলেন, তাঁরা বাংলাদেশকে ‘তৌহিদবাদী পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চাইলেন। এখানে যে এক-চতুর্থাংশ অমুসলমান, বিশেষ করে হিন্দু, বৌদ্ধ, আদিবাসী রয়েছে, তাদের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। নতুন রাষ্ট্রের সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িকতা জায়গা করে নেয়।

পূর্ব বাংলার মুসলমান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নানা মতবাদে বিভক্ত ছিলেন। কেউ ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী, তাঁরা তাঁদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের জন্য মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যে হাতড়ে বেড়াতেন। কেউ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক আধুনিকতাবাদী, তাঁরা সংখ্যায় কম। আরও কম সংখ্যায় ছিলেন একদল, তারা সমাজবাদী ধ্যানধারণা। পোষণ করতেন। পল্লিপ্রধান দেশে বিশাল জনগোষ্ঠী অশিক্ষিত ও অজ্ঞতার অন্ধকারে পড়ে থাকায় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা তাদের সহজেই প্রভাবিত করতে পারতেন তাদের মতাদর্শে। ধর্মের নামে তাদেরকে শোষণ করা সহজ ছিল।

পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি রাষ্ট্রকে ইসলামীকরণে বদ্ধপরিকর ছিলেন। কালচার অর্থে সংস্কৃতি শব্দটি তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না, তাঁরা চাইতেন তার পরিবর্তে তাহজিব বা তমদ্দুন শব্দ দুটি ব্যবহার করতে। আমরা একসময় বলতাম পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, কিন্তু ষাটের দশকে দেখা গেল ওটা যথেষ্ট নয়, বলা শুরু হলো ‘পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ’। এই শব্দের মানে কোনো বাঙালি জানেন কি না জানি না, আজও আমার কাছে এই পায়েন্দাবাদের অর্থ অজানা। বাঙালিদের মধ্যে– বিশেষ আর কাউকে বলতে শুনিওনি, শুধু গভর্নর মোনায়েম খান তাঁর বক্তৃতা শেষ করতেন ‘পায়েন্দাবাদ’ বলে। জাতীয় জীবনে এবং সংস্কৃতিতে গায়ের জোর খাটে না।

এক ভাষাভাষী ও এক ধর্মাবলম্বীর রাষ্ট্র সম্ভবত পৃথিবীতে একটিও নেই। পাকিস্তান পর্বে পূর্ব বাংলায় উর্দুভাষী মানুষ কয়েক লাখ ছিলেন। তাঁদের উর্দু দৈনিক পত্রিকাও ছিল। সাপ্তাহিক ও মাসিক উর্দু সাময়িকী তো ছিলই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোতে উর্দু, আরবি বিভাগও ছিল। কিন্তু সাধারণভাবে বাঙালিরা উর্দুর চর্চা করতেন না। বাংলা সাহিত্যের অনেক গল্প-উপন্যাস উর্দুতে তরজমা হয়েছে, অনেক উর্দু গল্প-কবিতা বাংলায় অনূদিত হয়েছে। সেটা স্বাভাবিক। কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর মদদে এবং তাদের খুশি করতে আগবাড়িয়ে বাঙালি শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ বাংলাদেশে উর্দুচর্চার ব্যবস্থা করেছেন। বিশেষ করে, কবি ইকবালকে পূর্ব বাংলায় জনপ্রিয় করতে বিচিত্র উদ্যোগ নেওয়া হতো এবং তাতে বাঙালি শিক্ষাবিদ ও লেখকদের সহযোগিতা ছিল সর্বাত্মক।

একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। নতুন প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের মতো একটি উর্দু ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থাকা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেখানে ১৯৬৭-তে উপাচার্য আজিজুর রহমান মল্লিকের প্রধান পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি সংস্থা : ‘বাজম-ই-আনজুম’। তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ইকবাল ও পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে গবেষণা ও সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করা। চট্টগ্রামের একটি সুন্দর বাঙালি জাতীয়তাবাদী আবহাওয়া দীর্ঘকাল থেকে ছিল। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সেখানকার কোনো বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের সম্পর্ক ছিল বলে তখন শুনিনি।

প্রগতিশীল বলে কথিত ও দাবিদার অনেকেই সেকালে ছদ্মবেশী মুসলিম জাতীয়তাবাদী ছিলেন। তারা সাম্প্রদায়িক ছিলেন তা-ও নয়, কিন্তু তাঁদের মুসলমান সত্তাকে প্রাধান্য দিতেন। সেকালের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, যেসব বাঙালি কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ ঢাকায় পাঞ্জাবি-পাজামা, প্যান্ট-শার্ট, স্যুট পরতেন, তাদের কেউ কেউ পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন আচকান ও চোস্ত পাজামা এবং মাথায় লিয়াকত টুপি বা আইয়ুব টুপি পরে। বিষয়টি হাস্যকর মনে হয়। পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গিয়ে এমন অনেকে এ কাজ করেছেন, যারা আমাদের সবচেয়ে আধুনিক বলে পরিচিত ছিলেন।

রাষ্ট্র থেকে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা সুযোগ-সুবিধা নেবেন, তা দোষের নয়। অনেক সময় ভালো কাজের জন্য রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য প্রয়োজন। কিন্তু তা আত্মবিসর্জন দিয়ে নয়। পাকিস্তান আমলে বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা প্রচুর সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। তাঁরা সরকারি খরচে ব্যাপক বিদেশ সফর করেছেন; করাচি, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডিতে গিয়ে দামি হোটেলে থেকেছেন, আর্থিক সহায়তা নিয়েছেন, তা নিয়ে তারা কোনো অন্যায় করেননি। রাষ্ট্রের টাকা জনগণের টাকা, সরকারপ্রধানের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, সেকালে যাদের থেকে এই সুবিধা নিয়েছেন, ১৯৭২ থেকে তারা হয় তা অস্বীকার করেছেন অথবা গোপন করে গেছেন। এই অসাধুতা বা সৎ সাহসের অভাবেই তারা প্রশংসার যোগ্য নন।

রাষ্ট্রীয় আদর্শের সঙ্গে কোনো নাগরিক ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করতে পারেন না, অস্বীকার করাও সম্ভব নয়। একাত্তরের আগে বাঙালি কোনো লেখক বুদ্ধিজীবী তা করেছেন তার প্রমাণ নেই। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অত্যন্ত বিশ্বস্ত নাগরিক ছিলেন তাঁরা। অক্টোবর ১৯৬৮তে, মুক্তিযুদ্ধের সোয়া দুই বছর আগে, বাংলা একাডেমি সাহিত্য ও সংস্কৃতি সপ্তাহ পালনের আয়োজন করে। তাতে প্রধান বাঙালি কবি সাহিত্যিক অংশগ্রহণ করেন এবং প্রবন্ধ পাঠ করেন। সে সব লেখা দিয়ে সরদার ফজলুল করিমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় আমাদের সাহিত্য (১৯৬৯)। আমাদের সাহিত্য কোনো ভালো শিরোনাম নয়। বইটির নামকরণ হতে পারত পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সাহিত্য আশির দশকের এক কবি সম্মেলনে আমি সরদার ফজলুল করিমকে জিজ্ঞাস করেছিলাম বইটির পুনর্মুদ্রণ না হওয়ার কারণ কী? তিনি ছিলেন সরল সজ্জন মানুষ। বললেন, ‘থাক, আর ওসব বই নিয়ে আলোচনা করা ভালো। অথচ বইটি কোনো আপত্তিকর বই নয়। মানসিক দুর্বলতা থেকে সেকালের অনেক ভালো বইটির কথাও বলতে সংকাঁচবোধ করতেন স্বাধীনতার পরে সেগুলোর লেখকেরাই। বাংলা একাডেমি আর একটি বই বের করেছিল, তার নাম। ‘পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম সাহিত্য (১৯৬৮)।

মুক্তিযুদ্ধের দেড়-দুই বছর আগে মুস্তাফা নূরুল ইসলামের মুসলিম বাংলা সাহিত্য (১৯৬৮), আনিসুজ্জামানের মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৮) এবং মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৮) প্রকাশিত ও পুরস্কৃত হয়। যদি পাকিস্তান টিকে যেত ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় না ঘটত, তাহলে এই সব বইয়ের সুবাদেই তারা পাকিস্তান সরকার থেকে আরও অনেক পদক পুরস্কার ও সুযোগ-সুবিধা পেতেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ তাদের সহকর্মীদের যাঁরা। পাকিস্তানে আসলে যেমন ছিলেন এবং স্বাধীনতার পরে তারা একই বিশ্বাস ধারণ করে রইলেন তারা শুধু অবহেলার শিকার হলেন না, নানাভাবে অপমানিত হলেন, কেউ কেউ হলেন নিগৃহীত। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সেটা বৈশিষ্ট্য নয়।

পাকিস্তানের এক অংশ ছিল এক মুল্লুকে, আরেক অংশ আরেক দিকে। দুই অংশের মানুষ, ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাপন একেবারেই দুই রকম। বাঙালি সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্রশিল্পীদের রুজি-রোজগারের একটি বড় ক্ষেত্র ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। বাঙালি চিত্রশিল্পীদের ছবির বাজার ছিল করাচি-লাহোর। পূর্ব বাংলায় ছবি কেনার মতো মানুষ ছিলেন অতি অল্প। যে ছবি ঢাকায় বিক্রি হতো খুব বেশি হলে চার-পাঁচ শ টাকায়, সেটাই ওখানকার বড়লোকেরা কিনতেন পাঁচ হাজার টাকায়। বাঙালি অনেক কবি উর্দুতে গান লিখেছেন। আমাদের প্রগতিশীল চলচ্চিত্র পরিচালকেরা বাংলায় ছবি করে লাভবান হতে পারেননি, তাঁরা উর্দুতে ছবি বানিয়েছেন। সে ছবির বাজার পাকিস্তানের দুই অংশেই পাওয়া গেছে। এই জাতীয় কাজে কোনো দোষই ছিল না। কিন্তু ষাটের দশকে যে শিল্পী সরকারি খরচে সাত-আটবার মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে গেছেন, উর্দু ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন, তিনিও তাঁর জীবনবৃত্তান্তে এখন উর্দু ছবিগুলোর উল্লেখ করেন না। পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে বিশ্বভ্রমণ করেছেন, সে কথা তো স্বীকারই করতে চান না। এসব খুব বড় রকমের হীনম্মন্যতা।

ষাটের দশকটা অনেকের জীবনেই ছিল স্বর্ণকাল। তাঁরা সব পেয়েছেন সে সময়। বিশেষ অন্যায়ভাবে পাননি। প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবেই পেয়েছেন। তাঁদের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো সে সময়েরই। ৭২-এ আমাদের একজন শীর্ষ চিত্রশিল্পী বললেন, স্বাধীনতার আগে ছবিই আঁকতে পারতাম না, আমি এখন মুক্তমনে ছবি আঁকতে পারি। অথচ তার সব উল্লেখযোগ্য কাজই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের। আমি তখন তাঁর ওই নিরর্থক বক্তব্যের সমালোচনা করে ইত্তেফাঁক-এ লিখেছিলাম।

কোনো জাতিই সত্যকে আড়াল করে মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সে চেষ্টা করলে সে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে। মানুষ মাত্রেই ভুলভ্রান্তি ও দুর্বলতার ঊর্ধ্বে নয়। বাস্তবতাকেও অস্বীকার করা যায় না। বাঙালি মুসলমানের প্রতিভাবান অংশটি নানা বিভ্রান্তিতে তাঁদের শক্তির অপচয় করেছেন। তারা ভুল করেছেন ব্রিটিশ আমলে, তারা ভুল ও বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলেন পাকিস্তানি আমলে, এবং বেদনার বিষয়, তারা ভুল ও বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশেও। বুদ্ধিবৃত্তির সততা ছাড়া কোনো জাতি স্থায়িত্বশীল উন্নতি করতে পারে না। সত্যের সাধনা ছাড়া জাতির কল্যাণ হয় না। এখনো সময় আছে, যদি বাঙালিদের নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্বজদের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়, তাহলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, তা না হলে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাঙালির কোনো স্থান থাকবে না। পদানত থাকতে হবে বহু বছর।

০৯. মাহে নও ও আবদুল কাদির

শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানকে চেনা কঠিন। সে কোন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোন রূপ ধারণ করবে, তা বিধাতার পক্ষেও বলা অসম্ভব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি মুসলমান কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এমন এক বুদ্ধিবিভ্রাট দেখা দেয়, যা কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ও সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।

পাকিস্তান রাষ্ট্র ও ধর্ম ইসলামকে যদি মুসলিম লীগের শাসক ও নেতাই শুধু একাকার করে ফেলতেন, তা হতো এক কথা; কিন্তু কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহ ও তৎপরতা ছিল আরও বেশি। প্রায় সব খ্যাতিমান কবি লেখকই পাকিস্তানবাদে এবং ‘পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে’ আপ্লুত হয়ে পড়েন। জাতীয়তায় তাঁরা যে বাঙালি, তা বেমালুম ভুলে যান বা অস্বীকার করেন। নাগরিকত্ব ও জাতীয়তা দুই জিনিস তা গুলিয়ে ফেলেন।

১৯৭২-এর জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশের মূলধারার কবি-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা সমস্বরে বলতে থাকেন যে তাঁরা ‘৪৭ থেকে ‘৭১ পর্যন্ত একটি মারাত্মক অধ্যায় পেরিয়ে এসেছেন। জাতির জীবনে শুধু নয়, তাঁদের নিজেদের জীবনে তা ছিল এক ‘দুঃসময়’। সে এক দুঃস্বপ্নের কাল। কেউ কেউ ওই সময়কে তুলনা করেছেন ‘জাহান্নাম’-এর সঙ্গে। জাহান্নাম হলো সবচেয়ে ভয়ংকর নরক। কিন্তু পরিহাসের বিষয় এই যে, যাদের জন্ম ১৯৩০-এর দশকে, তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই শিক্ষাজীবন শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সম্ভবপর সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন না। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। তাঁদের যথারীতি পদোন্নতি হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের নগর-বন্দরে ঘুরে অপার আনন্দ পেয়েছেন। অর্থাৎ, জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। এবং তা করেছেন প্রধানত সামরিক শাসনের মধ্যে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্য চর্চার একটি সুযোগ আসে। কিন্তু প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই ঢাকার চেয়ে করাচি ও লাহোরের দিকে ছোটাকেই আত্ম-উন্নতির উপায় বলে মনে করেন। একটি প্রদেশের মানুষের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি যতটা আনুগত্য প্রদর্শন করা উচিত, তারা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আনুগত্য দেখান। অনেকের আচরণে প্রকাশ পায় দাস্য মনোভাবের।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ও উদ্যোগে যে মাসিক সাহিত্যপত্রিকাটি প্রকাশিত হয় তার নাম মাহে নও। সাময়িকীটির প্রথম সংখ্যা বের হয় এপ্রিল ১৯৪৯ সালে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দেড় বছর পর। প্রতিষ্ঠাকালে এর সম্পাদক ছিলেন আবদুর রশিদ নামের কেউ। মাহে নও-এর প্রধান কার্যালয় ছিল করাচি। মাহে নও নামে উর্দু মাসিকও ছিল। বাংলা মাহে নও-এর কার্যালয় ছিল ঢাকায়। সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্রে সরকারি অর্থে একটি সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশের উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়।

মাহে নও-এর প্রথম সংখ্যায় ‘আমাদের কথা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় থেকে জানা যায় :

‘… মামুলি প্রপাগাণ্ডা ইহার উদ্দেশ্য নহে। ইহার আদর্শ পাকিস্তানের তাহজীব তামাদুন। ইহার উদ্দেশ্য দেশের প্রধান সাহিত্যিকদিগকে কদর দেয়া ও নয়া আজাদীর আবহাওয়ায় পরিপুষ্ট নবীন লেখক-লেখিকা সৃষ্টি করা। …. মাশরেকী ও মাগরেবী পাকিস্তানের মধ্যে বিরাট ব্যবধান দূরত্বের মাপকাঠিতে। আদর্শ ও ভাবরাজ্যে কোনো ব্যবধান আছে বলিয়া আজ আর মনে করা যায় না। তাই একাংশের চিন্তাধারা অপর অংশে পরিবেশন করিতে হইবে।

সরকারি পত্রিকায় অবশ্যই সরকারি নীতিরই প্রতিফলন ঘটবে। দেশের দুই অংশের মধ্যে সংহতির সৃষ্টি হোক –সে কামনা থাকাও খুবই স্বাভাবিক। মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে মুসলিম সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য গুরুত্ব পাবে, সেটাও প্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাঙালির যে হাজার বছরের হিন্দু-মুসলমানের সমন্বিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে, তাকে অবহেলা করা আত্মহত্যার শামিল। বাংলাদেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই জানত পাকিস্তানের দুটি অংশ– পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব বাংলার কেউই পূর্ব পাকিস্তানকে ‘মাশরেকি’ পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘মাগরেবি’ পাকিস্তান বলত না। এই শব্দ দুটি ছিল ৯৯ ভাগ বাঙালির কাছে অপরিচিত।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই অগণতান্ত্রিক মনোভাব থেকে শাসকেরা ঘোষণা দেন, দেশের ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে। ওই স্বৈরাচারী ঘোষণার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করেননি, প্রতিবাদ প্রথমে করেছেন প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েটের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিমান কবি-লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা সরকারি সুবিধা ও নেকনজর হারানোর ঝুঁকি নেননি।

চল্লিশের দশক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান লেখকেরা মানসম্পন্ন বিশুদ্ধ বাংলায় সাহিত্যচর্চা করেছেন। কেউ কেউ আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন তাঁদের কবিতায়, কিন্তু তা সাধারণ মুসলমান পাঠকদেরও প্রশ্রয় পায়নি। মুসলমান লেখকদের গদ্যে– গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধে– আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার বিরল। কিন্তু সাতচল্লিশের পরে গায়ের জোরে আরবি-উর্দুশব্দ ব্যবহারের প্রবণতা দেখা দেয়। মাহে নও-এর সম্পাদকীয়তে ইংরেজি কালচার অর্থে সংস্কৃতি না লিখে লেখা হলো ‘তাহজিব তামান’। এই পদ দুটির অর্থ শিক্ষিত বাঙালির কাছেও পরিষ্কার নয়। পূর্ববঙ্গকে নতুন নাম পূর্ব পাকিস্তান’ বললেও (সরকারি কাগজপত্রেও পূর্ববঙ্গ সরকার বলা হতো) একজন মানুষও মাশরেকি পাকিস্তান বলত না। স্বাধীনতা অর্থে আজাদি মেনে নেওয়া যায়। যা হোক, একটি মানসম্মত সাহিত্যপত্রিকার প্রয়োজন ছিল। কারণ, তখন ঢাকায় কোনো উন্নতমানের নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা ছিল না। কলকাতার হিন্দুদের পত্রিকায় মুসলমান লেখকেরা স্থান পেতেন না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি মুসলমান লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সমর্থনের সেটাও ছিল একটি কারণ।

কেন্দ্রীয় সরকার মাহে নও নামে উর্দু ও বাংলা সাময়িকী প্রকাশ না করে, যা করতে পারত তা হলো, উর্দুটির নাম মাহে নও এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা মাসিকটির বাংলা শব্দে নামকরণ। তা জাতীয় সংহতির পথে কোনো বাধা হতো না, মাহে নও-এর বাংলা নামকরণ হতে পারেনি দাস্যমনোবৃত্তিসম্পন্ন বাঙালি লেখকদের ব্যক্তিত্বহীনতার কারণে। তারা শুরুতে নিজের থেকেই পশ্চিমাদের প্রভুত্ব মেনে নেন।

মাহে নও-এর প্রথম সংখ্যায় যাদের যেসব লেখা ছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : শওকত ওসমানের গল্প (প্রথম প্রণতি), আশরাফ উজ্জামানের গল্প (আলেয়ার আলো), বেনজীর আহমদের কবিতা (দিগন্ত), আশরাফ সিদ্দিকীর কবিতা (সন্ধ্যার পাখি) এবং হাবীবুল্লাহ বাহারের প্রবন্ধ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, উর্দুভাষী মুখ্যমন্ত্রী স্যার খাজা নাজিমুদ্দীনের একটি প্রবন্ধ ছিল, যার শিরোনাম ‘কায়েদে আজম রহমতুল্লাহ আলাইহে’। রহমতুল্লাহ আলাইহে কথাটির আক্ষরিক অর্থ আল্লাহর রহমত তাঁর ওপর বর্ষিত হোক। কিন্তু সাধারণ রেওয়াজ বা ভাবার্থ হলো এই সম্মান শুধু পয়গম্বর ও পীর-আউলিয়াদের সম্পর্কে প্রযোজ্য। রাজনৈতিক নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কে এ অভিধা একেবারেই অপপ্রয়োেগ ও স্রেফ স্তাবকতা। জিন্নাহকে চল্লিশের দশকে কোনো কোনো লীগপন্থী পত্রিকা ‘আমিরে মিল্লাত’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছে। উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমানের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে জিন্নাহকে ‘কায়েদে আজম’ সম্বোধন করা হতো। মহাত্মা গান্ধীও তাঁকে কায়েদে আজম সম্বোধন করেছেন। তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাঁর স্তাবকের সংখ্যা পূর্ববঙ্গে সীমা ছাড়িয়ে যায়। তাঁর নিবেদিত প্রশস্তিমূলক কবিতা, প্রবন্ধ, নাটকের পরিমাণ বিপুল। লেখালেখির বিষয়বস্তু হিসেবে অবশ্যই তিনি গুরুত্বপূর্ণ, তা না হলে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা যশোবন্ত সিনহা তাঁকে নিয়ে বড় বই লিখতেন না। সুকান্ত ভট্টাচার্যও জিন্নাহকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা।

যা হোক, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচার বিভাগের পত্রিকা হলেও মাহে নও-এর মান ছিল উঁচু। সে সময় আধুনিক লেখকের সংখ্যাও ছিল কম। অল্প কিছু প্রপাগান্ডামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ থাকত বটে, মাহে নওর অধিকাংশ লেখাই ছিল উন্নত মানের। বিশেষ করে, ১৯৫২-তে যখন কবি ও প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির মাহে নও-এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন থেকে মাহে নও বাংলা ভাষার একটি প্রথম শ্রেণির সাহিত্যপত্রিকা হিসেবেই প্রকাশিত হতে থাকে। উন্নতমানের কাগজে ছাপা হতো নির্ভুল। পত্রিকাটি ছিল সচিত্র। মুসলমান শিল্পীদের আঁকা পেইন্টিং থাকত দু-চারটি প্রতিটি সংখ্যায়। একেবারে মাসের প্রথম দিনই মাহে নও স্টলে পাওয়া যেত। মাহে। নও-এর অনেক বহুরঙা প্রচ্ছদ করেছেন জয়নুল আবেদিন। পাকিস্তান না হলে তিনি বা তাঁর মতো মুসলমান শিল্পীরা কলকাতায় এই সুযোগ পেতেন না।

দীর্ঘদিন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মাহে নও সম্পাদনা করেছেন আবদুল কাদির। কবি হিসেবেই ছিল তাঁর খ্যাতি। পরে খ্যাতি অর্জন করেন গবেষক হিসেবে।

আবদুল কাদির যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র, তখন তিনি মুসলিম সাহিত্য সমাজ’র আবুল হুসেন, কাজী আবদুল অদুদ, কাজী আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ প্রগতিশীল লেখকের সংস্পর্শে আসেন। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচিতি পান। ওই সময় কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং তার একজন প্রীতিভাজনে পরিণত হন। কবিতা লিখতেন এবং গদ্যচর্চাও করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ বিএ ক্লাসের ছাত্র থাকা অবস্থায় মুসলিম হলের ম্যাগাজিন সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর পড়ালেখা অসমাপ্ত রেখে সাহিত্যচর্চার নেশায় কলকাতা যান এবং মুহম্মদ নাসিরউদ্দিনের সওগাত যোগ দেন সহ-সম্পাদক হিসেবে। সাহিত্য-সাময়িকী সম্পাদনায় তাঁর আগ্রহ ছিল তরুণ বয়স থেকেই। ১৯৩৭ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যকাগজ জয়তী। সেটি ছিল একটি প্রগতিশীল সাহিত্য-সাময়িকী। প্রতিষ্ঠিত লেখকেরা তাতে লিখতেন। নজরুল ইসলাম ও আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ এ তিনি সাময়িকী বিভাগে কিছুদিন কাজ করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। কবি হিসেবে তখন তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর ছন্দজ্ঞান অতি প্রখর। এ জন্যে তাঁকে একসময় বলা হতো ‘ছান্দসিক কবি’। পত্রিকা সম্পাদনা ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে তাঁর কাব্যচর্চা ব্যাহত হয়েছে।

সম্পাদক হিসেবে আবদুল কাদিরের নিষ্ঠা ও দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনার অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর দীর্ঘকালের। তিনি মুসলিম সাহিত্যসমাজের মুখপত্র, শিখা সম্পাদনা করেছেন বিশের দশকে। সম্পাদক হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর। আবদুল কাদিরের পর তারই সহকারী কবি তালিম হোসেন মাহে নও-এর সম্পাদক হন। তিনিও দক্ষ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর। সহকারী ছিলেন প্রাবন্ধিক শাহাবুদ্দিন আহমদ।

শুধু সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনানয়, আবদুল কাদির গ্রন্থ সম্পাদনায়ও ছিলেন খুবই নিষ্ঠাবান। নজরুল রচনাবলী সম্পাদনা তাঁর হাত দিয়েই শুরু। তাঁর সহযোগিতা ছাড়া নজরুল রচনাবলী সংগ্রহ করা কঠিন হতে বাংলাভাগের পর। নজরুল ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন বেগম রোকেয়া রচনাবলী, ইসমাইল হোসেন শিরাজী রচনাবলী, লুৎফর রহমান রচনাবলী, ইয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলী এবং আবুল হুসেন রচনাবলী। এই সম্পাদনার কাজটি যে বাংলা সাহিত্যের কত উপকার করেছে, তা যে কেউ উপলব্ধি করবেন।

একটি কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার। আজ নজরুলকে নিয়ে নানা রকম গবেষণা হচ্ছে। আবদুল কাদির নজরুলের লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনা না করলে নজরুল গবেষণা পরবর্তী গবেষকদের জন্য দুরূহ হতো। এই প্রসঙ্গে তালিম হোসেনের নামটি না নিলে ঘোরতর অন্যায় হবে। তাঁর সম্পাদিত নজরুল একাডেমী পত্রিকা নজরুল গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। প্রত্যেক নজরুলগবেষক আবদুল কাদির এবং তালিম হোসেনের কাছে অপরিশোধ্য ঋণের দায়ে আবদ্ধ। নজরুলচর্চায় নজরুল একাডেমীর ভূমিকা তুলনাহীন।

ষাটের দশকে আবদুল কাদির কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশনা কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁর পরিচালক ছিলেন মুহম্মদ এনামুল হক। তার অফিস ছিল গ্রিন রোডে (ঢাকা) এক বাড়িতে। আমরা যেতাম তার অফিসে, দেখতাম তিনি সারাক্ষণ কাজ করছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। তাঁর কাছে জানা যেত তিরিশ ও চল্লিশের দশকের বহুগুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

প্রচুর পড়াশোনা করতেন আবদুল কাদির। শেষ করলেও পড়াশোনা ছাড়া তিনি সময় নষ্ট করতেন না। স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে তিনি মাঝে মাঝে নিউ মার্কেটে আসতেন। বইপাড়ার কোনো বইয়ের দোকানে বসে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। তার থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে শিখেছি প্রচুর। বহু পুরোনো সাহিত্যকর্ম তাঁর কাছে ছিল। সেগুলো দেখতে চাইলে বলতেন, টাকা ছাড়া এসব কাউকে আমি দেব না। এদিক থেকে আবদুল কাদির সঠিক ছিলেন।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাঁর সম্পাদিত মাহে নও ছিল পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে নিয়মিত বাংলা সাময়িকী। এটি পূর্ব বাংলার প্রথম পত্রিকা, যা লেখককে সম্মানী দিত। সেকালে ২০-২৫ টাকা সম্মানী কম নয়। দুই মণ চাল কিংবা চার আনা সোনা অথবা ১২-১৩ ভরি রুপার দাম।

১০. নওবাহার

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে চল্লিশের দশক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের আত্মপ্রকাশের দরজা ছিল সংকীর্ণ। কলকাতার হিন্দুদের পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে মুসলমান লেখকদের লেখা ছাপা হতো না। মুসলমানদের দুটি প্রধান সাহিত্য পত্রিকা ছিল মোহাম্মদ আকরম খাঁর মোহাম্মদী এবং মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের সওগাত। আধুনিক মুসলমান লেখকদের ভরসা ছিল মোহাম্মদী ও সওগাত। পত্রিকা দুটি ছিল মানসম্মত, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সাময়িকীগুলোর প্রায় সমপর্যায়ের। খুব উঁচু মানের লেখা যেমন থাকত, তেমনি নতুন অনেক লেখকের কাঁচা রচনাও থাকত। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের কিছুটা দুর্বল লেখাও প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার দায়িত্ব নতুন লেখক তৈরি করা। খুব দুর্বল যারা তারা অবলীলায় ঝরে পড়ে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, ফররুখ আহমদ, গোলাম কুদ্দুস, আহসান হাবীব, রশীদ করীম প্রমুখ নতুন প্রজন্মের কবি ও কথাশিল্পীর লেখা সওগাত, মোহাম্মদীই ধারণ করেছে। মোহাম্মদী ছিল প্রধানত রক্ষণশীল, অনেকটা প্রতিক্রিয়াশীলও বটে; কিন্তু সওগাত ছিল প্রগতিশীল। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে বহু নারী কবি-সাহিত্যিক তৈরি করেছে সওগাত। নারী প্রগতির প্রশ্নে সওগাত-এর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিল সওগাত। লেখকদের মধ্যে দুটি দল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল– সওগাত দল ও মোহাম্মদী দল। মাঝে মাঝে দুই দলের মধ্যে কলমযুদ্ধ হতো। সে বিতর্কও মূল্যহীন নয়। তাতে উভয় পক্ষের ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটত। মোহাম্মদীতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ থাকত, সওগাত হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিল।

মুসলমানদের সম্পাদিত সাহিত্যপত্রিকাগুলোর মধ্যে তিরিশের দশকে হবীবুল্লাহ বাহারের বুলবুল ছিল মানসম্মত এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক। যদিও তিরিশের দশকেই হবীবুল্লাহ বাহার মুসলিম জাতীয়তাবাদী মুসলিম লীগে যোগ দেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক। ১৯৪৬-৪৭-এ মহাত্মা গান্ধী যখন নোয়াখালী শান্তি মিশনে আসেন, তখন তাকে তিনি সহযোগিতা করেন এবং তাতে গান্ধীজি প্রীত হন।

১৯৪১ সালে কাজী আফসারউদ্দিন আহমদ প্রকাশ করেন দ্বিমাসিক মৃত্তিকা। এই পত্রিকাটি ছিল অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী। হিন্দু-মুসলমান সবার লেখাই মৃত্তিকায় প্রকাশিত হতো। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহসহ অনেকেই ছিলেন মৃত্তিকার লেখক। এসব কাগজের চরিত্র ছিল লিটল ম্যাগাজিনের। প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি মোহাম্মদী বা সওগাত-এর মতো। চল্লিশের দশকে মুসলমানদের সম্পাদিত বেশ কিছু মাসিক পত্রিকা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। সেগুলো প্রায় সবই ছিল সাম্প্রদায়িক; হিন্দুবিরূপতা যত না ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রচারক ও আধুনিকতা বিরোধিতা।

১৯২০-এর দশকে কবি হিসেবে বাংলায় খ্যাতিমান ছিলেন কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্‌দীন প্রমুখ। গোলাম মোস্তফা ছিলেন বিভিন্ন জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অতি সরল-সোজা মানুষ। বালিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলে তিনি সত্যজিৎ রায়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর যশোরী উচ্চারণ নিয়ে সত্যজিৎ মৃদু রসিকতা করেছেন তাঁর শৈশবস্মৃতিতে। তিনি ছিলেন অতি উদার ও ইসলামি ভাবাদর্শের কবি। পাকিস্তান আন্দোলনের এক অবিচল সমর্থক ছিলেন গোলাম মোস্তফা। নজরুল ইসলামের হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ী সংস্কৃতি ও ভাবধারার তিনি ছিলেন বিরোধী, পাকিস্তানবাদী কবিতা ও গান রয়েছে তাঁর বহু। তাঁর একটি গান ছোটবেলায় আমরা স্কুলে গাইতাম :

পাকিস্তান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।
পুরব বাংলার শ্যামলিয়ায়,
পঞ্চনদীর তীরে অরুণিয়ায়,
ধূসর সিন্ধু মরু সাহারায়
ঝাণ্ডা জাগে যে আজাদ।

মুসলিম জাতীয়তাবাদী বা মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী হলেও গোলাম মোস্তফা হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন না। ছিলেন রোমান্টিক কবি, কোনো ইনটেলেকচুয়াল বা চিন্তাবিদ ছিলেন না। তখনকার অনেকের মতোই পাকিস্তান ও ইসলাম বিষয়ে প্রচুর কবিতা রয়েছে তার। সেগুলো চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রথম দিকের রচনা। ১৯৪৯-এ তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তখনই প্রকাশ করেন নওবাহার নামে একটি সচিত্র মাসিক পত্রিকা। আগস্ট ‘৪৯ সালে প্রকাশিত নওবাহার-এ সরকারি শুভেচ্ছা ছিল বলে শুনেছি। সেটা থাকা সম্ভব তা পত্রিকার ‘উদ্দেশ্য’ শীর্ষক সম্পাদকীয় থেকে ধারণা করা যায়। তাতে বলা হয়েছিল :

‘নওবাহার কোনো দলীয় প্রচারপত্র নয়। এ নিছক একখানি সাহিত্যপত্র। …বাস্তব রাজনীতির কোন আলোচনা ইহাতে থাকিবে না, তবে রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শন– যাহা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত– তাহার আলোচনায় বাধা নাই। পাকিস্তান বিরোধী কোন বিষয়বস্তুও নওবাহারে স্থান পাইবে না। …আমাদের তহজীব ও তমুদ্দনের রূপায়ণ হইবে নওবাহারের অন্যতম লক্ষ্য। নওবাহার কমিউনিজম রুখিবে। নারী-প্রগতি নওবাহারের অন্যতম সাধনা হইবে।…

‘নওবাহারকে কেন্দ্র করিয়া আমরা এমন একদিন সাহিত্যিক গঠন করিতে চাই যাহারা জাতির চিন্তায় বিপ্লব আনিবে।… এই কাৰ্য্যে আমরা আমাদের প্রিয় নবীর অনুসরণ করিতে চাই।’

পত্রিকাটি পজিটিভ ভূমিকা না নিয়ে না-বাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সম্পাদক পাকিস্তানবিরোধী কোনো লেখা ছাপবেন না, সেটা স্বাভাবিক ও সংগত; কিন্তু কমিউনিজম রুখবেন এবং ইসলামি চিন্তাধারার প্রচারক হবেন। সেটা কম রাজনীতি নয়। আধুনিক চিন্তাধারার কোনো কথা নেই। পাকিস্তানের মতো একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আধুনিক চিন্তার চর্চা হওয়ারই কথা। কিন্তু শাসকেরা চাইছিলেন পাকিস্তানকে ‘ইসলামি জহুরিয়াত’ বা ইসলামি গণতন্ত্র বানাতে। সেটা কী বস্তু, তা পৃথিবীর কোনো মানুষের ধারণায় ছিল না।

নওবাহারের প্রথম সংখ্যার লেখকসূচি দেখলেই তার নীতি ও আদর্শ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা হবে: গোলাম মোস্তফার কবিতা (নওবাহার), ফররুখ আহমদের কবিতা (জবানে আজাদী), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর প্রবন্ধ (পাকিস্তানে ইসলামের নীতি), আবুল ফজলের নাটিকা (পাকিস্তান), মীজানুর রহমানের নিবন্ধ (পাকিস্তানী), বেগম সুফিয়া কামালের কবিতা (ঈদের চাঁদ), শওকত ওসমানের গল্প (আরবের বন্ধু), গোলাম মোস্তফার প্রবন্ধ (মার্কসীজম কি বাঁচিয়া আছে?) প্রভৃতি। কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের ওপরই আক্রোশটা ছিল কিছুটা বেশি, কারণ মার্কসবাদ নিরীশ্বরবাদী। পাকিস্তানে ঈশ্বর থাকুন না থাকুন আল্লাহ থাকবেন না– তা সম্পাদক কল্পনাও করতে পারেননি।

লক্ষ করার বিষয় যে নওবাহারে সব রচনারই বিষয়বস্তু আরব দেশ, পাকিস্তান ও ইসলাম। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের নীতি-আদর্শ প্রচার দোষের ছিল না। মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্রে ইসলাম ধর্ম এবং হিন্দুপ্রধান ভারতে হিন্দুধর্ম প্রাধান্য পাবে, তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সঙ্গে আধুনিক শিল্প-সাহিত্য ও চিন্তাধারা যদি উপেক্ষিত হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্র জনগণের সার্বিক কল্যাণ করতে পারে না– এই বিষয়টি সেকালের খ্যাতিমান মুসলমান কবি-লেখকেরা উপলব্ধি করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। অথচ তাঁদেরই অনেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ভোল পাল্টান। ছদ্ম সেকুলার হতে গিয়ে অতিমাত্রায় ইসলামবিরূপতার প্রকাশ ঘটাতে থাকেন কারণে-অকারণে। তার ফলে এই হিন্দু মুসলমানের সমন্বিত সংস্কৃতির দেশে ইসলামি মৌলবাদকে মাথাচাড়া দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করেন।

স্বাধীনতার পরে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মযহারুল ইসলাম এমন মাত্রায় বাঙালি হতে চান যে তিনি ‘আসোলামু আলাইকুম’, ‘জনাব প্রভৃতিকে সাম্প্রদায়িক বিষয় মনে করে তা বাদ দিতে চান। তাঁর প্রস্তাব হয় : ‘জনাব’ এর বদলে লিখবেন ‘সুজন’। সুজন অমুক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে কোনো চিঠি দেওয়ার পরে বিষয়টি কারও চোখে পড়ে। উচ্চপর্যায় থেকে ধমকের পরে এই অপতৎপরতা বন্ধ হয়।

১১. মুসলিম জাতীয়তাবাদী কবি

১৯৪৭-এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের সময় নতুন রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’ ছিল একটি বাস্তবতা, যেমন ২৪ বছর পর ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয় একটি বাস্তবতা। উপমহাদেশের দুই প্রান্তে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা মুসলমানদের স্বশাসিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার ফসল পাকিস্তান। ১৯৪০ সালের মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব যদি অসংশোধিতভাবে বাস্তবায়িত হতো, তাহলে পশ্চিমে পাকিস্তান নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও এদিকে পূর্ব বাংলা নামেই একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হতো– পূর্ব পাকিস্তান বা পাকিস্তান নয়। ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে সিদ্ধান্ত হয়, দুই ডানাবিশিষ্ট একটি রাষ্ট্র, যার নাম হবে পাকিস্তান। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাতেও সম্মতি জানায় পরিস্থিতির কারণে। মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম মৃদু আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু তা গৃহীত হয়নি।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা সব বাঙালি মুসলমানের কাছে এক রকম ছিল না। খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে যা পাকিস্তান, মওলানা ভাসানীর কাছে পাকিস্তান হওয়ার কথা ছিল একেবারেই অন্য জিনিস। মওলানা আকরম খাঁ বা আবুল কালাম শামসুদ্দিন বা প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর কাছে যা পাকিস্তান, কবি ফররুখ আহমদ বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাছে পাকিস্তান তা নয়– তাদের ধারণায় পাকিস্তান অন্য রকম। এ সম্পর্কে প্রাবন্ধিক আবদুল হকের বক্তব্য এ রকম :

‘তখন [১৯৪৫-৪৬] পাকিস্তান আন্দোলনের সময়। এ আন্দোলনকে মুসলিম সমাজের একেক শ্রেণি একেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখত : শ্রেণিস্বার্থের দিক থেকে। এই শ্রেণিস্বার্থ পরে যেমন সুস্পষ্ট রূপ পেয়েছিল, তখন তেমন পায়নি। তখন ছাত্র ও অছাত্র যুব সম্প্রদায় প্রায় সমগ্রভাবেই পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করত, স্বপ্ন ও সংকল্প নিয়ে। পাকিস্তান পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হবে না– এই ছিল স্বপ্ন; একে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হতে দেওয়া হবে না –এই ছিল সংকল্প। সমগ্র যুব সম্প্রদায়ের না, সচেতন অংশের। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা তখন দ্রুত মুসলিম যুবসমাজে প্রসার লাভ করছে।… কিছু তরুণ নেতা ও নব্য বুদ্ধিজীবীর প্রচারণার ফলে সেই সময়ে এ রকম একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে, সমাজতান্ত্রিক আদর্শ এবং ইসলামী রাষ্ট্ৰাদর্শের মধ্যে সাদৃশ্যই বেশি, বিরোধ সামান্য। সেই সঙ্গে এই চেতনাও বেশ খানিকটা ছিল যে, মুসলিম লীগ নেতৃত্বের বড় অংশই প্রতিক্রিয়াশীল এবং ধনতন্ত্রের সমর্থক, অথ বা সমর্থক হবেন। ধনতন্ত্র পাকিস্তানের মৌলিক লক্ষ্যের বিরোধী এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক কর্মীদের মতো লেখকদেরও কর্তব্য আছে, এ বিষয়ে ফররুখ আহমদ এবং আমি একমত ছিলাম। ভারতীয় সমাজে যে সামাজিক এবং মানবিক বৈষম্য আছে তা পাকিস্তানে সম্ভব হবে না, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান। অধিকতর অগ্রসর রাষ্ট্র হবে, হওয়া উচিত, এই ছিল আমাদের ধারণা।

[‘সায়দুল হক, ফররুখ আহমদ’]

আবদুল হকের এই বক্তব্য শতভাগ সত্য। চল্লিশের দশকে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে, ফররুখ আহমদের সঙ্গে আবদুল হকের বন্ধুত্ব ছিল। ফররুখ রিপন কলেজে বুদ্ধদেব বসুর ছাত্র ছিলেন। তাঁর কবিত্বশক্তি সম্পর্কে বুদ্ধদেবের কোনো সংশয় ছিল না। তাঁর কবিতা পত্রিকায় ফররুখের কবিতা তিনি প্রকাশ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে আবদুল হক লিখেছেন, তার পরিচিতদের সকলেই জানেন, তিনি খুব মজলিসী এবং সদালাপী ছিলেন, তবে যেখানে মতের মিল হতো সেখানে।

ফররুখ অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। অন্যায়কে নীরবে মেনে নিতেন না। আবদুল হক লিখেছেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মুহূর্তে ১৯৪৭ সালে ফররুখ মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা এবং আজাদ ও মোহাম্মদীর মালিক-সম্পাদক মওলানা আকরম খাঁর বিরুদ্ধে এক প্রতারণার মামলা দায়ের করেছিলেন। ফররুখের রচিত ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান নামক একটি কবিতা মওলানা আজাদ তাঁর নিজের নামে ছাপেন। তার প্রতিবাদে ফররুখ মওলানার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন (অথবা তার ব্যবস্থা করেছিলেন); মামলার তদবির উপলক্ষে তিনি একদিন আমাকে সঙ্গে নিয়ে এক ব্যারিস্টারের কাছে গিয়েছিলেন বলে আবদুল হক লিখেছেন।

পূর্ব বাংলার মানুষ দীর্ঘকাল শিকার হয়েছিল শোষণ, অবহেলা ও বৈষম্যের। প্রগতিশীল তরুণেরা মনে করতেন, পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং সেখানে থাকবে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও সেখানে কোনো রকম অবিচার ও বৈষম্যের শিকার হবে না। অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল তরুণদের এ রকম একটি প্রত্যয় ছিল। ফররুখের বিশ্বাস ছিল ‘ইসলামি সমাজবাদে’। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময়ের ফররুখ সম্পর্কে আবদুল হক লিখেছেন:

.. ৬ সার্কাস রো-তে আমি এবং কবি হাবীবুর রহমান একটি ঘর ভাড়া নিয়ে কিছুদিন ছিলাম। পরে হাবীবুর রহমান অন্যত্র গিয়েছিলেন। সেইখানে আটচল্লিশের কোনো এক সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রা দর্শন কি হওয়া উচিত, এই আলোচনায় আমাদের বক্তব্য দাঁড়াল সংক্ষেপে সমাজতন্ত্র, তাঁর বক্তব্য দাঁড়াল “তবলীগ”। এই শব্দটিও তিনি ব্যবহার করেছিলেন। অবশ্য নিছক ধর্মপ্রচারের অর্থে তিনি বলেননি : অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি সকল ক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শ প্রচারের অর্থে বলেছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শকে পাকিস্তানের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করলে সে রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রই হবে, অধিকন্তু কমিউনিজমের জড়বাদ থেকে মুক্ত হওয়ায় পাকিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উন্নততর রাষ্ট্র হবে –এই ছিল ফররুখ আহমদের দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি ছিলেন জড়বাদের ঘোর বিরোধী। তাঁর কবিতায় নিন্দার্থে জড়বাদ শব্দটি প্রচুর ব্যবহৃত হয়েছে। এই জড়বাদ শুধু পশ্চিমী সভ্যতার নয়, কমিউনিস্ট মতবাদের জড়বাদও। প্রথম জীবনে তিনি অর্থনৈতিক আদর্শের আকর্ষণে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি স্বল্পকালের জন্য আকৃষ্ট হয়েছিলেন।… প্রধানত ঐ জড়বাদের জন্যই তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ও মতবাদ থেকে বিকর্ষিত হয়েছিলেন। ইসলামী আদর্শের রূপায়ণ এবং প্রচার পাকিস্তানের রাষ্ট্রনীতির অঙ্গ হওয়া উচিত, এই ছিল ফররুখ আহমদের দৃঢ় অভিমত। সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি সমগ্র পৃথিবীতে কমিউনিজম প্রচারের নীতি গ্রহণ করতে পারে, তা হলে পাকিস্তান সমগ্র পৃথিবীতে ইসলামী আদর্শ প্রচারের নীতি গ্রহণ করবে না কেন, এই ছিল তার যুক্তি।’

তার এই বিশ্বাসকে তাঁর সৎ আকাক্ষা বা শুভ ইচ্ছা বলা যেতে পারে কিন্তু যুক্তি নয়। কী প্রক্রিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা ফররুখের অজানা ছিল না। পাকিস্তান কোনো বিপ্লবের ফসল ছিল না। গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিষ্ঠিত, তবে রক্ষণশীল, অনেকখানি প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক নেতৃত্বে যে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে তার পক্ষে রাষ্ট্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। এই বিষয়টি আবেগপ্রবণ ফররুখ ভেবে দেখেননি।

সম্ভব নয় বলেই পাকিস্তানে যেমন ইসলামি সমাজবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সামরিক একনায়কত্ব, তেমনি অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে ‘সীমাহীন রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও এবং তার অন্যতম মূলনীতি সমাজতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যা হোক, পাকিস্তানি শাসকেরা শুরুতেই স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় দেন। তার প্রথম প্রকাশ ঘটে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ফররুখ ছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের একেবারেই বিপরীত অবস্থানে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। এ সম্পর্কে আবদুল হকের বক্তব্য:

‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘোষণার পরেই উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, আমরা উভয়ে তার বিরোধিতা করার সংকল্প নিয়েছিলাম। সাতচল্লিশের জুন মাসেই আমরা যুক্তভাবে বাংলার সপক্ষে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু প্রচারকার্য চালিয়েছিলাম, এবং উভয়েই বাংলার সপক্ষে পত্রপত্রিকায় লিখেছিলাম।’

তবে সাহস কম থাকায় আবদুল হক লিখেছিলেন ছদ্মনামে এবং সাহসী ফররুখ লিখেছিলেন স্বনামে। যে মাসে পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করে, সেই ‘৪৭-এর আগস্টেই সওগাত-এ ফররুখ এক নিবন্ধে লেখেন :

‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ চলছে। আর সবচাইতে আশার কথা এই যে, আলোচনা হয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, জনগণ ও ছাত্রসমাজ অকুণ্ঠভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে।

‘তাই যদি হয়, তাহলে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।’

(ফররুখ আহমদ, ‘পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’, সওগাত, আশ্বিন ১৩৫৪]

নতুন রাষ্ট্র থেকে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সবাই সরকারি নীতির অন্ধ সমর্থক ও ক্ষমতাসীনদের নির্লজ্জ স্তাবকে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁরা সেদিন প্রায় প্রত্যেকেই ইসলামের নিশানবর্দার হয়ে যান। ইসলামী ঐতিহ্য রক্ষায় তারা মাতৃভাষার মর্যাদাকে বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত ছিলেন না। ফররুখ আহমদ, যিনি ছিলেন ইসলামি মূল্যবোধের অবিচল সমর্থক, তাঁদের ধিক্কার জানিয়ে সেদিন লিখেছিলেন :

‘পাকিস্তানের, অন্তত পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে, এ কথা সর্ববাদীসম্মত হলেও আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানেরই কয়েকজন তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলা ভাষার বিপক্ষে এমন অর্বাচীন মত প্রকাশ করেছেন, যা নিতান্তই লজ্জাজনক। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপায়িত করলে ইসলামী ঐতিহ্যের সর্বনাশ হবে এই তাঁদের অভিমত।

‘কী কুৎসিত পরাজয়ী মনোবৃত্তি এর পিছনে কাজ করছে এ কথা ভেবে আমি বিস্মিত হয়েছি। যে মনোবৃত্তির ফলে প্রায় দু’শ বছর বাংলা ভাষায় ইসলামের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ ছিল, সেই অন্ধ মনোবৃত্তি নিয়েই আবার আমরা ইসলামকে গলাটিপে মারার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছি।

সেদিন ফররুখ সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবীকে চেপে রাখা কারুর সাধ্যেই কুলাবে না। ঐ ন্যায়সঙ্গত দাবীর বলেই পাকিস্তানের জনগণ শুধু আহার্যের নয় –সংস্কৃতি ও ভাষার অধিকার কেড়ে নেবে।’

বাঙালি তার ভাষার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। নতুন নতুন ভাষাসৈনিকের দাবিদার আজ অসংখ্য মানুষ। বহু সুবিধাবাদী ও বিভ্রান্ত মানুষ সেদিন এদিকেও ছিলেন ওদিকেও ছিলেন। ফররুখ আহমদের বহু নীতিই অভ্রান্ত ছিল না, কিন্তু বাংলা ভাষার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। তিনি ইসলামিক আদর্শের কথা বলেছেন, কিন্তু ঘৃণা করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানি মোনাফেক শাসক শোষকদের। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ফররুখকে যারা অবহেলা করেছেন, তাঁরা কেউ পাকিস্তানি আমলে তাঁর চেয়ে বেশি সততার পরিচয় দিয়েছেন, তেমন প্রমাণ নেই। মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেননি বলে তার সমর্থনে তিনি একটি বাক্যও লেখেননি, বিরোধিতা করেও রেডিও-টেলিভিশনেও বক্তব্য দেননি। কিন্তু রেডিও টেলিভিশনে কথিকা প্রচার করেছেন দেশ স্বাভাবিক আছে, কোনো গোলাগুলি নেই– এইসব বলে, স্বাধীনতার পরে তারা অবলীলায় সরকারে ভিড়ে গেছেন। ফররুখ মারা গেছেন অপুষ্টিজনিত দুর্বলতা থেকে।

 ১২. রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে

১৯৪৭-৪৮ সালের পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে নানা রকম বিভ্রান্তি ছিল। তখন পূর্ব বাংলায় শিক্ষিত সমাজের পরিধি ছিল খুবই ছোট। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নয়, কলেজ পর্যায়ে পড়ালেখা করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা ছিল অল্প। গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা খুবই কম। সারা প্রদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র একটি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, একটি মাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ : আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং সরকারি ও বেসরকারি কলেজ মাত্র কয়েকটি। প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিচর্চার পরিধি ছিল খুবই সংকীর্ণ। যারা চিন্তাশীল মানুষ, তাঁরা ছিলেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, একেবারেই সংঘবদ্ধ নন, বিভিন্ন মতাদর্শে বিভক্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। অনেকে কলকাতায় কোনো রকমে বেঁচেবর্তে ছিলেন, ঢাকায় এসে বেকায়দায় পড়েন। সরকারের শুভদৃষ্টিতে থাকায় কারও কারও কপাল খুলে যায়। তারা এমন কোনো বিতর্কিত বিষয়ে জড়িয়ে পড়া পছন্দ করতেন না, যার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার নাখোশ হবে এবং তাদের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটাবে।

ওই সময়ের পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখা যায়, অনেকেই পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা-ই নিয়েই ভাবিত ছিলেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা ছিল না। এবং তারা চাইতেন পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা বাংলাই হোক। মুসলিম লীগের প্রায় সব নেতাই এই শ্রেণিতে পড়েন। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে যারা আর কিছু অগ্রসর তারা চাইতেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা ও উর্দু। শুধু বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ মানবে না এবং সে দাবিও অন্যায্য; অন্যদিকে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা একমাত্র উর্দুকে মানতেই পারে না। অতি ক্ষুদ্র একটি গোত্র ছিল, বাঙালিদের মধ্যেও যারা চাইত পাকিস্তান মুসলমানদের দেশ, সেই দেশের রাষ্ট্রভাষা যদি শুধু উর্দু হয় তো হোক। নিতান্ত নির্বোধ কেউ কেউ ছিলেন, যারা মনে করতেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি হলেই-বা ক্ষতি কী? একটি জাতির মধ্যে সংহতি না থাকায় এমনটি হতে পারে। আরেকটি কারণ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে যুক্তিশীলতা ও বিচার-বিবেচনার অভাব। এবং বেশি অভাব আত্মপরিচয় ও স্বাজাত্যবোধের।

মুসলিম লীগের বাঙালি নেতারাও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ছিলেন না, যদিও তাঁদের নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ চেয়েছিলেন একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তাঁরা প্রকাশ্যে নেতার বিরোধিতা করেননি, যদিও তাঁদেরও দাবি ছিল বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা। কারণ, তাঁদের প্রায় কেউই উর্দু লিখতে বা পড়তে পারতেন না– দু-চারটে কথা বলতে পারতেন সেকালের অনেকেই।

জিন্নাহও তাঁর ভাষণে প্রথম বাক্যের পরে দ্বিতীয় বাক্যে বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা কী হবে, তা প্রদেশবাসীই ঠিক করবেন– তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং উর্দু অন্য কোনো ভাষা নয়। কি কলকাতা, কি দিল্লি, কি করাচি, কি ঢাকা সব জায়গায়ই বাঙালি নেতারা জিন্নাহর সঙ্গে কথা বলেছেন উর্দুতে –বাংলায় তো নয়ই, ইংরেজিতেও নয়।

১৯৪৭ সালের ১২ নভেম্বর, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে, মুসলিম জাতীয়তাবাদী সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র-যুবকদের এক সভা

অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন সাহিত্যিক, বুলবুল সম্পাদক ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবীবুল্লাহ বাহার। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন কবি জসীমউদ্‌দীন, মুহাম্মদ এনামুল হক, যৌনবিজ্ঞান বইয়ের লেখক আবুল হাসনাৎ, প্রাদেশিক কৃষিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল। সভার উদ্বোধন করেন প্রাদেশিক বেসামরিক সরবরাহমন্ত্রী নূরুল আমিন, পরে যার মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত প্রমুখ শহীদ হন। ওই সভায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, লীলা রায়সহ বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের বহু অধ্যাপক ও কবি-লেখক উপস্থিত ছিলেন।

উদ্বোধনী ভাষণে নূরুল আমিনের বক্তব্য মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর দৈনিক আজাদ-এর প্রতিবেদনে ছিল এ রকম :

‘যদি রাষ্ট্রের জনসাধারণের মাতৃভাষার মধ্যস্থতায় রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা না হয়, তবে নাগরিকদের সহিত সে রাষ্ট্রের সম্পর্ক অতি শীঘ্র বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের উপর বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা চাপানো যুক্তিযুক্ত নহে। বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে ঘোষণা করার কোনও প্রতিবন্ধক নাই বলিয়াই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’

নূরুল আমিন আরও বলেন :

‘এসলাম ধর্মের সহিত উর্দু ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বলিয়া আলেমগণ যে দাবী উত্থাপন করেন তাহা যুক্তিসঙ্গত নহে। সত্য কথা বলিতে কি এসলাম ধর্মের সহিত উর্দু ভাষার অধিক সম্পর্ক নাই। এসলাম ধর্মের সহিত ভারতের অন্যান্য ভাষার যতটা সম্পর্ক উর্দুর সহিতও ঠিক ততটা সম্পর্কই আছে।’

ওই সভায় নূরুল আমিন আরও কিছু কথা বলেছিলেন বাংলা ভাষা সম্পর্কে। তিনি বলেছিলেন বাংলা ব্যাকরণ ও বানান সহজ করা প্রয়োজন। সে ব্যাপারে বাঙালি সাহিত্যিক ও পণ্ডিতদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। নূরুল আমিনের বক্তব্যে পূর্ব বাংলার অধিকাংশ লীগ নেতার মতামতের প্রতিফলন ঘটে।

ওই সভায় কবি জসীমউদ্‌দীন তাঁর বক্তৃতায় দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। তাঁর দাবির পক্ষে তিনি বাঙালি কবির নোবেল পুরস্কার পাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি এমনও বলেন, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হবে না– এটা কোনো বিতর্কের বিষয়ই হতে পারে না। এরপর ১৯৫০ সালেও শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের সরকারি বাসভবনে কবি সাহিত্যিকদের এক বৈঠকে মন্ত্রী উর্দুর প্রতি সমর্থন দেওয়ায় সেখানে জসীমউদ্‌দীন রূঢ়ভাবে প্রতিবাদ করেন। এবং যারা মন্ত্রীকে মৃদু সমর্থন করে স্তাবকতা করছিলেন, তাঁদের ওপর শারীরিকভাবে চড়াও হতে উদ্যত হন। সৈয়দ আলী আহসান মন্ত্রীর পক্ষে ছিলেন।

যা হোক, বাঙালি কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ঐক্য, সংহতি ও বিচার-বিবেচনা থাকলে ভাষা আন্দোলন অল্প দিনেই শেষ হতে পারত। এবং বাহান্নতে এতগুলো তরুণের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হতো না। বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রান্তি ও সুবিধাবাদিতার কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকার সাহস পায়। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব সংহত করার বহু উপায় ছিল। জনগণ সুসংগঠিতই ছিল। কিন্তু সবকিছু বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে মাথা ঘামাতে থাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এবং তাদের সেই অপকর্মে তারা সহযোগী হিসেবে পায় পূর্ব বাংলার একশ্রেণির কবি সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদকে। একটি কথা শুনতে স্বাধীন বাংলাদেশের অনেকেরই ভালো লাগবে না, তা হলো উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা জিন্নাহ মাত্র দুবার –রেসকোর্সে ও কার্জন হলে উচ্চারণ করেছিলেন। তারপর তিনি এক বছর জীবিত ছিলেন, আর কখনো রাষ্ট্রভাষা নিয়ে কোনো কথা বলেননি; তাঁর কথার প্রতিধ্বনি করেছেন বাংলার উর্দুভাষী রাজনীতিবিদ– খাজা নাজিমুদ্দীন। রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে স্বাধীনতা অর্জনের সময় থেকেই নানা রকম উন্মত্ততা দেখা দেয় একশ্রেণির শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে। কেউ তোলেন আরবিকে রাষ্ট্রভাষার দাবি, কেউ প্রস্তাব করেন আরবি হরফে বাংলা লেখার। আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার প্রস্তাব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় তিন দশক আগেই একবার করা হয়েছিল। মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত আল-এসলাম-এর এক নিবন্ধে ১৯১৬ সালে বলা হয়েছিল :

‘উর্দুর ন্যায় আমাদের ভাষা আরবী অক্ষরে কায়দা মতে লেখা হইলে আরব ও পারস্যের লোক অতি সহজে আমাদের ভাষা পড়িতে ও লিখিতে পারিবে এবং আমরাও তাহাদের ভাষা পড়িতে ও লিখিতে পারি। আমাদের মাতৃভাষা আরবী অক্ষরে লিখিতে হইলে নিশ্চয়ই তাহার প্রতি সাধারণের ভক্তি অতি বেশি হইবে… মুসলমানদের উচিত এই বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করা। কারণ এই বর্ণ-পরিচয় দ্বারা তাহারা তাহাদের সমস্ত দেশের ভাষা সকল পড়িতে পারিবেন এবং এশিয়াবাসীগণের মধ্যে প্রণয় ও ঘনিষ্ঠতা বাড়িবে।’

[‘বাঙালীর মাতৃভাষা’, আল-এসলাম, ১ম বর্ষ, ৮ম সংখ্যা, অগ্রহায়ণ, ১৩২২]

কী সাংঘাতিক প্রস্তাব ও যুক্তি! ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, সেই ধরনের মানুষ ছাড়া এমন প্রস্তাব কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। যা হোক, ও কথায় কেউ কান দেয়নি। কিন্তু বিষয়টি শেষ হয়েও যায়নি। আরবি হরফে বাংলা লেখার স্কিম আবার সামনে আসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। ১৯৪৯ সালে পূর্ব বাংলা সরকার গঠন করে ভাষা কমিটি। সেই কমিটিতে ভাষাবিজ্ঞানী ও বড় সাহিত্যিকদের চেয়ে বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধী মোল্লা-মৌলভির প্রাধান্য ছিল। তখন প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় বলা হয়েছিল :

‘…. ভুলিলে চলিবে না যে বাংলা ভাষায় আরবী হরফ এস্তেমালের ধারণাটি কোন বিদেশীর চিন্তাপ্রসূত নয়….বা পার্টিশান [১৯৪৭] পরবর্তীকালের কোন ভূঁইফোড় প্ল্যান নয়। বহু বৎসর পূর্বেও এ খেয়ালটি দানা বাঁধিয়াছিল পূর্ব বাংলারই একজন মহৎ এবং মোত্তাকী সন্তানের মনে। চাটগাঁয়ের মওলানা জুলফিকার আলী সাহেবই ইহার অগ্রদূত। তিনি একজন খোদাভক্ত ও বিজ্ঞ লোক এবং সায়েমুদ্দাহার (নিষিদ্ধ দিনগুলি ছাড়া তিনি সারা বৎসর রোজা রাখেন)। দারিদ্র সত্ত্বেও তিনি প্রায় বিশ বৎসর যাবত আরবী হরফে একখানা বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা চালাইয়া আসিতেছেন। এই রূপ দৃঢ় অধ্যবসায় ও উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করা কেবল ইসলামের প্রাথমিক যুগের কথা মনে করাইয়া দেয় এবং আজকাল আমাদের মধ্যে অতি অল্পই দেখা যায়। অতঃপর তাঁর এই স্কিমের প্রতি মাশ্ৰেকী পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান] ওলামায়ে ইসলামের নজর পড়ে। তাঁরা সৰ্বান্তঃকরণে ইহার সমর্থন এবং সার পারাস্তি [পৃষ্ঠপোষকতা] করিয়াছেন। কাজে কাজেই স্কিমটি খাঁটি দেশী, বিদেশীয় কল্পনাপ্রসূত নহে।’

[‘দূরদর্শী রচিত হরফ সমস্যা পুস্তিকা’]

সমাজে যখন ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকে, তখন কেউ তাঁর মর্জিমতো কোনো ‘স্কিম’ দিতেই পারেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টাও চালাতে পারেন। আরবি কেন, কেউ যদি বলেন এশিয়ার মানুষ হিসেবে বাংলা ভাষা চীনা হরফে লিখলেই জাতির উপকার হবে, তাতে বিরাট দেশ চীনের সঙ্গে বাঙালিদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে, তাতেই-বা বিচলিত হওয়ার কী আছে? কিন্তু সেই কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যক্তিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষা সংস্কার কমিটির সদস্য করা কোনো দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় নয়। তা হলে বুঝতে হবে সরকারেরও কোনো দুরভিসন্ধি রয়েছে। মুসলিম লীগ সরকারের সেই দুরভিসন্ধি ছিল না –এমন কথা বলা যায় না। উর্দু বা পাঞ্জাবি ভাষা সংস্কারের চেয়ে উন্নত বাংলা ভাষা সংস্কারের জন্য পাকিস্তানি সরকারের মাথাব্যথা ছিল বেশি।

কেন বাংলা ভাষা নিয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকশ্রেণির এত মাথাব্যথা। জনবহুল পূর্ব বাংলার বহু সমস্যা ছিল। সেগুলো সমাধানের ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগ না নিয়ে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা না করে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে বিকলাঙ্গ করার অপচেষ্টার মধ্যে সুদূর দুরভিসন্ধি ছিল।

 ১৩. আইয়ুবশাহীর অভ্যুদয় ও লেখক সংঘ

বন্দুকের নলের মুখে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে, দেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র বাতিল করে সেকালে যেসব দেশে সামরিক শাসন জারি করা হতো, সেই শাসকেরা ওই রকম ক্ষমতা দখলকে ‘বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করতেন। শুধু তাঁরা যে করতেন তা নয়, তাঁদের তাঁবেদার ও সমর্থকেরাও তাকে বিপ্লবই বলতে চাইতেন। আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলকেও আখ্যায়িত করা হলো ‘বিপ্লব’ বলে।

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মুহাম্মদ আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের হর্তা-কর্তা বিধাতা নিযুক্ত করেছিলেন যাকে, তার নাম মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ওমরাও খান। তাকে চোখে দেখা তো দূরের কথা, বাংলার মানুষ তাঁর নামটিও কখনো শোনেনি। তিনিই হলেন আমাদের শাসক। আইন পরিষদ নেই, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নেই, তিনি একাই সব। তেমন ধরনের সরকার বাংলার মানুষ বখতিয়ার খিলজির পর থেকে হাজার বছরে কখনো দেখেনি। সিরাজদ্দৌলার পতনের পর ইংরেজ রবার্ট ক্লাইভ এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করলেও মীর জাফর আলী খান ওরফে মীরজাফর নামেমাত্র হলেও বাংলার নবাব ছিলেন কিছুকাল। ৫৮-র সামরিক শাসনের পর এ দেশে বেসামরিক নাগরিকের তিলমাত্র ক্ষমতা থাকল না।

তবে এটাও ঠিক, আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে অনেকগুলো ভালো সংস্কারমূলক উদ্যোগ নেন। তার প্রথমটি যদিও কবি-সাহিত্যিকদের জন্য। সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ প্রভৃতি সব পেশার মানুষের জন্যও সংস্কারের কাজ শুরু করেন। যেমন শিল্পসচিব আবুল কাসেম খানের সভাপতিত্বে গঠিত হয় ১২ সদস্যবিশিষ্ট বিজ্ঞান কমিশন ১৯৫৯-এর শুরুতেই। ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন বা জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থার পরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এফ আর খান। গঠিত হয় কুদরতুল্লাহ শাহাবের নেতৃত্বে পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড বা পাকিস্তান লেখক সংঘ। জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা নামটি চমৎকার, কিন্তু কী উদ্দেশ্যে সেটি গঠিত তা প্রথমে বোঝা যায়নি।

৩১ জানুয়ারি ‘৫৯, পাকিস্তানের দুই অংশের খ্যাতিমান লেখকদের এক সম্মেলনে আইয়ুব বলেন :

‘পাকিস্তানের লেখকগণের মধ্যে সংগ্রাম করার শক্তি এবং সৃজন করার যথেষ্ট প্রতিভা রয়েছে। তারা পাকিস্তানের প্রতি তাদের কর্তব্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন এবং পাকিস্তানের সংহতির জন্য অভাবনীয় ভূমিকা গ্রহণ করতে সক্ষম।’

তিনি বলেন, পাকিস্তানের জাতীয় সাহিত্যে থাকবে পাকিস্তানের আদর্শের রূপায়ণ। কিন্তু সেই আদর্শ কী? সে প্রশ্নের জবাবও তিনিই দেন :

‘পাকিস্তানের জনসাধারণের জন্য অধিকতর সুখী, আরামদায়ক, উন্নত, আনন্দময় ও সৃষ্টিশীল জীবনব্যবস্থার বাস্তব রূপায়ণই পাকিস্তানের আদর্শ। এই আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার ব্যাপারে লেখকগণ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন।’

শুধু এটুকু নয়, তিনি আরেকটু খোলাসা করে বলেন:

‘আমাদের কর্তব্য হচ্ছে ইসলামের নীতিগুলোকে আধুনিক মানের উপযোগী ভাষায় প্রকাশ করা, কারণ আধুনিক ভাষাই হচ্ছে যথার্থ শক্তির ভাষা। এ ভাষা। অবশ্যই বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও চলতি ঘটনাবলি প্রকাশের ভাষা হওয়া উচিত; কারণ দুনিয়া ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে, আর এখানে আমাদের প্রত্যেকেরই নিজেদের যথোপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।’

আইয়ুব খান জাতীয় সংহতি, জাতীয় পুনর্গঠন ও পাকিস্তানি জাতীয় চরিত্র গঠনের ওপর জোর দিয়েছিলেন এবং সে কাজে তিনি বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সহযোগিতা চান এবং তা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পানও। ক্ষমতা দখলের ছয় মাসের মধ্যে জেনারেল আইয়ুব গঠন করেন ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন বা জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা। ২৩ মার্চ ১৯৫৯, প্রেসিডেন্ট এক বেতার ভাষণে বলেন :

‘আমাদের সম্মুখে জাতীয় পুনর্গঠন ও ব্যক্তিগত চরিত্র পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব রয়েছে এবং কেবল স্ব-স্ব কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করেই আমরা তা পালন করতে পারি।’

আমাদের লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের ‘চরিত্র পরিশুদ্ধ’ করার তাগিদ আসে অবাঙালি সামরিক শাসকের কাছ থেকে। দেশের বুদ্ধিজীবীগণের দায়িত্ব সম্পর্কে আইয়ুব খান। বলেন, ‘চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান লোক হিসেবে আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাবলি নির্ধারণ, ও তার সঠিক সমাধানের উপায় উদ্ভাবন করে তারা খাঁটি স্বদেশপ্রেমের পরিচয় দেবেন। জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে সাহায্য করার এই-ই তাঁদের পক্ষে উস্কৃষ্ট পন্থা।

আমাদের খ্যাতিমান লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা সেদিন বাস্তবিকই ‘খাঁটি স্বদেশপ্রেমের পরিচয়’ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে আমাদের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকেরা খাঁটি স্বদেশপ্রেমের পরিচয় দিতে না পারায় নাজিমুদ্দীন রোডের উঁচু পাঁচিলঘেরা বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন।

জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা ও পাকিস্তান লেখক সংঘের মূল উদ্দেশ্য যা-ই হোক, এই দুই সংস্থা বেশ কিছু ইতিবাচক কাজও করেছিল, তাতে আমাদের লেখকসমাজ উপকৃত হয়েছিল। তবে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিলেন সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাবাদীরা।

১৯৫৯-এর ৪-৫ জুলাই লাহোরে পাকিস্তান লেখক সংঘের কার্যনির্বাহী পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান লেখকদের অনেকেই তাতে যোগ দেন। অধিবেশনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তার মধ্যে একটি ছিল ‘সংঘের তরফ থেকে একটি প্রকাশনালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম গ্রহণ করা। এই সিদ্ধান্তে বাঙালি লেখকেরা খুবই উফুল্ল হন। তখন ঢাকায় প্রকাশনা শিল্পের শৈশব অবস্থা। সাহিত্যের বইপত্রের প্রকাশক পাওয়া ছিল খুবই কঠিন।

সংঘের দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, ‘সংঘের সদস্যদের জন্য একটি বিশেষ সুবিধাজনক জীবন-বীমা পলিসির বন্দোবস্ত করা। এ সম্পর্কে আমাদের লেখকদের মন্তব্য ছিল, ‘এসব সংবাদ নিঃসন্দেহে আনন্দদায়ক। কারণ, বাঙালি লেখকদের অনেকেরই আর্থিক অবস্থা ছিল খারাপ। অকালে মারা গেলে পরিবার-পরিজন অসহায় হয়ে পড়ত। লেখকদের সুবিধাজনক জীবন-বীমা থাকলে তাদের মৃত্যুর পর পরিবার কিছুটা উপকৃত হতে পারত।

লেখক সংঘের বই প্রকাশের সংবাদে লেখকদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। মাহে নও মন্তব্য করেছিল, দেশের সকল স্থানের সকল শ্রেণির সৃষ্টিধর্মী লেখকেরা সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের উদ্যোগে তাদের শ্রেষ্ঠ রচনাবলী প্রকাশনের যে ব্যবস্থা করছেন, তার ফলে সাহিত্যক্ষেত্রে নূতন উদ্দীপনা সৃষ্টি হতে বাধ্য।

প্রকাশনা শুরু করার জন্য লেখক সংঘকে একটি তহবিলও করে দেওয়া হয়। পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গিল্ডকে বিনা সুদে এক লক্ষ টাকা ঋণ মঞ্জুর’ করা হয়েছে। এই অর্থ দ্বারা গিল্ডের নিজস্ব প্রকাশনালয় প্রতিষ্ঠার মৌলিক পরিকল্পনা কার্যকরী করার প্রাথমিক ব্যবস্থাদি ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে বলতে ১৯৫৮-র এপ্রিলের মধ্যে।

পাকিস্তান লেখক সংঘ প্রতিষ্ঠার এক বছর উপলক্ষে এক নিবন্ধে মাহে নও লিখেছিল:

‘১৯৫৮ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত গোটা জাতিই এই ব্যাপক নৈরাশ্য আর হতাশার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল, জাতীয় জীবন ও চিন্তাধারার রূপকার ও শিল্পী হিসেবে লেখকগণ হয়ে পড়েছিলেন দিশেহারা।’

[মাহে নও, জানুয়ারি ১৯৬০]

এই বক্তব্যটি বস্তুত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সামরিক সরকারের। সামরিক শাসনের আগে পাকিস্তানের তথা বাংলার লেখক-শিল্পীরা ‘হতাশার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিলেন’ এবং তাঁরা হয়েছিলেন ‘দিশেহারা’, তেমন কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। তবে বিভেদ, হিংসা-প্রতিহিংসা ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে রাজনীতি খুব খারাপ অবস্থায় গিয়ে পড়েছিল। তাতে মানুষের মধ্যে হতাশা দেখা দেওয়াও স্বাভাবিক।

সরকার-সমর্থক লেখক-বুদ্ধিজীবীরা বলেন, লেখক সংঘ বা রাইটার্স গিল্ডকে একটি অভিনব ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন বলেও অভিহিত করা যেতে পারে। অভিনব’ বললাম এই কারণে যে, ট্রেড ইউনিয়নকে যেমন শ্রমিকদের তরফ থেকে মালিকদের কাছে বা সরকারের কাছে দাবিদাওয়া পেশ করতে হয় এবং সে জন্য হয়তো আন্দোলন করতে হয়, রাইটার্স গিল্ডের বেলায় সে কথাটা একেবারেই খাটে না। কারণ, বর্তমান বিপ্লবী সরকারের সক্রিয় সহযোগিতার মধ্য দিয়েই এর গোড়াপত্তন হয়েছে। বস্তুত, রাইটার্স গিল্ডের প্রতিষ্ঠা বিপ্লবী সরকারের বহুমুখী প্রগতিশীল কর্মসূচির একটি গৌরবময় অধ্যায় বললেও অত্যুক্তি করা হয় না।

‘রাইটার্স গিল্ড প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাটাই মূলত একটি বিপ্লবী চিন্তাধারার পরিচায়ক। শুধু এশিয়া ও আফ্রিকাতেই নয়, পৃথিবীর কোনো দেশেই এর নজির বড় একটা চোখে পড়ে না।

[মাহে নও]

লেখকদের জন্য জীবন-বীমা ব্যবস্থা করা ছিল একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। যদিও সে উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতায় ফলপ্রসূ হয়নি।

১৯৫৯-এর জুলাইতেই লাহোরে লেখক সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির অধিবেশনে ঘোষণা করা হয়েছিল :

‘লেখক সংঘের তরফ থেকে প্রত্যেক সদস্যের জন্য ৫০০০ টাকার একটি জীবন-বীমার পলিসির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই পলিসির জন্য লেখক-সদস্যদের মাসিক মাত্র ৫ টাকা প্রিমিয়াম দিতে হবে।’ তবে সেকালে এমন লেখকই ছিলেন বেশি, যিনি ৫ টাকা প্রিমিয়াম দিলে ১০ দিন বাজার করতে পারতেন না।

১৯৬২-র ৩১ জানুয়ারি লেখক সংঘের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উৎসব হয় করাচিতে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধিদলে গিয়েছিলেন পূর্বাঞ্চল শাখার সম্পাদক মুনীর চৌধুরী, লেখক সংঘ পত্রিকার দুজন সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও রফিকুল ইসলামসহ অনেকেই। সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব উপস্থিত থাকতে পারেননি অনিবার্য কারণে।

তিনি লেখকদের উদ্দেশে পাঠিয়েছিলেন একটি বাণী। সেই বাণী পাঠ করে শোনান মুনীর চৌধুরী। লেখকদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বলেছিলেন :

‘পাকিস্তান লেখক সংঘের প্রতি অতীতে প্রেরিত আমার বিভিন্ন বাণী, আপনাদের পেশা, কার্যধারা, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে : সর্বোপরি চিন্তা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতায় আমার সক্রিয় সহযোগিতা আপনাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমার গভীর উৎসাহের পরিচয়।

‘পাকিস্তানের সামনে আজ একটি বড় সমস্যা হলো পাকিস্তানের আদর্শ অনুযায়ী জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করা। আমি জানি না সবাই এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন কি না। এই কর্মে আপনাদের দায়িত্ব সর্বাধিক, কারণ লেখক তার পরিবেশের বাহ্যিক, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক দিগন্তের যথার্থ রূপায়ণে ও প্রতিফলনের মাধ্যমে এই ঐক্যকে যথেষ্ট প্রভাবান্বিত করতে পারেন।

‘আমাদের সামনে যেসব সামাজিক সমস্যা রয়েছে, তার মূল উচ্ছেদ কেবল আইনের সাহায্যেই করা সম্ভব নয়, সামাজিক দুর্নীতির ব্যাপক উচ্ছেদ আপনাদেরই দায়িত্ব।

‘আমাদের উত্তরসূরিরা যেন কখনো বলতে না পারেন যে আমাদের সামনে একটি স্বাধীন ও মহৎ জাতি গঠন করার যে সুবর্ণ সুযোগ ছিল, তা আমরা নষ্ট করেছি। ইতিহাসের পথনির্দেশে আপনাদের লেখনী অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার। আমার আবেদন, আপনাদের লেখনী সর্বপ্রথম দেশের জন্য ব্যবহার করুন, যে ব্যবহার আপনারাই আমার চেয়ে ভালো জানেন। আপনারা সর্বদা আমার পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করবেন।’

বাঙালি লেখকদের প্রভাবশালী অংশ আইয়ুবের দেওয়া কোনো সুযোগই নষ্ট হতে দেননি। এবং লাভ করেছেন তাঁর পূর্ণ সহযোগিতা ও পেয়েছেন তাঁর আনুকূল্য। ওদিকে প্রগতিশীল ও স্বায়ত্তশাসনকামী রাজনীতিকদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ছিল কারাগারগুলো।

 ১৪. আইয়ুবীয় পৃষ্ঠপোষকতা

প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মোহাম্মদ আইয়ুব খান যে উদ্দেশ্যেই পাকিস্তান লেখক সংঘ এবং জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা বা বিএনআর প্রতিষ্ঠা করুন না কেন পূর্ব পাকিস্তানের আধুনিক কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের জন্য তা ছিল আশীর্বাদের মতো। পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার সাহিত্যে বহু আধুনিক চেতনাসম্পন্ন কবি সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু তাঁদের রচনা প্রকাশের জায়গার ছিল অভাব। পুরোনো দুটি বিখ্যাত সাময়িকী– মোহাম্মদী ও সওগাত নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছিল। মাহে নও ছিল সরকারি সাময়িকী। সিকান্দার আবু জাফর প্রকাশ করেন সমকাল– আধুনিকতাবাদীদের মুখপত্র। সেটা বছরে বের হতো তিন-চার সংখ্যা। সব কবি সাহিত্যিককে ধারণ করার ক্ষমতা সমকাল-এর ছিল না। আরও দু-একটি সাহিত্যপত্র বের হচ্ছিল অতি অনিয়মিত। মানসম্মত সাহিত্যের প্রসার ঘটাতে মানসম্মত ও রুচিসম্মত সাহিত্য সাময়িকীর প্রয়োজন। সেই রকম নিয়মিত সাহিত্যপত্র পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় ছিল না।

সেই অভাব পূরণে পাকিস্তান লেখক সংঘের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থানুকূল্যে লেখক সংঘ সাহিত্য সাময়িকী ও বই প্রকাশ শুরু করে। লেখক সংঘ পত্রিকা নামে কবি গোলাম মোস্তফার সম্পাদনায় সংগঠনের সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশিত হয়। তা সম্ভবত একটি সংখ্যাই বেরিয়েছিল। তারপর লেখক সংঘ পত্রিকার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পরিক্রম–পাকিস্তান লেখক সংঘের পূর্বাঞ্চল শাখার মাসিক সাহিত্য ও সংস্কৃতিপত্র। প্রথমে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও রফিকুল ইসলামের সম্পাদনায় এবং পরে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় পুরো ষাটের দশক পরিক্রম নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। পরিক্রমের একটি সম্পাদনা পরিষদ ছিল। তাতে ছিলেন সৈয়দ মুর্তজা আলী, আহমদ শরীফ, আবদুর রশীদ খান, আবদুল গনি হাজারী ও জাহানারা আরজু। তবে তাঁরা ছিলেন নামেমাত্র। সম্পাদনার দায়িত্ব পুরোটাই পালন করেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম ও হাসান হাফিজুর রহমান। এবং শেষের দিকে কখনো তাদের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন নজরুলবিষয়ক লেখক শাহাবুদ্দিন আহমদ ও রশীদ হায়দার। প্রকাশক হিসেবে নাম থাকত নাট্যকার আশকার ইবনে শাইখের।

পরিক্রম নামটির মধ্যেই আধুনিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। পঞ্চাশের দশক থেকে ঢাকার মার্কিন তথ্যকেন্দ্র, যার অফিস ছিল প্রেসক্লাবের উল্টো দিকে, মার্কিন পরিক্রমা নামে একটি ম্যাগাজিন বের করত। লেখক সংঘের কর্মকর্তারা ওই নামটি থেকে প্রভাবিত হয়ে পরিক্রমা নামে সাময়িকী প্রকাশের উদ্যোগ নেন। উদ্যোক্তাদের কাছে শুনেছি, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পরামর্শ দেন পরিক্রমা নয়, পরিক্রম নামকরণই হবে যথার্থ। তিনি বলেন, ‘পরিক্রমার ম-এর আকার ফেলে দাও।’ মুনীর চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম বা হাসান হাফিজুর রহমান কেউই পাকিস্তানবিরোধী ছিলেন না, তবে একই সঙ্গে বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে কোনো সংশয় ছিল না। অর্থাৎ তাঁরা বাঙালি জাতীয়তাবাদীও ছিলেন।

লেখক সংঘের পশ্চিমাঞ্চলের কার্যালয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী লাহোরে। তাতে যুক্ত ছিলেন উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি প্রভৃতি ভাষার খ্যাতিমান লেখকেরা। সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্য হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই প্রাধান্য ছিল উর্দু লেখকদের। দুই অঞ্চলের লেখকদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে পাকিস্তান লেখক সংঘ।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় প্রাচীনপন্থী ও আধুনিকতাবাদী তরুণ দুই শ্রেণির লেখকই ছিলেন। প্রাচীনপন্থী ও পাকিস্তানবাদী লেখকদের সাহিত্য সাময়িকী ছিল মাসিক মাহে নও– কেন্দ্রীয় সরকারের পত্রিকা। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত হলেও লেখক সংঘের পরিক্রম ছিল আধুনিকতাবাদীদের সাহিত্যপত্র। বিষয়বস্তু হিসেবে মাহে নও-এ যেমন ইসলাম ও মুসলমান প্রাধান্য পেত, পরিক্রমে প্রাধান্য পেত বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বিশ্বসাহিত্য। মাহে নও এর লেখকদের মধ্যে যেমন থাকতেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ বরকতউল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আবুল ফজল, আ ন ম বজলুর রশীদ, সুফিয়া কামাল, ফররুখ আহমদ প্রমুখ; তেমনি পরিক্রম-এ বেশি লিখতেন শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শওকত ওসমান, খান সারওয়ার মুর্শেদ, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ। নারী সাহিত্যিকদের মধ্যে জাহানারা আরজু, জাহানারা হাকিম, লতিফা হিলালীসহ ছিলেন কয়েকজন। সৈয়দ শামসুল হকের অচেনা নামে আস্ত একটি উপন্যাস পরিক্রম এর এক সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ষাটের দশকের শেষ দিকে। মাহে নও-এর মতো পরিক্রমও লেখকদের পারিতোষিক দিত। সেকালে পূর্ব বাংলার লেখকদের জন্য তা ছিল বড় প্রাপ্তি।

কোথায় ছিল লেখক সংঘের কার্যালয়? কোথা থেকে বের হতো পরিক্রম? বাংলা একাডেমির গেট দিয়ে ঢুকতে বাঁ দিকে ছিল একটি ছোট্ট এক কামরার ঘর। ইট-সিমেন্টের দেয়াল কিন্তু টিনের চাল। ঘরটি তৈরি করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে বর্ধমান হাউসের নিরাপত্তা প্রহরীদের বসার জন্য। ওই ঘরটি লেখক সংঘের পূর্বাঞ্চল শাখাকে দেওয়া হয়েছিল তাদের কর্মকর্তাদের কার্যালয় হিসেবে। সেখানে খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকেরা প্রতিদিন কেউ না কেউ বসতেন। তবে প্রতি মাসে একবার একটি বড় বৈঠক হতো। ছাত্রজীবনে সেসব বৈঠকের কোনো কোনোটিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। মুনীর চৌধুরী, খান সারওয়ার মুর্শিদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতেন দেশি ও বিদেশি সাহিত্য সম্পর্কে। কয়েক বছর আগে বাংলা একাডেমি সেই ঘরটি ভেঙে সেখানে একটি দালান বানিয়েছে। স্বাধীনতার পরে ওই ঘরটিতে ছিল বাংলা একাডেমির ডাকঘর। সেই সময়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ওই ঘরটি রেখে দেওয়া উচিত ছিল। হতে পারত সেখানে একটি ছোট্ট প্রদর্শনশালা। প্রদর্শিত হতে পারত পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সাহিত্য সাধনার জিনিসপত্র।

খুবই সুন্দরভাবে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হতো পরিক্রম। কিছুদিন নিউজপ্রিন্টে ছাপা হতো, পরে কর্ণফুলী মিলের সাদা উন্নতমানের কাগজে বের হতো। মনেটাইপে নির্ভুল ছাপা। অঙ্গসজ্জা ভালো। শুধু লেখকেরা নন, চিত্রশিল্পীরাও পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন লেখক সংঘ থেকে। পরিক্রম-এর প্রচ্ছদ কাইয়ুম চৌধুরী এবং দেবদাস চক্রবর্তীই সবচেয়ে বেশি আঁকতেন। লেখক সংঘের সঙ্গে তাঁরা যুক্ত থাকলেও স্বাধীনতার পরে তারা উভয়েই আইয়ুব সরকার ও লেখক সংঘের ঘোর সমালোচকে পরিণত হন। অব্যাহত সেই সরকারের নিন্দা করতেন।

প্রকাশনাশিল্পের সেই ঘোর দুর্দিনে লেখক সংঘ এবং বাংলা একাডেমি আধুনিক প্রকাশনার সূচনা করে। ষাটের দশকে বাংলা একাডেমি বহু মূল্যবান বই প্রকাশ করেছে, শুধু গবেষণামূলক বই নয়, সৃষ্টিশীল বইও। লেখক সংঘ অত করেনি, তবে যা করেছে তার গুণগত মূল্য অসামান্য। ফররুখ আহমদের কাব্য-নাটক নৌফেল ও হাতেম সম্ভবত লেখক সংঘ প্রকাশনীর প্রথম বই। শামসুর রাহমানের দ্বিতীয় ও শ্রেষ্ঠ কবিতার বই রৌদ্র করোটিতে প্রকাশ করে লেখক সংঘ। শামসুর রাহমান তাঁর এলোমেলো স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘বই বাবদ আমার প্রাপ্য টাকাও চটজলদি পেয়ে গেলাম। সেখানে অন্য প্রকাশকেরা চটজলদি তো দূরের কথা, দেরিতেও টাকা দিতেন না। তিনি আরও লিখেছেন, ‘…রৌদ্র করোটিতের জন্য আদমজী পুরস্কার পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম।… সেবার কথাসাহিত্যে আদমজী পুরস্কার পান শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার তাঁর সারেং বৌ উপন্যাসের জন্য। পশ্চিম পাকিস্তানের আহমদ নদিম কাশমি পুরস্কৃত হন কবিতার জন্য। তিনি একজন প্রগতিশীল উর্দু কবি। এই বর্ষীয়ান কবি ছোটগল্প লিখেও প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

[কালের ধুলোয় লেখা, পৃ. ১৫৪-৫৫]

আদমজী, দাউদ প্রভৃতি পুরস্কার সরকারের তত্ত্বাবধানেই প্রবর্তিত হয়। জমকালো পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান হতো করাচিতে। শামসুর রাহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ পিআইএ বা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের বিমানে করাচি যান। পুরস্কারটি গ্রহণ করেছিলেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের হাত থেকে। শামসুর রাহমানের স্মৃতিচারণা :

‘শহীদুল্লাহ কায়সার এবং আমি ১৯৬৩ সালে করাচিতে যাই আদমজী পুরস্কার গ্রহণের উদ্দেশ্যে। শহীদুল্লাহ কায়সারের পরিচিতি আমার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ছিল সঙ্গত কারণেই। প্রগতিশীল রাজনীতিতে সমর্পিত ছিলেন তিনি।… পুরস্কারের অর্থমূল্য আহামরি কিছু ছিল না। [কথাটি সঠিক নয়] তবে সেকালের পক্ষে ভালোই। তবে কবিতার জন্য জীবনের প্রথম পুরস্কার লাভের একটি আলাদা শিহরণ বোধ করেছিলাম। পুরস্কারটি গ্রহণ করতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের হাত থেকে, যার বিরুদ্ধে হাতির শুঁড় কবিতাটি লিখেছিলাম। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমাদের বসতে হয়েছিল একেবারে প্রেসিডেন্টের পাশে। কথা প্রসঙ্গে আইয়ুব খান আমাকে আমার বইয়ের নাম এবং তার অর্থ অনুবাদ করতে বললেন। আমি নির্দ্বিধায় বললাম, সানরেইস অন দ্য স্কাল। সেই মুহূর্তে আমার মুখে রৌদ্র করোটিতের ইংরেজি এ রকমই এসেছিল। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব মৃদু হাসলেন।’ [পৃ. ১৫৫]

ষাটের দশকে আইয়ুব খানের পাশে বসার সৌভাগ্য ছিল বিধাতার সান্নিধ্য লাভের মতো।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণের সেই স্মৃতি আরও বিস্তারিত আমাদের শুনিয়েছেন অনেকবার। প্রেসিডেন্টের এক পাশে শামসুর রাহমান, অন্য পাশে শহীদুল্লাহ কায়সার। মঞ্চে পশ্চিম পাকিস্তানের পুরস্কারপ্রাপ্ত অন্যান্য লেখক। শামসুর রাহমান তার স্মৃতিকথায় বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন, লেখক সংঘ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য নেই, যদিও লেখক সংঘের পরিক্রম-এর তিনি ছিলেন নিয়মিত লেখক এবং সেখান থেকে লেখার জন্য সম্মানী পেতেন। লেখক সংঘের বর্ধমান হাউসের ছোট্ট ঘরের আড্ডায়ও তিনি যোগ দিতেন।

লেখক সংঘ প্রকাশনীর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের মধ্যে ছিল আনিসুজ্জামানের মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য। বিষয়বস্তুর কারণেই হোক বা পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার জন্যই হোক, এই বইটিও তাকে এনে দেয় প্রচুর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা। মুসলমান লেখকদের নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা করায় ১৯৬৫ সালে আনিসুজ্জামান পান। দাউদ পুরস্কার। মুনীর চৌধুরীও একই সঙ্গে পুরস্কৃত হন তাঁর মীর মানস-এর জন্য, যা প্রকাশ করেছিল বাংলা একাডেমি। এ সম্পর্কে আনিসুজ্জামান স্বাধীনতার পর ১৯৭২-এ লেখেন :

‘দাউদ-পুরস্কার গ্রহণ করা আমাদের উচিত হয়েছিল কিনা, এ সম্পর্কে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে মতভেদ ঘটেছিল; কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি তর্কের ঝড় উঠেছিল পাক-ভারত সংঘর্ষের সময়ে মুনীর চৌধুরী ও আমাদের অপর দুই সহকর্মীর বেতার অনুষ্ঠান নিয়ে।’

[আনিসুজ্জামান, মুনীর চৌধুরী, ১৯৭৫, পৃ. ২৯]

লেখক সংঘ প্রকাশ করেছিল সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাহিত্য সমালোচনামূলক গ্রন্থ অন্বেষণ, হামেদ আহমেদের উপন্যাস প্রবাহ, আলাউদ্দিন আল আজাদের উপন্যাস ক্ষুধা ও আশা, হাসান আজিজুল হকের গল্পগ্রন্থ সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, ইব্রাহীম খাঁর অনুবাদ ইতিকাহিনী, হাসান হাফিজুর রহমানের আরো দুটি মৃত্যু গল্পের বই প্রভৃতি। মুনীর চৌধুরীর শেকসপিয়ারের অনুবাদ মুখরা রমণী বশীকরণ, নজরুলের ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে বিদ্রোহী রণক্লান্ত– রবীন্দ্রনাথ থেকে সাম্প্রতিককালের ৪৬ কবির নজরুলের ওপর লেখা ৪৬টি কবিতার সংকলন। এটি সম্পাদনা করেন কবি আবদুল কাদির।

লেখক সংঘ দুটি চমৎকার কবিতার সংকলন প্রকাশ করে। আফ্রিকা ও এশিয়ার কবিদের কবিতার অনুবাদ আফ্রো-এশীয় কবিতাগুচ্ছ এবং সমাজতান্ত্রিক চীনের একটি নাটকের অনুবাদ শ্বেতকুন্তলা। পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধের তিনটি সংগ্রহ প্রকাশের প্রকল্পও নেয়। পূর্ব বাংলার প্রবন্ধ সম্পাদনার দায়িত্ব নেন আহমদ শরীফ, পূর্ব বাংলার গল্পের দায়িত্ব পালন করেন মুনীর চৌধুরী এবং পূর্ব বাংলার কবিতার সম্পাদক শামসুর রাহমান। লেখক সংঘে জড়িত থাকার কথা শামসুর রাহমানের কোনো স্মৃতিচারণায় পাওয়া যায় না।

লেখক সংঘে যারা কাজ করেছেন তারা আমাদের সাহিত্যের উপকার করেছেন। বাংলাদেশ ও বাঙালির তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। আইয়ুব সরকারের প্রশংসা করে প্রচারণাও সেখান থেকে হয়নি। কিন্তু লেখক সংঘের সঙ্গে জড়িত থাকাকে স্বাধীনতার পরে কেন তাঁরা অমর্যাদাকর মনে করেছেন তা বোধগম্য নয়।

 ১৫. বিএনআর প্রকাশনা

আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর পরই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কয়েকটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, সেগুলোর অন্যান্য কাজের মধ্যে প্রধান ছিল প্রকাশনা। ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থেকে পাকিস্তানে আইয়ুব সরকার প্রকাশনার ওপর জোর দিয়ে থাকবে। যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রন্থ প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছে, তার মধ্যে পাকিস্তান লেখক সংঘ, জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড উল্লেখযোগ্য। বাংলা একাডেমির অন্যতম প্রধান কাজই ছিল বই প্রকাশ। আইয়ুব সরকার প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক একাডেমিকেও (স্বাধীনতার পরে যার নাম হয় বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ইসলাম ও মুসলমান-সংক্রান্ত বই প্রকাশের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র– ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তান– সাময়িকী শুধু নয়, বই প্রকাশের প্রকল্প নিয়েছিল। এসবের বাইরে পাকিস্তান পাবলিকেশনস নামে ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরাট প্রকাশনা সংস্থা। এই সব সরকারি প্রকাশনা সংস্থা থেকে ষাটের দশকে বহু মূল্যবান বই প্রকাশিত হয়েছে। সেসব বইয়ের লেখকেরা ছিলেন অনেকেই খ্যাতিমান ও বিশেষজ্ঞ।

জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা, ইংরেজিতে ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন সংক্ষেপে বিএনআর পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ধর্মীয় চেতনার দ্বারা জনগণের বন্ধন সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেয়। সে উদ্যোগ নির্দোষ ছিল না, তাতে সাম্প্রদায়িকতা ছিল।

সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভেতর দিয়ে পাকিস্তানের জন্ম, কিন্তু পাকিস্তান। প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িকীকরণ শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। সমগ্র সমাজ নয়, তরুণদের একটি অংশ উপলব্ধি করে সাম্প্রদায়িকতা সমাজ বিকাশের জন্য এবং প্রগতির পথে বড় বাধা। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ভাষা আন্দোলন এবং তার পরে ছাত্র-যুব আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন প্রভৃতি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী চেতনা বিকাশে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। তার ফলে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বাংলার মানুষ প্রত্যাখ্যান করে, অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি মূলধারায় পরিণত হয়।

সেই ধরনের একটি পরিবেশে বিএনআর যখন জাতীয় সংহতির নামে ইসলাম ও মুসলমানকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দিতে থাকে, তা প্রগতিকামীদের ভালো লাগেনি। পুস্তিকা ও ছোট বই যেমন প্রকাশ করেছে বিএনআর, তেমনি প্রখ্যাত লেখকদের গুরুত্বপূর্ণ বইও বের করেছে। উদাহরণের জন্য একটি বইয়ের নাম করতে পারি, সেটি মুহম্মদ বরকতুল্লাহ সম্পাদিত দর্শনে মুসলমান।

দর্শনে মুসলমান গ্রন্থে আটজন বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিকের জীবন ও দর্শন নিয়ে আলোচনা ছিল এবং সে আলোচনা বর্ণনামূলক নয় পাণ্ডিত্যপূর্ণ। আল-কিন্দি সম্পর্কে লিখেছিলেন সাইয়েদ আবদুল হাই, মুহম্মদ বরকতুল্লাহ লিখেছিলেন দুজন সম্পর্কে দুটি মূল্যবান প্রবন্ধ, তারা হলেন আল ফারাবি ও ইবনে সিনা, শাইখ শরফুদ্দীন লিখেছিলেন আল-গাজ্জালী সম্পর্কে, শাইখ আবদুর রহিম লিখেছিলেন আর-রাযী সম্পর্কে, অধ্যক্ষ সাইঁদুর রহমান লিখেছিলেন ইবনে খলদুনের দর্শন ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে, এ এফ এম আবদুল আযীয লিখেছেন মুজাদ্দেদ আলফেসানী সম্পর্কে এবং মুহম্মদ এছহাক আলোচনা করেন শাহ অলীউল্লাহ দেহলভীর জীবন। তখন বিএনআরের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শাখার পরিচালক ছিলেন সিএসপি অফিসার কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন :

‘দর্শনের ইতিহাসে মুসলিম জাতির এক গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। দর্শনের ক্ষেত্রে মুসলমান মনীষীরা রেখে গেছেন এক বিস্ময়কর অবদান, যা মৌলিকতা, সর্বজনীনতা ও স্বকীয়তার দীপ্তিতে চির ভাস্বর, চির অম্লান। তাঁদের এই অবদানে সুসমৃদ্ধ হয়েছে মানুষের জ্ঞান-ভাণ্ডার।

‘দুঃখের বিষয়, মুসলিম দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের এই অমর অবদানের কথা বিধৃত করে বাঙলা ভাষায় কোন বই নেই বললেই চলে –অথচ আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে দেশবাসীর সম্মুখে তুলে ধরে আমাদের জাতীয় ভাবধারাকে সঠিক পথে বিকাশের জন্য এই ধরনের বইয়ের একান্ত প্রয়োজন।

‘তা ছাড়া, বর্তমানে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদও আমাদের জীবনে সৃষ্টি করেছে জটিলতা, বেড়ে চলেছে আমাদের মানসিক উদ্বেগ ও অশান্তি। আমাদের জীবনে যাতে শূন্যতার সৃষ্টি না হয়, সেজন্য আজ সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতিকে আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার সম্বন্ধে অবহিত করে সচেতন করে তোলা, যেন আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন এক স্থায়ী ভিত্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই আধ্যাত্মিক বুনিয়াদ গঠনে আমরা মুসলমান দার্শনিক ও মনীষীদের ভাবধারা ও জীবন-সাধনা থেকে উৎসাহ ও উদ্দীপনা লাভ করতে পারি। এদিকে লক্ষ্য রেখেই পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা দর্শনে মুসলমান পুস্তকটি প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছে।

দর্শনে মুসলমান বইটির যা বিষয়বস্তু, তাতে এটি কলকাতার কোনো হিন্দু প্রকাশক যদি ছাপতেন কারও কিছু বলার ছিল না। বিষয়টি সর্বজনীন, সাম্প্রদায়িক নয়, যেমন সাম্প্রদায়িক নয় শ্রীচৈতন্য ও বাংলার বৈষ্ণববাদ। এসব হতে পারে ধর্ম বর্ণনির্বিশেষে যেকোনো লেখকের আলোচনা ও গবেষণার বিষয়। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে বাংলা ভাষার মূলধারার প্রধান লেখকদের কাছে ইসলাম ও মুসলমান ছিল অবহেলার জিনিস। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ দুটি কথা বলেছেন তা বিবেচনার বিষয়, তা হলো আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতেই এই বই প্রকাশ। এর অর্থ অতীতের যেকোনো দেশের যেকোনো মুসলমানের যা কিছু অর্জন তার উত্তরাধিকারী পাকিস্তানিরা। আরেকটি কথা বলেছেন, জাতিকে আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার সম্বন্ধে অবহিত ও সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে এই বই প্রকাশ। এই বক্তব্যে অসাম্প্রদায়িক বাঙালির উত্তরাধিকারের চেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে। বাঙালির আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম প্রভৃতি সব ধর্মের উপাদানই রয়েছে। সেই জিনিসটিকে পাকিস্তান সরকার অবহেলা করতে চায়। সেখানেই ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের আপত্তি।

‘পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ প্রচারও ছিল বিএনআরের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এ বিষয়ে সংস্থাটি সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করেছে এবং তাতে বাঙালি লেখক বুদ্ধিজীবীরা অংশ নিয়েছেন। বিএনআর ১৯৬০-৬১ সালে ইংরেজি ভাষায় একটি ছোট বই প্রকাশ করে তার নাম পাকিস্তানি ন্যাশনালিজম। তাতে ছিল তিনটি প্রবন্ধ, লিখেছিলেন তিনজন, পশ্চিম পাকিস্তানের শরিফ-আল-মুজাহিদ এবং পূর্ব বাংলার মুনীর চৌধুরী ও হাসান জামান। সম্পাদনা করেছিলেন শরিফ-আল-মুজাহিদ। পাকিস্তানের জাতীয় ভাবধারা এবং পুস্তিকাটির লেখকদের নিজস্ব চিন্তাধারা সম্পর্কে জানার জন্য বইটি বিশেষ সহায়ক। শরিফ-আল-মুজাহিদের প্রবন্ধে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটে। তাঁর প্রথম বাক্যটি এ রকম :

Pakistan was born as a result of the Indian Muslim’s claim to a separate nationhood in their own right.

শরিফ সাহেবের জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে ধারণাটির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তার ভাষায় :

Pakistani nationalism is, thus, essentially an ideological nationalism, as against the territorial, linguistic or social nationalism of the West. Its roots go deep into history, …. (পৃ.৬)।

মুনীর চৌধুরীর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি ছিল তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথমটির শিরোনাম ‘অন রিলিজিয়ন’ (ধর্ম সম্বন্ধে), তারপর ‘অন ল্যাঙ্গুয়েজ’ (ভাষা সম্বন্ধে) এবং ‘অন লাইফ’ (জীবন সম্বন্ধে)। প্রবন্ধটি সুলিখিত, কিন্তু তাঁর রচনাবলি বা আনিসুজ্জামানের মুনীর চৌধুরী জীবনীগ্রন্থে তার উল্লেখ নেই। অধ্যাপক চৌধুরী বলতে চেয়েছেন, পাকিস্তানিদের জাতীয় চেতনায় প্রাধান্য পাবে ইসলাম, কারণ পাকিস্তান মুসলমানদের বাসভূমি। মুনীর চৌধুরীর ভাষায় :

We are Pakistanis. We are, in Pakistan, overwhelmingly Muslims. The ideals of Islam formed a fundamental basis of our inspiration to build this separate homeland for the Muslims of Indo-Pakistan. It is only natural that the elements of our faith in Islam should now constitute the very backbone of our national consciousness. (9.36)

‘পাকিস্তানি ভাষা’ প্রসঙ্গে মুনীর চৌধুরীর যে পর্যবেক্ষণ, তা বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন পায়নি। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, একদিন পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানে দুটি নতুন ধরনের উর্দু ও বাংলা ভাষা জন্ম নেবে। পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ভাষায় ‘সিন্ধি, পাঞ্জাবি, পশতু প্রভৃতি ভাষার শব্দ ঢুকে যাবে এবং অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাও আর আগের মতো থাকবে না, সেখানে আরবি, ফারসি, উর্দু প্রভৃতি ভাষার শব্দ যোগ হয়ে এক নতুন ‘পাকিস্তানি বাংলা ভাষার জন্ম হবে। তাঁর ভাষায় :

… It is hoped that if the previously mentioned process of mutual give and take strikes deep roots into the speech habits of all Pakistanis then in no time a single new national language will automatically emerge out of it. It will be neither Urdu nor Bengali, but a very acceptable amalgam of all the languages of Pakistan, East or West, (পৃ. ২১)

সাংঘাতিক বক্তব্য। হাজার মাইল দূরে দুটি দেশে (হোক এক রাষ্ট্র) একটি অভিন্ন জাতীয় ভাষা সৃষ্টি করা সম্ভব ছিল না ১০০ বছরেও। যেখানে দুটি দেশেই রয়েছে কয়েকটি সমৃদ্ধ ভাষা। এসব ছিল কেন্দ্রীয় শাসকশ্রেণির প্রণোদনায় একেবারেই অবাস্তব ও ভুল চিন্তা। বাঙালি মুসলমানের বিভ্রান্তি। কী করে পাকিস্তানের দুই অংশে একটি অভিন্ন ভাষার সৃষ্টি হতে পারে? পৃথিবীর সেই নতুন ভাষাটির নাম কী। হতে পারত?

হাসান জাহানের প্রবন্ধটি আরও প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িকতার দোষে কলুষিত। তবে এ ধরনের বিভ্রান্ত চিন্তাই ছিল তখনকার বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবীদের মাথায়। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় না ঘটলে এ-জাতীয় বিভ্রান্তির ঘূর্ণিপাকে পড়ে যেত বাঙালি জাতি। চরম ক্ষতি হতো বাঙালি সংস্কৃতির।

পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ, মৌলিক গণতন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে লেখা খ্যাতিমান লেখকদের প্রপাগান্ডামূলক পুস্তক-পুস্তিকা বিএনআর প্রকাশ করলেও, এই সংস্থা বহু গুরুত্বপূর্ণ বইও বের করেছে। যদিও অনেক বইয়ের বিষয়বস্তু ইসলাম ও মুসলমান, তবু সেগুলো সুলিখিত এবং প্রয়োজনীয় প্রকাশনা। কাজী মোতাহার হোসেনের কয়েকটি জীবন বইটি প্রকাশ করে বিএনআর। তাতে নবাব স্যার সলিমুল্লাহসহ কয়েকজন মুসলমান মনীষীর জীবনকথা আলোচিত হয়।

বিএনআর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করে। তার নাম সুফীবাদ ও আমাদের সমাজ। মনোটাইপে ছাপা ২২০ পৃষ্ঠার বইটিতে ছিল চারটি প্রবন্ধ। কাজী দীন মুহম্মদের প্রবন্ধের শিরোনাম ‘সুফীবাদের ভূমিকা’, আবদুল করিমের প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশের সুফী-সম্প্রদায়’, মনির-উদ্-দীন ইউসুফের প্রবন্ধ ‘বাংলা সাহিত্যে সুফী প্রভাব’ এবং অধ্যক্ষ শইখ শরফউদ্দীনের প্রবন্ধ পূর্ব পাকিস্তানের সুফী প্রভাব। গ্রন্থে ভূখণ্ডকে ‘বাংলাদেশ’ বলাও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।

বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, খ্যাতিমান লেখকদের যেসব বই বিএনআর থেকে বেরিয়েছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাঁরা তাঁদের প্রকাশিত বইয়ের তালিকা থেকে ওই বইগুলোর নাম বাদ দেন। রাজনৈতিক সংকীর্ণতা ও মানসিক দীনতাবশত আমাদের শ্রদ্ধেয় লেখকেরা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হন যে তাঁরা বিএনআরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং যেখান থেকে রয়্যালটির টাকা পুরোটাই পেয়েছেন। যদিও সে টাকা বাংলাদেশের মানুষেরই টাকা, আইয়ুব বা মোনায়েম খানের ব্যক্তিগত টাকা নয়। তারা ভেবেছেন ওই সব বইয়ের মালিকানা স্বীকার করলে প্রমাণিত হবে তারা পাকিস্তানপন্থী। স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থী পরিচয় খুবই বিপজ্জনক ছিল। তবে কেউ স্বীকার করতে না চাইলেও বাস্তবতা হলো ২৫ মার্চ ‘৭১-এর আগে বাংলাদেশের বাঙালি-অবাঙালি সব নাগরিকই ছিল পাকিস্তানি।

১৬. জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা

জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা বা বিএনআরের প্রথম পরিচালক ছিলেন জনৈক পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার এফ আর খান। খুব বেশি দিন তিনি ছিলেন না। কোনো একটা অভিযোগে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এক যুগ সময়কালে বিএনআরের পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন কবীর চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ও হাসান জামান। ওবায়দুল্লাহ কবি ও সিএসপি অফিসার। কবীর চৌধুরী ও হাসান জামান শিক্ষাবিদ ও লেখক। তখন কবীর চৌধুরী ছিলেন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে গভর্নর মোনায়েম খান তাঁকে তাঁর নিজ জেলা ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে অধ্যক্ষ করে নিয়ে আসেন। মৌলিক লেখার চেয়ে অনুবাদেই তার আগ্রহ ছিল বেশি। ১৯৬৯-এর মার্চ থেকে ‘৭২-এর জুন পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন (তখনো মহাপরিচালকের পদ সৃষ্টি হয়নি)।

হাসান জামান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের রিডার। তিনি ছিলেন ইসলামপন্থী ও পাকিস্তানবাদী। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। বেশ কয়েকটি বইয়ের তিনি ছিলেন। রচয়িতা, যেমন ইসলাম ও কমিউনিজম, সমাজ সংস্কৃতি সাহিত্য, Basis of the Ideology of Pakistan প্রভৃতি। তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক হলেও তিনি ছিলেন একজন মেধাবী শিক্ষাবিদ। চল্লিশের দশকে। তিনি ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী পাকিস্তান আন্দোলনের একজন নিবেদিত কর্মী।

পঞ্চাশের দশকে মুসলমান লেখকদের মধ্যে যারা ‘পাকিস্তানি তমদ্দুন’, ‘পাক বাংলা সাহিত্য’ প্রভৃতি তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন, হাসান জামান তাঁদের একজন। তাঁদের বক্তব্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সাহিত্য মূলধারার বাংলা সাহিত্যের মতো হবে না, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যের মতোও হবে না, তা হবে পাকিস্তানের নীতি আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ‘পাক-বাংলা সাহিত্য’। অন্য কথায় ‘মুসলমান বাংলা সাহিত্য’। সে সাহিত্যের বিষয়বস্তু শুধু নয়, তার ভাষা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা-অলংকার সবই হবে মূলধারার বাংলা সাহিত্য থেকে অন্য রকম। আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের অব্যবহিত আগে এক আলোচনা সভায় খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন এক প্রবন্ধে বলেন, ‘আমাদের সাহিত্যে উপমা-প্রয়োগের যে ধারা চলছে তার পরিবর্তন দরকার, কারণ সেগুলো রাঢ়-বাংলার সংস্কৃতির অনুসারী ও পাকিস্তানি তমদ্দুনের পরিপন্থী।

[‘পাক-বাংলা সাহিত্য উপমা’]

১৯৫৮ সালে, সামরিক শাসন জারির আগে, আমেরিকার রকফেলার ফাউন্ডেশনের অর্থানুকূল্যে ঢাকায় এক বড় আকারের সাহিত্যবিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগকে। ওই সেমিনারে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, খান সারওয়ার মুর্শেদ, নূরুল হোসেন, হাসান জামান, কবীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, কবি আবুল হোসেন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আসকার ইবনে শাইখ প্রমুখ। সেকালে ইসলামপন্থী ও সেকুলারপন্থীদের মধ্যে বিশেষ বিভাজন ছিল না, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধেরও অভাব ছিল না।

ভাষা আন্দোলনের আট মাস পরে ‘৫২-র অক্টোবরে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে এক ‘ইসলামী সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল পাকিস্তানে সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীভূত করার অভিপ্রায় এবং সুষ্ঠু ইসলামভিত্তিক চিন্তা-প্রবাহ সৃষ্টি করা। সম্মেলনের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ এবং আবদুল গফুর। সম্মেলনের লক্ষ্য সম্পর্কে ঘোষণা করা হয় :

‘আমরা যদি পাকিস্তানকে “ইসলামী রাষ্ট্র” হিসাবে গড়ে তুলতে চাই তবে প্রথমে “ইসলামী রাষ্ট্রের স্বরূপ” সম্বন্ধে আমরা পরিষ্কার ধারণা করে নেব। আমরা আধুনিক দুনিয়ার বিভিন্ন মতবাদ ও সমস্যাবলীর তুলনায় ইসলামকে যাচাই করে নিতে চাই। ইসলামই যে শ্রেষ্ঠতম মানবকল্যাণকর আদর্শ তা আমরা কোনো গোঁজামিল না দিয়ে বুঝে নিতে ও অন্যদের বুঝিয়ে দিতে চাই।’

[সাঈদ-উর রহমান, পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পৃ. ২৯-৩০]

ওই সম্মেলনের সাহিত্য-সভার আলোচনায় যারা প্রবন্ধ পাঠ করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন, কবি শাহাদাৎ হোসেন, মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ, সৈয়দ আলী আহসান, হাসান জামান প্রমুখ। হাসান জামানের প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘ইসলামী তমদ্দুন’। তিনি প্রবন্ধে ‘ইসলামের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সংস্কৃতি পুনর্নির্মাণের আহ্বান জানিয়ে বলতে চান ইসলামের মূল ভাব ও মূল্যবোধ মানবিক ও সর্বজনীন। তাই সমাজ জীবনে তার প্রয়োগ ‘মঙ্গলজনক। সম্মেলনে কেউ কেউ সরকারের মৃদু সমালোচনাও করেন এবং বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের জন্য তারা সরকারকে সমালোচনা করেননি, তারা সরকারকে সমালোচনা করেছিলেন ইসলামী আদর্শ যথেষ্ট পরিমাণে বাস্তবায়ন না করায়। তখন খাজা নাজিমুদ্দীন ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক দুই সরকারপ্রধানই পূর্ব বাংলার নেতা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই লক্ষ করা যায়, রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে তথা শাসকদের চেয়ে পূর্ব বাংলার একশ্রেণির কবি শিল্পী-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ ছিলেন বেশি ইসলামপন্থী। তারা ভুলে গিয়েছিলেন পূর্ব বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং বাংলা সংস্কৃতি হিন্দু মুসলমানের সমন্বিত সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলমান-আদিবাসী সব ধর্মের উপাদানই আছে।

পূর্ব বাংলার সাহিত্যের মেজাজ ও চারিত্র পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্য থেকে ভিন্ন হবে তা স্বাভাবিক– সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে শুধু নয়, ‘৪৭-এর পর ভিন্ন রাষ্ট্রীয় সত্ত্বার কারণেও। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কারণে দুই বাংলার সাহিত্যের ভিন্নতা জোর করে সৃষ্টির চেষ্টা সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর। দুই বাংলার মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য বিভাজন চিরকালই ছিল, একই বাংলা ভাষায় সবাই কথা বললেও। পূর্ব বাংলার সাহিত্যকে নিষ্প্রয়োজনে ইসলামীকরণের চেষ্টা তখনকার তরুণ লেখকেরা সমর্থন করেননি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ কবি ও কথাশিল্পী মূলধারার বাংলা সাহিত্যের লেখক, তাঁরা ‘পাক-বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টা করেননি। অবশ্যই তাদের ভাষা ও শৈলী পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের থেকে সামান্য পরিমাণে হলেও আলাদা।

বিএনআরের শেষ ও নিন্দনীয় পরিচালক ছিলেন হাসান জামান। তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের পৃষ্ঠপোষক। তিনি ছিলেন হিন্দুবিরূপ, রবীন্দ্রসংগীত বিরোধিতার প্রশ্নে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা সরকারকে সমর্থন দেন যখন জসীমউদ্‌দীন, মুহম্মদ কুদরাত-ই-খুদাসহ পূর্ব বাংলার প্রধান কবি-সাহিত্যিকেরা সরকারি নীতির তীব্র বিরোধিতা করেন।

বিএনআর একেবারেই রাজনীতিনিরপেক্ষ শিল্প-সাহিত্য-দর্শনসংক্রান্ত বহু বই পুস্তিকা যেমন বের করেছে, তেমনি তার মূল কাজ ছিল আইয়ুব প্রবর্তিত ‘মৌলিক গণতন্ত্র বিষয়ে প্রচারমূলক বই-পুস্তিকা প্রকাশ করা। বিশেষ করে, এমন কিছু বই বের করেছে, যা সাম্প্রদায়িকতা দোষে দূষিত। পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মের তরুণেরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করতেন। তাঁরা ৪৭-পূর্ব সময়ের হিন্দু জমিদার মহাজনদের নিপীড়ন শোষণের বিষয়টিকে অতীতের একটি অধ্যায় হিসেবেই বিবেচনা করেছেন– বর্তমানের হিন্দুরা তার জন্য দায়ী নন। কিন্তু পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার সেই অতীতকে অব্যাহত স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা চালিয়ে যেত। অত্যাচারী ও শোষক হিসেবে মুসলমান জমিদারেরা কিছুমাত্র কম ছিলেন না তা সবাই জানেন।

পাকিস্তান আমলের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান, তাঁরা এদিকেও ছিলেন ওদিকেও ছিলেন। তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, আবার প্রয়োজনে সরকারের মৃদু সমালোচনাও করেছেন। বিএনআরের দরজা সবার জন্যই ভোলা ছিল। মফস্বলের বহু অখ্যাত কবি-লেখকের গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধের বই প্রকাশ করেছে। হাসান জামান লেখকদের প্রাপ্য টাকা পাণ্ডুলিপি গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিশোধ করতেন। তাতে বহু অসচ্ছল লেখক আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছেন। বই প্রকাশিত হওয়ায় লেখক হিসেবে তারা পেয়েছেন পরিচিতি, একজন অবহেলিত লেখকের জন্য তা বড় প্রাপ্তি।

খ্যাত-অখ্যাত এমন লেখক খুব কমই ছিলেন ষাটের দশকে, কবীর চৌধুরী ও হাসান জামানের সময় বিএনআর থেকে যাদের বই প্রকাশিত হয়নি। ১৯৬৮-৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় বিএনআর নিয়ে যখন সমালোচনা হচ্ছিল, তখন হাসান জামান আত্মরক্ষার জন্য চাতুর্যের আশ্রয় নেন। পত্রিকায় ফলাও করে বিরাট এক বিজ্ঞাপন দেন এই মর্মে যে ‘বিএনআর কাদের বই প্রকাশ করে গর্বিত। দেখা গেল, প্রগতিশীল শিবিরের অনেক লেখক আছেন তাঁদের মধ্যে। (অবশ্য ওই তালিকায় আহমদ শরীফ এবং সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নামও ছিল, কিন্তু তাদের কোনো বই বিএনআর থেকে প্রকাশিত হয়নি, অথবা তারা কোনো পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে রয়্যালটির টাকাও নেননি।)

উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের উদ্গাতা মওলানা ভাসানী যখন আইয়ুবের ‘দুর্গ জ্বালিয়ে দেওয়ার’ ডাক দিয়ে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন শুরু করেন, তখন একদিন উন্মত্ত জনতা নবাব আবদুল গনি রোডে বিএনআর কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়। (রেলভবনের পাশে)। টেবিল-চেয়ার-আলমারি পুড়ে ছাই হয়। অনেক ভালো ভালো রচনার পাণ্ডুলিপিও ভস্মীভূত হয়। গুদামে যেসব বই ছিল, সেগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং আধা-পোড়া বই কয়েক দিন রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। অনেক বই ছাপা হয়েছিল নিউজপ্রিন্টে। ১০-১২টি বই আমি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। ওই সময় একদিন উত্তরবঙ্গ থেকে আসা একজন লেখককে হাইকোর্টের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখি। কারণ জিজ্ঞেস করে জানি, তিনি ইতিহাসমূলক একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলেন, একটা চেকও পেয়েছেন, বইটি ছাপা হচ্ছিল, কিন্তু সব শেষ।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা হাসান জামানের পিএইচডি থিসিস ‘Rise of the Muslim Middle Class in India and Pakistan’ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

হাসান জামান ও তাঁর গোত্রের সবাই তাদের বিশ্বাসে অনড় ছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সাবলীলভাবে বিরোধিতা করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের আবেগ ও স্বপ্ন উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। নিয়তির পরিহাস এই যে তার বড় ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান এবং তাঁর ছেলে ও ভাগনে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। ১৯৭৮-তে হাসান জামান সৌদি আরবে মারা যান।

 ১৭. আইয়ুব আমলের সাহিত্যপুরস্কার

আইয়ুব আমলের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ছিল ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স প্রেসিডেন্ট পুরস্কার’। ১৯৫৮ সালে জেনারেল মুহম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পরপরই তিনি এই পুরস্কার প্রবর্তন করেন ‘গৌরবজনক সাহিত্যকীর্তির স্বীকৃতি প্রদানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু শুরু থেকেই এই সম্মানজনক পুরস্কারটি ছিল বৈষম্যমূলক। পুরস্কারের নীতি হিসেবে বলা হয়েছিল কমপক্ষে পাঁচ হাজার এবং ঊর্ধ্বপক্ষে দশ হাজার টাকা ও তৎসহ প্রেসিডেন্টের পদক প্রদানের রীতি রয়েছে এই পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে। শুধু সাহিত্যকর্মের জন্য নয়, প্রেসিডেন্ট পুরস্কার দেওয়া হতো বিজ্ঞান, চিত্রকলা, খেলাধুলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে গৌরবজনক অধ্যায় সৃষ্টির জন্যও। কৃতী ব্যক্তিদের এ ধরনের স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ প্রশংসনীয়।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘প্রেসিডেন্ট পুরস্কার’ দেওয়া হতো বাংলা ও উর্দু সাহিত্যের কবি-সাহিত্যিকদের। সম্ভবত পাকিস্তানের অন্য কোনো ভাষায় কোনো কবি সাহিত্যিক এই পুরস্কার ষাটের দশকে পাননি। পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধি ও পাঞ্জাবি ভাষার কবি-লেখকও ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পুরস্কার কমিটি গঠন করে দিত, সেই কমিটির সুপারিশমতো মনোনীত হতেন পুরস্কারপ্রাপ্তরা। প্রতিবছর পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগস্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করা হতো।

একই পুরস্কার কেউ পাবেন পাঁচ হাজার টাকা, কেউ পাবেন দশ হাজার টাকা, কেন এই বৈষম্য, তা সেকালে আমাদের বোধগম্য ছিল না। যারা বাংলা সাহিত্যে পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁদের কাছেও ব্যাপারটি স্পষ্ট ছিল না। জিনিসটি নিয়ে যে আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা প্রশ্ন তুলবেন, সে সাহসও ছিল না কারও। কেউ কেউ, বিশেষ করে যারা পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছেন, মর্মবেদনায় ভুগতেন, কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলতেন না। অথচ প্রশ্ন তোলা উচিত ছিল। গণতান্ত্রিক সমাজে অযৌক্তিক কাজের সমালোচনা এমন কি প্রতিবাদ হয়ে থাকে।

আমরা তখন তরুণ লেখক, সুতরাং ওই পদক-পুরস্কার নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা ছিল না। লক্ষ করেছি, যাঁর সাহিত্যকর্ম কম তিনি পেয়েছেন দশ হাজার টাকা এবং যার গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম রয়েছে তিনি পেয়েছেন পাঁচ হাজার টাকা। বাংলা সাহিত্যে প্রথম বছর (১৯৫৮) প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পান মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। নিঃসন্দেহে তিনি যোগ্যতম ব্যক্তি। তিনি পান দশ হাজার টাকা। তাঁর সঙ্গে একই বছর পুরস্কৃত হন কবি জসীমউদ্‌দীন। সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অপরিমেয়। তাঁকে দেওয়া হয় পাঁচ হাজার টাকা। জসীমউদ্‌দীনের মন খারাপ হয়েছিল, কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলেননি।

১৯৫৯ সালেও ওই একই ব্যাপার ঘটে। আজাদ পত্রিকার স্বত্বাধিকারী মুসলিম লীগের সাবেক নেতা মওলানা আকরম খাঁ পান দশ হাজার টাকা। ১৯৬০ সালে কবি গোলাম মোস্তফা পান পাঁচ হাজার টাকা।

১৯৬১ সালে কবি ফররুখ আহমদ পান পাঁচ হাজার টাকা এবং একই সঙ্গে মহিউদ্দীনও পান পাঁচ হাজার টাকা। ১৯৬২ সালে মহিউদ্দীন দ্বিতীয়বার একই পুরস্কার পান পাঁচ হাজার টাকা। বাংলা সাহিত্যে ফররুখ আহমদের অবদান আর মহিউদ্দীনের অবদান কি সমান? তা ছাড়া একই পুরস্কার পরপর দুই বছর একই ব্যক্তির পাওয়ার যুক্তি কোথায়?

রাষ্ট্রীয় পদক-পুরস্কারের অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে। সে গুরুত্ব শুধু অর্থনৈতিক নয়, মর্যাদারও। ইউরোপের প্রায় সব দেশেই অনেক রকম সাহিত্য পুরস্কার প্রচলিত রয়েছে। ভারতে আছে জ্ঞানপাঠ, আকাদমি পুরস্কার প্রভৃতি। যে উদ্দেশ্যেই আইয়ুব সরকার ‘প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রবর্তন করুক, কাজটি খারাপ ছিল না। মনোনয়ন ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতিত্বমূলক হওয়ায় পুরস্কারটির মর্যাদাহানি ঘটে এবং যারা পুরস্কৃত হন তাঁরাও গৌরব থেকে হন বঞ্চিত।

গণতন্ত্রহীন অনুন্নত দেশে সরকারি পুরস্কারের একটি নেতিবাচক দিক আছে, আর তা হলো তাতে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের শুধু নয়, পুরস্কারপ্রত্যাশী লেখকদের প্রতিবাদী চেতনা নষ্ট করে দেওয়া। সত্য উচ্চারণ থেকে তারা বিরত থাকেন। অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ জোর দিয়ে করতে পারেন না। আইয়ুবের সামরিক একনায়কী শাসনামলেও সেটি লক্ষ করা গেছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী নেতারা লড়াই করেছেন, নির্যাতিত-নিপীড়ন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, বিরল ব্যতিক্রম বাদে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অতুলনীয় সুবিধাবাদী।

১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পান আবুল ফজল পাঁচ হাজার টাকা, পরের বছরও তিনি আবার পুরস্কার পান পাঁচ হাজার টাকা। মহিউদ্দীন ও আবুল ফজল পরপর দুবার পুরস্কার পান পাঁচ হাজার পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকা। ১৯৬৬ সালে মুহাম্মদ এনামুল হক পেলেন পাঁচ হাজার টাকা, কিন্তু ‘৬৭ সালে বন্দে আলী মিয়া পেলেন দশ হাজার টাকা। সঙ্গীতে ওস্তাদ আয়েত আলী খান পেলেন দশ হাজার টাকা।

১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পান শওকত ওসমান। তার পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর শুনে প্যারিস থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁকে ২৫ আগস্ট ‘৬৮ এক চিঠিতে লেখেন, “শুনলাম বড় পুরস্কার পেয়েছ তাই লিখছি। অবশ্য এটা একটা অজুহাত, কারণ তুমি একটা পুরস্কার পেয়েছ তা কী এমন বড় খবর। পুরস্কারে খুশি হওয়ার কথা, তোমার নয়, আমাদেরও নয়। অন্য একটা দিক আছে বৈকি কিন্তু ওটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ও বিষয়ে অন্যদের মন্তব্য করার অধিকার আছে বলে– মনে হয় না।’

(সৈয়দ আবুল মকসুদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৮৩, পৃ. ২৩৪)

ওয়ালীউল্লাহ যে লিখেছিলেন পুরস্কারের অন্য একটা দিক, তা হলো আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া। যখন চালের মণ ছিল ৩০ টাকা এবং সোনার ভরি ১২০ টাকার কম, সেই সময় পাঁচ হাজার/দশ হাজার টাকা বিপুল টাকা। মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারটি যেহেতু ইসলামাবাদ থেকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় দিত, সুতরাং তার জন্য ঢাকা থেকে লেখকেরা কতভাবে কী পরিমাণ তদবির করতেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথবা তারাই পুরস্কার পেতেন, যারা সরকারের আস্থাভাজন।

আদমজী পুরস্কার দেওয়া হতোকবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, ভ্রমণকাহিনি, জীবনী প্রভৃতি বিভিন্ন শাখায় উল্লেখযোগ্য বইয়ের জন্য। প্রতিটি পুরস্কারের মান ছিল পাঁচ হাজার টাকা। লেখক সংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের পরামর্শক্রমে স্থায়ী চেয়ারম্যান মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পুরস্কারপ্রাপ্তদের মনোনীত করতেন। ১৯৬০ থেকে আদমজী পুরস্কার চালু হয়। প্রথম বছর পান আবদুস সাত্তার ও রওশন ইয়াজদানী, ১৯৬১তে রশীদ করীম ও আবদুর রাজ্জাক, ১৯৬২তে কাজী আবদুল মান্নান ও শওকত ওসমান, ‘৬৩তে শামসুর রাহমান ও শহীদুল্লাহ কায়সার, ‘৬৪তে আহসান হাবীব ও জহির রায়হান, ‘৬৫তে সুফি মোতাহার হোসেন ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং ‘৬৬তে আবুল ফজল ও ফররুখ আহমদ পুরস্কৃত হন। আদমজী পুরস্কারের যথেষ্ট মর্যাদা ছিল। যে বইটির জন্য পুরস্কার দেওয়া হতো, সেটি ভালো বিক্রি হতো। তাতে লেখক-প্রকাশক উভয়েই উপকৃত হতেন।

আরেকটি মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার ছিল দাউদ পুরস্কার। ১৯৬৩ সালে ‘দাউদ ফাউন্ডেশন’ এই পুরস্কার প্রবর্তন করে। বাংলা ভাষার জন্য দশ হাজার এবং উর্দু ভাষার সাহিত্যকর্মের জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হতো গবেষণা, জীবনী ও ইতিহাস গ্রন্থের জন্য, বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত বিষয়সমূহের ওপর গবেষণামূলক কার্যের জন্য। প্রতিটি পুরস্কারের মান ছিল পাঁচ হাজার টাকা। ষাটের দশকে দাউদ পুরস্কার পেয়েছেন মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ (১৯৬৩), জগলুল হায়দার আফরিক (১৯৬৩), আকবর উদ্দিন ও আশরাফ সিদ্দিকী (১৯৬৪), মুনীর চৌধুরী ও আনিসুজ্জামান (১৯৬৫), আবদুস সাত্তার ও মুন্সী রইসউদ্দীন (১৯৬৬) প্রমুখ।

পুরস্কার পাওয়ার কারণে কোনো কোনো বই ও তার লেখক জনপ্রিয়তা পেতেন। যেমন একজন লেখক জগলুল হায়দার আফরিক। তিনি পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁর ভ্রমণকাহিনি সিন্ধু নীলাভ দেশ নামক সুখপাঠ্য বইটির জন্য। ষাটের দশকে বইটি জনপ্রিয় ছিল। জগলুল হায়দার আফরিক চাকরি করতেন দৈনিক আজাদে। আজাদের হিসাব বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তিনি এবং আকরম খাঁর বিশেষ আস্থাভাজন। তিনি অনেকগুলো ভাষা জানতেন। শুনেছি আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দিসহ সাত আটটি ভাষা জানতেন। চল্লিশের দশকে তিনি অনেক দিন মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। তাঁর ইংরেজিতে একটি বই ছিল Call of the Red Sea. পঞ্চাশের দশকে তার একটি বই পরদা নশিন হওয়া পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। ষাটের দশকে তাঁর একটি উপন্যাস দেখেছি, নাম বিপ্লবী নায়িকা। স্বাধীনতার আগেই তিনি মারা যান। আমি তাঁকে দেখেছি। তিনি বিশেষ সজ্জন ছিলেন।

বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের জন্য আরও যারা দাউদ পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আশরাফ সিদ্দিকী, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল হক, আবদুস সাত্তার, মাযহারুল ইসলাম প্রমুখ। যে বইয়ের জন্য লেখকেরা দাউদ পুরস্কার পেয়েছিলেন, তার সবই যে বিশেষ মূল্যবান বই, তা বলা যায় না; কোনো কোনো ক্ষেত্রে বইটির চেয়ে বইয়ের লেখককেই পুরস্কৃত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও সেকালে ন্যূনতম মানসম্পন্ন না হলে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়া কঠিন ছিল।

পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ১৯৬৪ থেকে একটি সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করে। ন্যাশনাল ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা মমতাজ হাসান ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের একজন সমঝদার। ষাটের দশকে আমাদের প্রধান চিত্রশিল্পী ও লেখকদের মুখে মমতাজ হাসানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছি, তিনি ছিলেন তাঁদের অকৃপণ পৃষ্ঠপোষক। পূর্ব পাকিস্তানে চিত্রকর্ম বিক্রি হতো না বললেই চলে। সে জন্য পঞ্চাশের দশকের চিত্রশিল্পীদের অনেকেই করাচি-লাহোরে যাতায়াত করতেন ছবি বিক্রির জন্য। তারা কেউই নিরাশ হননি। বিশেষ করে, কোনো রকমে মমতাজ হাসানের সঙ্গে গিয়ে পরিচিত হতে পারলে ভাগ্য খুলে যেত। তিনখানা বই লিখে একজন খ্যাতনামা লেখক যা রোজগার করতেন, দু-তিনটি ছবি ন্যাশনাল ব্যাংকে গছাতে পারলে তার কয়েক গুণ বেশি উপার্জন করতেন একজন শিল্পী। মমতাজ হাসান শুধু ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টরই নন, সম্ভবত পাকিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবও হয়েছিলেন।

দাউদ বা আদমজী পুরস্কারের চেয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কারের বিষয় ছিল কিছুটা ভিন্ন। প্রতিবছর ২৫ হাজার টাকা পুরস্কারের জন্য বরাদ্দ করা হয়। বাংলা ভাষায় রচিত দুটি গ্রন্থের জন্য পাঁচ হাজার করে দশ হাজার, একইভাবে উর্দু দুটি গ্রন্থের জন্য দশ হাজার এবং ইংরেজি ভাষায় রচিত একটি বইয়ের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হতো। এই পুরস্কারটিতে বাঙালি লেখকেরা যথেষ্ট উপকৃত হয়েছিলেন।

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর বাংলা ও উর্দুতে লেখা দুটি গবেষণাগ্রন্থের জন্য দুটো পুরস্কার দেওয়া হতো এবং পাকিস্তানের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো যেতে পারে, এমন বিজ্ঞানবিষয়ক দুটি বাংলা ও ইংরেজি বইয়ের লেখকদের পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকা পুরস্কার ছিল। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর ইংরেজিতে রচিত একটি বইয়ের লেখককে ন্যাশনাল ব্যাংক পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দিত।

সেকালে সমগ্র পাকিস্তানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ মর্যাদা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে দেওয়া হতো খুবই সম্মান। মমতাজ হাসান, কুদরতুল্লাহ শাহাব প্রমুখের সুপারিশেন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীর স্থায়ী চেয়ারম্যান করা হয় পদাধিকারবলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে। লেখক বা প্রকাশককে বই জমা দিতে হতো। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিশিষ্ট একাডেমিশিয়ানরা ছিলেন বিচারকমণ্ডলীর সদস্য।

ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কারের প্রশ্নে একজনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। তিনি ডাক্তার মোহাম্মদ মোর্তজা। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের ডাক্তার। তার চেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি আমাদের মতো তরুণদের বাম সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন। তাঁর দীক্ষায় আমাদের বহু বন্ধু ষাটের দশকে বাম ধারার রাজনীতিতে এসেছেন। মস্কো-পিকিং দুই ধারার কমিউনিস্টদের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ ছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাংলা পরিভাষার কাজ তিনি করছিলেন। ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী প্রমুখ চাইতেন বাংলায় ডাক্তারি পড়বেন আমাদের ছাত্ররা মেডিকেল কলেজগুলোতে। তার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ হবে সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার প্রথম বছরই পান মোহাম্মদ মোর্তুজা। যে বইটির জন্য তিনি পুরস্কার পান তার নাম ‘জনসংখ্যা ও সম্পদ। তাঁর এই পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আমরা ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। প্রথম বছর আরেকটি ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার দুই ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল ড. এ কে এম আমিনুল হককে তাঁর চিল-ময়না-দোয়েল-কোয়েল বইটির জন্য আড়াই হাজার টাকা এবং অধ্যক্ষ আবুল কাশেমকে তাঁর একটি রসায়নবিষয়ক বইয়ের জন্য আড়াই হাজার টাকা। ১৬ ডিসেম্বরের পর ঢাকায় এসে ফুলার রোডে গিয়ে যখন শুনলাম আলবদর বাহিনী ডা. মোর্তজাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে, বেদনার সীমা ছিল না। অগণিত শহীদের তালিকায় যুক্ত হলো ফজলে রাব্বি, আলীম চৌধুরী, মোহাম্মদ মোর্তজাদের নাম।

১৯৬৫-তে ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার পেয়েছিলেন মোহাম্মদ আবদুল জাব্বার তাঁর খগোল পরিচয় এবং গোলাম আজম সিদ্দিকী তাঁর পাকিস্তানের অর্থনীতি বইয়ের জন্য। এই পুরস্কারটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো এই জন্য যে তা আমাদের বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির দাবি বাস্তবায়নে সহায়ক ছিল। পুরস্কারের কারণে অনেকেই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানবিষয়ক বই লেখায় প্রেরণা ও উৎসাহ পেতেন। ১৯৭০ সালে কবীর চৌধুরী একটি অনুবাদ বইয়ের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার পান।

ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের মাধ্যমেই প্রতি দুই বছর পরপর ‘ইউনেসকো পুরস্কার দেওয়া হতো। সেটাও দেওয়া হতো বাংলা ও উর্দু বইয়ের লেখককে। প্রতিবছর তিনটি বাংলা বই এবং তিনটি উর্দু বইয়ের লেখকের প্রত্যেকের জন্য ৪০০ ডলারের সমপরিমাণ টাকা বরাদ্দ ছিল। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পরের বছরই এই পুরস্কার চালু হয়। সাধারণ বিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক পারস্পরিক সমঝোতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়াও নাটক-উপন্যাসের মতো সৃষ্টিশীল বইয়ের জন্যও ‘ইউনেসকো পুরস্কার দেওয়া হতো। ইউনেসকো পুরস্কারপ্রাপ্ত কয়েকজন কবি-লেখক হলেন জহুরুল হক (সাত সাঁতার), খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন (যুগস্রষ্টা নজরুল), রাজিয়া মাহবুব (খাপছাড়া), আহসান হাবীব (রত্নদ্বীপ), আলাউদ্দিন আল আজাদ (কর্ণফুলী), আবদুল গনি হাজারী (কতিপয় আমলার স্ত্রী), আবদুল গাফফার চৌধুরী (কৃষ্ণপক্ষ), শাহ ফজলুর রহমান (মহাশূন্যে অভিযান) প্রমুখ। ইউনেসকো পুরস্কারপ্রাপ্ত বইগুলোর মধ্যে সাত সাঁতার, যুগস্রষ্টা নজরুল, কর্ণফুলী বাংলা সাহিত্যে টিকে গেছে।

আইয়ুব সরকার আরেকটি পুরস্কার চালু করেছিল। তার নাম ‘জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা পুরস্কার। এই পুরস্কারটিই ছিল বিতর্কিত। নাটক, শিশুসাহিত্য-বিষয়ক বইয়ের লেখকদের এই পুরস্কার দেওয়া হতো। বড়দের নাটকের জন্য দেওয়া হতো তিনটি পুরস্কার। প্রতিটির মান এক হাজার টাকা। সেকালে সেটাও কম টাকা নয়। প্রায় ১০ ভরি সোনার মূল্যের সমান। বড়দের নাটকের জন্য পুরস্কার পেয়েছিলেন নূরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, আশকার ইবনে শাইখ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সিকান্দার আবু জাফর, প্রাবন্ধিক আবদুল হক প্রমুখ। মুনীর চৌধুরী নিহত হওয়ার কথা শুনে মমতাজ হাসান গভীর দুঃখ পেয়েছিলেন বলে তাঁর ভাই শামসেদ চৌধুরীর কাছে শুনেছি।

কিশোর উপযোগী দুজন জীবনীলেখককে ‘জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা পুরস্কার’ দেওয়া হতো। একটি পুরস্কারের মান ছিল ৭৫০ টাকা, আরেকটির মান ৫০০ টাকা। অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েদের পড়ার উপযোগী একটি কবিতার বইয়ের জন্য ছিল একটি এক হাজার টাকার পুরস্কার। ছোটদের জন্য লেখায় পুরস্কার পেয়েছিলেন আহসান হাবীব, ফয়েজ আহমদ, জহুরুল হক, মোহাম্মদ নাসির আলী, কবি আজিজুর রহমান, রাজিয়া মাহবুব প্রমুখ।

এ ছাড়া ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তান (পরে যার নামকরণ হয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র) বই প্রডাকশন পুরস্কার প্রবর্তন করেছিল। ১৯৬২ সালে এই পুরস্কার চালু করে। বইয়ের অঙ্গসজ্জার জন্য বড়দের বইয়ের দুটি (প্রথম ও দ্বিতীয়) এবং শিশু-কিশোরদের বইয়ের জন্য দুটি পুরস্কার ছিল। সেটা পেতেন প্রকাশকেরা। প্রথম পুরস্কার এক হাজার টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার ৫০০ টাকা। প্রচ্ছদশিল্পীদের ন্যাশনাল বুক সেন্টার দুটি পুরস্কার দিত। প্রতিটির মান ৫০০ টাকা।

পদক পুরস্কারে লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা উপকৃত হয়েছেন সন্দেহ নেই; কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের বশে রাখা। এবং তাঁরা বশংবদ ছিলেনও, ব্যতিক্রম দু-একজন ছাড়া। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য লেখকদের কলম থেকে কোনো শক্ত লেখা বের হতো না। যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চলছে এবং বাংলার মানুষ চাইছে স্বায়ত্তশাসন, তখন তারা জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের সহায়তা করেননি। তবে হঠাৎ একদিন তাঁরাই পাকিস্তানি শাসকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর। নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর লেখকেরা আইয়ুব সরকারকে গালাগাল শুরু করলেন। শেখ মুজিবের যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অবধারিত, আইয়ুব-ইয়াহিয়া থেকে পাওয়ার আর কিছুই নেই, তখন ১৯৭১-এর ২৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান লেখক শিল্পী সমাজ’-এর পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। শুনেছি সংবর্ধনায় যেতে তিনি আগ্রহী ছিলেন না, কবি লেখকদের পীড়াপীড়িতে যান।

বাংলাদেশের লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের বঙ্গবন্ধু খুব ভালো চিনতেন। মঞ্চে বসে পরিচিত কবি-সাহিত্যিকদের দিকে তাকিয়ে তাঁদের ভালো করে দেখে তিনি তার ভাষণে বলেন :

‘জনগণ যখন অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করছিল, তখন একশ্রেণির শিল্পী, সাহিত্যিক-কবি…মৌলিক গণতন্ত্রের প্রশস্তি গেয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ গোছানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁরা কি আজ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন যে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন?’

স্পষ্টভাষী মুজিব সেদিন আরও একটু খোলাসা করে বলেছিলেন : ‘যে মৌলিক গণতন্ত্র ও ডিক্টেটরি শাসনের পতন ঘটানোর জন্য বাংলার বীর ছাত্র-জনতা-শ্রমিক বুকের রক্ত দিয়েছে, তাদের (আইয়ুবদের) গুণকীর্তন করে, প্রবন্ধ লিখে, বেতার কথিকা প্রচার করে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ পয়সা রোজগার করেছেন। বিএনআরের অর্থানুকূল্যে বই প্রকাশ করেছেন।’

[দৈনিক পাকিস্তান]

তাঁর ওই বক্তব্যে অনেক কবি লেখকই মাথা নিচু করে থাকেন। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো তাঁরাই স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানকে গালাগালি করে আওয়ামী লীগ সরকার ও জিয়াউর রহমানের সরকার থেকে পদক পুরস্কার ও সুবিধা নিয়েছেন।

১৮. রাষ্ট্রীয় খেতাব

ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকেরা এ দেশে তাদের সহযোগী ও তাবেদারদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন এবং সেসব পেয়ে তারা ধন্য হয়েছেন।

ইংরেজদের অধীনতা যারা মেনে নিয়েছেন, তাঁদের নানাভাবে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করা হয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম দিয়েছে একটি শ্রেণিকে ব্যবসা বাণিজ্য ও দালালি করে বিত্তবান হওয়ার সুযোগ। অকাতরে তাদের মধ্যে বিতরণ করেছে ভূসম্পত্তি। তারপর ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারি প্রথার প্রবর্তন করে বাংলার মানুষকে চিরদিনের জন্য শোষণের শিকারে পরিণত করে। অবশ্য সেই সব অনুগ্রহভাজন বিত্তবানের ছেলেমেয়েরাই কেউ কেউ দু-তিন পুরুষ পরে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে এককালের সুবিধাভোগীদের সন্তানদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। বহু জমিদার-জোতদারের সন্তানদের আত্মত্যাগ অসামান্য।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় ব্রিটিশ শাসকদের যারা বিশ্বাসভাজন, তাদের তারা বিভিন্ন খেতাব দিয়ে ভূষিত করতেন। সবচেয়ে বড় সামন্তপ্রভুদের বা জমিদারদের খেতাব দিতেন ‘নবাব বাহাদুর’ ও ‘নবাব’ এবং ‘মহারাজা’ ও ‘রাজা’। নবাব বাহাদুর ও নবাব দিতেন মুসলমানদের এবং মহারাজা ও রাজা হিন্দুদের। যেমন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর এবং নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়। তা ছাড়া সরকারের অনুগত বিশিষ্ট ব্যক্তি, জমিদার, সরকারি কর্মকর্তারা পেতেন খান বাহাদুর/ ‘রায় বাহাদুর’ এবং ‘খান সাহেব/ ‘রায় সাহেব। খান সাহেব ও রায় সাহেব ছিল সবচেয়ে ছোট খেতাব। মাসে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত যাদের আয় ছিল অথচ সমাজে যারা সম্মানিত, তাঁদের মধ্যে হিন্দুরা পেতেন রায় সাহেব এবং মুসলমানরা পেতেন খান সাহেব খেতাব। ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে বহু খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর এবং খান সাহেব ও রায় সাহেব ছিলেন। খেতাবধারীদের সাধারণ মানুষও সম্মান দিতেন। বহু কবি-সাহিত্যিক খেতাব পেয়েছেন।

সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান শুধু পদক-পুরস্কারই প্রবর্তন করেননি, তিনি ব্রিটিশ শাসকদের মতো চালু করেন খেতাব। সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা এবং সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাদের অবদান রয়েছে, এমন শিল্পী সাহিত্যিক ও সমাজসেবীদের তিনি ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে ওই খেতাব দিয়ে ভূষিত করতেন। অনুগত ও বিশ্বস্ত সরকারি, আধা-সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ভূষিত করা হতো খেতাবে।

আইয়ুব-প্রবর্তিত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ খেতাব ছিল হিলাল-ই-পাকিস্তান, তারপর হিলাল-ই কায়েদে আজম, সিতারা-ই পাকিস্তান, সিতারা-ই-সুজাত, সিতারা-ই ইমতিয়াজ, সিতারা-ই খিদমত, তমঘা-এ-ইমতিয়াজ, তমঘা-ই-কায়েদে আজম প্রভৃতি। খেতাবপ্রাপ্তরা নামের শেষে সংক্ষেপে খেতাব লিখতে পারতেন এবং লিখতেনও। যেমন সৈয়দ মুর্তজা আলী এবং কবি ও আমলা সানাউল হক পেয়েছিলেন ‘সিতারা ই-কায়েদে আজম। তিনি তাঁর প্যাডে লিখতেন সানাউল হক এসকিউএ অথবা ইংরেজিতে S.Q.A।

আমার মনে আছে, খেতাব পাওয়ার পর সানাউল হক আমাকে বলেছিলেন, ‘জানো, এই উপাধি ব্রিটিশ আমলের “স্যার” উপাধির সমান। তার একটি বন্ধুচক্র ছিল। তাদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, এ কে এম আহসান, সৈয়দ নাজিমুদ্দিন হাশেম প্রমুখ। তাঁকে জানতাম বাঙালি জাতীয়তাবাদী বলে। আমাদের সঙ্গে কথাবার্তায় তেমনটি মনে হতো। তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি আখাউড়ার কাছে চাওড়ায় আমাকে নিয়ে গেছেন। পুকুরের মাছ ও বাঙালির নানা রকম পিঠা খাইয়েছেন। তাঁর প্রয়াত বড় ভাইয়ের নামে বাড়িতে ‘কায়সার স্মৃতি অধ্যয়ন সমিতি গ্রন্থাগার’ নামে একটি ছোট পাঠাগার ছিল।

সুদক্ষ গোয়েন্দাদের রিপোর্টে পাকিস্তান সরকারের বিশ্বাসভাজন না হলে কারও পক্ষে আইয়ুবের খেতাব পাওয়া সম্ভব ছিল না। স্বাধীনতার পরে সানাউল হককে অত্যন্ত বেশি বাঙালি জাতীয়তাবাদী বলে মনে হতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের তিনি ছিলেন খুবই একজন ভক্ত। সে জন্য তিনি ভালো পোস্টিং পেয়েছেন। যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতার জন্যই সচিব হয়েছেন। কিন্তু তাঁর বিশেষ অনুরাগী হওয়ায় বঙ্গবন্ধু তাঁকে রাষ্ট্রদূত করে ব্রাসেলস পাঠান। একই সঙ্গে তিনি বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ প্রভৃতি কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন।

যেদিন তিনি ব্রাসেলস যাওয়ার জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন, আমি তাঁকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাই। কিছুদিন পরেই আসে ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও কূটনীতিক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর কাছে শুনেছি, পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে সানাউল হকের অস্বাভাবিক আচরণ। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ওই রাতে সানাউল হকের বাসভবনে ছিলেন। সকালে ক্ষমতাবদলের কথা শুনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের চেহারা মুহূর্তে বদলে যায়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার সঙ্গে তিনি যে আচরণ করেন, তা ছিল একজন কাপুরুষ ও অতি সুবিধাবাদীর মতো। তাই একেক সময় মনে হয়, বাঙালি কখন কী বিশ্বাস করে আর না করে, তা বিধাতার পক্ষেও আঁচ করা কঠিন।

মনে আছে, ‘হিলাল-ই-পাকিস্তান’ খেতাব যাঁরা পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিচারপতি কর্নেলিয়াস, আবদুল জব্বার খান, জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রমুখ ছিলেন। ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ পেয়েছিলেন নাট্যকার নুরুল মোমেন, সাংবাদিক-লেখক আবুল কালাম শামসুদ্দিন, নাট্যকার মুনীর চৌধুরী প্রমুখ। লেখকদের মধ্যে ‘তমঘা ই-ইমতিয়াজ পেয়েছিলেন শাহেদ আলী, আকবরউদ্দিন, আবু রুশদ, গোলাম মোস্তফা, তালিম হোসেন, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ এবং চিত্রশিল্পী শফিকুল আমিন। বাঙালি অফিসারদের মধ্যে তমঘা-ই-কায়েদে আজম’ খেতাব পান জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থার পরিচালক ও কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তমঘা-ই পাকিস্তান’ পান তল্কালীন কেবিনেট ডিভিশনের উপসচিব আবুল মাল আবদুল মুহিত, আরেক সিএসপি অফিসার ফজলুর রহমান খান প্রমুখ। তমঘা-ই-খিদমত পেয়েছিলেন অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টন্স সার্ভিসের আবু সাঈদ হাফিজুল্লাহ, সিএসপি অফিসার পি এ নাজির প্রমুখ।

আমাদের এক ঘনিষ্ঠজন শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেকশন অফিসার জিয়াউল হক পেয়েছিলেন তমঘা-ই-খিদমত। এটি ছোট খেতাব। তাকে অভিনন্দন জানাতে তার কমলাপুরের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি, আবু জাফর শামসুদ্দিন ও শওকত ওসমান। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মানুষ। আমাদের অভিনন্দনে বিব্রত হলেন। চুপ করে বসে রইলেন। সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে নয়, সম্ভবত পেয়েছিলেন খেতাবটি, কারণ তিনি ছিলেন একজন দক্ষ ও পরিশ্রমী অফিসার। অফিসের কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ‘ছয়-দফা’র ঘোরতর সমর্থক।

ষাটের দশকে পদক-পুরস্কার-খেতাব যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা কেউই কোনো অযোগ্য ব্যক্তি নন। তাঁদের প্রত্যেকেরই কমবেশি নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ রয়েছে। মধ্যবিত্তরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা কিছু প্রত্যাশা করেন। সেই চাওয়াতে এবং পাওয়াতে দোষও নেই। তবে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাসের পরিবর্তন প্রশংসার কাজ নয়।

একাত্তরের মার্চে স্বাধীনতার জন্য অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর বাংলার মানুষ যখন পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে নেমে আসে, তখন শিল্পী-সাহিত্যিকদের অনেকেই তাদের খেতাব বর্জন করেন। কিন্তু সেটা খুব বেশি দেরিতে। ব্রিটিশরা যে খেতাব দিত, তা ইংরেজি শব্দে নয়, বাংলা ও বাঙালির চেনা বা বোধগম্য শব্দে, যেমন খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর, খান সাহেব, রায় সাহেব। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকেরা যে খেতাব প্রবর্তন করেন, সেসব শব্দের অর্থ আজও অনেকেরই অজানা। অনেকেই বলতে পারবেন না কী অর্থ বহন করে ‘সিতারা-ই ইমতিয়াজ’ কিংবা ‘সেতারা-ই-সুজাত’ বা ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ শব্দগুলো।

পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা ছিল বাংলা ও উর্দু। সে জন্য সরকারি যেকোনো ব্যাপারে দুটি ভাষার ব্যবহারই প্রত্যাশিত। কিন্তু এই খেতাবগুলোর কোনোটিই বাংলা ভাষায় নয়। আমাদের কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদদের বিষয়টির প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। তারা তা করেননি। বিজাতীয় ভাষায় দেওয়া খেতাব গভীর আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন এবং তা সগৌরবে ব্যবহার করতেন।

কৃতী ব্যক্তিদের কাজের স্বীকৃতি অপ্রত্যাশিত নয়। পদক-পুরস্কারে মানুষের মর্যাদা কতটুকু বাড়ে তার চেয়ে বড় কথা, আমাদের মতো গরিব দেশে তারা আর্থিকভাবে কিছুটা উপকৃত হন। পশ্চিম পাকিস্তানি চিত্রশিল্পী জোবায়দা আগা এবং আমাদের কামরুল হাসান একই সঙ্গে প্রেসিডেন্টের পদক পান দশ হাজার টাকা করে। উভয়েই গুণী শিল্পী। পুরস্কার পাওয়ার পর কামরুল হাসান, তিনি তখন আইয়ুব প্রতিষ্ঠিত ডিজাইন সেন্টারের চিফ ডিজাইনার, তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন:

‘শিল্প-সাহিত্যের এই ধরনের পুরস্কার নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। এতে ব্যক্তিগতভাবে কোনো শিল্পীকে মর্যাদা দেওয়া হয় নাই। বরং শিল্পীর সাধনার এবং শিল্পীর রং ও তুলির মাধ্যমে যে পরিবেশ ও সমাজের চিত্র প্রকাশিত হইয়াছে তাহাকেই এই পুরস্কারের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া হইয়াছে।’

নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারি দায়িত্ব পালন করে যদি কেউ পদক পুরস্কার খেতাব পান, তা নিয়ে তাঁরা গর্ব করতেই পারেন। আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘তমঘা ই-পাকিস্তান’ (টিপিকে) পেয়েছিলেন তার যোগ্যতায় বাংলাদেশের যখন তিনি অর্থমন্ত্রী, তখনো ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ তিনি পেয়ে থাকবেন তার যোগ্যতার জন্য। তবে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নিজের পুরস্কার নেওয়া শোভন নয়।

 ১৯. একটি অবহেলিত অধ্যায়

আমরা যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি, সেখানে যে আধুনিক সমাজ গঠিত হয়েছে, তা নির্মাণের পেছনে কত মানুষের অবদান ও শ্ৰম কাজ করেছে, তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরে বহু খ্যাত-অখ্যাত মানুষ কোনো কিছু প্রাপ্তির আশা না করে নীরবে কাজ করে গেছেন একটি বসবাসযোগ্য সমাজ নির্মাণের জন্য। আজ বেগম রোকেয়ার নাম প্রতিদিন উচ্চারিত। তাঁর নামে রাস্তাঘাট, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অবশ্যই তাঁর অবদান বড়। তবে তাঁর যে নারীবাদী আন্দোলন, তা উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আজ আমাদের দেশে নারীদের বিভিন্ন সংগঠন, পরিষদ, সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারীদের জন্য রয়েছে বহু বড় বড় এনজিও। তাতে বিদেশি অর্থায়নও প্রচুর। কিন্তু কোনো নারীবাদী সংগঠন কি কখনো স্মরণ করে ডাক্তার লুঙ্কর রহমানের নামটি? যিনি ১৯২০-এর দশকে, রোকেয়ার জীবদ্দশায়ই কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নারী-তীর্থ’ নামের সেবাশ্রম এবং নারী-শক্তি নামে পত্রিকা।

যশোর জেলার অধিবাসী এবং পেশায় হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, লুৎফর রহমান প্রথম জীবনে কিছুকাল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছিলেন আদর্শবাদী ও যুক্তিবাদী মানুষ। শিক্ষকতায় গিয়েছিলেন জীবিকার জন্য নয়, মানুষ তৈরি করার ব্রত নিয়ে। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল উঁচু, কিন্তু সংগতি ছিল কম। বিত্তবান তিনি ছিলেন না, ছিল না তার কোনো বিত্তবান হিতৈষী। সীমিত শক্তি নিয়ে একটি উন্নত সমাজ গঠনের জন্য তিনি আমৃত্যু কাজ করেছেন। কোনো আনুকূল্য পাননি কোনো দিক থেকে। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি ১৯৩৬ সালে কলকাতায় মারা যান। তিনি তাঁর ঘরে দরিদ্র যক্ষ্মা রোগীদের রেখে চিকিৎসা করাতেন এবং একপর্যায়ে নিজেই যক্ষ্মায় সংক্রমিত হয়ে মারা যান। সুমহান আদর্শবাদিতা।

রোকেয়া ছিলেন উচ্চমধ্যশ্রেণির প্রতিনিধি, সাধারণ দরিদ্র, নির্যাতিত-নিপীড়িত নারীদের ব্যাপারে তাঁর বিশেষ দুশ্চিন্তা ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশে নির্যাতিত-নিপীড়িত নারীর সংখ্যাই বেশি। শুধু পেটের দায়ে বহু যুবতী ও অসহায় নারী পতিতালয়ে গিয়ে আশ্রয় নিত। লুত্ফর রহমান তাদের খোঁজ নিতেন। তাদের নিঃশব্দ কান্না তার বুকে বাজত। তিনি তাদের অনেককে পতিতালয় থেকে বের করে এনে সমাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। একবার যে নারী দেহব্যবসা করেছে, আমাদের সমাজ তাকে আর ঠাই দেবে না। একপর্যায়ে লুৎফর রহমান তার নিজের ঘরেই তাদের। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। আশপাশের মানুষ তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। তিনি তাঁর কর্মসূচির নাম দেন ‘নারী-তীর্থ’। সেখানে রোকেয়া একদিনও যাননি, কবি গোলাম মোস্তফা, নজরুল ইসলাম গেছেন। নজরুল ছাড়া তিনি আর কারও থেকে কোনো সমর্থন পাননি। লুৎফর রহমান পত্রিকা বের করেন নারী-শক্তি নামে। বাঙালি মুসলমানসমাজ উন্নত ও মহৎ কিছু কখনো দেখেনি। তাই কলকাতার কোনো বিত্তবান মুসলমান তাঁর মহৎ কর্মে এগিয়ে আসেননি।

লুৎফর রহমানের উপদেশমূলক রচনাবলি বহুপঠিত। বাংলা একাডেমিও তার রচনাবলি প্রকাশ করেছে। তা ছাড়া পাইরেট সংস্করণ হয়েছে তার প্রবন্ধগ্রন্থ উচ্চ জীবন, মহৎ জীবন, উন্নত জীবন, মানব জীবন, সত্য জীবন প্রভৃতি। ছেলেদের মহৎ কথা তার একটি চমৎকার বই। লুৎফর রহমান একজন সৃষ্টিশীল লেখকও ছিলেন। তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে পথহারা, প্রীতি উপহার, বাসর উপহার, রায়হান প্রভৃতি। একজন সৃষ্টিশীল লেখক, সংস্কারক ও সমাজকর্মী হিসেবে লুৎফর রহমান সমাজের মূলধারা থেকে যে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দাবি করেন, তা তিনি পাননি। ফলে তাঁর বইপত্র বাজারে রয়ে গেলেও ব্যক্তি লুৎফর রহমান হারিয়ে যান। আমরা প্রভাবশালী ও বিত্তবানের পায়ে অর্ঘ্য দিতে অভ্যস্ত– তাঁর অবদান যত সামান্যই হোক।

অশেষ অভাব ও অজ্ঞতার অন্ধকারে পড়ে থাকা বাঙালি মুসলমানকে অশিক্ষিত কাঠমোল্লা ও ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীরা শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রতারণা করে আসছিল। ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে, বিচিত্রভাবে প্রতারণা করে একটি শ্রেণি বৈষয়িকভাবে উঠেছিল ফুলে-ফেঁপে। তারা সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের থেকেও আনুকূল্য পেত। ওই ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ী ও সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের সরাসরি আঘাত করা কঠিন ছিল। নজরুল তাঁর জনপ্রিয়তা ও হিমালয়তুল্য ব্যক্তিত্বের জন্য খানিকটা পেরেছিলেন। অন্য কারও পক্ষে তা সহজ ছিল না। আবুল মনসুর আহমদ সেই ঝুঁকি নেন। তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন সাংবাদিকতা ও আইন ব্যবসাকে। নেশা হিসেবে বা সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য সাহিত্য ও রাজনীতি। আবুল মনসুরের ব্যঙ্গগল্প বা রম্যরচনা আয়না (১৯৩৫) বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য কাজ। তাঁর আরেকটি রসরচনা ফুড কনফারেন্স (১৯৪৪)। দুটি গ্রন্থে যে বিষয় দুটিকে তিনি আঘাত করেছিলেন, সেই ধর্ম ব্যবসা ও সুবিধাবাদী নষ্ট রাজনীতি আজও আমাদের দেশ ও সমাজকে পেছনের দিকে টানছে।

আয়না সম্পর্কে নজরুল লিখেছিলেন, ‘এমনি আয়নায় শুধু মানুষের বাইরের প্রতিচ্ছবিই দেখা যায়, কিন্তু আমার বন্ধু [কথা] শিল্পী আবুল মনসুর যে আয়না তৈরি করেছেন, তাতে মানুষের অন্তরের রূপ ধরা পড়েছে। যে-সমস্ত মানুষ হরেক রকম মুখোশ পরে আমাদের সমাজে অবাধে বিচরণ করছে, আবুল মনসুরের আয়নার ভেতরে তাদের স্বরূপমূর্তি– বন্য ভীষণতা নিয়ে ফুটে উঠেছে। মানুষের মুশোখপরা এই বহুরূপী বনমানুষগুলোর সবাইকে মন্দিরে, মসজিদে, বক্তৃতার মঞ্চে, পলিটিক্সের আখড়ায়, সাহিত্যসমাজে যেন বহুবার দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।’

নজরুল আরও বলেছিলেন, ‘বন্ধুবরের রসাঘাত কশাঘাতেরই মত তীব্র ও ঝাঝালো।’

আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব। তিরিশের দশক থেকে তিনি বাঙালি মুসলমানসমাজে একজন প্রতিনিধি-পুরুষ। সাংবাদিকতা করেছেন, সাহিত্যচর্চা করেছেন, রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন এবং সমাজের –বিশেষ করে মুসলমানসমাজের –দোষ ও দুর্বলতাগুলো দূর করতে কিছুটা সংস্কারের কাজও করেছেন। সমাজের অন্যায়-অসংগতি তাঁকে পীড়া দিয়েছে। সেসবের বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের প্রগতিশীল মানুষ।

মুসলমানসমাজের আধুনিক সাংবাদিকতার যারা পথিকৃৎ, আবুল মনসুর তাঁদের মধ্যে প্রধান। ১৯২০ এবং ‘৩০-এর দশকে বিভিন্ন কাগজে তিনি কাজ করলেও ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে নিখিল বঙ্গ প্রজা পার্টির মুখপত্র দৈনিক কৃষক এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। একটি অসাম্প্রদায়িক কাগজ হিসেবে সেটি প্রশংসিত হয়েছিল। তবে খুব বেশি সময় তিনি সেখানে ছিলেন না। ১৯৪১ সালে শেরেবাংলা ফজলুল হকের দৈনিক নবযুগে যোগ দেন। প্রধান সম্পাদক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, কিন্তু সম্পাদনার মূল দায়িত্ব পালন করতেন আবুল মনসুর। নজরুল তখন শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়ছিলেন। নবযুগে থাকাকালেই তিনি বাক্ ও স্মৃতিশক্তি হারান।

সাংবাদিকতায় আবুল মনসুরের গুরুত্বপূর্ণ অবদান দৈনিক ইত্তেহাদ, প্রকাশিত হয় ১৯৪৭-এর জানুয়ারিতে, মালিকানা ছিল অখণ্ড বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। কাগজ হিসেবে ইত্তেহাদ ছিল আধুনিক ও প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক। যদিও মুসলমানসমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা তাতে প্রাধান্য দিয়ে তুলে ধরা হতো। ১৯৫০ সালে ইত্তেহাদ বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের বাড়িতে ইত্তেহাদ আসত কলকাতা থেকে। মওলানা আকরম খাঁর আজাদ ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদী এবং ইত্তেহাদ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে ইত্তেহাদ বহু মুসলমান তরুণকে সাংবাদিকতা শিখিয়েছে, পরে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাঁরা খ্যাতিমান হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মোহাম্মদ মোদাব্বের, কে জি মুস্তফা, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, খোন্দকার আবদুল হামিদ, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রীস, কথাশিল্পী রশীদ করীম, সিরাজুদ্দীন হোসেন প্রমুখ। আমাদের বাড়িতে ইত্তেহাদ-এর বহু পুরোনো কপি ছিল। তার সাহিত্য বিভাগ, মহিলা বিভাগ, শিশু কিশোরদের পাতা, সিনেমার পাতা, খেলাধুলার পাতা প্রভৃতি ছিল মানসম্মত। তার চেয়েও বড় কথা, মুসলমান সমাজ তখন জেগে উঠেছে। সে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে সব ক্ষেত্রে। সে চাইছে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে এবং নিজেদের বিকশিত করতে। বাঙালি মুসলমান পুরুষ শুধু নয়, বাঙালি নারীও ঘরের বাইরে এসে নিজের শক্তির স্বাক্ষর রাখতে চাইছে। বাঙালি মুসলমান খেলাধুলায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। অগ্রগামী হিন্দুদের সঙ্গে খেলার মাঠে ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সিনেমার মতো নতুন শিল্পমাধ্যমে তার আগ্রহ দেখা যায়। মুসলমান শিশু কিশোরদের সুপ্ত প্রতিভা অঙ্কুরিত করার প্রয়াস দেখা দিয়েছে চল্লিশের দশকে। মুসলিম লীগ চাইছে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে স্বশাসন। মুসলমানসমাজ তাতে গভীরভাবে সাড়া দিচ্ছে।

আবুল মনসুর আহমদ একজন বিশিষ্ট সৃষ্টিশীল লেখক, বরং তার অন্যান্য পরিচয়ের মধ্যে লেখক পরিচয়ই প্রধান। আয়না ও ফুড কনফারেন্স-এর রম্য ছোটগল্পগুলো সাহিত্যকর্ম হিসেবে অসামান্য। তিনি কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছেন। শিল্পকর্ম হিসেবে সেসব উপন্যাস কতটা উত্তীর্ণ, তার চেয়ে বড় কথা, তাতে তিনি আঁকতে চেয়েছেন একটি সময়ের বাঙালি মুসলমানের বাইরের ও ভেতরের চিত্র। তাঁর উপন্যাস তিনটি– সত্যমিথ্যা, জীবনক্ষুধা ও আবেহায়াত। তিনি সমাজের সমস্যার কথা বলতে চেয়েছেন। জীবনক্ষুধায় চল্লিশের শেষের বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের মনোজগৎকে তুলে ধরতে পেরেছেন। বাংলা উপন্যাস নিয়ে যখন আলোচনা হয়, যেখানে আবুল মনসুর আহমদ বিশেষ গুরুত্ব পান না। বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের দুর্বলতা সেখানে।

আবুল মনসুর আহমদ পূর্ব বাংলার গ্রামীণ মুসলমানদের জীবনের রূপকার। তাঁর গদ্য পরিশীলিত নয়, তিনি বিষয়বস্তুর ওপর বা বক্তব্যের ওপর জোর দিয়েছেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ঢাকা অঞ্চলের গ্রাম্য শব্দ তিনি বেশি ব্যবহার করেছেন, শুধু সংলাপে নয়, ন্যারেশনেও। তবে সব ক্ষেত্রে সে ব্যবহার যথোপযুক্ত হয়নি। ভাষার প্রশ্নে তাঁর নিজস্ব বক্তব্য ছিল। তাঁর সঙ্গে অনেকেই একমত নন। অবশ্য তাতে তার গুরুত্ব কমে না। যে থিসিস তিনি দেবার চেষ্টা করেছেন তা বিবেচনার বিষয়। বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য আর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যের ভাষা কখনোই হুবহু এক হবে না।

আবুল মনসুরের চিন্তাধারার সঙ্গে আমরা ভিন্নমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে বাঙালি মুসলমানসমাজের অনেক চিহ্নিত প্রগতিশীলদের চিন্তায় যে অসংগতি লক্ষ করা যায় তার মধ্যে তা অনুপস্থিত। তিনি গা বাঁচিয়ে অথবা চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে কথা বলতেন না। যা ভাবতেন একান্তে তাই ব্যক্ত করতেন প্রকাশ্যে সকলের মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সম্মেলন ১৩৫১-তে (১৯৪৪) মূল সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন :

‘ধর্ম ভূগোলের সীমা ছাপিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু তমদ্দুন ভূগোলের সীমা এড়াতে পারে না, বরঞ্চ সে-সীমাকে আশ্রয় করেই সংস্কৃতির পয়দায়েশ; এখানেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সরহদ্দ। এখানেই পূর্ব পাকিস্তান একটি ভৌগোলিক সত্তা। এই জন্যেই পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা ভারতের অন্যান্য জাত থেকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ধর্মীয় ভ্রাতাদের থেকে একটা স্বতন্ত্র আলহিদা জাত।’

অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গ যে পাকিস্তানের একটি অবিচ্ছেদ্য নয় বিচ্ছিন্ন অংশ তা স্বীকার করে নিয়েই এই অঞ্চলের বাঙালি জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি আলোচনায় ব্রতী হন।

পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য মাহফিল আয়োজিত চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন’-এ তিনি ‘পাক-বাংলার কালচার ও ভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে অধিকাংশ আলোচকের সঙ্গে অভিন্ন মত পোষণ করেননি বলেই ‘ইসলামকেই পূর্ব বাংলার সংস্কৃ তির একমাত্র নিয়ন্ত্রণী শক্তি হিসেবে গণ্য করেননি। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলার কৃ ষ্টি ও ভাষার পার্থক্য স্বীকার করে নিয়ে, ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক-সামাজিক ঐতিহ্যের ভিত্তিতে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা পুনর্গঠনের ওপর তিনি জোর দেন।

মাসিক মোহাম্মদীতে (কার্তিক ১৩৫০/১৯৪৩) ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শীর্ষক এক নিবন্ধে আবুল মনসুর পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি এবং তার পরিচালকদ্বয় আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং মুজীবুর রহমান খাঁর প্রশংসা করে লিখেছিলেন :

‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত রূপায়ণের ভাবী রূপ নিয়ে মুসলিম বাংলার চিন্তানায়কদের মধ্যে এখন থেকেই আন্দোলন আলোচনা খুব স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছে। এই বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি যে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকায় অভিনয় করেছে, সে সম্বন্ধে বাঙলার মুসলমান এমনকি, এদের সীমিতাংশও, আজো পুরোপুরি সচেতন হননি।… বস্তুত পাকিস্তান দাবিকে একটা রাজনৈতিক, এমনকি নির্বাচনী শ্লোগান থেকে একটা ইনটেলেকচুয়াল আইডিয়্যালিজমে রূপান্তরিত করেছে প্রধানতঃ এই দুই ব্যক্তির মনীষা। আমি একাধিকবার স্বীকার করেছি, প্রধানতঃ এদের প্রেরণায় আমি পাকিস্তানের আদর্শবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। কায়েদ-ই-আজমের মনে যাই থাক, বাংলায় পাকিস্তানবাদ নিশ্চয় পার্লামেন্টারি কচকচিতে খেই হারিয়ে ফেলতো যদি না এই দুই ব্যক্তি নানা বিপদ ও অপ্রীতি অগ্রাহ্য করে নিশিদিন কলম চালিয়ে পাকিস্তানবাদকে এই ইনটেলেকচুয়াল রূপ দিতেন…।

এই পাকিস্তানবাদের ইনটেলেকচুয়াল রূপটি সেকালের প্রধান বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কেমন ছিল তা সংক্ষেপে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে আবুল মনসুরের ধারণায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলার যে চরিত্র গ্রহণের কথা ছিল ১৯৪৭ এর পর তারা দেখলেন এ এক অন্য পূর্ববঙ্গ। মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক নেতারা ততদিনে পূর্ব বাংলা দখল করে নিয়েছেন। এবং তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন একদল ভাড়াটে কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা পূর্ব বাংলার দুর্দশা দেখে প্রথম দিকেই মর্মাহত ও হতাশ হন। আবুল মনসুরও হতাশ হন। তিনি সেই শ্রেণির বুদ্ধিজীবী যিনি দিল্লির শাসকদের মনোভাবের সঙ্গেও একমত নন, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবি শাসক-শোষকদের সঙ্গে গাটছড়া বাধারও বিরুদ্ধে। তবে তিনি মোটেই উগ্র নন, যা বলার নিচু কণ্ঠে শান্তভাবেই বলেন। তাঁর ভাষায়, গোটা পাকিস্তান অর্থ ছিল কার্যতঃ ‘পশ্চিম পাকিস্তান।’ তিনি আর পরিষ্কার করে বলেন : ‘আমাদের রাষ্ট্রীয় রূপ “পূর্ব পাকিস্তান” বা ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ যাই হোক ভাষা-সাহিত্য-কালচার-সংস্কৃতিতে যে আমরা একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান ও অপরদিকে ভারত হইতে সম্পূর্ণ পৃথক, এসব ব্যাপারেই যে আমাদের নিজস্বতা ও স্বকীয়তা আছে, এটা আমার অনড় দৃঢ় মত।’ [আত্মকথা] ।

আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন প্রথমত পূর্ব বাংলার একজন খাঁটি বাঙালি, তারপর একজন মুসলমান এবং এই দুইয়ের সমন্বয়ে হয়ে উঠেছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি মুসলমান। ওই বাঙালি মুসলমান হওয়াটাই তার জন্যে হয়েছিল সমস্যা। তাঁর লেখা পড়ে এবং জীবন পর্যালোচনা করে মনে হয় না তিনি কিছুমাত্র সাম্প্রদায়িক ছিলেন। অনেক বাঙালি মুসলমান নেতার মতো একেবারেই ভারতবিদ্বেষী ছিলেন না, হিন্দুবিদ্বেষী তো ননই। তাঁর ব্যবহৃত কিছু কিছু শব্দ ও শব্দ বন্ধ তাঁকে ভুল বোঝার পথ করে দেয়। তার মধ্যে পূর্ববঙ্গীয়তা ছিল পুরোপুরি; কিন্তু হিন্দু-বিরূপতা ছিল না একেবারেই। যেমন তিনি পূর্ব বাংলাকে বলেছেন ‘মুসলিম বাংলা’, কথাটিতে আমরা শঙ্কিত হতে পারি কারণ পদ দুটিতে ধ্বনিত হয় যেন সাম্প্রদায়িক চেতনা। কারণ পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি ভুট্টোর মুখেও শোনা গেছে কথাটি ‘৭০-এর দশকে। ভারতের প্রতিরক্ষমন্ত্রী জগজীবন রাম ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে বাংলাদেশকে অখ্যায়িত করেছেন ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র’ বলে। এ সব কথায় সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ঘটে না। আবুল মনসুরকে সমর্থন করার জন্য বলছি না, বস্তুত তাঁর লেখা পাঠ করে সহজেই বোঝা যায় যে কথাটিতে তিনি বোঝাতে চাইতেন ‘মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গ’। অবহেলিত পূর্ব বাংলাই ছিল তাঁর চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। সেটা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ভেদবুদ্ধি থেকে নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতার চেতনাপ্রসূত।

যে ভৌগোলিক অবস্থানে আজকের বাংলাদেশ, যার রাজনৈতিক রূপ গ্রহণ করতে শুরু করে ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে, তারপর ১৯৪৭-এ এক চরিত্র গ্রহণ করে এবং ১৯৭১-এ যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্রের রূপ গ্রহণ করে, তার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন আবুল মনসুর আহমদ : ছোট এবং বড়, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ, দু’রকম ভূমিকাই তিনি পালন করেছেন। আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে চাই, যদি ১৯৪৭-এর পর খাজা নাজিমুদ্দিনদের হাতে ক্ষমতা না থেকে আবুল মনসুর ও তার সমধর্মীদের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হতো, অন্তত তাঁদের পরামর্শ গৃহীত হতো, তাহলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতো– সমাজ হতো সাম্প্রদায়িকতামুক্ত। অনুরূপভাবে ১৯৭১-এর পর যদি তাদের পরামর্শে বাংলাদেশ শাসিত হতো তাহলে ‘সোনার বাংলা না হোক অন্তত শান্তিতে বসবাসযোগ্য এক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হতো। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রায় একটি দশক জীবিত ছিলেন তিনি, কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাকে শ্রদ্ধা করেছেন কিন্তু তার পরামর্শ গ্রহণ করার প্রয়োজন মনে করেননি তাঁর পুত্রপ্রতিম শেখ মুজিব। আবুল মনসুরের মতো মধ্যপন্থী মানুষ প্রগতির জন্য কখনোই বাধা নন, কারণ তাঁরা রক্ষণশীল হতে পারেন কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল নন –তাঁরা মুখর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ও সকল রকম অন্যায়-অবিচার ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে।

সুতরাং তাদের চিন্তা, মেধা, প্রজ্ঞা ও মানবপ্রেম একটি জাতি গঠনে অত্যন্ত প্রয়োজন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা চেয়েছিলাম গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা। আবুল মনসুর আহমদ এই নীতিগুলোর কোনোটারই বিরুদ্ধে ছিলেন না। সমাজতন্ত্রী তিনি ছিলেন না, কিন্তু সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কোনো কর্মসূচির তিনি বিরোধিতা করতেন না। আর গণতন্ত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষ তিনি ছিলেন পুরোপুরি।

দুই

যে স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭১-এ অভ্যুদয় ঘটে, তা একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের প্রস্তুতি অনেক দিনের এবং সেই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ছিল জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বহু মানুষের। নিজস্ব ভূখণ্ডে স্বশাসিত হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা, তা এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে সুপ্ত ছিল, তাকে জাগিয়ে তোলার জন্য অসংখ্য মানুষ বিচিত্রভাবে কাজ করেছেন। সেই ভূমিকা সবচেয়ে বেশি পালিত হয়েছে সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে।

ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের অধিবাসী আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯২০ ২১ সালে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং তার পরপরই ক্ষণজীবী মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক মোহাম্মদীতে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পিছিয়ে থাকা মুসলমানসমাজকে কীভাবে সচেতন করে তোলা যায়, সে জন্য তিনি সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চাকে বেছে নেন। প্রচারণামূলক ও মননশীল রচনা শুধু নয়, বিদেশি ক্ল্যাসিক সাহিত্য, বিশেষ করে রুশ লেখক তুর্গেনিভের অনেক রচনা তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। তাতে তাঁর অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে সাংবাদিকতাকেই জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তিনি বাস্তবিক পক্ষে বাংলাদেশে আধুনিক সাংবাদিকতার অন্যতম জনক। দৈনিক ছোলতান, দৈনিক আজাদসহ কয়েকটি কাগজে তিনি সম্পাদক ছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ষাটের দশকের শুরুতে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক জেহাদ। দৈনিক জেহাদ ছিল আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের সমর্থক কাগজ, তাতে আবদুল গাফফার চৌধুরী, নির্মল সেন প্রমুখ নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকেরা চাকরি করতেন। সেটি ছিল একটি আধুনিক দৈনিক। পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছিল অল্প দিনে, কিন্তু বছর দেড়েকের মধ্যে দৈনিক জেহাদ বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৬৪ সালে আইয়ুব সরকার প্রতিষ্ঠিত প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান প্রকাশ করে দৈনিক পাকিস্তান– বাংলা ভাষার একটি সর্বাধুনিক কাগজ। আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, সানাউল্লাহ নূরী, ফজল শাহাবুদ্দিনসহ আধুনিক বহু কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিক দৈনিক পাকিস্তানে যোগ দেন, যাদের প্রায় সবাই ছিলেন কমবেশি প্রগতিশীল ঘরানার মানুষ। আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯৭১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈনিক পাকিস্তান-এর সম্পাদক ছিলেন। দৈনিক পাকিস্তান-এর সাংবাদিকতার মান ছিল খুবই উন্নত। ছাপা হতো আধুনিক যন্ত্রে। পৃষ্ঠাও ছিল উপমহাদেশে বাংলা ভাষার যেকোনো দৈনিকের চেয়ে বেশি।

দৈনিক পাকিস্তান-এর মহিলা বিভাগটি ছিল উঁচুমানের। সেটি সম্পাদনা করতেন মাফরুহা চৌধুরী। তিনি একজন ছোটগল্পকার হিসেবে ষাটের দশকে খ্যাতিমান ছিলেন। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে অরণ্য গাঁথা ও অন্যান্য গল্প, কোথাও ঝড়, স্থলিত নক্ষত্র, বিদীর্ণ প্রহর প্রভৃতি নাম করেছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন কবি তালিম হোসেনের স্ত্রী। তিনি এবং কবি আহসান হাবীব এক কামরায় বসতেন। কবি-লেখকেরা লেখা নিয়ে তাদের কাছে যেতেন। সাহিত্য নিয়ে কথাবার্তা হতো। নতুন লেখকদের তারা পরামর্শ দিতেন। একটি চমৎকার সাহিত্যিক পরিবেশ ছিল। দৈনিক পাকিস্তান-এর মহিলামহল অনেক নতুন লেখিকা তৈরি করেছে।

দৈনিক পাকিস্তানে নারী সাংবাদিকেরাও কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে রিপোর্টিংয়ে হাসিনা আশরাফ খুব নাম করেছিলেন। তিনি ছিলেন দৈনিক পাকিস্তান-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আলী আশরাফের স্ত্রী। আবুল কালাম শামসুদ্দীনের নেতৃত্বে দৈনিক পাকিস্তান উপমহাদেশের একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিকে পরিণত হয়।

সাংবাদিকতার অবসরে আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহিত্যচর্চা করেছেন। তাঁর সাহিত্যচর্চা মধ্যপ্রাচ্যপন্থী ছিল না। তবে আদর্শের দিক থেকে তিনি ছিলেন মুসলিম প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী। তাঁর দৃষ্টিকোণ প্রবন্ধগ্রন্থটি ১৯৬০-এ প্রকাশ করেছিল ইস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স, পঞ্চাশের দশকের খ্যাতিমান সাহিত্যের বইয়ের প্রকাশক। বইটি সেকালে খুবই পঠিত ছিল। তুর্গেনিভের অনুবাদ হলেও গল্পগ্রন্থ ত্রিস্রোতা এবং উপন্যাস খরতরঙ্গ চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে খ্যাতি অর্জন করেছিল।

ইস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্সে আব্বার সঙ্গে বইপত্র কিনতে যেতাম পঞ্চাশের শেষ দিকে। ষাটের শুরু থেকে যেতাম আমি নিজেই। ভালো ভালো বই পাওয়া যেত। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ভাষা ও সাহিত্য, আবুল ফজলের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা, রণেশ দাশগুপ্তের উপন্যাসের শিল্পরূপ, ইবনে ইমামের জলেস্থলে ও চিত্রবিচিত্র সেখান থেকেই কিনেছিলাম। সেকালে বইয়ের দোকানের ম্যানেজারের সঙ্গেও কথা বলতে ভালো লাগত। কাপড়চোপড় বা সোনার দোকানের সেলসম্যান আর বইয়ের দোকানের সেলসম্যানকে একরকম মনে হয়নি। সেকালে অনেক সেলসম্যানকে দেখতাম ক্রেতা না থাকলে তারা বসে বসে বই পড়ছেন। খুবই অল্প বেতনের ওই কর্মচারীদের বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে ভালো জ্ঞান ছিল।

ভাষাবিজ্ঞানী ও ধ্বনিতত্ত্ববিদ মুহম্মদ আবদুল হাই যে অতসী নামে একটি ছোটগল্পের বই লিখেছিলেন, তা মানুষ ভুলেই গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অত্যন্ত যোগ্য শিক্ষক ছিলেন প্রফেসর হাই, মানুষ হিসেবেও ছিলেন সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তিনি ছিলেন বিভাগীয় চেয়ারম্যান। তাঁর স্বার্থান্বেষী সহকর্মীরা কিছু টাকাপয়সা-সংক্রান্ত মিথ্যা অপবাদ রটান তাঁর সম্পর্কে। তা তাঁর কানে যাওয়ায় তিনি খুবই বিব্রত ও মর্মাহত হন। সম্ভবত দুশ্চিন্তা নিয়ে অন্যমনস্কভাবে রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। ট্রেনের ধাক্কায় ১৯৬৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু ছিল বাংলা বিভাগের জন্য শুধু নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি।

চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে কাজী আবুল হোসেন ছিলেন একজন জনপ্রিয় উপন্যাস লেখক। বহু উপন্যাস তিনি লিখেছেন, যা অনেকেই বলবেন ‘সস্তা, কিন্তু সেকালে ছিল বহুপঠিত। তাঁর উপন্যাসগুলোর বেশির ভাগই বেরিয়েছিল ইসলামিয়া লাইব্রেরি থেকে। তিনি বসতেনও সেখানে। আমি আব্বার সঙ্গে গিয়ে সেখানে তাঁকে দেখেছি। তিনি যে কোনো প্রভাবশালী লেখক নন, সে বোধ তাঁর ছিল এবং ছিলেন অমায়িক ও সজ্জন। ইস্ট বেঙ্গল প্রকাশ করেছিল কাজী আবুল হোসেনের উপন্যাস বনজ্যোৎস্না, চমৎকার লেখা, নামটিও তেমন সুন্দর। তার সতীনের ঘর কিনেছিলাম ইসলামিয়া লাইব্রেরি থেকে।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী নামের একজন কবি ও কথাশিল্পী ছিলেন। তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প ও কবিতার সংকলন ছিল। বাণ নামে তার একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছিল ইস্ট বেঙ্গল। তার আরেকটি উপন্যাস প্রেম পরিণয়। ইস্ট বেঙ্গলই বের করেছিল শাহেদ আলীর ছোটগল্পের সংকলন কৃষ্ণপক্ষ, যদিও তিনি বিখ্যাত তার জিব্রাইলের ডানার জন্য। জিব্রাইলের ডানা পড়ে সত্যজিৎ রায় প্রশংসা করেছিলেন এবং এই গল্পের অবলম্বনে ছবি করা যায়, সে মন্তব্যও নাকি করেছিলেন। শাহেদ আলীর আরেকটি গল্প সংকলন একই সমতলে। শাহেদ আলী ইসলামপন্থী ছিলেন, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে কোনো রকম গোঁড়ামি ছিল না, সংস্কারও নয়। তাঁর সম্পাদনায় ইসলামিক একাডেমি (বর্তমানে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন) থেকে প্রকাশিত হতো শিশু-কিশোর মাসিক পত্রিকা সবুজ পাতা ষাটের দশকে এবং স্বাধীনতার পরেও। সেটি ছিল একটি পরিচ্ছন্ন চমৎকার সাময়িকী। সবুজ পাতা তৈরি করেছে বহু লেখককে। সেটি যে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পত্রিকা, তা মনে হতো না। সত্তরের দশক পর্যন্ত সবকিছুতেই উন্নতমানকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। বই ও পত্রপত্রিকায় ছাপার ভুল সেকালে খুব কমই হতো।

চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মুসলমানদের অনেকেই গল্প, উপন্যাস ও নাটক রচনায় মনোযোগ দেন। চট্টগ্রামের মাহবুব-উল আলম নজরুলের সঙ্গে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তাঁর মোমেনের জবানবন্দী একটি আত্মজৈবনিক রচনা। বইটি একসময় খুবই পরিচিত ছিল এবং পঠিত হতো। আমি আমার কৈশোরে বইটি পড়েছি এবং কিছুকাল আগেও পড়ে দেখেছি, সাহিত্যকর্ম হিসেবে তার মূল্য রয়েছে। ছোটগল্পও তিনি লিখেছেন। তবে উপন্যাস বা উপন্যাসধর্মী ‘মফিজন’ প্রশংসিত হয়েছিল।

চিন্তাশীল লেখক হিসেবেই আবুল ফজলের খ্যাতি। ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের তিনি একজন। তবে তিনিও অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর উপন্যাস চৌচির ও জীবন পথের যাত্রী বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের সমস্যা নিয়ে রচিত। আবুল ফজল ছিলেন আমার খুবই শ্রদ্ধাভাজন। তিনি আমাকে বলেছেন, মধ্য পঞ্চাশে প্রকাশিত রাঙা প্রভাত উপন্যাসটি তাঁর সেরা রচনা। তিনি সমাজসচেতন ও বক্তব্যপ্রধান লেখক, ভাষার দিকে মনোযোগ দেননি। তাঁর চিন্তাশীল প্রবন্ধগুলো গুরুত্বপূর্ণ, গল্প-উপন্যাস পাঠকপ্রিয় হয়নি।

নানা কারণে অনেকেই হারিয়ে যান, যদিও একসময় তারা খ্যাতি অর্জন করেন। ছোটবেলায় কাজী দীন মোহাম্মদ নামের একজন লেখককে জানতাম। তাঁর বাড়ি ছিল গোপালগঞ্জে। তাঁর একটি বই গোলকচন্দ্রের আত্মকথা ছোটোবেলায়

আমাদের বাড়িতে দেখেছি। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তরকে অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। লেখার হাত ছিল, কিন্তু নিষ্ঠা নিয়ে বেশি দূর যাননি। তাঁর একটি ছোটগল্প ‘জাঁদরেল উকিলের জীবনালেখ্য’। শিল্পকর্ম হিসেবে বাংলা সাহিত্যের সেরা লেখকদের বহু গল্পের সঙ্গেই তুলনীয়। আমি গল্পটি থেকে সামান্য অংশ উদ্ধৃত করছি :

‘আমার এ পরম উপভোগ্য জীবনালেখ্য শঙ্কাহীন চিত্তে দর্শকের সম্মুখে হাজির করিতে আমি নিজে কেন প্রবৃত্ত হইলাম, প্রথমেই তাহার জবাবদিহি করা জরুরি মনে করিতেছি। …আমি রামা, শ্যামা বা করিম, রহিম নহি, আমি প্রভাময় রত্নবিশেষ, নিভৃত স্থানের কুসুম।

‘এ পোড়া দেশের সাহিত্যিকেরা ইদানীং প্রেমিক-প্রেমিকার ট্র্যাজেডি বা কমেডিপূর্ণ জীবনী লিখিয়াই তাহাদের কর্তব্য সমাধা করিতেছেন। সুতরাং আমার জীবনালেখ্য অঙ্কনে যে সাহিত্যিকেরা কেহ হাত বা মন দিবেন সে ভরসা কম। এই কারণেই এই বিংশ শতাব্দীর বাংলার সংস্কারপ্রয়াসী শ্ৰীমুকুন্দ দাস তাহার বাউল যাত্রার সুরে গাহিয়া বেড়াইতেন–

‘এ দেশের এডিটর খবর রাখে ক’জনার?
রামা আজ দিল্লী যাবেন, শ্যামা যাবেন কাছাড়,
স্টারে নাচবেন কুসুমসুন্দরী, বাহ্বা খবরের বাহার!

‘আমি উকিল। উকিলদের বৃত্তিটা সুযোগসন্ধানী। ইহারা যথাসময়ে যথারীতি “হয়”কে নয় এবং “নয়”কে “হয়” করাতে পারেন।

‘…আমি উকিল। আমি হিন্দু না মুসলমান, সে প্রশ্ন কেহ করিবেন না। কবি নজরুলের ভাষার অনুকরণে আপনাদিগকে ভাবিতে হইবে–

‘হিন্দু না মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল জাদরেল উকিল, সন্তান মোর মার।

‘ভূমিষ্ঠ হইবার পর মুহূর্তে বাবা আমাকের আঁতুড়ঘরে দেখিতে আসিয়া নাক সিটকাইয়াছিলেন। এ কথা পরে আমি মায়ের কাছে শুনিয়াছি। বাপের নাক সিটকানো আঁতুড়ঘরের আশীর্বাদ। সুতরাং আঁতুড়ঘর হইতে বাবা বাহির হইতে না হইতেই নাকি একজন ভ্রাম্যমাণ জ্যোতিষী আসিয়া হাজির হইলেন। উঠানে পা দিয়াই তিনি নাকি বকিতে আরম্ভ করিলেন, “এ বাড়িতে একটি পুত্রসন্তান জন্মেছে। বড়-কপালে। সিংহলগ্নে ভূমিষ্ঠ হয়েছে-লগ্নের দশম স্থানে তার পাঁচটি গ্রহের সমাবেশ হয়েছে। এ ছেলে একটা জাদরেল কিছু না হয়ে যায় না। ছয়টা গ্রহের সমাবেশ হলে তো গ্রহের ঠেলার চোটে একেবারে পাগল হয়ে যেত। পাঁচটা গ্রহ জীবন-ভর একে খুঁচিয়ে নিয়ে বেড়াবে, একেবারে কাজ পাগলা করে তুলবে।” জ্যোতিষীকে আমার বাবার মা দুইটি টাকা দিয়া বিদায় করিয়াছিলেন। জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস আছে দেখিয়া কেহ যেন মনে না করেন যে আমি হিন্দু। কারণ এমন শুভমুহূর্তে মুসলমানেরাও জ্যোতিষীর গণনার মর্যাদা রক্ষা করিয়া থাকেন।

‘বাবার নাক সিঁটকানো আমার বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দাঁতখিচুনিতে পরিবর্তিত হইল। আমার নিজের যখন দাঁত উঠে নাই সেই বয়স হইতে এক প্রকার দাঁতখিচুনি খাইতে শুরু করিয়াছি। এখন দাঁতখিচুনি প্রুফ হইয়া গিয়াছে। ওটা আর এখন গায়ে বিদ্ধ হয় না।

[জাঁদরেল উকিলের জীবনালেখ্য]

কাজী দীন মোহাম্মদ ছিলেন দুজন। আমি প্রথমে মনে করতাম তাঁরা একই ব্যক্তি। কিন্তু দুই কাজীর নামের বানানে সামান্য পার্থক্য ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রফেসর লিখতেন কাজী দীন মুহম্মদ। কথাশিল্পীর নামের বানান কাজী দীন মোহাম্মদ। ইনি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। সাহিত্যসমাজের বাইরে নিজের জগতে নিভৃতে থাকতেই পছন্দ করতেন। দু-একবার তাঁকে কবি জসীমউদ্‌দীনের বাসভবন কমলাপুরের ‘পলাশ বাড়ী’তে দেখেছি। তার লেখার হাত ছিল। কিন্তু বাঙালি মুসলমান অনেকের যা হয়, সাধনা অব্যাহত রাখতে পারেন না। তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন চল্লিশের দশক পর্যন্ত। তার আরেকটি বই, সম্ভবত কিশোর উপন্যাস কেনাই ডাকু।

শৈশব-কৈশোরে যাদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি, তাঁরা অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জসীমউদ্‌দীন নন; কিন্তু একটি শূন্যতা পূরণের কাজ তারা করেছেন। তাঁরা যে খুব বড় কিছু, সে রকম ধারণা তাঁরাও পোষণ করতেন না।

 ২০. সাহিত্যজগতের আদিখ্যেতা

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমদ ও আমি কলকাতায় বেড়াতে গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচিহ্নগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে। আমরা কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রায় সব বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা কিনতাম। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে দৈনিক পত্রিকা খুব সস্তা। একদিন সকালবেলা পত্রিকার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ভেতরের পাতায় পাত্রী-পাত্র চাই প্রভৃতি বিজ্ঞাপনের পাশে ছোট্ট একটি খবর দেখে চকিত হই। আমার পিতৃপ্রতিম কথাশিল্পী শওকত ওসমানের মৃত্যুসংবাদ। তাকে গুরুতর অসুস্থ দেখে গিয়েছিলাম। বাঁচার আশা ছিল না। ঢাকা থেকে পাঠানো আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদদাতার সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি ছিল এ রকম :

‘বাংলাদেশের কবি ও লেখক শওকত ওসমান গতকাল মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেছেন কারণ তাঁর বাবার মৃত্যুতেও তিনি শোক প্রকাশ করেছিলেন।’

আমি বুঝতে পারলাম আনন্দবাজার-এর প্রতিনিধি এতটুকু রিপোর্ট নিশ্চয়ই পাঠাননি, সম্ভবত দেরিতে গেছে বলে কাটছাঁট করে এইটুকু ছেপেছেন, পরদিন বিস্তারিত থাকবে। কলকাতার আরেকটি গৌণ কাগজেও শওকত ওসমানের মৃত্যুসংবাদ একটুখানি বেরিয়েছিল। পরদিন আগ্রহ নিয়ে সব পত্রিকা তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। শওকত ওসমানের নামগন্ধ নেই। ভাবলাম, রোববারের সাহিত্য সাময়িকী বিভাগে থাকবে তাঁর সম্পর্কে লেখা। না, কোথাও কিছু নেই। আনন্দবাজারসহ কয়েকটি বড় কাগজের সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিল। কেউ কেউ অনেক দিনের বন্ধু। কোথাও কোনো লেখা না থাকা সম্পর্কে একজনকে বললাম, তিনি বললেন, ‘হতে পারেন “শৈকত সাহেব” বাংলাদেশের কবি, এখানে তাঁর মৃত্যুসংবাদ দিয়ে কী হবে?

শওকত ওসমানের জন্ম হুগলী জেলার এক গ্রামে। উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। চল্লিশের দশকেই তিনি কলকাতায় লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে যুক্ত। অবিচল অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদবিরোধী। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় ছিলেন এবং লেখালেখি করেছেন। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের বিয়োগাত্ম ঘটনার পর ভারতে চলে যান এবং প্রায় এক দশক ভারতেই ছিলেন।

তাঁর মাতৃভূমি পশ্চিমবঙ্গে সত্তর ও আশির দশকে তাঁর অবস্থান সুখকর ছিল না। হুমায়ুন কবির ও আতোয়ার রহমান প্রতিষ্ঠিত চতুরঙ্গ পত্রিকার অফিসে থাকতেন এবং অতি কষ্টে জীবনযাপন করেছেন। স্টোভে কোনো রকমে নিজে রান্না করে খেতেন। তাঁর দিনলিপি লেখার অভ্যাস ছিল। সেই দিনগুলোর কথা তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন। মুখেও তিনি অনেক সময় আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। একদিন দেশ পত্রিকা অফিসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও পূর্ণেন্দু পত্রীর রুমে যান। তাঁরা তাঁকে চিনতেন। গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কেউ বসতে বললেন না। পূর্ণেন্দু পত্রী শুধু বললেন, ‘কেমন আছেন ওসমান সাহেব?’ সেই যে তিনি ওখান থেকে চলে আসেন, আর কোনো দিন ও-মুখো হননি।

শওকত ওসমানই একমাত্র বাঙালি মুসলমান লেখক, যার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব খ্যাতিমান লেখকের ব্যক্তিগতভাবে জানাশোনা ছিল। তাঁর মৃত্যুতে সেখানকার কেউ তাঁর সম্পর্কে কয়েক পঙক্তি লেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। শুধু তিনি নন, বাংলাদেশের কারও সম্পর্কেই নন।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন লেখক মারা গেছেন। তাঁদের সবারই কলকাতায় বা দিল্লিতে রাজনৈতিক বন্ধুবান্ধব ছিলেন। যেমন জীবদ্দশায় তেমনি মৃত্যুর পরে কেউ তাদের স্মরণ করে দুই লাইন লেখেননি।

রশীদ করীম কোনো সামান্য কথাশিল্পী নন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায়। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ। তাঁর শিক্ষাজীবনও কলকাতায় এবং লেখকজীবনের শুরুও কলকাতায়। ‘৪৭-এর বেশ পরে শওকত ওসমানের মতো তিনিও স্বদেশ ছেড়ে ঢাকায় আসেন। তাঁর উপন্যাস উত্তম পুরুষ, প্রসন্ন পাষাণ, আমার যত গ্লানি প্রভৃতি সুখপাঠ্য এবং আধুনিক ফিকশন। তাঁর বাড়িতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতি এসে খানাপিনা করেছেন এবং আড্ডা দিয়েছেন। একবার তেমন আয়োজনে শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমিও ছিলাম। রশীদ করীম ছিলেন সুশিক্ষিত ও সংস্কৃতিমান এবং মার্জিত স্বভাবের মানুষ। মতামত প্রকাশে স্পষ্টভাষী। কাউকে তোয়াজ করে কথা বলতেন না। সুনীলবাবুর সঙ্গে তার সাংস্কৃতিক বিষয়ে অনেক ব্যাপারে মতপার্থক্য ছিল। সে যা-ই হোক, পশ্চিমবঙ্গের পাঠকেরা যে রশীদ করীমকে চেনেন, সে ভরসা কম। কিন্তু সেখানকার লেখকদের তাঁর সম্পর্কে জানা উচিত, কারণ তিনি বাংলাদেশের একজন প্রধান ঔপন্যাসিক। তাঁর মৃত্যুসংবাদটাও ওখানে কোনো পত্রিকা ছাপেনি দুই লাইনে।

গত দুই দশকে বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে বিশিষ্ট যারা গত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কবি সুফিয়া কামাল, আহমদ শরীফ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, কবীর চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন প্রমুখ রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের কবি-সাহিত্যিক ও তাদের পত্রপত্রিকা তাদের স্মরণ করে ছোটখাটো প্রবন্ধ-নিবন্ধ বা স্মৃতিচারণামূলক রচনা লেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। শামসুর রাহমানের বহু গুণগ্রাহী কলকাতায় ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর কিঞ্চিৎ লিখেছিলেন দু-একজন, তবে তাঁর মতো কবির যা প্রাপ্য, তার পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগও নয়। তিরিশের কবিদের পরে শামসুর রাহমানের চেয়ে বড় কবি বাংলা ভাষায় আর কে আছেন, আমার জানা নেই।

বাংলাদেশের সাহিত্যসমাজ পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যসমাজকে সহোদর ও সহযোগী মনে করে। ওখানকার অত্যন্ত গৌণ কবি-সাহিত্যিকেরাও ঢাকায় এলে তাঁদের অতি সমাদর করা হয়। ইদানীং রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশেরও অনেকে কলকাতায় গেলে কল্কে পান। জীবদ্দশায় তা যে তারা পাচ্ছেন, তাতেই তারা খুবই প্রীত ও গর্বিত। তা-ও ভালো, কারণ মৃত্যুর পরে কেউ তাদের মনে করবে না।

বাংলাদেশের সাহিত্যসমাজ ও মিডিয়ার মাত্রাজ্ঞান নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন, তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের অতি গৌণ কেউ চোখটা বুজতে না বুজতেই বাংলাদেশে তাদের নিয়ে হাহাকার শুরু হয়। চব্বিশ ঘণ্টা না যেতেই অনেক কাগজ ফেঁদে বসে প্রকাণ্ড প্রবন্ধ। গত কয়েক মাসে এমন কেউ কেউ গত হয়েছেন, বাংলাদেশের পাঠকের কাছে তাঁদের অনেকের নামটাও পরিচিত নয়, কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে হপ্তা না পেরোতেই এমন সব সন্দর্ভ রচিত হয়েছে, যেন তাদের মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের এক স্তম্ভ ধসে পড়ল। এসব আদিখ্যেতায় সাহিত্যের কোনো উপকার হয় না। বরং ক্ষতিই হয় –দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি। মনে হয়, কলকাতার লেখকেরা বাংলাদেশে নিয়োগ দিয়েছেন তাঁদের অবৈতনিক পিআরও বা জনসংযোগ কর্মকর্তা।

বিরল ব্যতিক্রম বাদে, যে রাষ্ট্রের নাগরিকই হোক না কেন, কপটতা ও ছলছলামি বাংলাভাষীদের মধ্যে খুব বেশি। বাংলাদেশের বইয়ের বাজারটা ধরে রাখতে ভারতের অন্য কোনো ভাষার লেখকেরা নন, কলকাতার কিছু লেখক ঢাকায় এসে এখানকার বঙ্গসন্তানদের লেখালেখির খুব সতর্কভাবে উচ্চ প্রশংসামূলক কিছু কথাবার্তা বলেন। তাতে এখানকার সস্তা খ্যাতিলোভী অনেকের খুশির সীমা থাকে না। পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নানা রকম দোষ আছে, কিন্তু ফোপরদালালিতে বাংলাভাষীদের জুড়ি নেই। যে সম্পর্কে যার কোনো ধারণা নেই, সে সম্পর্কেও অযাচিতভাবে কথা বলা তার চাই।

হাজারো উদাহরণ দেওয়া যায়, সর্বশেষটি দিতে পারি। গত ১০ অক্টোবর কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের এক বইয়ের দোকানে ‘বাংলা সাহিত্য উৎসব’ নামক এক অনুষ্ঠান হয়েছে। প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানটি শুরু হয় এবং সেখানে কলকাতা ও বাংলাদেশের লেখকদের সঙ্গে বাংলাদেশের উপহাইকমিশনারও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে কলকাতার কথাশিল্পী সমরেশ মজুমদার তার বক্তৃতায় বলেন, বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষায় বেশ আঞ্চলিকতার ব্যবহার হয়। আরবি শব্দ প্রয়োগ করা হয়।

মজুমদার মহাশয়ের এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্যের অর্থ যেমন অস্পষ্ট নয়, তেমনি আমার কাছে তা বোধগম্যও হয়নি। তিনি বাংলা সাহিত্য বলেননি, বলেছেন ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’। বাংলা সাহিত্য বলতে তিনি সম্ভবত তাঁদের প্রদেশের লেখকদের সাহিত্যকেই বোঝান। সেই বাংলাদেশে সাহিত্যের ভাষায় ‘আঞ্চলিকতার ব্যবহার’ জিনিসটি কী? তাঁদের দেশের সাহিত্যে কি আন্তর্জাতিকতার ব্যবহার বেশ হয় নাকি?

তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য ও তাঁর ভাষা নিয়ে আরও কিছু মন্তব্য করেন, তাতে যে কারও মনে হতে পারে তিনি সুনীতি চাটুজ্জ্যের চেয়ে কম ভাষাতাত্ত্বিক নন। ওই অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “তিনি [মজুমদার] একপর্যায়ে “জামাই” শব্দটির ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশের লেখক-সাহিত্যিকদের খোঁচা দেন। তিনি বলেন, “জামাই” শব্দটি তো মেয়ের জামাই বলেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বুঝবেন। কিন্তু বাংলাদেশে জামাই মানে “বর”।

মজুমদার জামাই শব্দটি নিয়ে বাংলাদেশের লেখক-সাহিত্যিকদের ‘খোঁচা’ দিতে গিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন, দুই বাংলার ভাষায় ব্যবধান নিয়ে কী তত্ত্ব খাড়া করতে চেয়েছেন, তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের বা যেকোনো স্থানের বাংলা ভাষার কেউ যদি বলেন : ‘বিয়ের দিন জামাইয়ের সঙ্গে তার বন্ধুরাও খেতে বসেছিল।’ এই বাক্যে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের ভাষাগত পার্থক্যটা কী? খোঁচা যদি কেউ কাউকে দিতে চায় এবং সেই খোঁচায় আঘাত পেয়েও যদি কেউ দাঁত কেলিয়ে হাসতে চায়, তা তাদের ব্যাপার। ভাষা নামক বেচারার তাতে কিছুই যায়-আসে না।

আমরা বাংলাভাষীরা অসাম্প্রদায়িকতার ভাণ করে মানুষকে ধোকা দিয়ে খুবই মজা পাই। মজুমদারও মজা পান। ওই অনুষ্ঠানেই তিনি ‘মজা’ শব্দটি নিয়েও ভাষাতাত্ত্বিক পাণ্ডিত্যের প্রকাশ ঘটান। বাংলাদেশের কেউ যখন বলে, এই খাবারটি খুব মজা’, তখন পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা অবাক হয়ে ভাবে, লোকটা বলে কী, খাওয়ার জিনিস আবার মজা হয় কী করে, মজা মানে তো আনন্দ-ফুর্তি।

বাংলাদেশের লেখকেরা আরবি শব্দ খুব বেশি ব্যবহার করেন –এ এক অতি অসত্য কথা। বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে অনেক অমুসলমানের অনুমানপ্রসূত ধারণা যে তারা অবধারিতভাবে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করবেই। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের কোনো কোনো কবি-সাহিত্যিক তা করেছেন, কিন্তু দেশের মানুষ তা পছন্দ করেনি। বাংলাদেশের কোনো লেখকই খুঁজে খুঁজে আরবি শব্দ তাঁর লেখায় ব্যবহার করেন না। ধারণা করি, মজুমদার বাংলাদেশের কোনো লেখকের লেখাই, তিনি যাদের আতিথ্য গ্রহণ করেন, তাঁদের লেখাও পাঠ করেননি। পাঠ করলে দেখতে পেতেন, বাংলাদেশের লেখকদের ভাষা অন্য যেকোনো অঞ্চলের বাংলাভাষী লেখকদের চেয়ে শুধু সাবলীল নয়, প্রাঞ্জলও।

ঢাকায় যতই বেড়াতে বা জনসংযোগে আসুন, মজুমদার মহাশয়ের ধারণা নেই, কি বিষয়বস্তুর দিক থেকে, কি ভাবের দিক থেকে, কি রচনাশৈলীর দিক থেকে, বাংলাদেশের তরুণ লেখকদের কেউ কেউ যথেষ্ট ভালো লিখছেন। তাঁদের কোনো দিক থেকে আনুকূল্য নেই, প্রচার নেই, পৃষ্ঠপোষকতা নেই। তবে বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে একদিন তাঁদের কেউ নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠা পাবেন।

বাংলা বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা, ৯৯ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা এবং যে। এক শতাংশের মাতৃভাষা নয়, তারাও বাংলা বলতে পারেন। বাংলা ভারতের একটি প্রাদেশিক ভাষা। ভারতের প্রাদেশিক ভাষা তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম প্রভৃতি। কিন্তু ওইসব ভাষাভাষী মানুষ যতটা জাতীয়তাবাদী পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীরা তা নন। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা হিন্দিতে কথাবার্তা বলতে অস্বচ্ছন্দবোধ করে না। কিন্তু তামিলনাড়ু, কেরালা, অন্ধ, রাজস্থানে নিজেদের ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার হয় না। বাংলাদেশের লেখকদের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের উপদেশমূলক মন্তব্য প্রত্যাশিত নয়।

২১. বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা বাঙালির সাকিন

১৯৪৭ সালের বহু আগে থেকেই পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য পার্থক্য ছিল। সে পার্থক্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এমনকি ধর্মীয়। পূর্ব বাংলা মুসলমানপ্রধান ও কৃষিভিত্তিক, এখানকার বাঙালি সংস্কৃতিতে ইসলামি উপাদান বেশি। পশ্চিমবঙ্গ হিন্দুপ্রধান, সেখানকার সংস্কৃতিতে হিন্দুধর্মের উপাদান বেশি থাকাই স্বাভাবিক। পূর্ব বাংলার মানুষের কথাবার্তা, চালচলন ও মনমানসিকতা পশ্চিমবঙ্গীয়দের থেকে আলাদা। কোন দিকেরটা বেশি ভালো, তা নিয়ে তর্ক করা গ্রাম্যতা, যারটা তার কাছে ভালো।

পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালে কুমিল্লায় ঘণ্টাকয়েক অবস্থানকালে বলেছিলেন : ‘পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা নিষ্ঠাবান, দৃঢ়সঙ্কল্প, সরলচিত্ত। এরা বুদ্ধির অভিমানে বিদ্রূপের দ্বারা বড় কথাকে ছোট করে দেয় না।’ ঠাকুর ছিলেন বাঙালির মহত্তম সৃষ্টিশীল প্রতিভা। কথাবার্তা দায়িত্ব নিয়ে বলতেন। কলকাতা থেকে কুমিল্লায় এসে এখানকার মানুষকে ‘খুশি’ করতে পামপট্টি দিয়ে কথা বলার পাত্র তিনি ছিলেন না। ১৯৭২ থেকে পশ্চিমবঙ্গের কিছু লোক মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে অনবরতই বলেন ‘দুই বাংলা এক’– এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি নিম্নমাঝারিদের পক্ষে করা সম্ভব, রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষীর পক্ষে নয়। তিনি আরও পরিষ্কার করে বলেছেন, আমরা নিজেদের বাঙালি বলি কারণ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, অন্য কোনো কারণে নয়। অর্থাৎ তামিল, মারাঠি, পাঞ্জাবিদের মতো বাঙালিরা এথনিক বা নৃজনগোষ্ঠী নয়। বাঙালিরা একটি সংকর জাতি। একই রক্ত সবার মধ্যে প্রবাহিত নয়। তার সংমিশ্রণ ঘটেছে বহু জাতির রক্তের।

পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিক নবীনচন্দ্র সেন, গিরিশচন্দ্র সেন, দীনেশচন্দ্র সেন, গোবিন্দচন্দ্র দাস, কালীপ্রসন্ন ঘোষ প্রমুখ পশ্চিমবঙ্গের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রমানন্দ চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের থেকে যথাযথ মর্যাদা ও উপযুক্ত স্বীকৃতি পাননি। দীনেশচন্দ্র সেন বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আশাহত হয়েছিলেন এবং গোবিন্দ দাস রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে হতাশ হয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলেন। জোড়াসাঁকো থেকে ফিরে এসে গোবিন্দ দাস লিখেছিলেন, ‘কবিবর রবীন্দ্রনাথের… সহিত প্রায় ঘণ্টাখানেক কথোপকথন হইয়াছিল। তাহার আলাপে সন্তুষ্ট হইয়াছিলাম বটে কিন্তু একটু গর্বের গন্ধ পাইয়াছিলাম। গর্বটা বঙ্কিমবাবু বা রবিঠাকুর করলে মানায়, কিন্তু কলকাতার নিম্নমাঝারিরা করলে বিরক্তির উদ্রেক না করে পারে না।

পলাশীর যুদ্ধের পর ২০০ বছর বঙ্গের প্রাচীনতম নগরী ঢাকা ছিল অবহেলিত। ওই সময়কালেই কলকাতাকে ব্রিটিশ শাসকেরা গড়ে তোলে এশিয়ার একটি অতি আধুনিক মহানগরী হিসেবে। সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা চূড়া স্পর্শ করে। যেকোনো মহানগরীতেই স্থানীয়রা সুযোগ-সুবিধায় অগ্রাধিকার পায়, তাদের ভূমিকা পায় প্রাধান্য। দূরবর্তীরা বঞ্চিত হয় সুযোগ-সুবিধা থেকে। পূর্ব বাংলার মানুষের হয়েছিল সেই দশা। কলকাতার উঠতি বিত্তশালীদের সঙ্গে তাদের প্রতিযোগিতা দিয়ে পেরে ওঠা কঠিন ছিল। যদিও কলকাতা সমৃদ্ধি লাভ করে পূর্ব বাংলার কৃষকদের টাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলায় একটি নতুন আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে দেখা দেয় স্বশাসিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। পাকিস্তান আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বাত্মক। তাদের স্বশাসিত হওয়ার সেই স্পৃহাকে কেউ যদি ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলে গালমন্দ করে আনন্দ পান, তাহলে বলার কিছু থাকে না। প্রতিটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের পেছনেই একধরনের সাম্প্রদায়িকতা কাজ করে।

১৯৪৭-এ ঢাকা পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পেলে এখানে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে এবং নবজাগরণ ঘটে। কলেজ পর্যন্ত পড়া শিক্ষিত শ্রেণির সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। নতুন রাষ্ট্রে সরকারি চাকরিতে ঢোকার সুযোগ আসে। কৃষক শ্রেণি ও নিম্নমধ্যবিত্তদের ভেতর তৈরি হয় একটি মধ্য-শ্রেণি, যারা বই ও পত্রপত্রিকা পাঠ করত এবং সমাজ ও দেশ নিয়ে ভাবত। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে তাদের মধ্যে যেমন ছিল দেশাত্মবোধ তেমনি সুবিধাবাদিতা।

পূর্ব বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নতুন যাত্রা শুরু হয় অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়, অতীতের ধারাবাহিকতায়। ১৯৫০ থেকে ঢাকায় তথা পূর্ব বাংলায় শিল্প সাহিত্যের যে চর্চা শুরু হয়, তার সঙ্গে খানিকটা তুলনা করা চলে জার্মানিতে ৪৭ গোষ্ঠী’র শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে। যুদ্ধে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত জার্মানির তরুণ একদল লেখক সিদ্ধান্ত নিলেন অতীতের ধারাবাহিকতায়ই নতুন শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, তবে তার বিষয়বস্তু, ভাষা ও চেতনা হবে একেবারেই নতুন। ওই গোষ্ঠীর বিখ্যাত লেখকদের মধ্যে ছিলেন হাইনরিশ ব্যোয়েল, গুন্টার গ্রাস, সিগফ্রিড লেজ প্রমুখ।

১৯৪৭-এর পরে পূর্ব বাংলার শিল্প-সাহিত্যে তাঁদের মতোই ভূমিকা পালন করেন শিল্পী জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান, কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুদ্দীন আবুল কালামসহ বহু কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক। তাঁদের সবার সৃষ্টিশীলতার শক্তি সমান ছিল না। তবে বেদনাদায়ক হলো পূর্ব বাংলার বহু উচ্চশিক্ষিত ও সংস্কৃতিমান হিন্দু পরিবার ১৯৪৭-এর পর স্বদেশ ছেড়ে চিরদিনের জন্য ভারতে চলে যাওয়ায় পূর্ব বাংলার সমাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের হিন্দুবিদ্বেষী রাজনৈতিক আবহাওয়ায় হিন্দুরা নিরাপত্তার অভাব অনুভব করেছেন। তারা খুব সংগতভাবেই মনে করেছেন নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সমাজে তারা যথাযথ মর্যাদা পাবেন না, যদিও এই মাটিতেই তারা মুসলমানদের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করেছেন হাজার বছর।

পাকিস্তানি আমলেওকলকাতা থেকে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক পূর্ববাংলায় এসেছেন বিভিন্ন সভা-সম্মেলন উপলক্ষে অথবা ব্যক্তিগতভাবে বেড়াতে বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে। ১৯৫৭-র ফেব্রুয়ারিতে মওলানা ভাসানী আয়োজিত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে ভারত থেকে এসেছিলেন একদল খ্যাতিমান লেখক। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতা কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ও লেখক হুমায়ুন কবির, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী আবদুল অদুদ, প্রবোধকুমার সান্যাল, নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী প্রমুখ। দেবব্রত বিশ্বাসসহ অনেকেই অনেকবার ঢাকায় এসেছেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে।

পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্ক ভালো না থাকায় সেকালে দুই দেশের নাগরিক, বিশেষ করে কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের আসা-যাওয়া সহজ ছিল না। পূর্ব বাংলার প্রকাশিত বইপত্র কলকাতার ব্যবসায়িক কারণে আমদানিকারকেরা নিতে আগ্রহী ছিলেন না, কিন্তু কলকাতার প্রকাশিত বইপত্র প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ও চট্টগ্রামে আসত। সুতরাং, কলকাতায় কে কী লিখছেন, তা আমরা পড়তে পারতাম। কিন্তু পূর্ব বাংলার লেখালেখি সম্পর্কে সেখানকার বিদ্বানেরা থাকতেন অজ্ঞ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে দুই দেশের লেখকদের যাতায়াত ও যোগাযোগ বাড়ে। কিন্তু বেদনাদায়কভাবে লক্ষ করা গেল, ওপারের লেখকদের এ দেশের লেখকদের সম্পর্কে নির্ভুলভাবে জানার আগ্রহ কম। অনেকেই, বিশেষ করে যারা গৌণ, তাঁরা এখানকার সম্পর্কে আবোলতাবোল কথা বলেন। অনেকের নামটাও ঠিকমতো উচ্চারণ করেন না। বিখ্যাত কবি কায়কোবাদকে লিখতেন ‘কৈকোবাদ’, স্রেফ ইচ্ছাকৃত বিকৃতি। একটি অতি সোজা নাম শামসুর রাহমান, তাও ঠিকমতো বলেন না; একটু প্রবীণ গোছের যারা তারা কেউ বলেন ‘শাস’, কেউ ‘সামশুর’ কেউবা ‘রহোমান’। একই ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও যারা নামটাই শুদ্ধ উচ্চারণ করেন না, তাঁরা তাঁদের লেখা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করবেন, তা কী করে আশা করা যায়?

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যখন পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলা ছিল না, বহু বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক বাংলাদেশে আসেন। এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়, মনোজ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ অনেক প্রবীণ ও নবীন, খ্যাত ও অখ্যাত কবি-লেখক। কবি জসীমউদ্‌দীনের বাসভবন ‘পলাশবাড়ী’ তখন ভারতীয় লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সমাগমে প্রাণচঞ্চল। জসীমউদ্‌দীন আমাকে বললেন, মনোজ বসু ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ঢাকা শহরের দর্শনীয় জায়গা ঘুরিয়ে দেখাতে। কবির একটি নীল রঙের হিলম্যান বা সস্কোভিচ গাড়ি ছিল। মনোজ বসুকে আমি বলধা গার্ডেন, আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, ঢাকেশ্বরী মন্দির, কার্জন হল প্রভৃতি দেখাতে নিয়ে যাই। নজরুল, জসীমউদ্‌দীনের পুরোনো বন্ধু মনোজ বসুর সঙ্গে কথা বলে প্রীত হই। সরল-সোজা ধরনের মানুষ, মোড়লিপনার লেশমাত্র নেই। তাঁর ভুলি নাই, জলজঙ্গল, বন কেটে বসত, নিশি কুটুম্ব প্রভৃতি উপন্যাস; গল্পের বই বনমর্মর এবং ভ্রমণকাহিনি চীন দেখে এলাম প্রভৃতি ছাত্রজীবনে পড়ে আরাম পেয়েছি। মনোজ বসুর এক লেখায় পড়েছিলাম, ‘যশোরের রাজপুতুরের মতো কই মাছ’, সে কথাটি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতেই জসীমউদ্‌দীন তাঁর স্ত্রী বেগম মমতাজ জসীমউদ্‌দীনকে বললেন, ‘ও মনি, মনোজকে তো তাহলে যশোরের বড় কৈ খাওয়াতে হয়। শিগগির তুমি বাজারে পাঠাও। জসীমউদ্‌দীন তাঁর স্ত্রীকে আদর করে মনি ডাকতেন।

জসীমউদ্‌দীনের বাড়িতেই প্রথম দেখি প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক খুশবন্ত সিংকে। অনেক পরে আমি দিল্লিতে তাঁর সুজন সিং পার্কের ফ্ল্যাটেও গিয়েছি আমার ছেলে সৈয়দ নাসিফ মাকসুদ সম্পাদিত ইংরেজি ম্যাগাজিন Padma-র একটি কপি এবং গান্ধীবিষয়ক আমার একটি বই তাঁকে দিতে। আমার বিরল সৌভাগ্য হয়েছে বাহাত্তরে ঢাকায় সত্যজিৎ রায়ের একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার নেওয়ার। আর দুই কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ পেয়েছি। ঢাকা ও কলকাতায় মৃণাল সেনের ফ্ল্যাটে তার সঙ্গে দীর্ঘ কথা হয়েছে। কথা হয়েছে তিনজন বিদগ্ধ ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বুদ্ধিজীবী ভবতোষ দত্ত, অম্লান দত্ত ও অশোক মিত্রের সঙ্গে। ঢাকার এক মাঠের ঘাসে বসে তিন ঘণ্টা গল্পসল্প করার সুযোগ পাই বলতে গেলে অলৌকিকভাবে। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেনের সঙ্গে। তিনি আমাদের ঢাকারই মানুষ। যাদের নাম উল্লেখ করলাম, তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রেই যে সেরা, তাই নন, মানুষ হিসেবেও তাঁরা বড়। আদিখ্যেতা, ভণ্ডামি ও ফোপরদালালি তাঁদের চরিত্রে নেই। পূর্ব বাংলার মানুষ সম্পর্কে তাদের মধ্যে কোনো অশ্রদ্ধাবোধ লক্ষ করিনি।

অন্যদিকে কলকাতার অনেক লেখক এখানে এসে ঢাকা ক্লাব ও বনানী গুলশানের অনেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর বাড়ির আতিথ্য গ্রহণ করে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের চুটিয়ে প্রশংসা করেন, কিন্তু তাঁদের মনের ভাষা অন্য রকম। বাংলাদেশের শুধু মুসলমানদের নয়, এই ভূখণ্ডের হিন্দুদেরও চালচলন, ভাষার গ্রাম্যতা শুধু নয় তাদের দেশপ্রেম নিয়েও মশকরা ও কটাক্ষ করেন। সেখানকার একালের প্রবন্ধতে শুধু নয়, গল্প-উপন্যাসেও তা দেখা যায়। যেমন একজন লেখকের ভাষায় :

‘দেশ বিভাগের পর এ দেশে পূর্ববঙ্গের মানুষেরা চলে এসেছিলেন প্রাণ বাঁচাতে। জলস্রোতকেও হার মানানো সেই আসাটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মন থেকে মানতে পারেনি কোনোদিন। এই কিছুকাল আগেও এক জাতি-গোত্রের হলেও শুধু পূর্ববঙ্গীয় বলেই এপারের বাঙালি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে নারাজ ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষরা এই জনরাশিকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।…..

‘স্বাধীনতার পর ১৯৪৭-এ যারা এদেশে এসেছিলেন, সেই লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত তখন তাদের শিশুরা প্রতিনিয়ত শুনে এসেছে তাঁদের দেশ আছে ওপারে। সেই দেশে গোয়ালভরা গরু আর মাঠভরা ফসলের ছড়াছড়ি। সেই শিশু শুনেছে তার ঠাকুদা, ঠাকুর্মা যে ভাষায় কথা বলেন এখানকার মানুষ সেই ভাষায় কথা বলে না। সে দেখছে তার বাবা বাড়িতে যে ভাষায় কথা বলেন বাইরে তা না বলার চেষ্টা করেন। তার রক্তে বুড়িগঙ্গা, পদ্মার জল খলখল করে ঠাকুর্মার সূত্রে। এই ছেলেটি যখন ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, তখন তার একমাত্র লক্ষ্য নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। তার ঘঁটি সহপাঠীরা ব্যঙ্গ করে উচ্চারণের এবং সে মনে মনে ভাবে তার দেশ ছিল ওপার বাংলা।…..

‘দেশপ্রেম ইত্যাদি তার কাছে আশা করা যায় না। যে অর্থে মানুষ চাকরি বাঁচাবার জন্যে অফিসের প্রতি অনুগত সেই অর্থেই তার মানসিকতা এদেশের প্রতি কেন্দ্রীভূত। নিজের জায়গা বা বাড়ি মনে না করলে একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়ই। টানটা না থাকায়, মমতা না থাকায় ভালোবাসা জন্ম দিতে পারে না।…..

পরবাসীর কাছে স্বাদেশিকতাবোধ আশা করা যায় না।’

[সাকিন-নেই, সমরেশ মজুমদার]

সাতচল্লিশের পর পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দুরা ভারতে গেছে, কিন্তু সবাই কি ‘প্রাণ বাঁচাতে’ গেছে? না গেলে তাদের কি এ দেশে মেরে ফেলা হতো? এই লেখাটির রচনাকাল নব্বইয়ের দশকের শেষ বা এই শতাব্দীর শুরুর দিক। পূর্ব বাংলা থেকে যেসব হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে গেছে, তাদের দেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতাবোধ নেই, এই রায় দেওয়া তাদের প্রতি চরম অবিচার ও অসম্মান। তারা ভারত রাষ্ট্রটিকে ভালোবাসে না–তা ভাবাই যায় না। পার্টিশন ও উদ্বাস্তু নিয়ে বাংলা, হিন্দি, উর্দুতে বহু গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে। সাদাত হাসান মান্টো লিখেছেন, ওয়ালীউল্লাহও লিখেছেন; ঋত্বিক ঘটকসহ অনেকে করেছেন অবিনশ্বর ছবি, কিন্তু এই তত্ত্ব বা মারাত্মক মতবাদ কেউ প্রচার করেননি।

মজুমদার পড়াশোনা করে অথবা গবেষণা করে দেখেছেন বাংলাদেশের কবি ও কথাশিল্পীরা ‘বেশ আরবি শব্দ প্রয়োগ করেন’ তাঁদের লেখায়। একজন ভাষাবিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই জানেন ‘সাকিন’ শব্দটি এক শ এক ভাগ আরবি, এর মধ্যে অণু পরিমাণও সংস্কৃত নেই। অথচ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হয়েও তিনি তাঁর রচনার। নামকরণ করেছেন একটি নিখাদ আরবি শব্দ দিয়ে– ‘সাকিন নেই’।

বাংলা ভাষার এই লেখকের এ রচনাটি থেকেই আমরা জানতে পারলাম, একালের পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষের কাছে ‘ঢাকার ভাষা যতটা অপরিচিত, হিন্দি তার দশ শতাংশও নয়। বাঙালি ছেলেদের একাংশ [মেয়েদের নয়] হিন্দিতে কথা বলে গর্বিত হয়, যদিও তাতে আমিতাভ বচ্চনের ভঙ্গি মিশে থাকে। হতভাগ্য বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ তাদের প্রিয় বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাষায় কথা বলে না, বাংলায় কথা বলে তারা ‘গর্বিত’।

২২. শামসুর রাহমানের জন্মদিন সমাচার

বাঙালির মুখে উচ্চারিত কথা আর তার মনের ভেতরের অনুচ্চারিত কথা দুই রকম, বলতে গেলে একেবারেই বিপরীত। কারও আনন্দের সংবাদে তার অন্তরটায় তুষের আগুন জ্বলতে থাকে। সে আগুন কখনো চাপা থাকে, কখনো দপ করে জ্বলে ওঠে। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে হিংসার আগুন আরও বেশি।

৫০ বছর বয়সের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টির পরিমাণ বিপুল। যদি তিনি ৪৯ বছর বয়সে মারা যেতেন অথবা আদৌ নোবেল পুরস্কার না পেতেন, তা হলেও তিনি তার সময়ের বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখক ও কবি। যেকোনো মানুষের মতো রবীন্দ্রনাথও প্রশংসা, সম্মান ও স্বীকৃতি পছন্দ করতেন। শান্তিনিকেতনের তার অনুরাগী ও ভক্তরা তাঁর ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে সংবর্ধিত করার উদ্যোগ নেন। তাঁদের দেখাদেখি তার বিভিন্ন পেশার বন্ধুরাও তাঁকে সংবর্ধনা ও অভিনন্দন প্রদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ওই উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ মনে মনে খুশি হলেও তাঁর আশঙ্কা হয় সংবর্ধনা উপলক্ষে খরচ ইত্যাদির জন্য প্রয়োজন হবে টাকার এবং সে জন্য চাঁদা তোলা নিয়ে গোল বাধতে পারে। তার ওই আশঙ্কা একেবারেই অমূলক ছিল না।

যখন সংবর্ধনার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে যায়, তখন বিনয়বশত রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারকে লিখেছিলেন, এই সমস্ত বাহ্য আড়ম্বরের উদ্যোগ আয়োজনে আমি যে কিরূপ সংকোচ অনুভব করিতেছি তাহা অন্তর্যামীই জানেন।’ অন্তর্যামী সব মানুষের অন্তরের সব কথাই জানেন। কোন ব্যাপারে কে কতটা সংকোচ বোধ করেন আর কতটা সন্তুষ্ট, তা অন্তর্যামীর বিলকুল জানা। রবীন্দ্রনাথের সংকোচটা ছিল এই কারণে যে তিনি তাঁর স্বদেশবাসী ও স্বসম্প্রদায়কে অতি ভালোভাবে জানতেন। তাঁর ভাষায় ‘ঘটা করে তাঁর জন্মোৎসব’ করতে গেলে ব্যয় সংকুলানের জন্য ‘চাদার টাকা লইয়া মনোমালিন্য না হয়েই পারে না। যা হোক, শেষ পর্যন্ত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে কলকাতা টাউন হলে ‘পঞ্চাশোর্ধ পূর্তি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১২ সালের ২৮ জানুয়ারি। যদিও তাঁর জন্মদিনটি ছিল আরও কয়েক মাস আগে– ১৯১১ সালের ৬ মে।

রবীন্দ্রনাথের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সংবর্ধনার আয়োজনে বাঙালি কবিদের ভূমিকা ছিল না বললেই চলে। উদ্যোক্তাদের সবাই ছিলেন গদ্যলেখক, বিজ্ঞানী ও সামন্ত ভূস্বামী। যেমন প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিনয়কুমার সরকার, মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী এবং একমাত্র কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী। কবি-নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ ছিলেন রবীন্দ্রবিরোধীদের শিবিরে। রবীন্দ্রবিরোধীরা যে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান পণ্ড করার চেষ্টা করেছিলেন, সে কথা তাঁর জীবনীকার প্রশান্ত পাল লিখেছেন। রবীন্দ্র সংবর্ধনায় কলকাতার একশ্রেণির কবি-সাহিত্যিক সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তাতে রবীন্দ্রনাথ খুবই ব্যথিত হন।

আমাদের কালের বাংলা ভাষার প্রধান কবি যে শামসুর রাহমান, সে প্রশ্নে তাঁর সমসাময়িকদের অন্তর্দাহ থাকলেও কারোরই সন্দেহ ছিল না। তার একশ্রেণির গুণগ্রাহী (তাঁদের নাম আমি বলব না) তার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে সংবর্ধিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সে কথা শামসুর রাহমানকে বলায় তিনিও রবীন্দ্রনাথের মতো প্রীত হন বটে, তবে সংকোচও প্রকাশ করেন। সংকোচটা কৃত্রিমও ছিল না। রবীন্দ্রনাথের যে সমস্যা ছিল না, শামসুর রাহমানের সে সমস্যা ছিল। সমস্যাটি হলো তিনি জানতেন না যে তাঁর জন্মদিনটি কবে।

জন্মোৎসব করতে হলে ব্যক্তিটির জন্মের তারিখটি তো জানতে হবে। যদিও আজকাল অনেকেই কোনো একটা তারিখে জন্মদিন উদযাপন করতে সংকোচ বোধ করেন না। শামসুর রাহমানের এক অনুজপ্রতিম (তার নামও আমি বলব না) পরামর্শ দেন, তার আম্মা কোনো রকমে কাছাকাছি কিছু বলতে পারেন কি না। তার আম্মাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পরে জানান যে, কার্তিক মাসের প্রথম দিকের বুধবার বাচ্চুর জন্ম।

জন্মদিন যে উদ্যপান করার জিনিস, তা শামসুর রাহমানের পরিবারের কেউ জানতেনই না। তাঁর পরম সাদাসিধা স্নেহময়ী আম্মা তো ননই। একটি সূত্রে কার্তিক মাস ও বুধবার পাওয়া যাওয়ার পর তার এক/একাধিক প্রীতিভাজন বাংলাবাজার থেকে লোকনাথ পঞ্জিকা সংগ্রহ করেন। কথিত জ্যোতিষী একজনকে ডেকে আনা হয় দৈনিক বাংলায় শামসুর রাহমানের কামরায়। গুনেটুনে বের করা গেল যে শামসুর রাহমান মর্ত্যধামে চক্ষু মেলেন ১৯২৯ সালের ২৪ অক্টোবর। এটি জানার পর তিনি একটি বিবৃতিমূলক কবিতাই লেখেন : ‘উনিশ শো ঊনত্রিশ সালে চব্বিশ অক্টোবরে/ জন্মেছি ঢাকায় আমি ছায়াচ্ছন্ন গলির ভেতরে/ ভোরবেলা নিম্নমধ্যবিত্ত মাতামহের নিবাসে,’…

[বিচিত্রা, ঈদুল আজহা সংখ্যা, ১৯৮২]

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ অক্টোবরই যদি জন্মগ্রহণ করে থাকেন, তাহলে এবার এবং এর আগেও অনেক বছর যাবৎ তাঁর জন্মদিন ২৩ অক্টোবর উদ্যাপান হয় কীভাবে? অনেকের তিনটে জন্মদিনও থাকে, কিন্তু শামসুর রাহমানের মাত্র দুটি জন্মদিন হলো কেমন করে? অবশ্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহরও তিনটে জন্মদিন পাওয়া গেছে, যদিও তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৫ আগস্ট ১৯২২ সালে। সরকারি কাগজপত্রে তাঁর জন্মদিন ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২২। ওয়ালীউল্লাহর ৬০তম জন্মদিন ১৯৮২-তে বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ১০ সেপ্টেম্বরই উদ্যাপন করে।

এবার বাংলা একাডেমি শামসুর রাহমানের ৮৭তম জন্মদিন যথাযথ মর্যাদায় উদ্যাপন করেছে। তার সমসাময়িক কবি-লেখকেরাই ছিলেন বক্তা। আবেগের আতিশয্যে হোক অথবা স্মৃতিবিভ্রাটবশত হোক, ওই অনুষ্ঠানে তাঁর সমসাময়িক এক কবি-কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন : ‘শামসুর রাহমান যখন তরুণ ছিলেন তখনো তাঁর জন্মদিনে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আজও মনে পড়ে, মায়ের কোলে বসে জন্মদিনের খাবার খাচ্ছেন তিনি।’

[সমকাল, কালের কণ্ঠ, প্রথম আলো, ২৪ আগস্ট ২০১৫]

শামসুর রাহমানের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে যারা ঘনিষ্ঠ, তাঁরা জানেন ৫০ বছর বয়সের আগে তাঁর বাড়িতে এবং সারা পৃথিবীর কোথাও তাঁর জন্মদিন পালিত হয়নি। তার আম্মা ছিলেন খুবই পরহেজগার মহিলা। যা তিনি জানেন না, কস্মিনকালেও সে সম্পর্কে বানিয়ে বলতে জানতেন না। শামসুর রাহমান তাঁর প্রথম সন্তান। পুত্রের জন্মের সময়টি তার মনে ছিল, দিন-তারিখ ভুলে গিয়েছিলেন। যা হোক, তার ৫০তম জন্মদিন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চমৎকারভাবে অনুষ্ঠান করে উদ্যপান হয়। সেদিনের সংবর্ধনার অভিজ্ঞানপত্রে বলা হয়েছিল :

‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। আমাদের মধ্যে কবি তুমি নিঃসন্দেহে। দীর্ঘ তিরিশ বৎসরে তারুণ্য থেকে প্রৌঢ়ত্বে যেতে যেতে অনেকখানি পথ, অনেক বাঁক ও বন্ধুরতা পার হতে হয়েছে তোমাকে, কিন্তু কবিতার রাজতিলক তোমার ললাট থেকে কখনো মোছেনি। আমাদের ব্যক্তিক আনন্দ-সংকটে, জাতির গৌরবে কি দুর্দিনে আমাদের হাতে হাত রেখে চলেছে শামসুর রাহমানের কবিতা। আমাদের আনন্দ গর্ব ও ভালোবাসা তাকে নিয়ে।

‘পঞ্চাশ বৎসর বড়ো কম সময় হলো না, তিরিশ বৎসরের একতী কাব্যচর্চাও এদেশে দুর্লভ। সময় ও সাধনার সিদ্ধিতে যিনি জয়ী, কাল তাকে জয়মাল্য পরাবেই; আমরা যারা তোমার সহগামী, সতীর্থ ও অনুজ, এই উৎসবে শরিক হতে পেরে আমরা নিজভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞ।’

সংবর্ধনা সভায় শামসুর রাহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কথাশিল্পী রশীদ করীম তাঁর সংক্ষিপ্ত অভিভাষণে বলেছিলেন :

‘শামসুর রাহমানের কবিতা সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে তাঁর কবিতার প্রবল সমসাময়িকতার কথা, যে কারণে পাঠকের সঙ্গে অবিলম্বেই তার যোগাযোগ ঘটে যায়। এটাও তাঁর অসামান্য জনপ্রিয়তার একটি কারণ। গত তিরিশ বছর ধরে আমাদের এই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংকটাপন্ন ঘটনাবলীর কোনো অভাব দেখিনি আমরা। সেই সব মুহূর্তে শামসুর রাহমানের কবিতা প্রায় একজন অভিভাবকের মতোই আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের হৃদয়ে যে আবেগ ও উৎকণ্ঠা স্তব্ধ হয়ে ছিল, তাকে তিনি ভাষা ও প্রাণচাঞ্চল্য দিয়েছেন। জাতির চেতনা শামসুর রাহমানের কবিতার সঙ্গে মিশে গেছে। আবার শামসুর রাহমানের কবিতাও জাতির চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে।

‘… কবিতার যে রাজ্যে শামসুর রাহমানের অভিযান, সেই বহির্বিশ্বে তিনি প্রায় দিগ্বিজয়ী। কিন্তু বড় ইচ্ছে হয়, দৃশ্যময়তা, চিত্রময়তা ও গীতময়তার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটু নিবিড় চিন্ময়তা তিনি আমাদের মতো তাঁর অজস্র ভক্ত-পাঠক ও অনুরাগীদের উপহার দেন।’

২১২ সদস্যবিশিষ্ট সংবর্ধনা পরিষদে কবি, কথাশিল্পী, চিত্রশিল্পী, চিত্রপরিচালক, নাট্যশিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সুফিয়া কামাল, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হাসান হাফিজুর রহমান, বেলাল চৌধুরী, আখতারুজ্জমান ইলিয়াস, আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, শামসুজ্জামান খান, ইমদাদুল হক মিলন, হুমায়ুন আজাদ, সুভাষ দত্ত, ফজলে লোহানী, রামেন্দু মজুমদার, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমদ, কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুণ্ডু, রফিকুন নবী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী প্রমুখ। খাটাখাটনির জন্যও আমার না থেকে উপায় ছিল না।

শামসুর রাহমানের সমসাময়িক যারা সংবর্ধনায় যুক্ত হননি, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সৈয়দ আলী আহসান, আহসান হাবীব, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিসুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ।

সংবর্ধনা উপলক্ষে ব্যক্তিগতভাবে চাঁদাবাজি না করে প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সহায়তা নেওয়া হয়েছিল। টাকা দিয়েছিল অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ ও ফিলিপস লিমিটেড।

৫০তম জন্মদিন ঘটা করে এবং তাঁর অনুজপ্রতিমদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় অতি সুন্দরভাবে উদ্যাপান হলেও তাঁর ৬০তম জন্মদিন উদযাপন কিঞ্চিৎ বিপত্তি ঘটে। সমসাময়িক কেউ এগিয়ে এলেন না। তাঁর সমসাময়িক ও বন্ধুস্থানীয় কেউ এ কথাও আমাদের বলেন, শুধু কি একজনের জন্মদিনই পালন করবেন?

শামসুর রাহমানের ৬০তম জন্মদিন কিন্তু ২৪ অক্টোবর উদ্যপান হয়নি। একদিন পিছিয়ে আনা হয় –২৩ অক্টোবর। ৬০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও তাঁর সমসাময়িক এবং কথিত বন্ধু অনেকেই যোগ দেননি।

শামসুর রাহমান ছিলেন সৎ, সজ্জন ও নিরহংকার মানুষ। ধান্ধাবাজির লেশমাত্র তাঁর মধ্যে ছিল না। জন্মতারিখটি নিয়ে তাঁর মনে খুঁতখুঁত ছিল। এর মধ্যে কলকাতা থেকে তার এক গুণগ্রাহী বা ভক্ত ঢাকায় আসেন। পঞ্জিকা গ্রহ-নক্ষত্র প্রভৃতিতে তার ছিল কিছু জ্ঞান। তাঁর সামনে জন্মদিনের অনিশ্চয়তা নিয়ে কথা ওঠে। কলকাতায় গিয়ে তিনি পাজী-পঞ্জিকা ঘেঁটে এবং জ্যোতিষীদের সঙ্গে কথা বলে জানান, ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবরই পৃথিবীর আলো দেখে থাকবেন শামসুর রাহমান। এখানকার বাংলাবাজারের জ্যোতিষীরাও তাতে সমর্থন দেন। শামসুর রাহমানের জন্মদিন সমাচার সম্পর্কে লিখতে গেলে বসওয়েলের ড. জনসনের জীবনীর মতো একটি প্রকাণ্ড গবেষণাগ্রন্থ লিখতে হয়।

ভারতের রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেনের মতো শামসুর রাহমানও বলতেন, ‘আমাকে যখন চোখের সামনে জ্যান্ত দেখতে পাচ্ছেন, তাতে একদিন যে জন্মেছিলাম তাতে কি কোনো সন্দেহ আছে?

শুধু সমসাময়িক হলেই কারও ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় না। শামসুর রাহমানের যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁরা অনেকে এখনো বেঁচে আছেন। তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে যারা গবেষণা করবেন, তাদের উচিত তাদের থেকে কাগজপত্র সংগ্রহ করা। কোনোক্রমে যেন ভুল তথ্য প্রতিষ্ঠা না পায়। সব মানুষের মতো শামসুর রাহমান শুধু জন্মগ্রহণ করেননি, তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন আমাদের মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকার জন্য।

২৩. জীবনানন্দ ও শামসুদ্দীন আবুল কালাম

মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্প উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই বিকশিত হয় কলকাতায়। তার সিকি শতাব্দী পরে উনিশ শতকের ষাটের দশকে ঢাকায় খুব ছোট আকারে মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্প যাত্রা শুরু করে। ঢাকায় মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্পের পথিকৃৎদের মধ্যে ছিলেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার এবং কবি ও গদ্যলেখক হরিশ্চন্দ্র মিত্র। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত বাঙ্গালা যন্ত্র নামক ছাপাখানা থেকে বহু ছোট-বড় বই প্রকাশিত হয় ১৮৬০ থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। ওই সময়সীমায় আরও অনেক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকায়। কুড়ি শতকের শুরুতে ঢাকায় স্থাপিত হয় মনোমেশিন– সেকালের সবচেয়ে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র। একটি-একটি করে সিসার তৈরি হরফ সাজিয়ে কম্পোজ করার পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে টাইপ করলেই হয়ে যেত মেশিনেই কম্পোজ। তারপর তা সংশোধন করে প্রয়োজনমতো মেকআপ দিয়ে হতো বই ছাপা। ঢাকায় প্রথম যে ছাপাখানায় মনোমেশিন স্থাপিত হয়, তার নাম আলেকজান্ডার স্টিম মেশিন প্রেস। সেটি ছিল নবাবপুরে। ওই প্রেস থেকে ঢাকায় উন্নতমানের বই প্রকাশিত হয়েছে। উনিশ শতকের শেষ দশকেই গড়ে ওঠে বাংলাবাজারে বইপাড়া, যেমন কলকাতায় কলেজ স্ট্রিট ও কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের (বর্তমানে বিধান সরণি) বইয়ের জগৎ।

আমাদের কয়েকজন আত্মীয়ের ঢাকায় ছাপাখানা ও প্রকাশনার ব্যবসা ছিল পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর, তাঁতীবাজার, বাংলাবাজার, প্যারীদাস রোড, প্রসন্ন পোদ্দার লেন, পাতলা খান লেন প্রভৃতি এলাকায়। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে, ভাষা আন্দোলনের অল্পকাল পরে, পাটুয়াটুলী দ্য বেঙ্গল প্রিন্টিং ওয়ার্কস নামক এক বড় ছাপাখানায় প্রায়ই যেতাম আব্বার সঙ্গে। একদিন সেখানে দেখি, কয়েকজন ভদ্রলোক গল্পগুজব করছেন। ওই প্রেসে মুদ্রিত হয়েছে একটি বই। এর মধ্যে এক ঘি বিক্রেতা সেখানে গিয়ে হাঁক দেন। প্রেস মালিক তাকে ডাকেন এবং একটি পাত্রে সম্ভবত পাঁচ সের (কেজি) ঘি দিতে বলেন। মুদ্রক ও প্রকাশক ছিলেন একই ব্যক্তি। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল প্যারাডাইস লাইব্রেরি, যা ছিল বাংলাবাজারে। প্রকাশক যাকে ওই পাঁচ কেজি ঘি উপহার দিলেন, তাঁর নাম সরদার জয়েনউদ্দিন। উপলক্ষ নয়ান ঢুলী নামক একটি গল্পগ্রন্থের প্রকাশ। নয়ান ঢুলীর লেখক জয়েনউদ্দিন।

আজকাল স্রেফ আবর্জনা ধরনের বইয়েরও প্রকাশনা উৎসব হয়। খ্যাতিমান লেখকেরা ঘটা করে টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে মোড়ক উন্মোচন করেন। রঙিন কাগজের প্যাকেট খুলে বুকের কাছে বইটি ধরে ছবি তোলেন। তারপর একটি পঙক্তি না পড়েও হড়হড় করে বইটির লেখক ও বইটির প্রশংসা করেন। এ কাজটি আমাকেও মাঝে মাঝেই করতে হয়। বলতে হয় : এ বই আমাদের সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। মনে মনে বলা হয় : এই ঘোড়ার ডিম প্রকাশ কাগজ ও কালির স্রেফ অপচয়।

নয়ান ঢুলীর একটি কপি উপহার পেলেন আমার আব্বা। বইটি নাড়াচড়া করে দেখে আমার অভূতপূর্ব অনুভূতি হলো। সেই প্রথম আমি একটি সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মের ঘ্রাণ উপভোগ করি। সেই থেকেই নতুন বাঁধাই করা বইয়ের ঘ্রাণ নিতে আমার ভালো লাগে। কেমন এক মদির গন্ধ।

ওই প্যারাডাইস লাইব্রেরি থেকেই প্রকাশিত হয় শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্পগ্রন্থ পথ জানা নাই। তার আগেই প্রকাশিত হয়েছিল তার আরেকটি গল্পের বই শাহের বানু। পথ জানা নাই-এর কাগজ, বাঁধাই ও প্রচ্ছদপট ছিল নয়ান ঢুলীর চেয়ে উন্নত। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে আমার অল্প বয়সেই আমি পথ জানা নাই এবং নয়ান ঢুলী পড়ি।

শামসুদ্দীন আবুল কালাম প্রথম লিখতেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন নামে। আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সঙ্গে নাম মিলে যাওয়ায় বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে তিনি নাম পরিবর্তন করেন। শামসুদ্দীনকে আমি তখনো কাছ থেকে দেখিনি। পাটুয়াটুলীতে তিনি তাঁর প্রকাশকের অফিসে যেতেন এবং কখনো যেতেন। বাংলাবাজার প্যারাডাইস লাইব্রেরিতে, যে লাইব্রেরির ম্যানেজার ছিলেন আমাদের পরিবারের একজন। আমার সেই ভাইয়ের কাছেই তাঁর কথা শুনতাম। তাঁকে আমি কাছে দেখি কয়েক বছর পরে আজিমপুর কলোনিতে।

শামসুদ্দীনকে কাছ থেকে না দেখার আরেক কারণ, তিনি আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের কিছুদিন পরেই কোনো এক বৃত্তি নিয়ে অথবা চাকরি নিয়ে ইতালির রোমে যান। পরে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) এবং বিশ্বখাদ্য কার্যক্রমে ভালো পদে নিযুক্ত ছিলেন। বিদেশে চাকরি অনেকেই করেছেন, কিন্তু তাঁরা মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় দেশে আসতেন। শামসুদ্দীনের দেশে না আসার একটি কারণও ছিল। তাঁর স্ত্রী তাকে ছেড়ে অভিনেতা ও অসামান্য আবৃত্তিকার গোলাম মোস্তফাকে বিয়ে করেন। তখন মহিলা একটি কন্যাসন্তানের মা। দাম্পত্য জীবনের এই ট্র্যাজেডিতে শামসুদ্দীন প্রচণ্ড আঘাত পান। তাঁর বেদনার কথা তার বন্ধুবান্ধবেরা জানতেন।

শামসুদ্দীন আবুল কালামের প্রথম জীবন থেকে শেষ পর্যন্ত যিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তাঁর নাম আবদুল মতিন। তিনি আমারও অগ্রজপ্রতিম ছিলেন এবং আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। আবদুল মতিন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল। মতিন চৌধুরীর শ্যালক। ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় আবদুল মতিন বামপন্থী রাজনীতি এবং প্রগতি লেখক ও শিল্পসংঘের একজন সক্রিয় কর্মী। ছিলেন। তিনি ছিলেন ফজলুল হক হলের ছাত্র। ছোটগল্প, কবিতা লিখতেন এবং ঢাকা-কলকাতার ভালো ভালো পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। পাকিস্তান অবজারভারে কাজ করেছেন। ১৯৬০ সালে তিনি লন্ডনে যান এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ষাটের দশকে লন্ডনে পাকিস্তান অবজারভার-এর বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন।

অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ও সজ্জন ছিলেন আবদুল মতিন। তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও শামসুদ্দীন আবুল কালামের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ রেখেছেন। ১৯৭১-এর ১০ অক্টোবর প্যারিসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মারা গেলে আবদুল মতিনই প্রথম তাঁর মৃত্যুসংবাদ ঢাকা ও কলকাতায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। তিনি লন্ডন থেকে প্যারিসে গিয়ে আনমারি ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে দেখা করেন। তখন মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে। কলকাতায় শওকত ওসমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শওকত ওসমান তাঁর বন্ধু ওয়ালীউল্লাহর আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ শুনে প্রায় পাগলের মতো হয়ে যান। ১৬ ডিসেম্বরের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে তিনি আমাকে আবদুল মতিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে লেখার তাগিদ দেন।

আবদুল মতিন মাঝে মাঝে রোমে গিয়ে শামসুদ্দীনের সঙ্গে এবং প্যারিসে গিয়ে ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে দেখা করেছেন। শেষ জীবনে শামসুদ্দীনের সঙ্গে তাঁরই সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ ছিল। রোমে শামসুদ্দীন প্রায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন। লেখালেখিতেই বেশি সময় ব্যয় করতেন। ওয়ালীউল্লাহর মতো তাঁরও গল্প-উপন্যাসের বিষয়বস্তু ছিল বাংলার গ্রামের মানুষ, যে মানুষদের থেকে তিনি বহুদিন ছিলেন দূরে।

দু-এক বছর পর পর আবদুল মতিন ঢাকায় আসতেন। লন্ডনেও তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ঢাকায় আসতেন একুশের বইমেলার সময়। অনেকগুলো বইও তিনি লিখেছেন। ঢাকায় এলে তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটাতাম। আমার বাড়িতে হোক বা অন্য কোথাও হোক। রেস্তোরাঁয় তিনি আমাকে খাওয়াতেন। তাঁর কাছে শুনতাম শামসুদ্দীনের রোমের দিনযাপনের কথা। নিতান্ত নিঃসঙ্গ। এক অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকতেন। নিজেই রান্নাবান্না করে খেতেন। তাঁর শেষটি ছিল খুবই করুণ। একা ঘরে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ডাক্তারকে জরুরি ফোনে জানানোর সময় পাননি। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পরে সরকারি লোকজন ঘর থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে। কারও থেকে শুনে আমি তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রচার করি।

কাশবনে কন্যা এবং কাঞ্চনমালা উপন্যাস দুটির জন্যই শামসুদ্দীনের খ্যাতি। একসময় লালসালু, সূর্যদীঘল বাড়ি এবং কাশবনের কন্যার নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হতো। পূর্ব বাংলার গ্রামের দরিদ্র মুসলমানদের জীবনালেখ্য।

নদীমাতৃক পূর্ব বাংলার গ্রামীণ মানুষের জীবনসংগ্রামের কথা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির পরে আর যে দুটি উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে তার মধ্যে অমরেন্দ্র ঘোষের চর কাসেম এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমার অল্প বয়সে আমি চর কাসেম পড়েছি। অমরেন্দ্র ঘোষও ছিলেন নদীবহুল বরিশালের অধিবাসী। চল্লিশের দশকে বা পঞ্চাশে তিনি বাংলাদেশে খ্যাতিমান ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি কলকাতায় চলে যান। সেখানে গিয়ে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি ও মিলনে বিশ্বাস করতেন। কলকাতার মূলধারার হিন্দু কথাশিল্পীরা তাঁকে পছন্দ করতেন না। শুনেছি, তিনি কলকাতায় ছিলেন প্রায় পরবাসী।

অমরেন্দ্র ঘোষের পূর্ব বাংলা থেকে চলে যাওয়ায় পূর্ব বাংলার কথাসাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার আরেকটি উপন্যাসও প্রশংসিত হয়েছিল : পদ্মদীঘির বেদেনী। পঞ্চাশের শুরুতে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস দক্ষিণের বিল (দুই খণ্ড)। সাম্প্রদায়িকতা একটি বহুমাত্রিক বিষয়। তা যে শুধু অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যেই বিদ্বেষ ও দূরত্ব সৃষ্টি করে তা-ই নয়, স্বধর্মাবলম্বীর মধ্যেও বিভেদ তৈরি করতে পারে। অমরেন্দ্র ঘোষ ছিলেন একজন সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি –অনেকের মতো ছদ্মবেশী অসাম্প্রদায়িক নন। আমাদের এখানে অদ্বৈত মল্লবর্মণকে নিয়ে যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু অমরেন্দ্র ঘোষ হারিয়ে গেছেন। আশির দশকে আমি মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহাকে অনুরোধ করেছিলাম অমরেন্দ্র ঘোষের চর কাসেম পুনর্মুদ্রণের জন্য। তিনি আমাকে বলেছিলেন একটি দীর্ঘ ভূমিকা লিখে দিতে, কিন্তু নানা কারণে আর হয়ে ওঠেনি। চর কাসেম-এর কলকাতায় সংস্করণ হয়েছিল কিন্তু সমাদৃত হয়নি।

শিল্পকর্ম হিসেবে দুর্বল এবং ভাষা সুপাঠ্য না হলেও কাজী আফসারউদ্দিন। আহমদের চর ভাঙা চর উপন্যাসেও ঢাকা অঞ্চলের নদীতীরের মানুষের জীবনের কথা আছে। বই হিসেবে প্রকাশের আগেই মোহাম্মদীতে চর ভাঙা চর ধারাবাহিক বের হয়েছে। তখনই পড়তাম। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জে আমাদের এলাকার মানুষ। ঢাকায় থাকতেন পুরানা পল্টন নিজের বাড়িতে। আমরা নতুন লেখকেরা তাঁর বাড়িতে যেতাম। তাঁর স্ত্রী বেগম জেবু আহমদ শিশুদের জন্য লিখে নাম করেছিলেন। জেবু আহমদ ছিলেন বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন-এর সম্পাদক এবং পরে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী আলতাফ হোসেনের বোন।

জীবনানন্দ দাশ, অমরেন্দ্র ঘোষ, শামসুদ্দীন আবুল কালাম বরিশালের অধিবাসী। জীবনানন্দের সঙ্গে শামসুদ্দীনের ব্যক্তিগত পর্যায়ে খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। অমিশুক নির্জন স্বভাবের মানুষ হিসেবে সবাই জীবনানন্দকে জানে। শামসুদ্দীন ছাত্রজীবন থেকেই তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। জীবনানন্দ দ্বারা ছাত্রজীবনে তিনি প্রভাবিত হয়ে কিছুদিন পদ্যচর্চাও করেছেন।

১৯৫৪-র অক্টোবরে দুর্ঘটনায় যখন জীবনানন্দ মারা যান, তখন শামসুদ্দীন ঢাকায়। শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমানসহ ঢাকার তরুণ কবি সাহিত্যিকেরা একটি শোকসভার আয়োজন করেন। সেখানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন শামসুদ্দীন। তাতে তিনি বলেছিলেন :

‘বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় প্রথম জীবনানন্দের কবিতা পড়েছিলাম। তারপর কলকাতায় কবিতার পুরোনো সংখ্যাগুলো কেনার জন্য একদিন ‘কবিতা ভবনে’ যাই। তখন বুদ্ধদেব বাবুই প্রথম তার আশ্চর্য কবিত্বশক্তির কথা বারবার উল্লেখ করেছিলেন। স্কুলে পড়ি তখন, ম্যাট্রিক দেব। সেই কালে আমরা দুই বন্ধু তাঁর অনুসরণে কবিতা লেখার প্রয়াস করেছিলাম।’

জীবনানন্দের স্মৃতিচারণা করে শামসুদ্দীন সেদিন আরও বলেছিলেন :

‘তারপর তাঁকে প্রথম দেখি যখন আমরা আই. এ ক্লাসের ছাত্র। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন তিনি। শ্যাম রঙের স্বাস্থ্যবান মানুষ। চল্লিশোত্তর বয়স তখন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, পাম্প-সু। কাঁধে পাট করে রাখা একখানা চাদর, হাতে একটি কি দুটি বই। মুখ তাঁর সর্বদা ভারি, গম্ভীর, চোখে আশ্চর্য সারল্য এবং তীক্ষ্ণতা। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতেন। আমি আর আমার আর এক বন্ধু নির্মল চট্টোপাধ্যায় তাঁকে অবাক হয়ে দেখতাম। কখনো ক্লাসের অবকাশে মাঠের ধারে শুয়ে শুয়ে পড়তাম তার কবিতা। তখনও পর্যন্ত তাঁর শেষতম কাব্যগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি। কিছুদিন পরে “কবিতা ভবন” থেকে “এক পয়সায় একটি” কবিতা সিরিজে প্রকাশিত হলো তাঁর বনলতা সেন। আমাদের মধ্যে সেদিন রীতিমতো সাড়া পড়ে গিয়েছিল। নতুন বয়সের অনভিজ্ঞ মনের কাছে ধূসর পাণ্ডুলিপি যে সাড়া জাগাতে পারেনি, বনলতা সেন দ্বারা তা সম্ভব হয়েছিল। “বনলতা সেন” কবিতাটি আমরা যত্রতত্র মুখে মুখে আবৃত্তি করে বেড়াতাম। কলেজের এক অনুষ্ঠানেও আবৃত্তি করলাম একদিন।

একসময় জীবনানন্দের সঙ্গে শামসুদ্দীনের ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।

দুই

জীবনানন্দ দাশকে তাঁর প্রথম জীবনে খুব কাছে থেকে দেখেছেন এমন মানুষের সংখ্যা দুই বাংলাতেই কম। তাঁর জীবনের একটি বড় সময় কেটেছে তার জন্মস্থান বরিশালে। ব্রজমোহন কলেজে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। কলকাতার খ্যাতিমানদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে তার ছাত্ররা বরিশালে তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন বটে, তবে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ পাননি। সে জন্য দায়ী তাঁর লাজুক স্বভাব। লোকজনের সঙ্গে মেলামেশায় তাঁর আগ্রহের অভাব। অথচ তিনি কোনো অহংকারী মানুষ ছিলেন না। শামসুদ্দীন আবুল কালাম ছিলেন তাঁর সাক্ষাৎ ছাত্র। জীবনানন্দকে তিনি গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তিনি তাঁর সেই স্মৃতিচারণামূলক লেখায় বলেছিলেন :

‘একদিন বাড়িতে গেলাম তার। কলেজে তাঁর প্রখর গাম্ভীর্যের জন্য কাছে এগোতো না কেউ। সবারই ধারণা ছিল তিনি ভীষণ রাশভারী প্রকৃতির লোক। আমরাও অবকাশ পেতাম না কথা বলার। তাঁর বাড়ি একটা মেয়েস্কুলের কম্পাউন্ডের মধ্যে। খুব সম্ভবত সে ইস্কুলটা তাঁর পিতারই প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাংলো ধরনের বাড়ির উপরে শণের চাল। বেড়া আধেক ইট আর আধেক বাঁশের। কিন্তু ভিতরে সাহিত্য পাঠকের কাছে আশ্চর্য এক জগৎ। বই, বই আর বই। বাংলার, বাংলার বাইরের, অসংখ্য পত্রিকা। সবই সযত্নে গুছিয়ে রাখা দেখে মনে হয় বার বার পড়া। একধারে একটা ছোটো টেবিল। হয়তো তাঁর লেখার। অন্দরে ছিলেন তাঁর স্ত্রী এবং বালিকা কন্যা মঞ্জু দাশ। তাঁরাও কবিরই মতো স্বল্পভাষী– নির্জনতাপ্রিয়। সেইকালে, মঞ্জু দাশের বোধ হয় বয়স দশ কি বারো, বঙ্গশী পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো।’

জীবনানন্দের কাছে গিয়ে শামসুদ্দীন ও তাঁর বন্ধুদের তাঁর সম্পর্কে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। তিনি চুপচাপ থাকতে পছন্দ করলেও কথা বলার মানুষ পেলে গল্পসল্প করতেন। তাঁর মধ্যে শিশুসুলভ সারল্য ছিল। শামসুদ্দীনের ভাষায় :

‘সেদিন তার বাড়িতে না গেলে “জীবনানন্দবাবু অসামাজিক মানুষ” এই ধারণা করেই চিরদিন দূরে দূরে থেকে যেতাম। সে ধারণা অচিরেই ভেঙে গেলো। অমন রাশভারী চেহারার ভিতরে একটি সহজ সরল শিশুর মন খুঁজে পেয়ে আমরা চমৎকৃত হয়ে গেলাম।’

তিরিশের দশকে ছাত্রজীবন থেকেই শামসুদ্দীন কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ– ‘কতকী’ লিখতেন। তাঁর চলাফেরা ছিল বাম প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে। সমাজের নিচতলার মানুষের প্রতি ছিল তাঁর সহানুভূতি। জীবনানন্দের দ্বারা প্রথম দিকে অনেকটা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি জানান :

‘এই সময় কলেজে একদিন তার সঙ্গে কথা বলছি, এমন সময় প্রগতিশীল [এক] ছাত্র-কবি হঠাৎ কথার মাঝখানেই তাঁকে প্রশ্ন করলে : “আপনি জনগণের জন্য লেখেন না কেন?” তার সাহস দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

‘জীবনানন্দ বাবু এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কয়েকবার তার এবং আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আস্তে প্রশ্ন করলেন : “তুমি এই প্রগতিশীল সাহিত্য-আন্দোলনের মধ্যে আছো বুঝি?”

‘সে বললে : “হ্যাঁ। অবশ্যই। আমরা এই সমাজ-ব্যবস্থাকে বদলাতে চাই; কায়েম করতে চাই শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা। যেখানে কবি ও সাহিত্যিকেরাও আমাদের সঙ্গে আসবেন তাদের বুর্জোয়া, পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণি ত্যাগ করে– মার্কসবাদ যে নতুন পথ দেখিয়েছে–।”

‘কথার মাঝখানেই জীবনানন্দ বাবু হঠাৎ প্রশ্ন করলেন : “তুমি কার্ল মার্কস পড়েছো? ডস ক্যাপিটাল?”

‘ছাত্র “কবি”টি থতমত খেয়ে বললে : না।

‘জীবনানন্দ বাবু একটু কাল তার দিকে তাকিয়ে থেকে হাসি গোপনের বহু চেষ্টা করেও অকস্মাৎ উচ্চহাস্যে ফেটে পড়লেন। হঠাৎ সে হাসি। এমন আচম্বিতে [সে হাসি] বেরিয়ে আসা যে, অবাক হয়ে দেখতে হয় তাঁকে। সঙ্গে হাসা যায় না।

‘ছাত্রটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পালিয়ে বাঁচলো।’

নজরুল ইসলামের অট্টহাসি নিয়ে অজস্র লেখালেখি হয়েছে। মাইলখানেক দূর থেকে তা শোনা যেত। তাঁর হাসির কারণে পাড়া-প্রতিবেশীর ঘুম হারাম হয়েছে। অনেকে অভিযোগ করেছেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। নজরুলের হাসি ছিল প্রাণমাতানো এবং তাঁর শ্রোতাদের মতে উপভোগ্য। তাঁর সমসাময়িক আরও দুই কবিও ছিলেন অট্টহাসিতে অভ্যস্ত। তাঁরা হলেন জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসু। বসু ছিলেন ছোটোখাটো হালকা পাতলা মানুষ, নজরুলের মতো সিংহের শক্তি তাঁর ছিল না, কিন্তু তাঁর হাসিও আধা কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যেত। রিপন কলেজ বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আছেন কি না, তা তাঁর সহকর্মী ও ছাত্ররা জানতে পারতেন তার হাসির শব্দ থেকে। এ কথা জানান খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত।

জীবনানন্দের হাসির বৈশিষ্ট্য ছিল অন্য রকম। হঠাৎ হেসে উঠতেন খুব জোরে। কী কারণে হাসছেন, তা স্পষ্ট ছিল না। শামসুর রাহমান যখন তাঁর বাসায় তার সঙ্গে দেখা করতে যান কলকাতায় তখনো তিনি জীবনানন্দের হাসি শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন। সে গল্প শামসুর রাহমান বহুবার আমাদের বলেছেন। হঠাৎ কী কারণে হেসে উঠলেন, তা বোঝার আগেই হাসি মিলিয়ে গেল। শামসুর রাহমানের ভাষায়, দুনিয়ার কোনো কিছুর সঙ্গেই সে হাসির কোনো সম্পর্ক নাই। এবং সে হাসির স্থায়িত্বও খুব কম।

জীবনানন্দের হাসি উপভোগের অভিজ্ঞতা শামসুদ্দীনেরও ছিল। তাঁর ভাষায় :

‘জীবনানন্দ বাবুর এই হাসিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবেগকে চেপে রাখতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। ভালো লাগার আবেগকেও। অসংযত জীবনযাপন তো দূরের কথা– রচনাও ছিল সংযমী। হাসির আবেগকেও লুকিয়ে রাখতে চাইতেন তিনি। অনেক সময় দেখা গেছে, যে-হাসির প্রসঙ্গ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, সেইকালে অকস্মাৎ বাঁধভাঙার মতো করে বেরিয়ে পড়েছে তার হাসি। তবু এমন হাসতে তাকে তার বন্ধুবান্ধব ছাড়া কেউ কখনো দেখেনি।

প্রতিবেশী হিসেবে জীবনানন্দকে খুব কাছ থেকে দেখে তাঁর প্রকৃত স্বরূপটি ধরতে পেরেছিলেন শামসুদ্দীন। তিনি বলেছেন,

‘বন্ধু-সংখ্যা তাঁর প্রচুর নয়। অচিন্ত্য বাবু, প্রেমেন বাবু তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বুদ্ধদেব বাবুও শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে খুব।’ শামসুদ্দীন আরও জানান, যারা তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশেছেন তাঁরা তাঁর সত্যিকারের মনটিকে চিনেছেন। নয়তো বাইরে তিনি নির্জনতাপ্রয়াসী, আত্মকেন্দ্রিক, অর্থাৎ ভদ্রতাহীন ভাষায় “অসামাজিক” বলেই পরিচিত ছিলেন। বরিশালের মতো মফস্বল শহরে থেকেও তাঁর মনকে আমি কোনোদিন হাঁপিয়ে উঠতে দেখিনি। নিজের বাড়ি, তাঁর সামনের মাঠ এবং ইংরেজি সাহিত্যের অসংখ্য কাব্য ও কবিতার বই-ই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় সুহৃদ।’

সমবয়সী হলেও বিপুল খ্যাতিমান নজরুলকে জীবনানন্দ সমীহ করতেন। বাংলা কবিতায় তাঁর অতুলনীয় অবদান এবং জাতীয় জীবনে তার ভূমিকার প্রশংসা করতেন। তাঁদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মেলামেশার সুযোগ ঘটেনি। প্রথম দিকে জীবনানন্দ নজরুলের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। শোকসভায় শামসুদ্দীন বলেছিলেন :

‘কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছিল ঝরা পালক। সুন্দর সাবলীল ছন্দোবদ্ধ কবিতা। নজরুল ও সত্যেন দত্তের কথা মনে পড়িয়ে দেয় সে-সব কবিতা।’

স্মৃতি রোমন্থন করে শামসুদ্দীন তাঁর প্রবন্ধটিতে লিখেছিলেন : “বরিশাল থেকে। তিনি চলে গেলেন কলকাতায় দেশভাগের পরেই। বরিশালে আমরা তার অত্যন্ত কাছাকাছি এসেছিলাম। তিনি আমার বরিশালের বাসায় এসেছেন অনেকদিন। আমাদের ছোটো টিনের ঘরের দোতলায় তাঁকে সাহিত্যের আড্ডায়ও পেয়েছি। একদিন সেই আড্ডায় অচিন্ত্য কুমারকে দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন বলে মনে পড়ছে। মনে তাঁর কোনো ঘোরপ্যাঁচ বা সঙ্কীর্ণতা ছিল না– সহজ সরল, সাদাসিধে এবং নিরহঙ্কার ছিলেন তিনি। আরও ছিলেন বিনয়ী।

চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকটি ছিল রাজনৈতিকভাবে অস্থির। জীবিকা উপার্জনে হিমশিম খেয়েছেন জীবনানন্দ। বরিশাল থেকে গিয়ে কলকাতায় থাকতেন ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডে। দৈনিক স্বরাজ পত্রিকার রবিবারের সাময়িকীর সম্পাদনা করতেন কিছুদিন। তখনো শামসুদ্দীন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। জীবনানন্দ একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগও নিয়েছিলেন, সে তথ্য দিয়েছেন তিনি:

‘স্বরাজ বন্ধ হয়ে যাবার পরে একটা মাসিক পত্রিকা প্রকাশের সঙ্কল্প করেছিলেন তিনি, আমি ও নির্মল চট্টোপাধ্যায় মিলে। কিন্তু বিজ্ঞাপন সংগ্রহে তিনজনই অপটু ছিলাম বলে শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলালো না।’

শামসুদ্দীনের সহপাঠী বন্ধু ছিলেন নির্মল চট্টোপাধ্যায়, লেখালেখি করতেন, তবে বেশি দূর যেতে পারেননি কলকাতায় গিয়ে। কলকাতায় গিয়ে বড়িষা ও খড়গপুর কলেজে বছর দুই অল্প বেতনে জীবনানন্দ অধ্যাপনা করেন। কলকাতা থেকে শামসুদ্দীন চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত ছিল হিন্দু মুসলমানের মিলন। কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের নেতাদের নীতি ছিল বিপরীত। কলকাতায় একসঙ্গে হেঁটেছেন, গল্প করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘দেশভাগের অব্যবহিত পরেই কলকাতার অর্থনৈতিক জীবনে যে আলোড়ন এসে পড়েছিল, তাতে করে বেশি দিন আর সম্পর্ক রাখা চললো না। ঢাকায় আসার পর আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি। গত বছর (১৯৫৩) কালকাতায় বন্ধু নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছিলাম তিনি কোথায় হাওড়া গার্লস কলেজ] অধ্যাপনার কাজ নিয়েছেন। প্রশ্ন করে জেনেছিলাম, আমার খোঁজখবরও তিনি নিতেন নির্মলের কাছ থেকে।’

শোকসভায় শামসুদ্দীন বলেছিলেন : ‘তাঁর খ্যাতি সাহিত্যমহলের চৌকাঠ পেরিয়ে সাধারণ্যে পৌঁছায়নি। কারণ তিনি ছিলেন স্বল্পবাক, চলতেন ভিড় এড়িয়ে, লিখতেন না ঘন ঘন, সভায় হতেন না সভাপতি, না করতেন বক্তৃতা। সবচেয়ে বড় কথা, না ছিলেন তথাকথিতভাবে “ফ্যাসিবাদবিরোধী” বা “প্রগতিশীল”। …কিন্তু তার জন্য, তাঁকে আমি জানতাম বলেই বলতে পারি খেদ করতে দেখিনি কোনোদিন। বরঞ্চ যাদের কাছে তিনি শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন, তাঁরা মুষ্টিমেয় হলেও, তাদের নিয়েই তিনি খুশি থেকেছেন। তিনি নিজেই বলতেন : খ্রিষ্টান পাদরীরা যেমন জনতার হাজার হাজার বর্গমাইলের দিকে তাকিয়ে বাইবেল বিতরণ করেন, শ্ৰেষ্ঠকাব্য সে রকমভাবে বিতরিত হবার জিনিস নয়।

‘কথাটি অবশ্য তাঁর নিজের কবিতা সম্বন্ধে তিনি বলেননি।’

জীবনানন্দ দাশ ‘বামপন্থী’ বা প্রগতিবাদী কবি ছিলেন না বটে কিন্তু যাঁরা নিজেদের ওই পন্থী বলে ঘোষণা করতেন বা দাবি করতেন তাঁরা কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল না পড়লেও তিনি পড়ছিলেন বলে শামসুদ্দীন জানতেন।

পঞ্চাশের দশকে শামসুদ্দীন আবুল কালাম পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডিপিআর বা জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক ছিলেন। থাকতেন আজিমপুর কলোনির ফ্ল্যাটে। আমরা থাকতাম কলোনির পাশেই শেখ সাহেব বাজারে। তিনি সুদর্শন ছিলেন। মুখে চমৎকার দাড়ি ছিল। ফ্যাশনের দাড়ি, ধর্মীয় দাড়িনয়। সাহিত্যচর্চাছাড়া চলচ্চিত্রে তার আগ্রহ ছিল। ইতালি গিয়েও তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর একটি প্রজেক্টরও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেছেন। লন্ডনে আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্যারিসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। শামসুদ্দীন ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী। কলকাতা থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর জানাশোনা ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। তাঁর যে সিনেমার ব্যাপারে উৎসাহ রয়েছে, তা শেখ মুজিব জানতেন। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডন যান, তখন শামসুদ্দীন রোম থেকে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আপনি দেশে চলে আসেন। আপনাকে চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের পরিচালক নিয়োগ দেব।’

প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে শামসুদ্দীন ঢাকায় এসেছিলেন। প্রায় এক মাস ছিলেন। লেখকসমাজ থেকে কোনো অভ্যর্থনা পাননি। লেখক-শিল্পীদের মধ্যে প্রভাবশালী যারা তারা যার যার মতো সরকারের আনুকূল্য পেতে ব্যস্ত ছিলেন। বেইলি রোডের গণভবনে এবং ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে কয়েক দিন শামসুদ্দীন গিয়েছিলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাকে কেউ দেখা করার ব্যবস্থা করে দেননি। ঢাকায় কয়েক দিন ঘোরাফেরা করে হতাশ হয়ে রোমে ফিরে যান। সেখানে গিয়ে বাংলাতেই উপন্যাস লিখেছেন কিন্তু দেশের সঙ্গে স্থায়ী দূরত্ব রচিত হয়েছিল শামসুদ্দীন আবুল কালামের।

২৪. পঞ্চাশের নতুন নক্ষত্রমণ্ডলী

তিরিশ ও চল্লিশের দশকের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পঞ্চাশের দশকের পূর্ব বাংলার আধুনিক বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিল্পকলার সৌধ। ওই দুই দশকে যারা শিল্প-সাহিত্যের জগতে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁদের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, মূলধারার বাংলার শিল্প-সাহিত্যের পাশে তাঁদের কাজ দুর্বল ও ম্লান মনে হতে পারে, কিন্তু যে মানেরই হোক, তাঁদের কাজের ঐতিহাসিক মূল্য অবহেলা করার নয়। তাঁদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। কলকাতার লেখক-পাঠকের কাছে তাদের কদর ছিল না। পূর্ব বাংলার নতুন প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের নব্য আধুনিকদের কাছেও তারা গণ্য হয়েছেন প্রাচীনপন্থী হিসেবে। পঞ্চাশের আধুনিকেরা তিরিশ ও চল্লিশের লেখকদের চেয়ে খুব যে বেশি ভালো লিখেছেন, তা নয়। তবে পঞ্চাশে কয়েকজন শক্তিশালী আধুনিক লেখকের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের মধ্যে শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মূলধারার সঙ্গে সংযুক্ত থেকেই পূর্ব বাংলার শিল্প সাহিত্য নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। নতুন রাষ্ট্রে শিল্পী-সাহিত্যিকেরা নতুনভাবে আত্মপ্রকাশে প্রয়াসী হন। তাতে দুটি ধারাই ছিল : একটি পাকিস্তানবাদী বা মুসলিম জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িক ধারা, অন্যটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা। প্রথম কয়েক বছর পাকিস্তানবাদীদের আধিপত্য ছিল খুব বেশি। তাঁদের চিন্তাধারা ছিল প্রাচীনপন্থী বা মধ্যপ্রাচ্যপন্থী। অধিকাংশ তরুণ লেখক তাঁদের নীতি আদর্শের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেননি। তাঁদের আগ্রহ ছিল আধুনিকতার প্রতি। বিষয়বস্তুর জন্য তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের দিকে না তাকিয়ে নিজের দেশের মাটি ও মানুষের সুখ-দুঃখের কথাই বিবেচনায় আনেন। তবে তাঁদের রচনা দুর্বলতা মুক্ত নয়, বিশেষ করে ভাষা ও রচনাশৈলীর বিচারে।

চল্লিশের শেষ এবং পঞ্চাশের অনেকগুলো বছর পাকিস্তানবাদীরা পাকিস্তানের পাকভূমি এবং ইসলামের ইতিহাসের গৌরবগাথা রচনায় সমস্ত শক্তি ক্ষয় করেন। তাঁদের অনেকের রচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে আজান, নামাজ, ঈদ, শবে বরাত, হজ, জাকাত প্রভৃতি এবং মুসলিম ইতিহাসের খ্যাতিমান পুরুষদের জীবনকাহিনি প্রাধান্য পায়। অবশ্য পাকিস্তানবাদীদের অনেকের বেশ কিছু মননশীল প্রাবন্ধিক রচনা রয়েছে, সেগুলো খুবই সাবলীল গদ্যে রচিত ও বস্তুনিষ্ঠ; কিন্তু পাকিস্তানবাদীদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার অভাব ছিল প্রকট। পাকিস্তানবাদী কবি ও কথাশিল্পীদের রচনায় কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের কথাও অনুপস্থিত। তা ছাড়া বিষয়বস্তু যা-ই হোক, তাদের ভাষা ও রচনাশৈল্পীও সেকেলে এবং শিল্পকর্ম হিসেবে তা মূল্যহীন। পঞ্চাশে অনেক ইসলামী পন্থী কবি ফররুখ আহমদের মতো জোর করে বা অকারণে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। তা করে তারা মুসলমান। পাঠকদের মন জয় করতে চেয়েছেন বটে, কিন্তু তার পরিবর্তে তাঁরা পাঠকের বিরক্তি সৃষ্টি করেছেন। পঞ্চাশের নতুন পাঠকশ্রেণিরও আগ্রহ ছিল আধুনিক রচনার প্রতি– প্রাচীনপন্থী আবর্জনা নয়।

উপযুক্ত আরবি-ফারসি শব্দে অমুসলমান পাঠকেরও আপত্তি ছিল না, কিন্তু অপ্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দে রচিত সাহিত্যে মুসলমান পাঠকেরও অরুচি ছিল। বিষয় হিসেবেও নতুন পাঠকদের মধ্যপ্রাচ্য ও ইসলাম নিয়ে আগ্রহ ছিল না। তারা চেয়েছেন সাহিত্যে তাঁদের জীবনের প্রতিফলন ঘটুক, তাঁদের স্বপ্ন ও বাস্তব নিয়ে সাহিত্য রচিত হোক।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিকেরা নতুন রাষ্ট্রে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করার প্রত্যয় নিয়ে লেখালেখি করতে থাকলেও তাঁরা কী রকম একটি ধারা। সৃষ্টি করবেন, সে সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলাম ও মুসলমানত্ব প্রাধান্য পাবে– সে রকম একটি অঘোষিত বা ঘোষিত নীতি তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু অবিলম্বে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠায় লেখকদের একটি বড় অংশ মুসলিম জাতীয়তার পরিবর্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। তারা উপলব্ধি করেন, বাংলা বিসর্জন দিয়ে উর্দুর আধিপত্য স্বীকার করার জন্য তারা পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন দেননি। আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত নতুন প্রজন্মের লেখকেরা রক্ষণশীলতার পরিবর্তে আধুনিকতাবাদের দিকেই ঝুঁকে থাকেন। এসব আধুনিকতাবাদী লেখক-কবিদের কেউই মোটেও পাকিস্তানবিরোধী। ছিলেন না। তারা পাকিস্তানও চেয়েছেন, প্রগতিশীলতাও চেয়েছেন। তাঁরা অপছন্দ করেছেন পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকচক্রের স্বৈরাচারী মনোবৃত্তিকে।

১৯৪৮-এর শেষ দিকে প্রকাশিত হয় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু, শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্পের বই পথ জানা নাই ১৯৪৮-এ এবং অনেক দিনের আশা ১৯৪৯-এ। আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্পগ্রন্থ জেগে আছি এবং ধানকন্যা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের বছরখানেক আগে প্রকাশিত হয়। এসব গল্প উপন্যাসে পাকিস্তানি ভাবধারার কোনো চিহ্ন ছিল না। যে কবির কথা এখন সবাই ভুলে গেছে, সেকালে যথেষ্ট নাম ছিল, আবদুর রশীদ খানের নক্ষত্র মানুষ মন কাব্যগ্রন্থ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অল্প আগে এবং তাঁর বন্দি মুহূর্ত বায়ান্নর শেষ দিকে প্রকাশিত হয়। এসব কবি-কথাশিল্পী পাকিস্তানের অনুগত নাগরিক ছিলেন, তারা মুসলমানিত্ব ও বাঙালিত্ব দুই পরিচয়ই ধারণ করতেন, কিন্তু আধুনিক হওয়ার চেষ্টাও করেছেন। তাঁরা ছিলেন তিরিশের আধুনিক কবিদের দ্বারা প্রভাবিত। তাঁদের উত্তরসূরি।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পূর্ব বাংলার কবি-লেখকদের এক নবজীবন দান করে, কিন্তু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এই ভূখণ্ডের কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের দান করে এক নবতর জীবনদর্শন। তাঁদের আর আত্মপরিচয়ে কোনো সংকট বা বিভ্রান্তি রইল না। তারা বাঙালি। ধর্মীয় পরিচয়ে কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ প্রভৃতি।

একুশের ভাষা আন্দোলনের অল্প পরে আমি আমার বাবার সঙ্গে ঢাকায় আসি। তিনি শহীদ রফিকের ওপর দীর্ঘ ১৪ পৃষ্ঠার মতো একটি শোকগাথা লেখেন, সেটা ছাপাতে এসেছিলেন আমাদের এক আত্মীয়ের প্রেসে। সম্ভবত কয়েক মাস ঢাকা শহরে একটি শোকের থমথম পরিবেশ ছিল। ১৯৫৩-র মার্চে আবার ঢাকায় আসি। সেই সময় জিন্দাবাহার লেনের কোনো এক বাঁধাইখানা থেকে আব্বা একটি বই সগ্রহ করেন। বইটি তিনি কাপড় দিয়ে জড়িয়ে আলমারিতে রেখে দিয়েছিলেন। কখনো পড়ার প্রয়োজন হলে তিনি পড়তেন, তারপর ওইভাবেই কাপড়ে মুড়ে কাপড়চোপড়ের নিচে আলমারিতে রেখে দিতেন। বইটি কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। তার নাম একুশে ফেব্রুয়ারি। বিভিন্ন কবি-লেখকের লেখার একটি সংকলন, সম্পাদনা করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। পুঁথিপত্র প্রকাশনীর পক্ষে প্রকাশক ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান।

মোহাম্মদ সুলতান ও হাসান হাফিজুর রহমানের প্রকাশিত ও সম্পাদিত সেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে একটি বই বললে সম্পূর্ণ বলা হয় না। ওই বই থেকে পূর্ব বাংলার আধুনিক সাহিত্যের নবযাত্রার শুরু। ওই সংকলনের যারা লেখক ছিলেন, পরবর্তী দশকে তারাই আমাদের আধুনিক লেখক এবং প্রধান লেখক। কারা ছিলেন তার লেখক? কবিদের মধ্যে ছিলেন শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আনিস চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, জামালুদ্দিন ও আতাউর রহমান। গল্প ছিল পাঁচটি। লেখক শওকত ওসমান (মৌন নয়), সাইয়িদ আতীকুল্লাহ (হাসি), আনিসুজ্জামান (দৃষ্টি), সিরাজুল ইসলাম (পলিমাটি) ও আতোয়ার রহমান (অগ্নিবাক)।

একুশের গান ছিল দুটি। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ এবং তোফাজ্জল হোসেনের একটি গান। তাঁর গানের প্রথম কয়েকটি চরণ এ রকম :

রক্ত শপথে আমরা আজিকে তোমারে স্মরণ করি
একুশে ফেব্রুয়ারি,
দৃঢ় দুই হাতে রক্ত পতাকা উর্ধ্বে তুলিয়া ধরি
একুশে ফেব্রুয়ারি
তোমারে স্মরণ করি।
তুমি হয়ে আছ আমাদের মাঝে চিরজ্যোতি অম্লান
তোমার বক্ষে কত না শহীদ রক্তে করিল স্নান,
কত বীর ভাই সেদিন জীবন করে গেল বলিদান
সেদিন প্রথম ভীরু কুয়াশার জাল গেল দূরে সরি।

ওই বইয়ের গেটআপ বা অঙ্গসজ্জা, মেকআপ আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। ওই সময়ে তার চেয়ে ভালো করার উপায় ছিল না। ক্রাউন আকারের ১৮০ পৃষ্ঠার বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন আমিনুল ইসলাম এবং অঙ্গসজ্জার রেখাঙ্কন করেছিলেন মুর্তজা বশীর। সঙ্গে আরও কোনো কোনো নতুন শিল্পী ছিলেন। বইটি ছাপা হয়েছিল পাইওনিয়ার প্রেস থেকে, যার স্বত্বাধিকারী ছিলেন এম এ মকিত। ব্লক বানিয়ে দিয়েছিল বাদামতলীর নামকরা এইচম্যান কোম্পানি। এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম উল্লেখ করার কারণ, তারা জাতির জীবনে একটি ঐতিহসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন।

একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনের একটি ২২ পৃষ্ঠার ভূমিকা লিখেছিলেন আলী আশরাফ : একুশে ফেব্রুয়ারিবিষয়ক প্রথম নির্মোহ ও নিরপেক্ষ দলিল। একুশের ইতিহাসের ঘটনাপঞ্জি লিখেছিলেন অর্থনীতির ছাত্র চট্টগ্রামের অধিবাসী কবির উদ্দিন আহমদ। পরবর্তীকালে একুশের ভাষা আন্দোলন নিয়ে লাখো পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে, কিন্তু এই বইয়ের এই দুটি রচনার সঙ্গে ওই লাখো পৃষ্ঠার তুলনা চলে না। ওই সংকলনের লেখকদের অধিকাংশই আজ বেঁচে নেই। এখনো আমাদের মধ্যে আছেন আনিসুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী ও চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। মুর্তজা বশীর শুধু চিত্রাঙ্কন করেননি, একটি বেওয়ারিশ ডায়েরির কয়েকটি পাতা’ শীর্ষক তাঁর একটি রচনাও ছিল। আর একটি একুশের নকশা ছিল সালেহ আহমেদের, শিরোনাম ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত সাক্ষর। ওই সংকলনের সকল প্রয়াত ও জীবিত লেখককে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

আলী আশরাফ ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’ শীর্ষক তাঁর প্রবন্ধে লিখেছিলেন :

‘…লীগ নেতারা ঘোষণা করলেন “উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা”। স্বৈরাচারী লীগ শাসন পাকিস্তানের অন্যান্য ভাষাভাষী জনগণের ভাষাগুলোকে উপেক্ষা করে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রে বিশেষ মর্যাদা দিতে চাইলেন।

‘এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেই অতীতের সেই ভাষার লড়াই আবার জেগে উঠল নতুনভাবে নতুন শক্তিতে। সে লড়াই একটা বিশেষ গৌরবময় রূপ ধারণ করেছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু বিভাগোত্তরকালের ইতিহাসই নয়, এ পবিত্র দিনটি আমাদের দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পুরো ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।’

১৯৫৩-তে এই অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণীটি প্রকাশ করা ছিল ঘোরতর রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। সেই ঝুঁকি নিয়েই তারা সেদিন তা করেছিলেন। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং বাজেয়াপ্ত করে তার সমস্ত কপি। আমার আব্বা মোহাম্মদ সুলতানের সহায়তায় একটি কপি জোগাড় করেছিলেন।

একুশে ফেব্রুয়ারির মূল কপিটি আমার কাছে ছাড়া আজ আর কোথাও কারও কাছে নেই। গত ৬০ বছরে আমাদের হাজারখানেকের বেশি বই খোয়া গেছে। ওই বইটিকে আমি যক্ষের ধনের মতো আজও আগলে রেখেছি একটি পবিত্র স্মৃতি হিসেবে। আশির দশকে বাংলা একাডেমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারি বইটির একটি কপি কারও কাছে আছে কি না তা জানতে। তারা একটি ফ্যাক্সিমিলি প্রকাশ করার পরিকল্পনা নেন। কোথাও পাওয়া যায়নি। আমার কপিটি থেকেই ফটোকপি করে নেওয়া হয়েছিল।

২৫. আলাউদ্দিন আল আজাদ

সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা শিল্প-সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। কবি, কথাশিল্পী, মননশীল লেখক ও শিল্পীদের সমসাময়িক রাজনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনুপ্রাণিত এবং প্রভাবিত করবেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শিল্প-সাহিত্য আর আগের মতো রইল না। মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পূর্ব বাংলার মুসলমান লেখকদের রচনার বিষয়বস্তুতে নতুন উপাদান যোগ হয় : ইসলাম ও মুসলমান। বিশেষ করে যারা পাকিস্তানবাদী ছিলেন, তাঁদের রচনায়। কিন্তু পাকিস্তানের অনুগত নাগরিক হয়েও নতুন প্রজন্মের অনেকেই পাকিস্তানবাদী ছিলেন না। তাঁরা কেউ ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, কেউ ছিলেন বামপন্থী ধারায় জীবনের জন্য শিল্প’ নীতিতে।

পাকিস্তান ও ভারতের রাজনৈতিক আদর্শ ছিল ভিন্ন; কিন্তু দুই নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের একটি ক্ষেত্রে অভিন্নতা ছিল, তা হলো, দুই রাষ্ট্রই কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের এক নম্বর শত্রু ঘোষণা করে। স্বাধীনতার অল্পকাল পরই ভারত সরকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করে। বহু কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীকে জেলে ঢোকানো হয়। অনেকে আত্মগোপনে চলে যান। কেউবা পূর্ব পাকিস্তানে, কেউবা পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান। পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলেও ব্যাপক হারে কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করে। ১৯৪৭-পরবর্তী কয়েকটি বছর পাকিস্তান ও ভারতে কমিউনিস্টদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। দুই দেশের কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বা অন্যভাবে বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।

নতুন প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে তরুণ লেখকদের মধ্যে আলাউদ্দিন আল আজাদ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তখন তিনি কলেজের ছাত্র। লেখালেখি করে কিছুটা পরিচিতিও পেয়েছেন। ‘৪৭-এর পর কলকাতা থেকে ঢাকায় পালিয়ে এসেছিলেন চল্লিশের দশকের কবি ও কথাশিল্পী গোলাম কুদ্দুস। তিনি ছিলেন শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহদের বন্ধু। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। চুয়াডাঙ্গার অধিবাসী, কিন্তু ‘৪৭-এর পর ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে কলকাতায় থেকে যান। আশির দশকে আমি কলকাতায় তাঁর আহিরিপুকুর লেনের বাসায় তাঁর একটি সাক্ষাঙ্কার গ্রহণ করি। তিনি বলেন, ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি ঢাকায় এসে আত্মগোপন করে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেন। ঢাকার বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা নেপাল নাগ তাকে ওয়ারী এলাকায় এক হিন্দুর পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। নাম পরিবর্তন করে থাকলেও গোয়েন্দা পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেটা টের পেয়ে গোলাম কুদ্দুস পুরানা পল্টনে এক পরিচিত লোকের বাড়িতে এসে ওঠেন। সারা দিন তিনি ঘরে থাকতেন, রাতে বেরিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতেন।

১৯৪৮ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কিছুদিন পুরানা পল্টনে এক বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। রেডিও পাকিস্তান ঢাকার সহকারী বার্তা সম্পাদক ছিলেন। তাঁর এক অবাঙালি বাবুর্চি ছিল। তাকে নিয়ে একদিন ঠাঠারিবাজারে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক বাড়ির জানালায় গোলাম কুদ্দুসকে দেখতে পান। তখন দাঁড়িয়ে কোনো কথা না বলে, না দেখার ভান করে তিনি বাজার করে আসেন। বাসায় এসে ওয়ালীউল্লাহ তাঁর কাজের লোকটির হাতে একটি চিরকুট দিয়ে গোলাম কুদুসের কাছে পাঠান। চিরকুটে লেখা ছিল :

‘আপনি আমার চাকরের সঙ্গে এক্ষুনি আমার বাসায় চলে আসতে পারেন। খুব নিরাপদ আস্তানা। যতদিন খুশি থাকতে পারেন। আমি অবিবাহিত।’

অনিশ্চিত পরনির্ভর জীবনে বন্ধুর এই আহ্বান বিধাতার আশীর্বাদের মতো। মুহূর্ত দেরি না করে গোলাম কুদ্দুস ওয়ালীউল্লাহর বাসায় চলে আসেন। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর ওয়ালীউল্লাহর বন্ধুবান্ধবরা আসতেন। আড্ডা চলত অনেক রাত অবধি। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেই ছিলেন তার বন্ধু। একদিন আসেন পুলিশের একজন ডিআইজি। পেশাগত দক্ষতা থেকে তিনি বুঝতে পারেন গোলাম কুদ্দুস একজন আত্মগোপনকারী বাম নেতা। তাঁর সম্পর্কে তিনি ওয়ালীউল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন। তাঁদের কথাবার্তা কানে যেতেই গোলাম কুদ্দুস পরদিনই অন্য জায়গায় চলে যান।

গোলাম কুদ্দুস এ সম্পর্কে আমাকে যা জানান, তা এ রকম : ‘পুরান ঢাকায় কারও বাড়িতে এক রাত রইলাম। তার পরদিন পার্টির এক কর্মী আমাকে নিয়ে যায় ঢাকার পাশেই মালিবাগ নামক এক শহরতলির গ্রামে। সেই মালিবাগ গ্রামে গাছপালা-জঙ্গল ছিল প্রচুর। সেখানে এক টিনের ঘরে থাকতেন এক তরুণ লেখক। নিজেই রান্না করে খেতেন এবং প্রচুর পড়াশোনা করতেন। আমি যাওয়ায় তিনি পেলেন একজন সঙ্গী। সেই তরুণের নাম আলাউদ্দিন আল আজাদ। কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় কর্মী।’

গোলাম কুদ্দুস জানান, মালিবাগ থেকে হেঁটে আজাদ শহরে ঢাকা কলেজে যেতেন। (বর্তমান ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস নয়) বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। বিভিন্ন মানুষ থেকে বই ধার নিয়ে আসতেন। বাংলা, ইংরেজি গল্প-কবিতার বই প্রচুর পড়তেন। মার্ক্সবাদী সাহিত্য নিয়ে আমার সঙ্গে তাঁর আলোচনা হতো।

আমি গোলাম কুদ্দুসকে বললাম, আপনি যে মালিবাগ গ্রামের কথা বলছেন এখন আর তা কোনো গ্রাম নয়, শহরতলিও নয়, অতি ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা মহানগরীর একটি এলাকা।

চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে গোলাম কুদুসের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল কবি ও কথাশিল্পী হিসেবে। বাম রাজনীতিতে বেশি জড়িয়ে পড়ায় তাঁর লেখালেখির ক্ষতি হয়। তাঁর দুটি কবিতার বই প্রশংসিত হয়েছিল। একটি বিদীর্ণ এবং অপরটি ইলা মিত্র। নাচোল আন্দোলনের ইলা মিত্রকে নিয়ে কবিতা লিখে ডান-বাম সব শ্রেণির পাঠকেরই প্রশংসা অর্জন করেন। তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে বন্দী, মরিয়াম, একি শূঙ্গে প্রভৃতি রয়েছে। ঢাকায় থাকলে এবং সাহিত্যচর্চা ভালোভাবে চালিয়ে গেলে গোলাম কুদ্দুস বাংলা সাহিত্যে একটি স্থান করতে পারতেন বলে মনে করতেন তাঁর বন্ধু শওকত ওসমান ও কবি আবুল হোসেন। গোলাম কুদ্দুস জানান, আলাউদ্দিন আল আজাদের কিছু ছোটোগল্প কলকাতার লেখকসমাজেও প্রশংসিত হয়েছিল। তাঁর গল্পের সংকলন জেগে আছির কলকাতার পত্রপত্রিকায় প্রশংসামূলক সমালোচনা বেরিয়েছিল। কিছুদিন পরে বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় তাঁর কবিতাও প্রকাশিত হয়। পঞ্চাশের শুরুতেই আজাদ একজন প্রতিষ্ঠিত কবি ও কথাশিল্পী।

আলাউদ্দিন আল আজাদ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। প্রস্তুতি নিয়েই তিনি সাহিত্যসাধনা করেছেন। প্রথম দিকে তিনি কবিতা ও গল্পই বেশি লিখতেন। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই প্রকাশিত হয় আজাদের দুটি ছোটগল্পের। বই : জেগে আছি এবং ধানকন্যা। এই দুই সংকলনের গল্পগুলো তাঁর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে রচিত। সুতরাং, অপরিণত হাতের ছাপ থাকাই স্বাভাবিক; কিন্তু শিল্পকর্ম হিসেবে অবহেলা করার মতোও নয়। তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স এবং ‘৫৪-তে মাস্টার্স করেন। তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং যথার্থ অর্থে একজন ভাষাসংগ্রামী।

একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তপাতের পর পরই ভাষাসংগ্রামীরা রাতারাতি একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। কিন্তু সরকার চায়নি কোনো স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করা হোক ঘটনাস্থলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা শহীদ মিনারটি ভেঙে দেন। প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা দেখে অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র আজাদ লিখেছিলেন। একটি প্রতিবাদী কবিতা :

স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ভয় কি বন্ধু,
আমরা এখনো চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো। যে ভিত কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরার মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটিকা ধূলায় চূর্ণ যে-পদপ্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক
ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
চার কোটি পরিবার।

[একুশে ফেব্রুয়ারি]

সংঘবদ্ধ সাহিত্যচর্চায় পঞ্চাশের প্রথম দিকে আজাদ খুবই সক্রিয় ছিলেন। সাহিত্যের সভা-সমাবেশের আয়োজন করতেন এবং সাহিত্য সম্মেলনগুলোতে অংশগ্রহণ করতেন। ওই সময়ে বাম ধারার লেখক হিসেবে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের প্রত্যাখ্যান করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করতে যাঁরা তখন ভূমিকা রাখেন, আজাদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। বিশেষ করে তাঁর পরিচিতি ছিল সমাজ সজ্ঞান লেখক হিসেবে। জেগে আছি এবং ধানকন্যার গল্পগুলোতে সমাজের হতদরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের চিত্রই তিনি এঁকেছেন। ‘কয়েকটি কমলা লেবু’, ‘কয়লা কুড়ানোর দল’, ‘রঙিলা’, ‘সুবসা’, ‘শিষ ফোঁটার গান’ প্রভৃতি গল্পে সর্বহারা মানুষের দুঃখ-বেদনার কথাই বলা হয়েছে। পাকিস্তানি জোশের জ্বরে আক্রান্ত সমাজে এই সমাজসচেতন ধারার রচনার মূল্য ছিল অসামান্য।

আজাদ ছিলেন বহুমুখী সৃষ্টিশীল প্রতিভা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ প্রভৃতি তিনি দুহাতে লিখবেন। তার প্রথম উপন্যাস তেইশ নম্বর তৈলচিত্র প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। পরবর্তী তিন বছরে প্রকাশিত হয় তাঁর তিনটি উপন্যাস : কর্ণফুলী, শীতের শেষ রাত বসন্তের প্রথম দিন এবং ক্ষুধা ও আশা। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও কবিতার বই বের হয় একটু দেরিতে। প্রথম কাব্য সংকলন মানচিত্র ১৯৬১-তে এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ ১৯৬২-তে। পঞ্চাশের দশকে এবং ষাটের শুরুতে প্রকাশিত তার দুটি নাটক– মরক্কোর জাদুকর এবং ইহুদির মেয়ে প্রশংসিত হয়েছিল। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ শিল্পীর সাধনা তাঁর মননশীলতার পরিচয় বহন করে। ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত রচিত আজাদের সাহিত্য সম্ভারের পরিমাণ প্রচুর।

শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ এবং তাদের বন্ধুরা পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের সাহিত্যের যে ভিত্তি স্থাপন করেন, তার ওপরই নির্মিত হয়েছে আধুনিক বাংলাদেশের সাহিত্যের সৌধ।

আশির দশকের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ কবি হতে গিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যজগতকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেন। এক দলকে তার পাশে নিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা দেন, অন্যদের করেন নানাভাবে অসম্মান। আজাদ শিক্ষা। মন্ত্রনালয়ে যুগ্মসচিব পদমর্যাদায় উপদেষ্টা বা এ ধরনের কোনো পদে ছিলেন। সুতারাং সরকারি পক্ষে তাঁর না থেকে উপায় ছিল না। তার ফলে তিনি তাঁর প্রথম দিকের বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাঁর সেই বন্ধুরাও ক্ষুদ্রতামুক্ত ছিলেন না।

 ২৬. পথ নির্মাণ করেছেন যারা

এক একজন লেখক কোন ভাষায় লিখলেন, কী লিখলেন, কেমন লিখলেন, সেটাই বিবেচ্য। তিনি কোন ধর্মমতাবলম্বী, তিনি আস্তিক না নাস্তিক, সেটা তাঁর সাহিত্য বিচারের সময় কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। লেখক কোন দেশের নাগরিক, জাতিসত্তার দিক থেকে তিনি কী– সেটাও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তিনি কোন ধর্মাবলম্বী তা বড় ব্যাপার নয়। কাহলিল বা খলিল জিব্রান মূলত আরবি ভাষার প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও মরমি কবি। শেষ জীবনে তিনি ইংরেজিতেও লিখেছেন। তাঁর পরিচিতি তিনি আরবি সাহিত্যের লেখক। জাতীয়তার প্রশ্ন যদি আসে, তিনি একজন লেবানিজ। নাগরিকত্বের দিক থেকে দেখলে তিনি একজন আমেরিকান। তাঁর অশ্রু ও মৃদুহাসি আরবি ভাষায় রচিত, তা পরে আ টিয়ার অ্যান্ড আ স্মাইল নামে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। মূলত ইংরেজিতে রচিত তাঁর দ্য প্রফেট, দ্য ফোররানার, দ্য স্যান্ড অ্যান্ড ফোম প্রভৃতি। লেবাননের আরবি সাহিত্যের লেখক হিসেবেই তার পরিচিতি। আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন, বাস করতেন নিউইয়র্কে। ইংরেজি ভাষায় লিখলেও ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে কাহলিল জিব্রান উল্লিখিত হন না। তিনি মুসলমান না খ্রিষ্টান, সে প্রশ্ন কেউ তোলে না। একই কথা একালের ঔপন্যাসিক সালমান রুশদি সম্পর্কেও প্রযোজ্য। তিনি একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান লেখক। জন্ম তাঁর মুম্বাইতে হলেও পশ্চিমেই থাকেন এবং লেখেন সব সময়ই শুধু ইংরেজিতে, কোনো ভারতীয় ভাষায় নয়। তিনি মুসলমান পিতামাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন বলে তাঁর আসল নাম ‘আহমদ সালমান রুশদি’। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনি তাঁর ফতোয়া দিয়ে রুশদির মুসলমান পরিচয়কে বিশ্বব্যাপী বড় করে তোলেন। তা না হলে তিনি আধুনিক ইংরেজি ভাষার একজন লেখক হিসেবেই শুধু পরিচিতি পেতেন। প্রেম চাঁদ উর্দু ও হিন্দি ভাষার ভারতীয় কথাশিল্পী, তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী কি না তা কোনো বিবেচনার বিষয় নয়।

বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। এ ভাষার ইতিহাস লেখকেরা কোনো দিন লেখেন না মুকুন্দ রায়, ভারতচন্দ্র, ঈশ্বর গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র হিন্দু কবি কথাশিল্পী, এ কথাও কেউ কখনো লেখেন না যে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-ব্রাহ্ম কবি। কিন্তু যখন আলাওল, মীর মশাররফ বা নজরুল বা জসীমউদ্‌দীনের নাম আসে, তখন তাদের ধর্মীয় পরিচয়টি অবধারিতভাবে উল্লেখ করা হয়। অন্যান্য ইসলাম ধর্মাবলম্বী কবি-সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে তো বটেই। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার শিকড় বঙ্গীয় সমাজে অনেক গভীরে। গোবিন্দচন্দ্র দাস একেবারে নির্ভেজাল পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের কবি, তিনি পশ্চিমবঙ্গের কেউ নন, কিন্তু শুধু তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে পশ্চিমবঙ্গ তাঁকে স্বীকার করে। তিনি মুসলমান হলে তাঁকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ আলোচনা-গবেষণা করত না। এদিক থেকে পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশ অনেক বেশি উদার। এখানকার সাহিত্যসমাজ বাংলা ভাষার যেকোনো কীর্তিমানকে নিজের বলে মনে করে। সে কারণেই শামসুর রাহমানের জন্মমৃত্যু বার্ষিকীতে কলকাতায় এক ছটাকও লেখালেখি হয় না, কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখকে নিয়ে এখানে নাচানাচির শেষ নেই।

ওখানকার একশ্রেণির কবি-সাহিত্যিক বাংলাদেশের বাজার ধরার জন্য বাংলাদেশকে চুটিয়ে প্রশংসা করেন, তবে তা করেন ঢাকায় এসে। দেশে ফিরে গিয়ে এখানকার প্রধান লেখকদের সম্পর্কেও দুই লাইন লেখেন না। আমাদের একশ্রেণির লেখক, সাংবাদিকের মধ্যেও একধরনের হীনম্মন্যতা ও দাস্যমনোবৃত্তি বাসা বেঁধেছে। তারা মনে করেন, কলকাতায় গিয়ে কল্কে পেলেই জীবন ধন্য। নির্ভেজাল জাতীয়তাবোধ বিকশিত হলে, স্বাজাত্যচেতনা অম্লান থাকলে এমনটি হতো না। জর্জ বার্নার্ড শ, জেমস জয়েস ইংরেজি সাহিত্যেরই দিকপাল, কিন্তু আইরিশরাই তাদের মনে করে নিজের মানুষ। জয়েসকে নিয়ে আইরিশদের যে অহংকার, ব্রিটিশদের ততটা নয়।

বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তা থাকায় আমাদেরও সে রকম হওয়ার কথা। নির্মলেন্দু গুণ আমাদেরই কবি, পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের কেউ নন। তা যে নন তা গুণের উপস্থিতিতে আমি নিজেই কলকাতায় একবার প্রমাণ পেয়ে এসেছি। কয়েক বছর আগে নির্মল এক লাখ টাকার পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠানটি ছিল চমৎকার, উপস্থিতিও ছিল ভালো। কিন্তু না পুরস্কারদাতারা শ্রোতারা কারোই গুণের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে বিশেষ ধারণা আছে বলে মনে হলো না। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বাংলাদেশের কেউ নন, সম্পূর্ণ পশ্চিমবঙ্গের বা ভারতীয় লেখক, যদিও তার রচনার সঙ্গে বাংলাদেশের পাঠকদের পরিচয় যথেষ্ট। লেখকের জাতীয়ত্ব ও নাগরিকত্বের পরিচয়টি বড়, তাঁর ধর্মবিশ্বাস নয়।

বাংলা সাহিত্যের মূলধারার হিন্দু লেখকেরা বাঙালি মুসলমান লেখকদের আলাদা সারিতে রাখার পক্ষপাতী, যেমন অনেক আগে একসময় ভোজসভায় হিন্দু-মুসলমান। উচ্চবর্ণের হিন্দু ও নিম্নবর্ণের হিন্দু আলাদা সারিতে বসতেন। এ ক্ষেত্রে নজরুলই প্রথম ব্যতিক্রম। কবিজীবনের শুরুতেই নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ এক অনুষ্ঠানে তার পাশে বসান। ব্যাপারটি প্রতাঁকে পরিণত হয়। বাংলা কাব্যে নজরুলের অবস্থান রবীন্দ্রনাথের পাশেই। রবীন্দ্রযুগের প্রধানতর একজন কবি জসীমউদ্‌দীন। তাঁকেও ‘পল্লীকবি’, ‘মুসলমান কবি’, ‘পূর্ব বাংলার কবি’ এ রকম নানা অভিধায় ঠেলে দিয়ে বাংলা কবিতার মূলধারা থেকে সুকৌশলে সরানোর নানা অপচেষ্টা হয়েছে। কৌশলীরা আপাতত কিছুটা সফল হলেও চূড়ান্ত বিজয় জসীমউদ্‌দীনেরই হবে, কারণ তিনি ‘খাঁটি বাংলা ভাষার কবি। তিনি মৌলিক কবি, পশ্চিমের আধুনিক কবিদের অনুকরণ করে আধুনিক কবি’ হওয়ার চেষ্টা তিনি করেননি।

১৯২০, ৩০ ও ‘৪০-এর দশকে নজরুল ছাড়াও বেশ কয়েকজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী লেখকের আবির্ভাব ঘটে, যাঁদের রচনা যথেষ্ট পরিশীলিত নয়, কিন্তু তাঁরা আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক লেখক। তাঁরা বাঙালি মুসলমানসমাজের সংকীর্ণতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার প্রভৃতি বিষয়কে আঘাত করে লিখেছেন। সৃষ্টিশীল ওই লেখকদের সব রচনা শিল্পকর্ম হিসেবে বড় কিছু নয়, কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। সেগুলো পাঠ করে বড় লেখকেরা যদি তাদের দুর্বলতাগুলোকে এবং গুণগুলোকে ধরিয়ে দিতেন, তাহলে তারা উৎসাহিত হয়ে হয়তো অপেক্ষাকৃত ভালো লিখতেও পারতেন। তাতে বাংলা সাহিত্য উপকৃত হতো। কিন্তু তারা পেয়েছেন শীতল অবজ্ঞা। অনেকের মধ্যে সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু কোনো আনুকূল্য না পাওয়ায় তাঁদের কোনো অগ্রগতি হয়নি।

মুসলমান লেখকদের অনেকেই বহুদিন ইসলাম ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পড়ে থেকে শক্তি ক্ষয় করেছেন। বাংলার পলি মাটিতে তাদের পা দুটি ছিল, কিন্তু তাদের চোখ ও মন ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির দিকে। বিশের দশকে অনেক মুসলমান তরুণ কবি-সাহিত্যিক যশোপ্রার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলেন নজরুল। তারা যে বাঙালি এই আত্মপরিচয় নিয়েও তাঁদের সব দ্বিধা কেটে যায়। পাকিস্তানি জোয়ারে অনেক মুসলমান তরুণ ভেসে গেলেও, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুই দশক আগে থেকেই একটি অসাম্প্রদায়িক ক্ষীণ ধারা মুসলমান লেখকেরা সৃষ্টি করেন। সর্বহারা ও শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ পেয়েছে কারও কারও রচনায়। তাঁরা কোনো দিক থেকেই কোনো আনুকূল্য পাননি। বামপন্থী কবি হিসেবে অকালপ্রয়াত সুকান্ত ভট্টাচার্য স্বীকৃতি পান। কিন্তু তারও আগে যশোরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার অধিবাসী আশরাফ আলী খান জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন এবং শ্রমজীবী ও সর্বহারাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ১৯২০-২১ সালে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। বহু পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেও জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে পারেননি। দারিদ্র্যের যন্ত্রণা সইতে না পেরে ১৯৩৯ সালে আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তাঁর কংকাল একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তাঁর কবিতায় কাব্যগুণের অভাব কোথায়–

ওগো রাজপথ কোথা পেলে এত গভীর মায়ের স্নেহ?
তোমার বুকের স্নেহ-সুধা হতে বঞ্চিত নয় কেহ;
ধনীরা চালায় গাড়ি-ঘোড়া ওই বুকের উপর দিয়া,
দুখীরা ঘুমায় দুই বাহু ‘পরে ক্ষীণ দেহ এলাইয়া;
যেই অভাগার দাঁড়াবার স্থান জগতে কোথাও নেই;
তুমি দাও তব বিশাল বক্ষে যত্নে তাহারে ঠাঁই।

আশরাফ আলী খান ইকবালের উর্দু কাব্যগ্রন্থ শেকোয়ার বাংলায় অনুবাদ করেন। তাঁর ওই তর্জমার তারিফ করেছেন নজরুল। এ ধরনের মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন দরিদ্র, কিন্তু চিন্তাচেতনায় ছিলেন প্রগতিশীল।

বাঙালি মুসলমান আত্মঘাতী ও বিস্মৃতিপ্রবণ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আশরাফ আলী খানের যেমন ঠাঁই হয়নি, যথেষ্ট সাহিত্যকর্ম তার নেই, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সাংবাদিকতায় তাঁর যে দান, তা-ও স্বীকৃতি পায়নি। বঙ্গীয় মুসলমানদের দৈনিক পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনায় যারা পথিকৃৎ, আশরাফ আলী তাঁদের একজন। আজ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগ রয়েছে। সেগুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের কজন আশরাফ আলীর নামটি জানেন? ১৯২৮-২৯ সালে তিনি ছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ছোলতান-এর সম্পাদক। বিশের দশকে মুসলমানদের একটি ইংরেজি দৈনিক ছিল দ্য মুসলমান। সম্পাদক ছিলেন মজিবর রহমান। কুড়ি শতকের প্রথম দিকের বাঙালি মুসলমানের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তাচেতনার ইতিহাস রচনার জন্য দৈনিক ছোলতান, দ্য মুসলমানের সাহায্য নেওয়া অপরিহার্য। আমি দ্য মুসলমান ঘেঁটেছি কিন্তু দৈনিক ছোলতানের কপিগুলো দেখার। সুযোগ পাইনি। উল্লেখযোগ্য যে, ছোলতান নামে একটি সাপ্তাহিকও ছিল, যা সম্পাদনা করেছেন মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। দৈনিক ছোলতানেরও প্রধান পরিচালক ছিলেন তিনি। পথনির্মাতাদের ভুলে যেতে নেই।

বিত্তহীন ও মুসলমান বলে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান কলকাতায় মর্যাদা পাননি। হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ছিলেন বলে ডা. লুৎফর রহমান নামে পরিচিত ছিলেন। উন্নত জীবন, মানব জীবন, মহৎ জীবন প্রভৃতি বইয়ের সাহিত্যমূল্য যতটা, তার চেয়ে বেশি এগুলোর জীবন গঠনে ভূমিকার জন্য। তাঁর লেখাগুলো অনুপ্রেরণাদায়ক, যা একটি অনগ্রসর সমাজে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিতে খুবই প্রয়োজন। তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী ও সমাজসংস্কারক। লুৎফর রহমান সম্পর্কে মাসিক সওগাত মন্তব্য করেছিল :

‘[তাঁর থেকে] অনেক রচনা পাইবার আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যবশত; এত বড় একজন শক্তিশালী লেখককে আমরা হারাইতে বসিয়াছি। বিগত কয়েক মাস যাবত তিনি কঠিন ক্ষয়কাস রোগে আক্রান্ত হইয়াছেন। তাঁহার জীবনের আশা খুব কম। অর্থাভাবে চিকিৎসা হইতেছে না।]

[সওগাত, শ্রাবণ ১৩৩৩] তাঁর উপযুক্ত চিকিৎসা সহায়তার জন্য ‘সনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো হয়েছিল, কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি মুসলমানসমাজ থেকে। নারীমুক্তি আন্দোলননের তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ প্রবক্ত। গঠন করেছিলেন ‘নারী তীর্থ’ নামে একটি সংগঠন। নির্যাতিতা নারীদের আশ্রয়কেন্দ্র ছিল নারী তীর্থ। নারী তীর্থের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লুৎফর রহমান সওগাতে লিখেছিলেন :

‘নারীর সুবিপুল দুর্ভাগ্যের বোঝা, তাহার জীবনের শত দুর্দশার কথা আমরা অবগত আছি। নারীর প্রতি যে অসহ্য রকম অবিচার হইতেছে, ইহার সাহস করিয়া বলিবার প্রয়োজন আমরা অনুভব করিতেছি। নারীকে লইয়া বাঙলার পথে ঘাটে যে রহস্য-লীলা চলিয়াছে, ইহার বিরুদ্ধে এবং নারীর অন্য সকল প্রকার দুঃখের বিরুদ্ধে আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করিলাম।

‘নারী জীবন ব্যর্থ হইয়া যাওয়াতে আমাদের জীবনের কাজও ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। আজ নারী-পুরুষ সবাইকে শক্তি-সাধনায় জাগ্রত হইতে হইবে। দিকে দিকে নারী-জীবনের জয়-সঙ্গীত ধ্বনিত হোক।’

মুহম্মদ নাসিরউদ্দিন লিখেছেন, “দুঃখের বিষয় শারীরিক অসুস্থতার দরুন ও অর্থের অভাবে তিনি “নারী তীর্থ” সংঘটি পরিচালনা করতে পারেননি। … অর্থাভাবে তাহার উপযুক্ত চিকিৎসা হয়নি। অকালে এই মহান লেখক ও চিন্তাবিদের জীবনদীপ নির্বাপিত হইয়াছে।

দুই

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই সংঘবদ্ধ সাহিত্যচর্চার একটি পরিবেশ গড়ে ওঠে ঢাকায়, যেমনটি অনেক আগেই তৈরি হয়েছিল কলকাতায়। ওই সময়ের নতুন লেখকদের বন্ধুচক্রটি বিশেষ ছোট ছিল না। আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আনিসুজ্জামান প্রমুখ। বয়সে ছিলেন চার-পাঁচ বছরের ছোট-বড়।

তরুণ লেখকদের মধ্যে ছাত্র হিসেবে মেধাবী এবং লেখক হিসেবে নিষ্ঠাবান ছিলেন আজাদ। তিনি আড্ডায় সময় দিতেন কম, লেখালেখিতে সময় দিতেন বেশি। সে জন্য অল্প বয়সেই তাঁর বেশ কয়েকটি বই বেরিয়ে যায় এবং তিনি অল্প সময়ে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। শামসুর রাহমান তাঁকে আখ্যায়িত করতেন ‘সাব্যসাচী সাহিত্যস্রষ্টা” বলে। রাহমান তার স্মৃতিকথা কালের ধুলোয় লেখাতে বলেছেন :

‘আলাউদ্দিন আল আজাদ আমাদের কালের বিরল এক প্রতিভাবান সব্যসাচী সাহিত্যস্রষ্টা। … আমরা যারা পঞ্চাশ দশকের লেখক বলে চিহ্নিত তাদের মধ্যে আলাউদ্দিন আল আজাদ শুরু থেকেই একজন নামজাদা লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।’

প্রায় সব বয়সী এবং বন্ধুপ্রতিম আজাদ সম্পর্কে রাহমানের ধারণা ছিল খুবই উঁচু। সমসাময়িকদের মধ্যে খ্যাতির প্রশ্নে যে অসূয়া থাকা স্বাভাবিক, তিনি ছিলেন তা থেকে মুক্ত। আজাদ সম্পর্কে রাহমানের বক্তব্য তাঁর প্রমাণ। তিনি লিখেছেন :

‘আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখনী কখনো আলস্য পোহায়নি; জনপ্রিয়তা, প্রতিষ্ঠা, নানামুখী সাফল্য তাঁকে আত্মতুষ্টির মোহে আটক রাখতে পারেনি। তিনি লিখে গেছেন অনবরত, এখনও লিখে চলেছেন, প্রশংসিত হচ্ছেন বিজ্ঞ সমালোচক এবং উৎসাহী পাঠক-পাঠিকা মহলে। ঈর্ষাযোগ্য তাঁর সাহিত্য রচনার ক্ষমতা। গোড়ার দিকে তাঁর জীবনযাত্রার পথ পুষ্পময় ছিল না, অভাবের কাটার খোঁচা তাঁকে খেতে হয়েছে বারবার। কিন্তু প্রতিভার উজ্জ্বলতা যার সত্তাকে লালন করে, কোনও বাধা, কোনও অভাব কিংবা বহুরূপী প্রতিকূলতা তাঁর অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করতে পারে না। তাই আজাদ রূপকথার নায়কের মতো অভাবের রাক্ষসটিকে সাধনার ক্ষুরধার অস্ত্রের আঘাতে বধ করে গোছানো, নিরাপদ, ঝলমলে সংসাররূপী রাজকন্যার সঙ্গে সুখী জীবনযাপন করছেন।

আজাদের সঙ্গে শামসুর রাহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না। উভয়ের জীবনযাপনের ধরনও ছিল ভিন্ন। রাহমান ছিলেন অবৈষয়িক, অরাজনৈতিক সাদাসিধা মানুষ। শেষ জীবনে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে দূরত্ব রচিত হয়েছিল। সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং সে সম্পর্কে বলতে গেলে দীর্ঘ আলোচনা করতে হয়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক যখন শিথিল, সেই সময়ও শামসুর রাহমান আজাদ সম্পর্কে লিখেছিলেন :

‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আলাউদ্দিন আল আজাদ কস্মিনকালেও স্থবিরতাকে মেনে নেবেন না; কারণ তিনি আমাদের একজন প্রধান লেখকই নন, একজন অত্যন্ত সচেতন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষও। আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তিনি তোলেন না বলেই জানি। তিনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন তুখোড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ অনার্স এবং এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। পিএইচডি করেছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দেশের শিক্ষা বিভাগের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেছেন ডক্টর আলাউদ্দিন আল আজাদ। তবে ভবিষ্যৎ তাকে কুর্নিশ করবে এ দেশের একজন প্রতিভাবান লেখক হিসেবেই।’

কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে তিনি যখন অনার্সের ছাত্র, তখন ১৯৫১-তে কলকাতায় এক আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে যান। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ছিল কমিউনিস্টবিরোধী। শামসুর রাহমান সে প্রসঙ্গে জানান, ‘শান্তি সম্মেলন শেষ হওয়ার পরেই প্রগতিশীল লেখক আলাউদ্দিন আল আজাদকে প্রেসিডেন্সি জেলে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে কিছুদিন কাটাতে হয়। … প্রগতিশীল চিন্তাধারার জন্যে তাকে পাকিস্তান আমলে দুবার কারারুদ্ধ হতে হয়।’

জীবনের প্রথম দিকে জেলজুলুম সহ্য করেছেন, আজাদের শেষ জীবনটাও দুঃখভারাক্রান্ত। ডায়াবেটিসে ভুগেছেন বহুদিন। একমাত্র ছেলেটিকে সুপ্রতিষ্ঠিত দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর ছাত্ররা অনেকেই রাষ্ট্রের উঁচু পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাদের সহযোগিতা তার প্রত্যাশিত ছিল। চক্ষুলজ্জা ত্যাগ করে দেশের জন্য অনেকের কাছে গেছেন। দু-একবার আমি তাঁর সঙ্গী হয়েছি। কোনো আনুকূল্য পাননি। প্রীতিভাজনদের ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছেন বটে, কিন্তু সে কষ্ট সামান্য কষ্ট। জীবনের শেষ প্রান্তে প্রিয়তম পুত্রকে নিয়ে তিনি যে আঘাত পান, তা পৃথিবীতে যেকোনো পিতার জন্যে সর্বোচ্চ আঘাত। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে অকালে তাঁর ছেলে মারা যান। ওই সময় মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে আমার ফোনে কথা হতো। যখন পুত্রের প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি কেঁদে দিতেন, আমি সইতে না পেরে অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে কোনো অজুহাতে ফোন রেখে দিতাম। পুত্রের মৃত্যুর অল্পদিন পরই তিনিও মারা যান। তবে সন্দেহ নেই, একদিন তার মূল্যবান সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন হবে, রচিত হবে তার জীবন নিয়ে গ্রন্থ।

ব্যাপারটি কাকতালীয়। যা ছিল আমার শৈশবকাল ও কৈশোরের সময়, বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যেরও সেটি শৈশবকাল।দেড়শ বছরের কলকাতার প্রাধান্য থেকে বেরিয়ে এসে এই ভূখণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের আবেগ-অনুভূতি, তাদের স্বপ্ন ও বাস্তব, তাদের হতাশা ও বঞ্চনার কথা তাদের নিজেদের ভাষায় প্রকাশ করার সুযোগ পায়। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে দীর্ঘকাল পিছিয়ে থাকায় তাদের যোগ্যতার অভাব ছিল। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দুর্বল থাকায় কলকাতায় তাদের কেউ জায়গা দেয়নি, মর্যাদা দেয়নি। আত্মপ্রকাশের জন্য একটা ভূখণ্ড চাইছিল তারা, যেখানে ঘটবে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাংস্কৃতিক বিকাশ। সেই ভূখণ্ডটি তারা অর্জন করে ১৯৪৭-এ। ফলে আত্মপ্রকাশ ঘটে একদল কবি, লেখক ও চিত্রশিল্পীর।

যারা পথ নির্মাণ করেন, তাদের দোষ ও দুর্বলতা ক্ষমার অযোগ্য নয়। যে উদ্যানে গোলাপ, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা প্রভৃতি নেই, সেখানে ভাঁটফুল বুনোফুল যা-ই ফুটুক, তাকে কদর না করে উপায় নেই। ১৯৪৮ থেকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত ঢাকা থেকে যেসব গল্প-উপন্যাস-কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর লেখকদের অমূল্য সাহিত্যকর্মের জন্য নয়, অন্য কারণে মর্যাদা প্রাপ্য। তাঁদের তৈরি মেঠো পথটিই ৫০ বছরের মধ্যে সুপরিসর পিচঢালা সড়কে পরিণত হয়েছে।

পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে একটি উপন্যাস বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পায়। সেটি আকবর হোসেনের অবাঞ্ছিত। তাঁর আরেকটি উপন্যাস কী পাইনি। দুটি উপন্যাসই আমাদের বাড়িতে পঠিত হয়েছে, আমিও পড়েছি, অন্যদেরও পড়তে দেখেছি। শিল্পকর্ম হিসেবে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু উপন্যাস দুটি ১৫-২০ বছর খুবই জনপ্রিয় ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে অনেকগুলো সংস্করণ হয়। এবং জনপ্রিয়তার কারণেই ষাটের দশকে অবাঞ্ছিতর কাহিনি অবলম্বনে চলচ্চিত্র হয়েছিল এবং তা জনপ্রিয়ও হয়েছিল। মনে পড়ে আমিও দেখেছিলাম কারও সঙ্গে।

আকবর হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় ষাটের দশকের প্রথম দিকে। তখন আমার কিছু গল্প-কবিতা পত্রপত্রিকায় বেরোচ্ছে। কবি জসীমউদ্‌দীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাহিত্য সাধনা সংঘ’। প্রতি সপ্তাহে ওই সংগঠনের বৈঠক বসত কমলাপুরে, কোনো দিন জসীমউদ্‌দীনের বাসভবন ‘পলাশবাড়ীতে, কোনো দিন তাঁর প্রতিবেশী অবাঞ্ছিতের লেখক আকবর হোসেনের বাড়িতে এবং কোনো দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বাঙালি জাতীয়তাবাদী জিয়াউল হকের বাসভবনে। তরুণ ও প্রবীণ ২৫-৩০ জন কবি-সাহিত্যিক সেই রবিবাসরীয় বৈঠকে যোগ দিতেন। লেখকেরা তাঁদের রচনা পাঠ করতেন। তা নিয়ে আলোচনা করতেন অন্যরা। মাঝে। মাঝে ওই বৈঠকে আসতেন অজিত গুহ, জগন্নাথ কলেজের বাংলার অধ্যাপক। তাঁর আলোচনা হতো খুবই বস্তুনিষ্ঠ ও মনোজ্ঞ । সাহিত্যের আসর শেষ হলে কোনো দিন অজিত গুহের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর হাটখোলার বাসস্থান ‘টয় হাউসে’ যেতাম। তিনি ছিলেন অসামান্য সংস্কৃতিমান মানুষ। আমাদের মতো কবিযশোপ্রার্থীদের অকৃপণভাবে উৎসাহ দিতেন।

সাহিত্য সাধনা সংঘের আসরে প্রবীণদের মধ্যে যেতেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, জয়নুল আবেদিন, শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দিন, কবি-গীতিকার আজিজুর রহমান, প্রাবন্ধিক আবদুল হক প্রমুখ। আরেকজন প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন, তিনি হলেন রাচি মানসিক হাসপাতালের সাবেক চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ হোসেন। তিনি ছিলেন নজরুলের চিকিৎসক। আমি ১৯৬৪ সালে সাহিত্য সাধনা সংঘের এক বৈঠকে নজরুলের ওপর একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলাম। সেই কাঁচা রচনাটির ওপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছিলেন অজিত গুহ, আজিজুর রহমান ও মোহাম্মদ হোসেন। নজরুলের অসুস্থতা নিয়ে এবং তাঁর সেই সময়ের অবস্থা নিয়ে ডাক্তার হোসেন বহু মূল্যবান তথ্য দিয়েছিলেন। সম্ভবত ডাক্তার হোসেনের ভায়রা ছিলেন চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শফিকুল আমিন। তিনিও মাঝে মাঝে জসীমউদ্‌দীনের রবিবাসরীয় বৈঠকে যোগ দিতেন।

সাহিত্য সাধনা সংঘের সাহিত্য আলোচনার চেয়ে কম আকর্ষণীয় ছিল না তাতে পরিবেশিত নাশপানি। জসীমউদ্‌দীনের কৃপণতা সম্পর্কে নানা সত্যমিথ্যা গল্প প্রচলিত আছে, কিন্তু তাঁর বাড়িতে অনুষ্ঠিত সাহিত্যের বৈঠকে যারা যোগ দিতেন, তাঁদের তিনি অকৃপণভাবে আপ্যায়িত করতেন। যেদিন আকবর হোসেনের বাড়িতে বৈঠক হতো, সেদিন খানাপিনার আয়োজন থাকত পর্যাপ্ত। তিনি চাকরি করতেন অ্যাকাউনট্যান্ট জেনারেলের অফিসে। চাকরি ছাড়াও তাদের পারিবারিক অবস্থা ছিল ভালো। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী মহকুমার কেয়া গ্রামে। তাঁর সঙ্গে আমার এতটাই ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল যে একবার মধ্য-৬০-এ তিনি আমাকে তাদের গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন। চার-পাঁচ দিন ছিলাম সেখানে। তাঁর বৃদ্ধ বাবা ও ছোট ভাই নূরুদ্দীনের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠতা জন্মে। তাঁদের সঙ্গে আমি গ্রামবার্তা প্রকাশিকার সম্পাদক-প্রকাশক কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বাড়িতে যাই। হরিনাথের এক নাতি, তাঁর ছোট ছেলের সঙ্গে কথা হয়। কাঙালের গানের কিছু বই আমাকে উপহার দেন। স্মরণীয় যা তা হলো, যে মেশিনে দেড় শ বছর আগে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা মুদ্রিত হতো, সেটি দেখতে পাই। ছোট ট্রেডল মেশিনটি তখনো চালু ছিল। অল্পসল্প ছাপার কাজ তাতে হতো। কাঙালের নাতির তা থেকেই খুব কষ্টে জীবিকা নির্বাহ হতো।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আমি মাস তিনেক জসীমউদ্‌দীন ও আকবর হোসেনের প্রতিবেশী ছিলাম। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ তুলে নিলে প্রথমেই আমি তাঁদের দুজনের সঙ্গে দেখা করি। তারা পরামর্শ দেন কোনো রকমে ঢাকার বাইরে যেতে। পূর্ববর্তী তিরিশ ঘণ্টার নারকীয়তার পর অস্পষ্ট অবস্থায় পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তা বোঝার সাধ্য কারোরই ছিল না। যা হোক, আকবর হোসেনের আরও কয়েকটি উপন্যাস পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রকাশিত হয়, যেমন মোহমুক্তি, ঢেউ জাগে প্রভৃতি। তত দিনে নতুন যুগের কথাশিল্পীদের আবির্ভাব ঘটেছে।

তিন

আমাদের শৈশব-কৈশোরে বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে যাদের সক্রিয় দেখেছি, তাঁদের প্রায় সবাই আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন। এ প্রজন্মের কেউ তাঁদের নামটিও জানেন না, তাঁদের লেখার সঙ্গে পরিচয় তো নেই-ই। একটি বনে কত উদ্ভিদই জন্মে কিন্তু টিকে থাকে অল্প, বৃক্ষে পরিণত হয় আরও অল্প কয়েকটি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পনেরো-আনা’ প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘মরার পরে অল্প লোকেই অমর হইয়া থাকেন, সেইজন্যই পৃথিবীটা বসবাসযোগ্য হইয়াছে। ট্রেনের সব গাড়িই যদি রিজার্ভ গাড়ি হইত তাহা হইলে সাধারণ প্যাসেঞ্জারদের গতি কী হইত?… জীবন বৃথা গেল। বৃথা যাইতে দাও। অধিকাংশ জীবনই বৃথা যাইবার জন্য হইয়াছে। এই পনের আনা অনাবশ্যক জীবনই বিধাতার ঐশ্বর্য সপ্রমাণ করিতেছে।’

শিল্প-সাহিত্যজগতের গৌণদের নিয়ে ভাবতে গেলে রবীন্দ্রনাথের কথাটিকে দামি মনে হয়। তাঁর ভাষায়, ‘জীবন বৃথা গেল। যাইতে দাও। কারণ, যাওয়া চাই। যাওয়াটাই একটা সার্থকতা। নদী চলিতেছে –তাহার সকল জলই আমাদের স্নানে এবং পানে এবং আমন-ধানের ক্ষেতে ব্যবহার হইয়া যায় না। তাহার অধিকাংশ জলই কেবল প্রবাহ রাখিতেছে। আর কোনো কাজ না করিয়া কেবল প্রবাহরক্ষা করিবার একটা বৃহৎ সার্থকতা আছে।’ কোনো জাতির শিল্প-সাহিত্যের জগৎটিও প্রবহমান নদীর মতো। শুধু অল্প কয়েকজন প্রধান তাঁকে প্রাণবন্ত রাখতে পারেন না, সজীব রাখতে গৌণদের ভূমিকাই বেশি।

১৯৫৫-তে আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ি প্রকাশের আগে আরও অনেকে তাঁদের গল্প-উপন্যাসের বই প্রকাশ করেছেন। কবিতার বইও বেরিয়েছে কারও কারও। সেকালে দুজন বেদুইন ছিলেন, একজন বেদুইন সামাদ এবং আরেকজন বেদুইন শমসের। উভয়েরই লেখনী-নাম, আসল নাম ছিল অন্য। বেদুইন সামাদ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলায় আসেন। তিনি অনেকগুলো উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস বেলাশেষে, পথে যেতে যেতে এবং নিষ্পত্তি প্রকাশিত হয় মধ্য-৫০ বা ওই দশকের শেষে। মোটের ওপর তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

বেদুইন শমসের ছিলেন আইনজীবী, ফরিদপুরের অধিবাসী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কয়েক বছরে প্রকাশিত হয় তাঁর কয়েকটি উপন্যাস : রিকশাওয়ালা, বেঈমান, বুড়িগঙ্গার বুকে, কাঁটা ও ফুল প্রভৃতি। দুই বেদুইনই সেকালে বিভিন্ন সাময়িকীতে লিখতেন। তবে উভয়েই কর্মজীবনে ঢাকার বাইরে থাকায় মূলধারার লেখকদের সঙ্গে ছিল তাঁদের অনতিক্রম্য দূরত্ব। সে কারণেই তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগেই হারিয়ে যান।

সরদার জয়েনউদ্দিনের আদিগন্ত, শামসুদ্দীন আবুল কালামের আলমনগরের রূপকথা, আবদুল গাফফার চৌধুরীর চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান পঞ্চাশের প্রথম দিকেই প্রকাশিত হয় এবং কথাশিল্পী হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠা পান। পরে অবশ্য তাঁরা আরও পরিণত উপন্যাস লিখেছেন। তাঁদের রচনার বিষয়বস্তু ইসলাম তথা পাকিস্তানি ধ্যানধারণা নয়, দেশের সাধারণ মানুষ।

পঞ্চাশের দশকে ছোটগল্প লিখে যারা খ্যাতি অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ষাট ও সত্তরের দশক পর্যন্ত খ্যাতি ধরে রাখতে পেরেছিলেন, অনেকেই হারিয়ে যান। কেউবা লেখাই ছেড়ে দেন। ওই দশকে যারা ছোটগল্পকার হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ সাবের, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মিরজা আবদুল হাই, সুচরিত চৌধুরী পাঠকসমাজে সমাদৃত হয়েছিলেন।

শহীদ সাবের ছিলেন চল্লিশের দশকের বাম ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পরে কমিউনিস্ট পার্টির একজন কর্মী হিসেবে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের নজরে পড়েন এবং পঞ্চাশের প্রথম দিকে কয়েকটি বছর বিনা বিচারে কারাগারে কাটান। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেন। ১৯৫৫-তে প্রকাশিত হয় তাঁর ছোটগল্প সংকলন এক টুকরো মেঘ। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমি যখন বংশাল রোডের সংবাদ অফিসে তাঁকে দেখেছি, তখন তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। টেবিলে বসে আপনমনে লেখালেখি করলেও কথাবার্তা বিশেষ বলতেন না। অনেকগুলো বছর সংবাদই ছিল তাঁর ঘরবাড়ি। সংবাদ যেন একটি পরিবার এবং সেই পরিবারের একজন স্থায়ী সদস্যের মতো ছিলেন শহীদ সাবের। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে তিনি সংবাদ অফিসেই ছিলেন। পরবর্তী তিন-চার দিনে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও তিনি সংবাদেই থেকে যান। ৩০-৩১ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সংবাদ অফিস জ্বালিয়ে দেয়, ভেতরে তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে একজন চরম নিরীহ মানুষ মারা যান। শহীদ সাবেরের কবিতাও বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।

হাসান হাফিজুর রহমান সংগঠক হিসেবে ছিলেন অসামান্য। অন্যকে লেখায় উৎসাহ দেওয়ায় ছিলেন অদ্বিতীয়। ছিলেন অসামান্য বন্ধুবৎসল। গল্প-কবিতা-নিবন্ধ লিখতেন। পঞ্চাশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে রচিত তাঁর আরও দুটি মৃত্যু গল্পটি প্রশংসিত হয়েছিল। গল্পকার হিসেবে সাইয়িদ আতীকুল্লাহর হাত ছিল ভালো। পঞ্চাশ ও ষাটে কয়েকটি গল্প লিখে তিনি একজন আধুনিক গল্পকার হিসেবে পরিচিতি পান, কিন্তু একপর্যায়ে লেখা ছেড়ে দেন। কিছুই যখন লিখছেন না, চাকরি করছিলেন ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তার, অথচ লেখার শক্তি আছে। আমরা প্রায়ই আড্ডা দিতাম, যদিও তিনি ছিলেন অত্যন্ত নীরস প্রকৃতির মানুষ। স্বাধীনতার পরে আমি তাঁকে লেখার জন্য পীড়াপীড়ি করি। আমি তখন সময় নামে একটি সাহিত্যপত্র প্রকাশ করছিলাম। তার প্রথম সংখ্যায় তাঁকে একটি লেখা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। তিনি অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি বললাম, একটা কবিতা অন্তত দিন। তিনি দিলেন একটি কবিতা। কেউ কেউ প্রশংসা করল। সেই যে তিনি কবিতা লেখা শুরু করলেন, আমৃত্যু শুধু কবিতাই লিখলেন। অনেকগুলো কবিতার বইও বের হলো। তাঁর কবিতায় রসের লেশমাত্র ছিল না। শেষ জীবনে সংবাদে কাজ করেছেন এবং ক্যানসারে মারা যাওয়ার আগে প্রেসক্লাবেই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতেন।

আতীকুল্লাহর শেষ গল্পটি আমি তাকে অনুরোধ করে লিখিয়ে ত্রৈমাসিক নাগরিক-এ ছেপেছিলাম উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের পরে। তাঁকে দিয়ে শেষ গল্প আমি লিখিয়েছি এবং প্রকাশও করেছি, এবং তাঁর প্রথম কবিতাও আমি অনুরোধ করে লিখিয়ে আমার পত্রিকায় ছেপেছি। আতীকুল্লাহকে দিয়ে চাপ দিয়ে লেখানোর কারণ তার পড়াশোনা ছিল। আধুনিক সাহিত্য কী তা তিনি বুঝতেন। কিন্তু কবিতা লিখতে গিয়ে পণ্ডশ্রম করে শক্তি ক্ষয় করেন, সাহিত্যের কোনো উপকার করতে পারেননি।

বাংলাদেশে ছোটগল্পের একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। যথেষ্ট ভালো লিখছিলেন অনেকেই। তবে নিষ্ঠাসহকারে চর্চা অব্যাহত রাখতে পারেননি তাঁরা। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ভাষা ভালো ছিল। বাহুল্যবর্জিত ও মার্জিত। চট্টগ্রামের সুচরিত চৌধুরীর গল্পের স্বাদ ছিল আলাদা। তাঁর গল্পের বই আকাশে অনেক ঘুড়ি ভালো লেগেছিল। মিরজা আবদুল হাই কয়েকটি চমৎকার গল্প লিখেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির সূত্রে তাঁকে তকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে থাকতে হয়েছে, যে জন্য বাংলাদেশের মূলধারার লেখকদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। সত্তর ও আশির দশকে তার সঙ্গে আমার কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়। তাঁর একটি গল্প ‘মেহেরজানের মা’ পড়ে সত্যজিৎ রায় প্রশংসা করেছিলেন এবং বলেছিলেন এটি ছবি করার উপযুক্ত। আমাদের কোটারিবিশিষ্ট সাহিত্যজগতে দলছুট মিরজা আবদুল হাই জায়গা করে নিতে পারেননি। অবহেলিত থেকেই মারা যান।

চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মহিলা কথাশিল্পী ছিলেন হাতে গোনা। নূরুন নাহার নামের একজন ছোটগল্পকারের দেখা পাওয়া যায় ‘৪৭-এর পরে। সম্ভবত তিনি থাকতেন চট্টগ্রামে, তবে শুনেছি তিনি ছিলেন টাঙ্গাইলের বাসিন্দা। তিনি ছিলেন কলকাতা লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের ছাত্রী। বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে পঞ্চাশের দশকে তাঁর খুবই খ্যাতি ছিল। সমাজের আনুকূল্য পাননি। ঢাকার বাইরের লেখকেরা মূলধারা থেকে প্রায়ই পান অবহেলা। তিনিও অবহেলায় আজ হারিয়ে গেছেন। অথচ তিনি সামান্য লেখিকা ছিলেন না।

নূরুন নাহারের একটি কবিতার বই অগ্নি ফসল প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম থেকে। পঞ্চাশের দশকেই প্রকাশিত তাঁর ছোটগল্পের বই বোবা মাটি যথেষ্ট নাম করেছিল। সম্ভবত মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। নূরুননাহারের বই নিয়ে চৌধুরী ছোট একটি আলোচনা লিখেছিলেন। নূরুন নাহারের দুটি উপন্যাসও বেরিয়েছিল পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে। সেগুলো জাঙ্গালের মেয়ে এবং রূপালী হৃদয়ের তীরে। আজ আমাদের অনেক মহিলা কথাশিল্পী রয়েছেন। তাঁদের পথ যারা তৈরি করেছিলেন প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে তাঁদের ঋণ অস্বীকার করা যায় না।

পঞ্চাশের দশকের একজন শক্তিশালী ছোটগল্পকার ও সম্পাদকের নাম আহমদ মীর, আজ তিনি বিস্মৃত। তার আসল নাম মহিউদ্দিন আহমদ। হুগলীর অধিবাসী। পঞ্চাশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বহু মুসলমানের মতো তিনিও পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। তার কয়েকটি গল্প অসামান্য। তাঁর গল্পগ্রন্থ লাল মোতিয়া বেরিয়েছিল ষাটের দশকে, কিন্তু গল্প লিখে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন পঞ্চাশের দশকেই। তাঁর ‘ধোবিয়া তালাও’ গল্পটি আমার কাছে আছে। চমৎকার গল্প।

মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তান সরকারের তথ্য বিভাগ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পাক জমহুরিয়াত পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন। ওই পত্রিকায় আমার প্রথম লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। আমার সেদিনের আনন্দের কথা পৃথিবীর কোনো মানুষকে বোঝাতে পারব না। পঞ্চাশের দশকে স্পন্দন নামে একটি মাসিকপত্র তিনি প্রকাশ করেছিলেন। আমার আব্বা তার গ্রাহক ছিলেন। তারপর তিনি বের করেন একটি পাক্ষিক রম্য পত্রিকা রমনা। সেটিরও আমরা গ্রাহক ছিলাম। সেকালে একটি পত্রিকার নতুন সংখ্যাকে অমূল্য সম্পদ মনে হতো। এক লেখা কয়েকবার পড়তাম।

মহিউদ্দিন আহমদ ওরফে আহমদ মীরের আরেকটি পরিচয় তিনি ছিলেন ‘বার্ডস অ্যান্ড বুকস’ নামের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মালিক। আধুনিক সব বই তিনি প্রকাশ করতেন। চমৎকার তার প্রকাশনার মান। গেটআপ, ছাপা, বাঁধাই সুন্দর। তিনি কিছুদিন চাকরি করেছেন মার্কিন পরিক্রমা নামক একটি পত্রিকায়। মার্কিন ছোটগল্পকার এডগার এলান পোর অনেকগুলো গল্পের তিনি অনুবাদ করেন। সেগুলো তাঁর প্রকাশনা থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশ করেন। তাঁর ওই অনুবাদ বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে একটি সময় মহিউদ্দিন আহমদ একটি অতি ভালো গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছেন।

চার

সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তিত হয় ১৯৬০ সালে। দ্বিতীয় বছর ১৯৬১ সালে কবিতায় আহসান হাবীব, উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ছোটগল্পে মবিনউদ্দীন আহমদ, নাটকে নূরুল হোসেন, গবেষণা প্রবন্ধে মুহম্মদ আবদুল হাই এবং শিশুসাহিত্যে বেগম হোসনে আরা পুরস্কৃত হন। মবিনউদ্দীন আহমদ আজ বিস্মৃত। যে লেখক আহসান হাবীব, ওয়ালীউল্লাহ প্রমুখের সঙ্গে পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, তাঁর নিশ্চয়ই পাঠযোগ্য সাহিত্যকর্ম থাকবে। সেকালে এখনকার মতো দলীয় রাজনীতির ব্যাপার ছিল না বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানে। তা থাকলে সত্যেন সেনের মতো কমিউনিস্টের বই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হতো না সামরিক শাসক মোহাম্মদ আইয়ুব খানের আমলে।

আজ বাংলাদেশের সাহিত্যে মবিনউদ্দীনের নামনিশানা নেই। তাঁর এভাবে হারিয়ে যাওয়ার কারণ খুবই সহজ। তিনি বিত্তবান ছিলেন না। কোনো প্রভাবশালী পুত্র-কন্যা রেখে যাননি। তিনি কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন না অথবা যুগ্ম সচিবের ওপরের পদে চাকরি করেননি।

যদি থাকত তার প্রভাবশালী পুত্র-কন্যা অথবা কোনো নামীদামি পত্রিকার সম্পাদক তাঁর গুণগ্রাহী, তাহলে ২০১২ সালে তারা ঘটা করে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করতেন। ওসব বাদ দিলেও বাংলাদেশে যদি একাডেমিক পর্যায়ে মৌলিক গবেষণার রেওয়াজ থাকত, তাহলে কেউ তার সম্পর্কে কিছু আলোচনা করতেন। মবিনউদ্দীন কোনো প্রকাণ্ড বড় লেখক ছিলেন না, কিন্তু লেখক তিনি ছিলেন এবং শুধু লেখকই ছিলেন। বেশ কিছু চমৎকার ছোটগল্প রয়েছে তাঁর। তিনি সেই সময় পূর্ব বাংলায় কথাসাহিত্যের চর্চা করেছেন। যখন বড় মাপের লেখক এখানে দু-চারজনের বেশি ছিলেন না।

মবিনউদ্দীন ছিলেন অতি সজ্জন, নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। তিনি যে একজন খ্যাতিমান লেখক, সে রকম কোনো অহংকার তাঁর আচরণে প্রকাশ পেত না। পঞ্চাশের দশকে আমি তাঁকে দেখেছি। তার সঙ্গে আমার আব্বার বন্ধুত্ব ছিল, যদিও আব্বা তার চেয়ে বয়সে কিছু বড় ছিলেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমি তাঁকে দেখেছি পাটুয়াটুলী লয়াল স্ট্রিটে সওগাত অফিসে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের সম্পাদকীয় দপ্তরে। মবিনউদ্দীন চাকরি করতেন ঢাকা জজ কোর্টে। সম্ভবত ছিলেন নিচের পদের কোনো কর্মকর্তা।

মবিনউদ্দীনের জন্ম ১৯১২ সালে মানিকগঞ্জ জেলার পারিল নওয়াদা গ্রামে। তাঁদের পরিবার ছিল গ্রামীণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার। তাঁর এক চাচা ছিলেন ঢাকার সাব-ডেপুটি কালেক্টর। পরিবারের অনেকেই ছিলেন শিক্ষিত। কথাসাহিত্যিক মতীয়র রহমান খান তাঁদেরই পরিবারের সদস্য। মবিনউদ্দীন কলকাতা বঙ্গবাসী বা সিটি কলেজ থেকে চল্লিশের দশকে বিকম পাস করেন। আইকম পাস করেন জগন্নাথ কলেজ থেকে। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যাওয়ায় চাচা-মামাদের অভিভাবকত্বে তিনি বেড়ে ওঠেন। সে জন্য তাকে কষ্ট করতে হয়েছে।

ব্রিটিশ আমলে একজন গ্র্যাজুয়েট মুসলমান চেষ্টা করলে অনেক কিছুই হতে পারতেন। মবিনউদ্দীন ছিলেন সাহিত্যগত প্রাণ। কোর্টে চাকরি এবং লেখালেখি ছাড়া তিনি আর কিছুই করেননি। সেকালে তাঁর চেয়ে ছোট চাকুরে ঢাকায় বিষয় সম্পত্তি করেছেন। তাঁর সে আগ্রহ ছিল না। কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন ছিলেন তাঁরই এলাকার মানুষ। মঈনুদ্দীনের বাংলাবাজার আলহামরা লাইব্রেরিতেও তিনি সন্ধ্যার দিকে যেতেন। তাঁর কোনো একটি বই আলহামরা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে থাকতে পারে বলে মনে পড়ছে।

মবিনউদ্দীন মূলত ছোটগল্পই লিখতেন। একটি উপন্যাসও তার আছে। তাঁর ছোটোগল্প সংকলনগুলোর মধ্যে রয়েছে কলঙ্ক (১৯৪৬), সাহানা (১৯৪৮), হোসেন বাড়ির বউ (১৯৫২), ভাঙা বন্দর (১৯৫৪), কুদরত খার ভিটে (১৯৫৫), মুখচর (১৯৫৬), বুনো শয়তান (১৯৫৬) প্রভৃতি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর অনেক লেখাই অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। ১৯৭৮ সালে যখন তিনি মারা যান, তখন নতুন যুগের কেউ তাঁকে চেনে না। দুই লাইন মৃত্যুসংবাদ কোথাও বেরিয়েছিল বলে মনে পড়েনি। কেউ শোক প্রকাশ করেনি।

মবিনউদ্দীনের ‘সন্তান’ শীর্ষক একটি ছোটোগল্প পড়ে ভালো লেগেছিল বলে এখনো মনে আছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের জীবনের দুঃখ-সুখ-দ্বন্দ্ব, তাদের হতাশা প্রভৃতি তাঁর লেখার বিষয়বস্তু। তার হোসেন বাড়ির বউ বইটি তিনি আমার আব্বাকে উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর শৈল্পিক গুণাগুণ সম্পর্কে এখন বলতে পারব না। তবে পঞ্চাশের দশকে তিনি যথেষ্টই পঠিত ছিলেন এবং খ্যাতিমান ছিলেন। ষাটের দশকের প্রজন্ম থেকে উপযুক্ত মর্যাদা না পেয়ে আড়ালকেই বেছে নেন মবিনউদ্দীন আহমদ তাঁর জীবনের শেষ দুটি দশক। তাঁর উত্তরসূরিরা জানেন না যে তাঁদের পথনির্মাতাদের তিনি একজন।

সরদার জয়েনউদ্দীনের গল্পের বই নয়ান ঢুলী প্রকাশের মুহূর্তটির আমি একজন সাক্ষী, সে কথা আগে উল্লেখ করেছি। তার গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা অনেক। সত্তরের দশকে হাতিরপুল বাজারে একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা। তিনি কাঁচাবাজার করতে গিয়েছিলেন চটের থলে নিয়ে। অনেক দিন পরে দেখা বলে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা বললেন। একপর্যায়ে তিনি প্রায় অনুরোধের মতো বললেন, ‘আমার অনেক সূর্যের আশা উপন্যাসটি কষ্ট করে হলেও পড়বেন।’ তাঁর ওই কথা আমার বুকে বাজে। লেখক কেন তার পরবর্তী প্রজন্মের একজনকে তাঁর একটি বই পড়তে অনুরোধ করবেন? তাঁর অনুরোধের আগে কেন আমি তাঁর উপন্যাসটি পড়িনি, তা ভেবে নিজের প্রতিই আমার ক্ষোভ হয়।

সরদার জয়েনউদ্দীন অবহেলা করার মতো কথাশিল্পী নন। তাঁর অবদান অস্বীকার করা অথবা তাঁকে অবহেলা করা অপরাধের শামিল। যখন তিনি জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন, তার দ্বারা উপকৃত হয়েছে এ দেশের প্রবীণ ও নতুন প্রজন্মের প্রায় সব কবি-সাহিত্যিক। প্রত্যেকের বই বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর সম্পাদিত কেন্দ্রের সাময়িকী বইতে প্রশংসামূলক সমালোচনা করিয়েছেন। আমার কোনো কোনো বইয়েরও আলোচনা বেরিয়েছে বই পত্রিকায়।

একটি সময় সত্তরের দশকে কোনো কারণ ছাড়াই জয়েনউদ্দীন বাংলাদেশের লেখকসমাজ থেকে অবহেলিত হতে থাকেন। খ্যাতিমান সবাই তখন আখের গোছাতে অতি ব্যস্ত। এখন কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না, যারা শেখ মুজিবের সরকার থেকে সুবিধা নিয়েছেন সাড়ে তিন বছর, জিয়া সরকার তাদের বঞ্চিত করল না। জিয়া মামলা-মোকদ্দমা ঠুকে দিলেন আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে। অনেকেই জেলের ভাতও খেলেন তার সময়ে। কিন্তু আওয়ামী কবি-শিল্প-সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীদের কোনো অসুবিধা হলো না। প্রাপ্তিযোগে বিশেষ ঘাটতি দেখা গেল না। ওই সব সুবিধাবাদিতা দেখে জয়েনউদ্দীনের ঘেন্না জন্মে থাকবে। তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। স্বনামধন্য লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তার ধারণা প্রকাশ পেয়েছে কুমিল্লার লেখক-অধ্যাপক তিতাস চৌধুরীকে লেখা একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে। ১৩৯০ বঙ্গাব্দে লেখা ওই চিঠিতে সরদার লিখেছিলেন :

‘ঢাকার লোকজন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পেশাদার বুদ্ধিজীবীদের কার্যকলাপ দেখে-শুনে মনে ঘেন্না ধরে গেছে। শুধু তাই নয়, নিজের মনটার প্রতিও কেমন যেন অবিশ্বাস জন্মে গেছে। মাঝে মাঝেই মনে হয় আগের সেই সহজ-সুন্দর অপরকে সহজে ভালোবাসবার মনটা বুঝি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল। এ ভাবনার রশি আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে, তাই সভা-সমিতি, যাকে মনে হয় গলাবাজীর আসর, ওসব জায়গায় আমি যাই-ই না। অর্থাৎ স্বনির্বাসিত জীবনযাপন করি।’

[তিতাস চৌধুরী, দেখা অদেখার স্মৃতি, পৃ. ১৮২]

একজন কথাশিল্পী জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে কতটা বেদনা থেকে এমন। কথা বলতে পারেন। সরদার ছিলেন সহজ-সুন্দর সাদা মনের মানুষ। সহজেই সব। বয়সের ও সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশতে পারতেন। এখন বায়তুল মোকাররম। জাতীয় মসজিদের উত্তর দিকের যেখানে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি, সেখানে একটি দোতলা বাড়ি ছিল। পুরোনো বাড়ি। পরিত্যক্ত সম্পত্তি। চমৎকার একটি উঠানও ছিল। সেটি ছিল ন্যাশনাল বুক সেন্টার। মনে পড়ে সেখানেই ১৯৬৯ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে একটি সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার প্রধান কবি-সাহিত্যিক শিল্পী প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন নওরোজ কিতাবিস্তানের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, শওকত ওসমান, জয়নুল আবেদিন ও জয়েনউদ্দীন। সেদিন। ওয়ালীউল্লাহ একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দেশের সাহিত্যসমাজ আমাকে এতটা ভালোবাসে, আমি জানতাম না। এতকাল বিদেশে রয়েছি, তবু তাঁরা আমাকে মনে রেখেছেন। আমার লেখা পড়েন। এর পরে আর বিদেশে থাকা যায় না। যত শিগগির সম্ভব আমার স্ত্রী ও আমি দেশে চলে আসব। ছেলে-মেয়ে থাকবে প্যারিসে।

ওই সময় ওয়ালীউল্লাহ গুলশানে একটি একতলা বাড়ি কেনেন। তাঁর পরিকল্পনা। ছিল তিন-চার বছরের মধ্যে দেশে ফিরে আসবেন এবং শুধু লেখালেখিতেই জীবনের শেষ বছরগুলো ব্যয় করবেন। এর অল্পকাল পরেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার। সপক্ষে ইউরোপে জনমত গঠনে তিনি বিরামহীন কাজ করেন। পাকিস্তান সরকার তাঁকে চাকরিচ্যুত করায় তিনি তখন বেকার। দেশের জন্য তাঁর উদ্বেগের অন্ত ছিল না। নিজের আর্থিক অনটন। মানসিক চাপ সইতে না পেরে একাত্তরের ১০ অক্টোবর তিনি মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান।

ন্যাশনাল বুক সেন্টারের ডিরেক্টর হিসেবে সরদার যে ঘরে বসতেন, সেটি ছিল একটি সুপরিসর কক্ষ। তিনি ছিলেন মজলিসি প্রকৃতির মানুষ। নিজেকে তিনি একজন অফিসার মনে করতেন না। তাঁর গায়ের বর্ণ ছিল কালো। লম্বা গড়ন। চুল পেছনের দিকে আঁচড়াতেন। সব সময় পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন। তাঁর ঘরে কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা বসত। প্রায় প্রতিদিন। আমিও কোনো দিন যেতাম। যা মাইনে পেতেন, তার অনেকটাই কবি-সাহিত্যিকদের চা-শিঙাড়া-বিস্কুট খাইয়ে খরচ করতেন। সেই জয়েনউদ্দীন অবসর গ্রহণের পর নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। কাঁঠালবাগান ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ছিল তাঁর বাড়ি। শেষ দিনগুলো তাঁর সেখানেই একাকী কাটে। ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৬ তিনি মারা যান।

জয়েনউদ্দীনের জন্ম গ্রামের প্রান্তিক কৃষক পরিবারে। পাবনা জেলার কামারহাটি গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর হিসাবে ১৯১৮ সালে, যদিও ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটে অন্য সাল আছে। ১৯৪০ সালে পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে তিনি বছরখানেক পড়েছিলেন, কিন্তু কারও বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষাজীবনে ইতি টেনে সেনাবাহিনীতে হাবিলদার ক্লার্ক হিসেবে যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পান। কিছুদিন পাকিস্তান অবজারভার-এ কাজ করেন বিজ্ঞাপন বিভাগে। পঞ্চাশের দশকে আমি যখন তাঁকে দেখি, তখন তিনি দৈনিক সংবাদের বিজ্ঞাপন বিভাগের ম্যানেজার।

পঞ্চাশের দশকে আমাদের বাড়িতে দুটি সাময়িকী যেত। তার নাম সেতারা ও শাহীন। এক কপি করে নয়, যেত একটা বান্ডিল। তাতে থাকত ১০টি কপি। আব্বা সেগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পুশিং সেল করতেন। কয়েক মাসের টাকা জমা হলে জয়েনউদ্দীন গিয়ে নিয়ে আসতেন। ওই উপলক্ষে এক বেলা তাঁর সান্নিধ্য পেতাম। ১৯৬২তে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেওয়ার আগে জীবিকার জন্য সরদারকে নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হয়েছে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আইয়ুব সরকার ন্যাশনাল বুক সেন্টার (জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা করলে ১৯৬৪তে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয় গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে। পরে হয়েছিলেন পরিচালক।

নিষ্ঠার সঙ্গে সাহিত্যচর্চা করেছেন জয়েনউদ্দীন। ১৯৬৭ সালে তাঁর অনেক সূর্যের আশা আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পায়। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে। আদিগন্ত (১৯৫৯), পান্না মতি (১৯৬৪), নীল রং রক্ত (১৯৬৫), বেগম শেফালী মীর্জা (১৯৬৮) প্রভৃতি। গল্পগ্রন্থ বীরকন্ঠীর বিয়ে (১৯৫৫), খরস্রোত (১৯৫৫), বেলা ব্যানার্জির প্রেম (১৯৬৮) প্রভৃতি।

২৭. বিদ্যাবিনোদিনী বৃত্তান্ত ও দৌলতন নেছা

বেগম রোকেয়া ভাগ্যবান। এখন বাংলাদেশ, ভারত ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশে অতিপরিচিত নাম। তাঁর অবদান অসামান্য। কিন্তু মৃত্যুর পর অনেক দিন তিনি বিস্মৃতই ছিলেন। এমনকি কোথায় তাঁর কবর, সে খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি কেউ। তাঁর সন্তানসন্ততি থাকলে নিশ্চয়ই নিতেন। তাঁর সম্পর্কে যাঁরা আলোচনা করেছেন, তাঁরাও জানতেন না কোথায় রোকেয়া সমাহিত। কলকাতা থেকে কিছু দূরে সোদপুরের কাছে পানিহাটিতে তাকে কবর দেওয়া হয়। বহুদিন পর পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের সময় তাঁর কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলার নারী জাগরণে রোকেয়ার অবদান অবিস্মরণীয়। কিন্তু অনেক দিন তাঁর সম্পর্কে মানুষ বিশেষ জানত না। তিরিশের শেষের দিকে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ রোকেয়ার একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশ করেন। জীবনীটি সুখপাঠ্য। সেটি প্রকাশের পরও রোকেয়াকে নিয়ে আগ্রহ খুব অল্প মানুষেরই ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে জনশিক্ষা পরিচালক (ডিপিআই) নিযুক্ত হন প্রখ্যাত রসায়নবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ কুদরাত-ই খুদা। তিনি শামসুন নাহার মাহমুদের রোকেয়া জীবনী নবম-দশম শ্রেণিতে পাঠ্য করেন। তাঁর জীবনী স্কুলপাঠ্য করায় রোকেয়ার পরিচিতি সাধারণের মধ্যে ব্যাপকতা পায়। রোকেয়ার প্রতিষ্ঠার পেছনে ড, খুদা ও শামসুন। নাহার মাহমুদের অবদান সবচেয়ে বেশি, যদিও তাঁদের স্বীকৃতি নেই। এবং বর্তমানে রোকেয়ার খ্যাতি এতই বেশি যে তাঁর সমসাময়িক আরও যেসব নারী সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন, তাঁরা আড়ালে পড়ে গেছেন।

এখন কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে কে নারী আর কে পুরুষ, এ প্রশ্ন কেউ তোলেন । সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন নারী কবি-কথাশিল্পীরা। বাংলা সাহিত্যেও অনেক প্রধান কবি-সাহিত্যিক নারী। বাঙালি-আমেরিকান ঝুম্পা লাহিড়ী, যিনি ইংরেজি ভাষায় গল্প-উপন্যাস নিয়ে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন, তিনি নারী কি পুরুষ তা নিয়ে কেউ ভাবেন না। বাংলা সাহিত্যে মহিলাদের অবদান বিরাট। তবে বাঙালি মুসলমান লেখিকাদের আবির্ভাব দেরিতে। সেই পথ যারা তৈরি করেছেন, অশেষ প্রতিবন্ধকতা অগ্রাহ্য করে তারা চিরস্মরণীয়। স্বাধীনতার আগে দু-একবার বাংলা একাডেমিতে দেখেছি নূরুন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনীকে। তখন তিনি বৃদ্ধা। কী রকম সামাজিক অবস্থায় সাহিত্যজগতে তার প্রবেশ, সে সম্পর্কে তিনি তাঁর শৈশবস্মৃতিতে অতি প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছেন। তাঁর ভাষাতেই তাঁর কথা নিবেদন করি, যদিও উদ্ধৃতি দীর্ঘ না করে উপায় নেই :

‘উঁচু পাঁচিল-ঘেরা অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়ি। গোলা বাড়ির সারি সারি ধানের মরাই এর পাশে মিষ্টি কুল, আম, লিচু, নিম গাছের মেলা। পাঁচিলের ওধারে কাজীর পুকুরের টলটলে পানি। খুব ছোটবেলায় ঘরে যখন মন টিকতো না, গিয়ে হাজির হতাম খামারবাড়িতে, যেখানে এক-এক দুই দুই করে একটানা সুরে জনমজুরেরা ধান মেপে তুলছে, সে জায়গা পার হয়ে চলে আসতাম বড় দীঘির পাড়ে। সেখানে হয়তো জেলেরা জাল গুটিয়ে তুলছে আর তাতে ধরা পড়ে ছটফট করছে ছোট বড় রূপোলী মাছগুলো। বাড়িরই কেউ পাড়ে দাঁড়িয়ে তদারক করছেন মাছ-ধরা।

‘কিন্তু আর একটু বড় হবার সঙ্গে সঙ্গেই চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হতে হলো। খান্দানী-ঘরের রেওয়াজই ছিল এই। এমনকি বাড়ির সদর দরজা মাড়ানও বন্ধ। দেয়ালের ফাটল, ঘুলঘুলী দিয়ে, চোরের মতো লুকিয়ে কখনো দেখতাম পাশের বাড়ির কর্মচাঞ্চল্য, ছোট মেয়েরা খেলা করছে, বৌ-ঝিরা করছে রান্না, বাড়ির গিন্নী ঘুরে ফিরে এসে দেখে যাচ্ছেন ওদের রান্না, ছেলেদের খেলাধুলা।-এমনি সব খুঁটিনাটি ছবি।

‘নিজেদের ঘর-সংসারের কাজের কোন দায়িত্ব নাই। ছোট মানুষ, কী কাজই বা জানি। মাঝে মাঝে ঘরের এলোমেলো জিনিষগুলো ঝেড়ে মুছে গুছাবার চেষ্টা করি। মা হাসেন, বলেন, খুব কাজের হয়েছে মেয়ে আমার! অবসর সময়ে নানাজান কেতাব পড়ান, সব দিন পড়াবারও সময় পান না তিনি। আবার অন্যের কাছে ত’ পড়তে দেন না নানাজান। বলেন, সহি পড়ানো না জানলে, তার কাছে পড়া ঠিক নয়। কোরান-কেতাব গলদ পড়ার চেয়ে না পড়াও ভালো। পড়া খুব ভালভাবেই মুখস্থ করে রাখি। ভুল হোলে নানাজান ভীষণ ধমকানি দেন। স্কুলের পড়াশুনার কোন বালাই নাই। মেয়েরা স্কুলে গিয়ে ইংরেজি, অঙ্ক ইতিহাস পড়বে, একথা তখনকার দিনে কারও কল্পনাতেই আসততা না।

‘অলস দিনে প্রচুর সময়। ভাইয়েরা ওস্তাদের কাছে, তাদের পড়া শেষ করে স্কুলে যায়। বাড়ি থাকলে তাদের সঙ্গে খেলা-ধুলা করি। ঝগড়া করি, মারামারিও যে হোত না তা নয়! খেয়েদেয়ে, বইখাতা নিয়ে ওরা বাড়ির বার হয়। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে উদাস মনে চেয়ে থাকি আমি, তাঁদের গমন-পথের পানে। যতোদূর দেখা যায় চেয়ে দেখি, দৃষ্টির বাইরে গেলে দু-হাতে চোখ মুছি। ভীষণ দুঃখ হয়, একটু আগের ঝগড়ার জন্যে মনে অনুতাপ হয়। আবার কখন ফিরবে ওরা, সেই আসা পথে চেয়ে থাকি। ফিরে এলে, ছুটে গিয়ে ওদের হাত থেকে বই-খাতা নিয়ে তুলে রাখি। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে সযতনে রাধা পোলাও, কোর্মা বাড়তে বসি। ভাইরা হাসিমুখে নিজ নিজ আসনে বসে পড়ে। তাদের সামনে থরে থরে সাজিয়ে দেই, ধুলামাটির রান্না, জাফরানি রং এর পোলাও, টুকরো ইটের কোর্মা, ছোট ছোট কুলের ডিম রান্না, কলাপাতার উঁটার চাকা করে কাটা মাছ ভাজা, এটা-ওটা মিশিয়ে একটা ঘণ্টা, খড়িমাটি গোলার ফিরনী- এমনি সব। ছোটভাইরা, জিভ আর তালুতে আওয়াজ তুলে পরিতৃপ্তির সঙ্গে আহার করে, আর আমরা খুশিতে ডগমগ

মন্তব্য করে, একটুও মজা না, বিচ্ছিরি রান্না সেজ-বুবুর। অন্যটি বলে, না বিচ্ছিরি রান্না মেজ-বুবুর, সেজ-বুবুর রান্না খুব ভালো। ব্যস, বেধে যায় ঝগড়া! আর যদি তোকে খেতে বলি কোন দিন। সেজ-বুবু বলে, আমিও খাওয়াবো না খোকনকে আর। অর্থাৎ, ছোটর সঙ্গে বাধে আমার ঝগড়া, মেজর বাধে তার ছোটর সঙ্গে। সেই সব ঝগড়া-বিবাদ ভুলতেও বেশি সময় লাগে না। পরক্ষণেই ভাইয়েরা গোলা বাড়িতে গিয়ে আম, জাম, পেয়ারা কুল যে সময়ের যা ফলমূল পেড়ে নিয়ে আসে কেঁচড় ভরে, আমরা মহাআনন্দে হাত-পা ছড়িয়ে খেতে বসে যাই ভাইবোনে মিলে। মধুর স্মৃতি-বিজড়িত দিনগুলো মানুষের জীবনে আর ফিরে আসে না। খুঁজে পাওয়া যায় না সেই হাসিকান্না ভরা আনন্দময় শৈশব-জীবনের ফেলে-আসা হারিয়ে-যাওয়া দিনগুলো।

[ছোটবেলার জীবন, মৃত্তিকা, ১৯৬১]

এক অতি সংবেদনশীল মন ও শিল্পীর চোখ ছিল নূরুন্নেছা খাতুনের। দেশাত্মবোধ জেগেছিল তাঁর মধ্যে শৈশবেই। তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর স্মৃতিকথায়। তাঁর ভাষায় :

‘কতো অতীত দিনের কাহিনী শুনতাম আব্বাজানের কাছে। শুনতাম, আমার এই মাতৃভূমি মুর্শিদাবাদের বুকে, তরুণ সিরাজের ভাগ্য বিড়ম্বনার করুণ ইতিহাস। বাংলার বীর নবাবদের বীরত্বকাহিনী। আবেগ-আপ্লুত মন বিদ্বেষে শিউরে উঠতো, মীরজাফরের উমিচাঁদের দলের বিশ্বাসঘাতকতার আলেখ্যে শিশুপ্রাণ ক্ষোভে রোষে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠতো ক্ষণে ক্ষণে। সান্ত্বনা পেতে চাইতো ধুলামাটির খেলার মধ্যে, কাটাকুটি আর গেরুয়া মাটি দিয়ে তৈরী হ’তো গড়, কেল্লা, কামান, বন্দুক। মাথার কাঁটা দিয়ে খোঁড়া সরু নালার ওপারে ইংরেজ আর এ পাশে নবাবী ফৌজ। শুরু হতো যুদ্ধ। গুঁড়িয়ে একাকার হোয়ে যেত ওপারে ইংরেজদের দুর্গগুলো। শিশু-মন ভরে উঠতো আত্মতৃপ্তিতে।’

৭০-৮০ বছর আগে একজন বাঙালি নারীর নিসর্গ প্রেম যে অসাধারণ চিত্ররূপময় ভাষায় বর্ণিত হয়েছে, তা ভাবলে অবাক লাগে। এত সুন্দর প্রকৃতির। বর্ণনা খুব কম বাঙালি লেখকই দিতে পেরেছেন। সেই পঞ্চাশের দশকে নূরুন্নেছা খাতুন লিখেছেন :

‘বীরভূমের লাল-মাটির শেষে আবার মুর্শিদাবাদের চন্দনের মতো সাদা কোমল ধুলোর রাজ্য শুরু। ছোটবেলায় ওপারের জানালাটা ঘেঁষে বসে, প্রকৃতির বুকে ছয় ঋতুর আনাগোনা দেখা যেন আমার এক রকম নেশার মত ছিলো। শরৎ, হেমন্ত, শীত পার হয়ে আবার যখন চৈত্র-বৈশাখের দিনগুলো ফিরে আসততা, কেন জানি, আমার মনটা অকারণে খারাপ হয়ে যেতো। খড়কুটো ধূলিমাটি উড়িয়ে বওয়া শুকনো বাতাস, কাকের একটানা ডাক, আকাশের বুকে-ওড়া চিলের তীব্রতীক্ষ করুণ কান্নার সুর, শুকনো তাল-পাতার উদাস সুরের বাজনা বাজানো,– শুনি আর চেয়ে চেয়ে দেখি। মনটা উদাস ব্যথায় ভরে ওঠে। জীবনের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো, আর অনাবশ্যক বেঁচে থাকার সার্থকতা কী?– এই মনোভাব নিয়ে, শেষের বেশে সজ্জিত পাতার দল, রিক্ত মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিসর্জন দিচ্ছে তাদের অবহেলিত প্রাণ। দেখতে দেখতে মনে হোত, কি যেন হারিয়ে গেছে, পালিয়ে গেছে কারা যেন! এখনও মনে পড়ে, আমরা ছোটরা, ক্লান্ত গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণে এই মন-উদাস-করা দিনগুলোর নাম দিয়েছিলাম, বাগড়া বাজা দিন।

‘(বাগড়ার অর্থ : শুকনো তালপাতা)! এমনি করে, শরতের বিকালে, জানালার গরাদ ধরে চেয়ে থাকতাম স্তব্ধ নীল আকাশের নীচে বিস্তৃত মাঠের পানে। সবুজ বনানী আর সুনীল আকাশ একসঙ্গে মিশে আছে মনে হয়। নীচে বিলের পানি দুধ নদীর মতো দেখায়। অলস গতি কৃষকেরা লাঙ্গল কাঁধে মাঠ থেকে ফেরে। রাখাল বালকেরা বটের ছায়ে বসে কড়ি খেলে। গরুগুলো এলোমেলোভাবে এখানে-সেখানে চরে ফেরে, ঘাস খায়। খেলায় রত রাখালেরা মাঝে মাঝে চেয়ে দেখে, গরুগুলো ঠিক আছে কি-না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, খেলা ছেড়ে উঠে পড়ে রাখাল-বালক, পাঁচনবাড়ি দিয়ে গরু তাড়িয়ে গাঁয়ের পথ ধরে ওরা। কাক, শালিক, বকের সারি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে বসে তাদের আশ্রয়স্থল বটবৃক্ষের শাখায়। নানা সুরের নানা কণ্ঠের কিচির-মিচির, কা, কা, ওয়াক-বক শব্দে মুখরিত করে তুলে চারদিক। আঁধার ঘনিয়ে আসে ধীরে ধীরে, কালো যবনিকায় ঢেকে ফেলে সব-কিছু।’

কীভাবে তিনি প্রতিকূলতার মধ্যে লেখিকা হয়ে উঠলেন সে কথা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বলেছেন নূরুন্নেছা খাতুন। তাঁর হৃদয়গ্রাহী ভাষায় কথাশিল্পী হয়ে ওঠার কথা :

‘এতো অবরোধের মধ্যে মানুষ হয়েও কেমন করে সাহিত্যের দরবারে নিজের স্থান খুঁজে নিতে পেরেছিলাম, সে কথা জানতে নিশ্চয়ই অনেকের আগ্রহ হচ্ছে। সেই আশা-আগ্রহ ভরা সাধনার দিনগুলোর কথাও আজ বলবো। আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েদের শিক্ষালাভের পথে কোনই বাধা নেই, তাই অতো যুগ আগে বাংলার গ্রামের, অভিজাত-পরিবারের মেয়েদের পক্ষে লেখাপড়া শেখার চিন্তাও যে কতো। অসম্ভব ছিলো, তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। কিন্তু বাল্যের কোন একদিনে, যে প্রেরণা আমি নিজের মধ্যে অনুভব করেছিলাম, তারই জন্যে আর শুভানুধ্যায়ীদের উৎসাহে, বাংলা-সাহিত্যের দরবারে কিছু পেশ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।

‘দেখতে দেখতে কোন ফাঁকে কেমন করে যেন কেটে গেলো কটা বছর। বড় বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বোনটি ব্যস্ত পুতুলের বিয়ে নিয়ে। আর ছোট ভাইগুলো? তারা থাকতো, মাষ্টার সাহেবের সামনে ঘাড় হেঁট করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে বসে, নয় তো খেলায় মেতে উঠতো লাটু, আর ডাংগুলি নিয়ে। দেখতাম, কর্মচঞ্চল বাড়িতে সবাই আপন আপন কাজে ব্যস্ত। আমিই একা, একান্ত একা। বাড়ির অবসরপ্রাপ্ত বুড়ি ঝিটা, গোয়ালঘরের এক কোণে বসে গন্ধকে পাট কাঠির মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে দেশলাই তৈরী করছে এক মনে। ছুটে যেতাম তার কাছে। দুহাতে তার গলা জড়িয়ে বলতাম, একটা গল্প বলো না ঝি-মা!

‘ফোকলা মুখে, একরাশ হাসি হেসে ঝি-মা বহুবার-শোনা সেই একই বাঙমা বেঙমীর গল্প বলতো, কিংবা শোনাতো জীয়ন-কাঠি মরণ-কাঠির কথা। কিন্তু তাতে কি আর তখন মন ভোলে?– শৈশব ছাড়িয়ে তখন পা দিয়েছি বাল্যে। মন চায় নতুনত্ব। নতুন কিছু জানতে শিখতে মন তখন উৎসুক ছিল। অনুযোগ শুনে বুড়ো-ঝি মুখ ভার করে বলতো, তাহলে আর কোন কিস্সা শোনাই বলো? তোমার ভাইয়েদের কাছে শোনো গে, ওরা সব নেকাপড়া করে, অনেক নতুন নতুন গল্প জানে।

‘অনুসন্ধিৎসু মন এবার একটা পথ খুঁজে পেলো। কোথা থেকে আকস্মিক একটা আলোর রশ্মি এসে পড়ে কোন এক অজানা জগৎকে চোখের সামনে উদ্ভাসিত করে তুললো। মনে হলো, তাইতো, ঠিকই তো। এবার থেকে বই-ই তো আমার সঙ্গী হতে পারে। কতো দেশের কতো মানুষের নতুন নতুন গল্প শোনাতে পারে। ওরা- বইরা আমার।’

নূরুন্নেছা খাতুনের শৈশবস্মৃতি এত লম্বা লম্বা উদ্ধৃতির মাধ্যমে উপস্থাপিত করার কারণ, এ কালের পাঠকের তাঁর সম্পর্কে তো নয়ই, তাঁর রচনাশৈলী সম্পর্কেও ধারণা নেই। তিনি আজ একজন বিস্মৃত মানুষ। অথচ তার যে অবদান তাতে তিনি হারিয়ে যাওয়ার মতো লেখিকা নন। শৌখিন লেখিকা তিনি ছিলেন না, ছিলেন কমিটেড লেখক। সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্যই তিনি কথাশিল্পী হওয়ার ব্রত গ্রহণ করেন। জন্ম মুর্শিদাবাদের এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারে। বাবা খোন্দকার হাবিবুস সোবহান ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বাল্যবিবাহের বিরোধী ছিলেন। তাঁর বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সে, সে কালের জন্য সেটা বেশি বয়স। স্বামী কাজী গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন আইনজীবী। শ্বশুরবাড়িতে সাহিত্যচর্চার উৎসাহ পান। বাড়িতেই বাংলা ও ইংরেজি ভাষা রপ্ত করেন।

১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় নূরুন্নেছার প্রথম উপন্যাস স্বপ্নদ্রষ্টা। একটি সামাজিক উপন্যাস হিসেবে এটিকে উপেক্ষা করা যাবে না। ভাষা পরিমার্জিত রচনাশৈলী সাবলীল। ১৯২৫-এ প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস আত্মদান, বলা হয়েছিল ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। অন্য দুটি উপন্যাস বিধিলিপি ও নিয়তি। ফিকশন ছাড়াও প্রাবন্ধিক রচনাও রয়েছে তার, যেমন ‘মোসলেম বিক্রম ও বাংলার মোসলেম রাজত্ব (১৯১৬)। তাঁর একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস জানকী বাঙ্গ।

নূরুন্নেছা প্রথম বাঙালি মুসলমান ঔপন্যাসিক, যিনি ছিলেন সাহিত্যে নিবেদিতা এবং একই সঙ্গে সমাজসেবা ও নারী জাগরণের একজন কর্মী। পিছিয়ে থাকা মুসলমানসমাজের কল্যাণে তিনি কাজ করলেও তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। মুসলিম জাতীয়তাবাদে নয়, তিনি ছিলেন বিশ্বাসী বাঙালি জাতীয়তাবাদে। ১৯৩১ সালে মুন্সিগঞ্জে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের ১৬তম অধিবেশন হয়। সেখানে নূরুন্নেছা ‘বঙ্গ সাহিত্যে মুসলমান’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং সেটি শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সেই প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন :

‘…যদিও আমাদের বঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের আদি পুরুষগণ আরব, বাগদাদ বা পারস্য দেশ হইতে পূর্বে এদেশে আসিয়াছিলেন, কিন্তু এই বঙ্গের ফল, জল, আকাশ-বাতাস, ঔষধি-বনস্পতি প্রভৃতির সহিত যুগযুগান্তর ধরিয়া আমরা পরিচিত। এই বঙ্গের বাণীই আমাদের জন্মদিন হইতে আরম্ভ করিয়া শেষের দিন পর্যন্ত নিয়ত কর্ণকুহরে ধ্বনিত হইতেছে, কিন্তু আমাদের সম্প্রদায়ে এমন অনেকে আছেন, যাঁহারা পরম সত্যকে অস্বীকার করেন। পঞ্চনদ তীরবাসী সকলেই পাঞ্জাবী, বিহারের সকলেই বিহারী, কিন্তু বাঙ্গালার সন্তান যাহারা তাহারা কেবলমাত্র ধর্মান্তরের জন্যই বাঙালী নহেন, ইহার ন্যায় আশ্চর্যজনক অযৌক্তিক কথা আর আছে কি না জানি না। আমাদের ভ্রাতৃবৃন্দের জননী জায়া দুহিতাগণের মনে বঙ্গবাণীর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধাভক্তি যদি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে থাকে, তবে তাহা অচিরে কি মঙ্গল ও কল্যাণকে যে আমাদের করায়ত্ত করিয়া দিবে, তাহা একমুখে বলিয়া শেষ করা যায় না।

মোসলেম মহিলা সম্মেলনের সভানেত্রীর অভিভাষণে নূরুন্নেছা বলেছিলেন :

‘আমরা হচ্ছি পর্দানশীন মোসলেম রমণী। সাহিত্যে আমাদের পুরুষদেরই একটু দাঁড়াবার স্থান মেলে না, আমরা তো কোন দূরে পড়ে আছি।…

‘দূর চিরদিনই দূর থাকে না। সাধনায় তা নিকট হয়ে আসেই আসে।… এখন নিজের নিজের চেষ্টায়, বিদ্যায় ও জ্ঞানের উজ্জ্বল জ্যোতির ভেতর দিয়ে, অশেষ বাধাবিঘ্ন মাড়িয়ে, নিঃশব্দে খানিকটা এগিয়ে যাওয়াই হচ্ছে আমাদের প্রধান কর্তব্য।

‘স্ত্রী-শিক্ষা– এটা নিশ্চয়ই আজকাল আমাদের অপরিহার্য জিনিসের মধ্যে হয়ে পড়েছে। আর এইটিই আমাদের রুগ্‌ণ সমাজে নাই বললেই চলে। তার ফলে আমাদের জাতীয় জীবন সকল রকমে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

অসামান্য মহিলা ছিলেন নূরুন্নেছা খাতুন। তাঁর অবদানের জন্য যে স্বীকৃতি তিনি দাবি করেন, তা তিনি পাননি। তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়েছে বিপরীত। পরিবার থেকে উৎসাহ পেয়েছেন, মুসলমান সাহিত্যসমাজ থেকে ততটা পাননি। তবে নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ তাঁকে ‘বিদ্যাবিনোদনী’ ও ‘সাহিত্য সরস্বতী’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে।

দুই

প্রতিকূল সময়ে নিজের পথ নিজে করে যারা এগিয়ে যান, তাঁদের মর্যাদা আলাদা, ইতিহাসে তাঁদের একটি আসন প্রাপ্য। নারী-শিক্ষা, বাঙালিত্ব, নারী প্রগতি, সমাজসংস্কার প্রভৃতি প্রশ্নে নূরুন্নেছা খাতুনের মতামত খুবই স্পষ্ট। সাহিত্যের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সওগাত-এ প্রকাশিত তাঁর প্রথম গদ্য রচনা ‘আমাদের কাজ’-এ তিনি বলেন :

‘সমাজের উন্নতি করতে হলে তার প্রথম সোপন হচ্ছে সাহিত্যের সাধনা।…

‘সর্বক্ষণ এই ভাবটা আমাদের অন্তরে পোষণ করতে হবে যে “বাঙ্গালী” শব্দের উপর আমাদের প্রতিবাদী হিন্দুর যে পরিমাণ অধিকার, তার চেয়ে আমাদের দাবি অনেকাংশে বেশি অর্থাৎ কিনা, প্রকৃত বাঙালী বলে পরিচয় দিতে হলে হিন্দুর চেয়ে আমরাই বরং দু’পা এগিয়ে যাব। আমাদের সর্বক্ষণ মনে থাকা দরকার যে-ভারতের অর্ধেক সংখ্যক মোসলমান আমার এই বাঙ্গলা দেশেরই সন্তান।

‘আমাদের জন্মগত অধিকারে অনাস্থাই আমাদের সমাজকে এক রকম কোণঠাসা করে রেখেছে, একে গজাতে দিচ্ছে না। এখন আর বাঙ্গালা শিখবার ভয়ে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে সঙ্কুচিত হলে চলবে না। বুক ঠুকে এগিয়ে দাঁড়িয়ে এখন জোর গলায় বলতে হবে- আমি বাঙালী আর এই বাঙ্গালা সাহিত্যই আমার সাহিত্য।

‘জাতীয় জীবনকে গড়ে তুলবার একমাত্র উপায় হচ্ছে জ্ঞানচর্চা। আমাদেরকে এই পথ অবলম্বন করতেই হবে। … আমাদের দেহ-মনের জড়তা ও আড়ষ্ঠতা দূর করতে হবে। স্বকীয় চেষ্টায় এখন একটু ত্রুটি হলেই পতঙ্গের মতো পদদলিত ও নিষ্পেষিত হয়ে মরতে হবে।’

[‘আমাদের কাজ’, মহিলা সওগাত, ভাদ্র ১৩৩৬]

আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে একজন স্বশিক্ষিত মুসলমান নারী, যিনি এই বক্তব্য দিতে পারেন তিনি সামান্য নারী নন, তিনি নিঃসন্দেহে অসামান্য। যখন নূরুন্নেছা এই কথা বলছেন, তখন রোকেয়া জীবিত। তার এই বক্তব্যে তিনটি বিষয় পাওয়া যায়। এক, সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের উন্নতি ঘটানো সম্ভব, দুই. বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ শুধু নয় সারা ভারতের অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানের বাসভূমি বাংলাদেশ, সুতরাং বাঙালিত্বের দাবিদার বাঙালি মুসলমানেরই বেশি। মুসলমানের চেয়ে তার বাঙালি পরিচয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মুসলমান পৃথিবীর দেশে দেশে বহু জাতির মধ্যে রয়েছে, কিন্তু বাঙালি মুসলমান শুধু বাংলাদেশেই এবং তারাই এই ভূখণ্ডে সংখ্যায় বেশি। সুতরাং, বাঙালিত্বের দাবিদার বাঙালি মুসলমানেরই বেশি। এবং সেই দাবি যদি বাঙালি ছেড়ে দেয় মুসলমানিত্বকে ধরে রাখতে গিয়ে তা হলে তা হবে তার জন্য আত্মঘাতী। এই বিষয়টি তখন সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান পুরুষ ভেবে দেখেননি।

তৃতীয় যে বিষয়টির ওপর নূরুন্নেছা গুরুত্ব দিয়েছেন তা হলো জ্ঞানচর্চা এবং বাঙালি মুসলমানকে সেই পথ অবলম্বন করতেই হবে। বাঙালি মুসলমান নারীদের এবং পুরুষদেরও ‘দেহ-মনের জড়তা ও আড়ষ্ঠতা দূর করে আত্ম-উন্নতির চেষ্টা করতে বলেছেন। আত্ম-উন্নতির চেষ্টা না করলে পোকামাকড়ের মতো ‘পদদলিত ও নিষ্পেষিত হয়ে মরতে হবে, সে কথা সোজাসুজি বলেছেন।

সাহিত্যচর্চা ও সমাজকল্যাণে নূরুন্নেছার একজন যোগ্য উত্তরসূরি দৌলতন নেছা খাতুন, যাকে আজ আমাদের সাহিত্যসমাজ একেবারেই ভুলে গেছে। তার জন্ম ১৯২২ সালে বগুড়ার সোনাতলায় তাঁর বাবার কর্মস্থলে। তাঁর বাবা ইয়াছিন আলী রেলওয়েতে চাকরি করতেন। তিনিও লেখালেখি করতেন। তার স্বর্গোদ্যান, হীরার ফুল, জীবনতারা নামে কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছিল।

সেকালের প্রথামতো শৈশবে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয়। মাত্র আট বছর বয়সে ডাক্তার হাফিজুর রহমান নামক এক চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর সহযোগিতায় ১৯৩৮ সালে তিনি ম্যাট্রিক, ১৯৪০ সালে আইএ এবং ‘৪২ সালে বিএ পাস করেন। লেখাপড়ায় ছিল তাঁর অদম্য আগ্রহ। সংসার সামলে ১৯৫৯-এ তিনি সমাজকল্যাণে এমএ করেন।

দৌলতন নেছা শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না, রাজনীতিতেও ছিল তাঁর আগ্রহ। রাজনীতিতে তাঁর শুরু তিরিশের দশকে কংগ্রেসী রাজনীতি দিয়ে। ওই সময় একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনে অংশ নিয়ে। একজন মুসলমান মেয়ের জন্য সেটা খুব ছোটো ব্যাপার ছিল না। ১৯৫৪-র নির্বাচনে যে কয়েকজন মহিলা যুক্তফ্রন্টের টিকিটে নারীদের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের একজন দৌলতন নেছা। তার এলাকা ছিল রংপুর দিনাজপুর। মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১১ মাস কারাবাস করেন। ১৯৫৫ সালে তাঁকে পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯৫৮-তে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর তিনি রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকেন। এর মধ্যে তার জীবনে নেমে আসে এক বিপর্যয়। স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ১৯৬৪-তে। একমাত্র ছেলে ছিলেন সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। তিনিও মারা যান। ষাটের দশকে তিনি থাকতেন ঢাকার র‍্যাঙ্কিন স্ট্রিটে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যেত। তিনি ছিলেন শ্যামলা, বেঁটে-খাটো এবং মাথায় চুল ছিল পাতলা। বাংলা একাডেমিতে তিনি কখনো আসতেন। ষাটের দশকে ঝরণা নামে তার একটি বই বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছিল।

১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন কুড়িগ্রাম গাইবান্ধা থেকে। ওই সময় নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা ও সংরক্ষণের বিধান রেখে তিনি যৌতুকবিরোধী আইন প্রণয়নের খসড়া সংসদে উত্থাপন করেন।

আজীবন দৌলতন নেছা বাল্যবিবাহ ও যৌতুকের বিরোধিতা করেছেন। ওই বিল উত্থাপনের সময় সংসদে তিনি বলেন :

‘বিবাহের সময় যৌতুকের দাবি আজ অতিশয় ব্যাপক ও ভয়াবহ আকার ধারণ করিয়া বিরাট জাতীয় সমস্যার রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। ইদানীং এই প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা হইতেছে এবং জনগণ ব্যাপকভাবে ইহার অবলোপ দাবি করিতেছেন। যৌতুক সামাজিক পাপ। ইহা স্বামী-স্ত্রীর প্রেমপূর্ণ সম্পর্কের মূলে আঘাত করিতেছে এবং দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরাট হুমকি দেখা দিয়াছে।’

নারী প্রগতির জন্য দৌলতন নেছা অবিরাম কাজ করেছেন। তবে তাঁর কর্মক্ষেত্র ঢাকার মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজ নয়, উত্তরবঙ্গের অবহেলিত অঞ্চল। তিনি তিরিশের দশকে গাইবান্ধা মহিলা সমিতি গঠন করেন। ১৯৭০ এর দশকে তিনি সেখানে এক মহিলা সংস্থার সভানেত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকারের এক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বেইজিংয়ে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে যোগদান করেন।

দৌলতন নেছার সাহিত্যকর্মের পরিমাণ অল্প নয়। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাস পথের পরশ ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি পুনর্মুদ্রিত হওয়া প্রয়োজন। কথাশিল্পী শামসুদ্দীন আবুল কালামের মন্তব্য, দৌলতন নেছার পথের পরশ এক জীবনালেখ্য; এই প্রচেষ্টা পথের দাবীর চেয়েও উৎকৃষ্টতর বলে আমার মনে হয়েছে।’ কথাটি নিঃসন্দেহে অতিরঞ্জিত। শরৎচন্দ্রের পথের দাবীর সঙ্গে পথের পরশের কোনো তুলনা হয় না শিল্পকর্ম হিসেবে, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের একটি চিত্র তাতে পাওয়া যায়। অনেক ছোটগল্পও লিখেছেন তিনি। রোমন্থন’ শীর্ষক ছোটগল্পের ভাষা :

‘প্রভাতের দিকে একটু তন্দ্রা এসেছিল নাজমার। দূর থেকে ভেসে আসা কান্নার করুণ শব্দে তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। সেই সঙ্গে অস্পষ্ট কলরবও কানে এসে পড়ল। লোটনকে কি পাওয়া গেল!

‘দরজা খুলে আঙ্গিনায় বেরিয়ে আসতেই বাইরে থেকে ভোলা চেঁচিয়ে বলল, লোটনের শাড়ী নাকিন খালের পানিতে ভাইসা উঠছে বুজী। লোক নামছে খালে খোঁজনের লাইগা। আপনে বাঁশের মইটা বাইয়া ছাপড়ার ওপরে উঠলে দেখবার পাইবেন। আমি ওহানে যাইতাছি। রুদ্ধ কণ্ঠে কেঁদে উঠল জয়তুন।

‘পাথরের মতো স্থির দৃষ্টি নিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নাজমা। জয়তুনের কান্নার শব্দে ফিরে তাকাল।

‘জয়তুন নাজমার হাত ধরে আকর্ষণ করে বলল, আহ বুজী উপরে উইঠা দেহী। মই বেয়ে ছাপড়ার উপরে উঠে অদূরে খালের উপর দৃষ্টি পড়তেই শেলের মতো নাজমার কানে বেজে উঠল ললাটনের সেদিনের সেই আর্তচীৎকার,

‘বুজী গো বুজী…

‘সবে সন্ধ্যাবাতি দিচ্ছিল নাজমা সেদিন, পিঠে কার কোমল করস্পর্শে ফিরে দেখে লোটন একটু বিস্মিত হয়ে নাজমা বলল,– এমন ভর সন্ধ্যেবেলা তুই যে লোটন,

‘আইজ দিনভোর মায়ে আমারে ঘরে বন্ধ কইরা রাখছিল বুজী।

‘কেন রে?

‘মুখ নীচু করে লোটন বলল, তোমার কাছে আইতে দিব না তাই। সহালে ইসকুলে তাই আইতে পারি নাই বুজী।’

দৌলতন নেছা কতটা নারী প্রগতিবাদী ছিলেন, তা তাঁর আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগের একটি লেখা থেকে বোঝা যায়। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে তিনি লিখেছিলেন :

‘চিরকালই দেখা গেছে ধর্মের অনুশাসনের নামে মানুষকে যত সহজে অবনমিত করা যায় আর কোন শক্তি তা পারে না। তাই দেখা গেছে ধর্মের নামে ও ধর্মের দোহাই দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধর্মের বুকে এমন অনেক জিনিস জমা হয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অঙ্গ নয়। হয়ত কোন প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি করেছে মানুষকে আয়ত্তে রাখার জন্য অথবা কোন সমষ্টিগত শক্তি করেছে নিজেদের ক্ষমতাকে সমাজের বুকে কায়েমী রাখার জন্য।

‘পাশ্চাত্য দেশের নারী আন্দোলনের ধারাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে আমাদের দেশের নারী আন্দোলনের গতিও একই ধারায় পরিণতির পথে এগিয়ে, চলেছে। সময়ের পার্থক্য আছে কিন্তু গতির পার্থক্য নাই। আমাদের দেশেও ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষ নারী জাতির অগ্রসরণের পথে বার বার বাধা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তবুও সমস্ত বাধা-বিপত্তি ঠেলে নারীর অগ্রসরণ অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। যদিও এখনও করবার রয়েছে তাঁদের আরও অনেক।

‘এই সেদিনও ভারতে ধর্মের অনুশাসন থেকে হিন্দু মেয়েদের রক্ষা করে সামাজিক অধিকার প্রদান করল রাষ্ট্র–মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার ও বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দিয়ে।

‘মুসলিম সমাজে এখনও বহু প্রকার আইন আছে যা ধর্মের অনুশাসন থেকে মুক্তি পেয়ে রাষ্ট্রের আওতায় আসা দরকার। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় পুরুষের বহুবিবাহ রদ। নারীর পক্ষ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার ইত্যাদি।

‘আজ মুসলিম নারী সমাজকে এইসব অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্যোগী হয়ে নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে।’

[‘পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলনের গতি’]

দৌলতন নেছার উপন্যাস, ছোটোগল্প ও প্রবন্ধ নিবন্ধের বইগুলোর মধ্যে রয়েছে বধূর লাগিয়া, নাসিমা ক্লিনিক, করমপুরের ছোট বউ, সমাজকল্যাণ প্রভৃতি। সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ১৯৭৭ সালে ‘নূরুন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী স্বর্ণপদক’ দেওয়া হয়।

দৌলতন নেছার সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রজন্মের অনেক নারী সাহিত্যচর্চা ও সমাজসেবা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁদের কারও থেকে তাঁর অবদান কম নয়। নানা কারণে তিনি আজ বিস্মৃত। বাংলা একাডেমির সংক্ষিপ্ত জীবনীমালা সিরিজে দৌলতন নেছা খাতুনের একটি জীবনী প্রকাশিত হয়েছে বেশ আগে। লিখেছেন গোলাম কিবরিয়া পিনু, যিনি তাঁরই এলাকা গাইবান্ধার মানুষ। পথনির্মাতাদের ভুলে যাওয়া ভালো না। ১৯৯৭ সালের ৪ আগস্ট দৌলতন নেছা মারা যান।

 ২৮. মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগস্ট, জাতীয় দিবস ২৩ মার্চ, একুশে ফেব্রুয়ারি, জিন্নাহর জন্ম-মৃত্যুদিন প্রভৃতি উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। আজিমপুর কলোনির সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, আজিমপুর লেডিস ক্লাব, কিংবা বাংলা একাডেমি বা পাকিস্তান কাউন্সিলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তিও হতো। তাতে একজন স্বনামধন্য কবির উপস্থিতি ছিল অবধারিত। হালকা মোটাসোটা, বেঁটে খাটো ওই মহিলা কবির নাম মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। তাঁর কাঁধে থাকত ঝোলানো একটি কাপড়ের ব্যাগ। তাতে দু-চারখানা বই বা খাতা। তার মুখে স্মিত হাসি। কথাবার্তায় গভীর মমতা। তিনি ছিলেন মৃদু হাস্যরসিক। এক মমতাময়ী মাতৃমূর্তি। প্রবীণদের তিনি ছিলেন আপা এবং আমাদের বয়েসী তরুণদের তিনি ছিলেন সবারই খালাম্মা। ষাটের দশক পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ও খ্যাতিমান মহিলা কবি। স্বাধীনতার পরে তিনি আড়ালে চলে যান। সমাদর ছিল না বলে জীবনের শেষ আট-দশ বছর তিনি সভা-সমাবেশে আসতেন না। ১৯৭৭ সালে তিনি নীরবে নিভৃতে ৭১ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।

১৯৩০-এর দশকের শুরুতে কবি হিসেবে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার আত্মপ্রকাশ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পসারিনী প্রকাশিত হয় ১৯৩২-এ। এই বই সম্পর্কে সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের মন্তব্য : বাংলা ভাষায় মুসলিম (মহিলা) কবির ইহাই প্রথম প্রকাশিত আধুনিক কবিতার বই। এতে তিনি প্রকৃতি, প্রেম ও বিরহ নিয়ে কতকগুলো কবিতা লিখেছেন।’

প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাননি সিদ্দিকা। বাড়িতেই উচ্চশিক্ষিত বাবার কাছে এবং গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠ নিয়েছেন। আর পাঠ নিয়েছেন তিনি প্রকৃতি থেকে। মাহমুদা খাতুন তার আত্মকথায় লিখেছেন :

‘আমি যখন মিশন স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ি, সেই সময় কবিতা লিখতে শুরু করি। বারো কি তেরো বছর বয়সে আমার প্রথম কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয়।

‘ছোটবেলা থেকে আমি মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম। মায়ের মৃত্যুর পর কোনো শাসন ছিল না বলেই আমার এক কৃষাণী বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতাম বনে জঙ্গলে, পুকুর ধারে, বাড়ির পেছনে ছিল বিরাট আমবাগান। সেখানকার পাখির ডাক, বুনোফুল আমাকে মুগ্ধ করত। দুই-এক লাইন করে কবিতা লিখতাম। সেই সময় আমার গৃহশিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত আনোয়ারা গ্রন্থের লেখক মজিবর রহমান। তিনি আমার কবিতা লেখায় উৎসাহ দিতেন।

‘আমার মায়ের অনেক বই ছিল। আমি চুপি চুপি সেইসব বই পড়তাম। তা থেকেই আমি জীবন ও প্রেম সম্পর্কে সচেতন হই। বাবার একজন হিন্দু কেরানি আমাকে খোকাখুকু ও শিশুসাথীর গ্রাহক করে দেন। আমার কবিতা লেখার পেছনে বাবার প্রেরণা ছিল।

‘বাবার বদলির চাকরির জন্য কোনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারতাম না। তাই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেছি। রাজশাহী এসে মিশন স্কুলে ভর্তি হলাম, তখন মেমসাহেবের সংস্পর্শে এসে আমার মনে অনেক আধুনিক চিন্তাধারার সৃষ্টি হয়। বাড়িতে তখন ভীষণ কড়া পর্দা। আমার বড় বোনকে স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে পর্দায় আব্রু করা হয়েছে। আমার বেলা সেটা সম্ভব হতে দেইনি।

‘শুরুতে আমি কেবল কবিতাই লিখতাম না, শান্তি, দীপক ও সবুজ বাংলা প্রভৃতি পত্রিকায় আমার বেশ কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে।

‘দেশ বিভাগের পূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মানসী ও মর্মবাণী, উদয়ন, বসুমতি, প্রদীপ, কিষাণ, অগ্রগতি, সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, আজকাল, দীপালি, জয়ন্তী, বঙ্গলক্ষ্মী, উত্তরায়ণ, গুলিস্তান, যুগান্তর, মোয়াজ্জিন, আনন্দবাজার [পত্রিকা], বেগম, নবশক্তি, নবযুগ, স্বাধীনতা, নায়ক, সত্যযুগ, পুষ্পপত্র ইত্যাদি পত্রিকায় আমার লেখা বের হয়েছে।’

মাহমুদা খাতুন ছিলেন অতি শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু ভেতরে তিনি ছিলেন দ্রোহী। সমাজে প্রচলিত নারীর অবরোধ প্রথা তিনি মেনে নেননি। অল্প বয়সেই বেরিয়ে আসেন তিনি সেই কারাগার থেকে। সাহস করে যোগাযোগ স্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামের সঙ্গে। দুই শ্রেষ্ঠ কবির আশীর্বাদ ও অনুপ্রেরণা তিনি পান। পরিচয়-এ প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে সিদ্দিকা রবীন্দ্রনাথকে একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন, প্রাপ্তি স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লেখেন :

কল্যাণীয়াসু,

আমার শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত এবং দুর্বল। যথাসাধ্য সকল কাজ থেকে নিষ্কৃতি নেওয়ার চেষ্টা করছি।

তোমার কবিতাটি পরিচয়-এর সম্পাদকের কাছে পাঠাই, আশা করি তারা ছাপাবেন, কিন্তু সম্পাদকীয় বিচারবুদ্ধির ওপর আমার কোনো হাত নেই এ কথা নিশ্চিত জেনো। দেখেছি তারা অনেক সময় অনেকের ভালো লেখাকেও বর্জন করে।থাকেন; তার পরিচয় পেয়েছি।

ইতি ৩ আশ্বিন, ১৩৪২ শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গিয়ে দেখাও করেন। সে কথা তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন :

‘… বিশ্বকবির পায়ে হাত দিয়ে সেলাম করলাম। আমি সেলাম করে উঠলে দুহাত ঊর্ধ্বে তুলে চোখ বন্ধ করে বহুক্ষণ ধরে কি প্রার্থনা সারলেন। আমি অবাক হয়ে দেখছি তাঁর সর্বদেহ থেকে আলোক বিকিরণ হতে লাগলো। তার পরে তিনি পাশে বসিয়ে গল্প করতে আরম্ভ করলেন, “তোমরা যে পর্দা থেকে বাইরে এসেছ এই আমি আশ্চর্য হয়েছি। দ্যাখো সূর্যের কিরণ না পেলে যেমন গাছপালা বড় হয় না, ফল-ফুল ভালো দেয় না, মানুষও তেমনি বাইরের আলো-বাতাস ছাড়া পূর্ণ হতে পারে না। পদ্ম পঙ্ক থেকে ঊর্ধ্বে উঠেই সূর্যের কিরণ লাভ করে, না হলে সে লাভ করতে পারত না। আর এখানেই তার সার্থকতা।”

নাসিরউদ্দিন লিখেছেন, ‘বাল্যকালে কবির বিবাহ হয় কিন্তু তার বিবাহিত জীবন খুব স্বল্পকাল স্থায়ী। তিনি স্বামীগৃহে যাননি, বিবাহিত জীবন উপভোগ করেননি। সকলে তাঁকে চিরকুমারী বলেই জানে। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা তাঁর পিতার সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন।’

সিদ্দিকা ছিলেন সমাজসচেতন রোমান্টিক কবি। ১৯৩০ সালে সওগাত-এ প্রকাশিত একটি কবিতায় তিনি বলেন :

বসন্ত উৎসব আজ হয়ে গেছে শেষ
পড়ে আছে বাসি ফুল-মালা,
রিক্ত ভূষা উদাসিনী ধরণীর বুকে
জাগে শুধু বুক ভরা জ্বালা।

[বসন্ত বিদায়]

১৯৬০-এ প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই মন ও মৃত্তিকা। ওই কাব্য সম্পর্কে কলকাতার দেশ লিখেছিল :

‘কবিতাগুলির শীতল স্বভাব, ছন্দের কোমল মাধুর্য মনকে পরিষ্কৃত করে, বক্তব্যে কোথাও অস্পষ্টতা নেই। স্বচ্ছ, সুন্দর একটি ভাবাবেশ প্রতিটি কবিতায় পরিব্যাপ্ত।’

সংগ্রামী মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে সিদ্দিকার কোনো কোনো কবিতায় :

রাজপথ বেয়ে চলে উদ্দাম মিছিল
হৃদয়ে হৃদয়ে তার পদধ্বনি বাজে।
বাঁচার মতো বেঁচে ওঠো,
মানুষের অধিকার মানুষের দাবি
সবচেয়ে বড়।

বাংলাদেশে অনেক সামান্য মানুষের, যাদের তেমন কোনো ঐতিহাসিক ভূমিকা নেই, জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী ঘটা করে পালিত হয়। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার যদি থাকত সুযোগ্য ও বিত্তবান ছেলেমেয়ে, তাহলে তিনি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতেন না। তাঁর তৃতীয় কবিতার বই অরণ্যের সুর প্রকাশিত হয় ১৯৬৩-তে। শুধু কাব্যচর্চা নয়, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করতেও তিনি সমাজসেবামূলক কাজ করতেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি ছিলেন ঢাকার শ্রদ্ধেয়া মহিলাদের একজন।

প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত মুসলমান নারী কবি-সাহিত্যিক পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিলেন অল্প কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন খোদেজা খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলায় মাস্টার্স, খোদেজা খাতুনের জন্ম ১৯১৭ র ১৫ আগস্ট, মৃত্যু ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০। কর্মজীবনের শুরু বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে, শেষ জীবনে ছিলেন রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ এবং ইডেন গার্লস কলেজের অধ্যক্ষা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি বিভিন্ন সাহিত্য সংস্কৃতি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রথম জীবনে কবিতার চর্চাও করেছেন, তবে তিনি ছিলেন মূলত গদ্যলেখক, ১৯৭৭ থেকে ৮৫ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সভানেত্রী।

খোদেজা খাতুনের এক ভাই কে এম শমসের আলী কবি হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। তিনিও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন, তাঁরও রয়েছে অনেকগুলো কবিতার বই : আলিঙ্গন (১৯৩৩), সাক্ষর (১৯৪৯), সুরের মায়া (১৯৪৭), রসনার কবি (১৯৬১) প্রভৃতি।

খোদেজা খাতুনের গদ্য কবিত্বময়। স্বাধীনতার আগে আমরা তাঁকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পেয়েছি। স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন তিনি। তিরিশের দশকে ইডেন কলেজের ৩৬ জন ছাত্রীর মধ্যে মুসলমান মেয়ে ছিলেন চারজন। তাঁদের একজন। তিনি, আর একজন দর্শনের অধ্যাপিকা আখতার ইমাম।

তাঁর কবিতার বই বেদনার এই বালুচরে (১৯৬৩), গল্পগ্রন্থ সাগরিকা (১৯৫৯), রূপকথার রাজ্যে (১৯৬৩), শেষ প্রহরের আলো (১৯৬৯) প্রভৃতি এবং প্রবন্ধগ্রন্থ সাহিত্য ভাবনা প্রভৃতি। তাঁর একটি রম্যরচনা গ্রন্থের নাম অরণ্য মঞ্জুরী (১৯৭১)।

তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ নম্বর বাংলোর আবাসিক ছাত্রী ছিলেন। তাঁর ভাষায় :

‘১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ সন পর্যন্ত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন যাপন করেছি। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত কাটিয়েছি ওই বাংলোতে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা, বিশেষ করে আবাসিক ছাত্রী সংখ্যা এতই নগণ্য ছিল যে, কেবলই ছাত্রীদের জন্য কোন আবাসিক হল ছিল না। তখন ছাত্রদের জন্য মাত্র তিনটি হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হল তিনটির নাম ছিল ঢাকা হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও জগন্নাথ হল। ছাত্রীরা নিজেদের সুবিধামতো যে কোন হল-এ সংযুক্ত হতে পারত। আবাসিক ছাত্রীদের বেলায়ও তাই, তবে তারা অবস্থান করত ওই দশ নম্বর বাংলোতে, যার নাম ছিল ইউনির্ভাসিটি উইমেন্স রেসিডেন্স। তখন আবাসিক ছাত্রী সংখ্যা ছিল আট জন; পরে হয়েছিল বারো জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি ক্লাসে সর্বমোট পঞ্চাশ জনেরও কম ছাত্রী পড়ত।

‘দশ নম্বর বাংলো অর্থাৎ ঢাকা ইউনির্ভাসিটি উইমেন্স রেসিডেন্স ছিল তৎকালীন একমাত্র বিখ্যাত ছাত্রীনিবাস, যাকে অনেকেই বলত সাইনোসিওর অব অল আইজ। ওই বাড়ি সম্বন্ধে এই মন্তব্যটি অন্তত তখনকার দিনে খুব চালু ছিল। মনোরম ভঙ্গিতে তৈরি ছিল সেই বিল্ডিং। ভারি চমৎকার ছিল তার পরিবেশ। ব্রিটিশ আমলে সাহেবদের থাকবার জন্য তৈরি হয়েছিল এই সুদৃশ্য বাংলো। অট্টালিকার ভেতরে দু’পাশে দুটো ফায়ার প্লেস এবং তার উপর দিয়ে ছাদের উপর পর্যন্ত দুটো চিমনি ছিল বিলাতি প্যাটার্নে। বাংলোতে সম্মুখভাবে লম্বা বারান্দার দু’পাশে বৃত্তাকার বরান্দা ঘিরে সবুজলতার নীল ফুল ফুটে থাকত, ফুলসমেত হালতার টব ঝুলানো ছিল। বিরাট এলাকাজুড়ে ছিল দশ নম্বর বাংলোর চৌহদ্দি প্রাচীর। প্রাচীরের পাশে সমান্তরালভাবে ছিল দীর্ঘকায় বিলাতি পাম-ট্রি; সকালের রোদ তার মাথায় চিকন মসৃণ পাতায় পাতায় পড়ে ঝিকমিক করত। সামনের কাঁটাতারের বেড়া ঘিরে ছিল ঝুমকোলতা আর মেহেদির বেড়া। কাঁটাতারের বেড়ার দু’প্রান্তে দুটি বড় গেট। বাড়িটির একপাশে ছিল অশোক, বকুল, শিরীষ, চেরি আর কৃষ্ণচূড়ার বড় বড় গাছ, ফুল ফোঁটার সময় এলে তাদের দিক থেকে চোখ ফেরানো যেত না। অন্য পাশে ছিল কাঠবাদাম, কুল, তেঁতুল আর জারুল গাছ। পেছনে কিচেন হাউস আর সারভেন্টস কোয়াটারস ছিল। সামনে বিরাট লন। অর্ধচন্দ্রাকার পিচঢাকা রাস্তা। বাংলোর সম্মুখভাগ দিয়ে ইন ও আউট দু’ধারের দু’গেটে শেষ হয়েছে। এই রাস্তার দুপাশ দিয়ে অজস্র ফুলের সমারোহ নিয়ে ফুলগাছিগুলো সবাইকে যেন স্বাগত জানাত ফোঁটা ফুলের হাসিমুখ বাড়িয়ে। মালী নমি সমস্ত দিন ফুলগাছগুলোর যত্ন নিত। শীতের বিকালের মরসুমি ফুলের এবং অন্যান্য ফুলের সুরভিত স্মৃতি এখনও সুদূর থেকে অনেক স্মৃতির সঙ্গে বিজড়িত হয়ে ভেসে এসে মনকে আকুল করে। রঙবেরঙের ডালিয়া, এস্টার, পপি, হলিহকস, ক্রিসেনথিমাম, টিউলিপ, কর্নফ্লাওয়ার, সূর্যমুখী, অপরাজিতা, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ দেশি-বিদেশি আরও কত কী ফুল; সেসব ফুলে ঘেরা সেই কমনীয় দিনগুলো দশ নম্বর বাংলোসমেত কোথায় গেল? জীবনের তারুণ্যের দিন, বসন্তের দিন, সৌন্দর্যের দিন, আনন্দের দিনগুলো যে এভাবেই কেটেছে। এই শহরের আকাশে বাতাসে সেদিন রঙধনুর রঙ ছড়ানো ছিল। শত শত সূর্য উদয়ের পথে ছড়িয়ে ছিল আশার আলোর ফুলঝুরি। তাই এক সূক্ষ বেদনাবোধের আবেগে বলতে ইচ্ছে হয়, “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না, রইল না, সেই যে আমার নানারঙের দিনগুলি!”…

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই ছিল দশ নম্বর বাংলো। প্রায় সময়ই ক্লাসের ঘণ্টা শুনে তবে আমরা ক্লাসে ছুটতাম বাংলো থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাড়িতে সে সময় ছিলেন মরহুম মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রতি ঈদপর্বে ড. শহীদুল্লাহ, ড. হাসান, ড. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং আরও অনেক শ্রদ্ধেয় প্রফেসর আবাসিক ছাত্রীদের সাদর আমন্ত্রণ জানাতেন। সেই সব স্নেহসিঞ্চিত মুহূর্তগুলো জীবনের অক্ষয় সম্পদ।

[স্মৃতিময় এসএম হল, সলিমুল্লাহ হল, প্রাক্তন ছাত্র সমিতি পুনর্মিলনী, ২০০৩ স্মরণিকা]।

ষাটের দশকে শিক্ষকতায় আসেন অনেক নারী। স্কুলগুলোতে তো ছিলই, বিভিন্ন সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও আধ্যাপিকা ছিলেন কেউ কেউ। তাঁরা ছিলেন প্রগতিবাদী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপিকা আখতার ইমাম ছিলেন সবার শ্রদ্ধার মানুষ। ইংরেজি, বাংলায় দর্শন বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতেন। তাঁর প্রকাশিত বইও রয়েছে দর্শন বিষয়ে।

২৯. লেখক ও প্রকাশক

কোনো বইয়ের পাঠকের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু লেখকের, বইটির প্রকাশক ও মুদ্রক থাকেন আড়ালে। কিন্তু বস্তুতপক্ষে কোনো বইয়ের লেখকের সঙ্গে প্রকাশকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটি ভালো বই পাঠকের হাতে স্যুচারুরূপে পৌঁছে দিতে মুদ্রক ও প্রকাশকের অবদান যে কত বড়, তা খুব কম পাঠকই বইটি পড়ার সময় বিবেচনা করে থাকেন। কোনো লেখকের প্রকাশক-ভাগ্য ভালো হওয়াটাও নিয়তির কথা। খুব বড় লেখকও প্রথম জীবনে যোগ্য প্রকাশকের থেকে অবহেলা পান। সেটা দুঃখজনক কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। প্রকাশককে আর্থিক ঝুঁকি নিতে হয়। যেখানে অর্থনৈতিক ঝুঁকির প্রশ্ন, সেখানে সতর্কতা অবলম্বন না করে উপায় নেই।

আমার নিজের প্রকাশক-ভাগ্য মন্দ নয়। আমার জার্মানির জার্নাল বইটির প্রথম সংস্করণ আমি নিজের টাকায় করেছিলাম। প্রচ্ছদ করেছিলেন সৈয়দ লুফুল হক। ছাপা-বাঁধাই বিশেষ ভালো হয়নি। বইটি কিঞ্চিৎ জনপ্রিয় হওয়ায়, প্রথম সংস্করণের বারো শর মতো কপি কয়েক মাসে শেষ হয়ে যাওয়ায়, দ্বিতীয় সংস্করণ– সামান্য পরিবর্ধিত সংস্করণ–কন্টিনেন্টাল পাবলিশার্স নামক এক নতুন প্রকাশক বের করেন। দ্বিতীয় সংস্করণের প্রচ্ছদ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। প্রচ্ছদটি ছিল ভিন্ন ধরনের চমৎকার কাজ। এ সংস্করণ আরও তাড়াতাড়ি শেষ হয়। তখন কয়েকজন বিশিষ্ট প্রকাশক ভ্রমণকাহিনিটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের আগ্রহ দেখান। মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা আমাকে অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ এক চিঠি দিয়ে বইটি তাকে দিতে অনুরোধ জানান। তাঁকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তাঁর দাবি উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তৃতীয় সংস্করণের পর থেকে যত মুদ্রণ হয়েছে, সবই মুক্তধারা থেকে বেরিয়েছে কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদসহ। আমার প্রথম প্রবন্ধের সংকলন যুদ্ধ ও মানুষের মূর্খতা-ও মুক্তধারা প্রকাশ করে চিত্তরঞ্জন সাহার আগ্রহে। আমার রবীন্দ্ররাজনীতি নামে একটি বইয়েরও প্রকাশক মুক্তধারা। প্রতিটি নতুন বই বেরোলে বা নতুন সংস্করণ হলে চিত্তদা সৌজন্য কপির সঙ্গে আমার জন্য মিষ্টি ও ফলমূল পাঠাতেন।

আমি খুবই বিরলপ্রজ কবি, তিন মাসে ছয় লাইন লিখি। আমার রাশি রাশি গদ্য লেখার ভিড়ে সেই পদ্য খুব কম পাঠকের চোখেই পড়ে। তবে আমার বিরল সৌভাগ্য যে বাংলাদেশের সেরা কবিরা আমার কবিসত্তাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ তাঁদের সম্পাদিত সাময়িকীতে খুব গুরুত্ব দিয়ে একসময় আমার কবিতা প্রকাশ করেছেন। শামসুর রাহমান ও মান্নান সৈয়দের আগ্রহে প্রকাশিত হয়। আমার প্রথম কবিতার বই বিকেলবেলা। নামটি তাঁদের দুজনেরই খুব পছন্দ হয়। বিকেলবেলা বিষয়টির সঙ্গে অর্থবহ অসামান্য প্রচ্ছদ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। তখন কম্পিউটার আসেনি, সুতরাং হাতে আঁকা শিল্পকর্ম। তখন নিউমার্কেটের বিখ্যাত বইয়ের দোকান ছিল ‘নলেজ হোম’। তার মালিক এ এম খান মজলিশ ছিলেন খুবই সজ্জন-ভদ্রলোক। সেখানে প্রতিদিনই রাত নয়টা পর্যন্ত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা হতো। নলেজ হোম বের করেছিল বিকেলবেলা। ছয় শ পঞ্চাশ কপি ছেপেছিল। তা বিক্রি হতে তিন-চার বছর লেগেছে। প্রকাশকের জন্য আমার কষ্ট হয়। তারপরও খান মজলিশ সাহেব একদিন আমাকে একটি খামে পুরে চার শ টাকা দিলেন। আমার প্রয়োজন ছিল বলে টাকাটা আমি নিই, তবে না নেওয়াই উচিত ছিল। আমার বই প্রকাশিত হওয়ায় আমি নাম করেছিলাম; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন প্রকাশক। আমার দ্বিতীয় কবিতার বই দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা প্রকাশিত হয় স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে। প্রকাশক মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ। তিনিও খুবই ভালো মানুষ। অত্যন্ত ভদ্র-নম্র। এই বইয়েরও একরঙা প্রচ্ছদ করেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী।

উনিশ শতকের কবি গোবিন্দচন্দ্র দাসের ওপর আমার দুটি বই : গোবিন্দচন্দ্র দাসের ঘর-গেরস্থালি এবং গোবিন্দচন্দ্র দাস। প্রথমটির প্রকাশক ছিলেন নতুন, দ্বিতীয়টির প্রকাশক বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি রয়্যালিটির টাকাটা একবারেই দিয়ে দেয়। আমার মওলানা ভাসানীর প্রামাণ্য জীবনী মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রকাশকও বাংলা একাডেমি। প্রায় হাজার পৃষ্ঠার ওই বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে হাক্কানী পাবলিশার্স। হাক্কানীর স্বত্বাধিকারী গোলাম মোস্তফা বের করেন আমার আরও বই। তার মধ্যে প্রবন্ধ সংকলন বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও রয়েছে। হাক্কানীর অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর তৃতীয় সংস্করণ বের করেন ওসমান গনি তাঁর আগামী প্রকাশনী থেকে। আগামী আমার আরও বই প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে রয়েছে ভাসানী কাহিনী এবং সৈয়দ আবুল মকসুদের কবিতা। আমার আরও কয়েকটি বই তাঁর প্রকাশনী থেকে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। দেরি হচ্ছে আমার কারণেই।

একজন প্রকাশকের কথা আমার মনে পড়ে। তিনি নওরোজ কিতাবিস্তানের আবদুল কাদির খান। তিনি প্রকাশ করেছিলেন আমার গবেষণাগ্রন্থ হরিশ্চন্দ্র মিত্র-ঢাকার সাহিত্য ও সংবাদপত্রের পথিকৃৎ। এটির অর্থবহ প্রচ্ছদ করেছিলেন খ্যাতিমান শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী। বইটি দুই বাংলায়ই প্রশংসিত হয়েছিল একটি অনুসন্ধানী কাজ হিসেবে। গবেষক অধ্যাপক অরবিন্দ পোদ্দার, ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে, প্রাবন্ধিক শিবনারায়ণ রায় প্রমুখ তারিফ করে লিখেছিলেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকার অন্যতম প্রধান প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান ছিল নওরোজ কিতাবিস্তান। শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক মোহাম্মদ নাসির আলী ছিলেন তার অন্যতম মালিক। দুটি শাখা ছিল, একটি বাংলাবাজারে, অন্যটি নিউমার্কেটে। কাদির খান দুই জায়গাই বসতেন। রয়্যালিটির টাকা পরিশোধে তাঁর কার্পণ্য ছিল না।

একসময় আহমদ পাবলিশিং হাউস ছিল বড় প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকেও আমার কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণকাহিনি পারস্যের পত্রাবলি এবং প্রবন্ধসংকলন চিন্তা ও চেতনা। সত্তরের দশক থেকে মেছবাহউদ্দীন আহমদ তাঁর বাবার কাজ দেখাশোনা করতেন। লেখকদের সঙ্গে তাঁদেরও সম্পর্ক ছিল বিশেষ আন্তরিকতাপূর্ণ। জিন্দাবাহার ছিল আহমদ পাবলিশিংয়ের প্রধান কার্যালয়।

স্বাধীনতার পরে নতুন প্রজন্মের প্রকাশক হিসেবে যারা আত্মপ্রকাশ করেন, তাঁদের মধ্যে সাহিত্য প্রকাশের কর্ণধার মফিদুল হক অন্যতম। তিনি নিজেও লেখক। তিনি বের করেন আমার বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ দার্শনিক এবং পথিকৃৎ নারীবাদী খয়রন্নেসা খাতুন। মফিদুল হকের পরিচ্ছন্ন ও রুচিশীল প্রকাশনা। গ্রন্থ প্রকাশই তাঁর একমাত্র কাজ নয়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্যর একাধিক সংস্করণ একাধিক প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে। সর্বশেষ সংস্করণের প্রকাশক বাংলাবাজারের মনন প্রকাশ-এর শাহ আল মামুন। মনন থেকে আমার আরও বই বেরিয়েছে। তার মধ্যে আমার কিছু কলামের সংগ্রহ সহজিয়া কড়চাও রয়েছে।

আমার ভারতের প্রকাশক কলকাতার নয়া উদ্যোগ-এর পার্থশঙ্কর বসু। তিনি নোয়াখালীর গান্ধী মিশন ডায়েরি প্রকাশ করেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস সমগ্রও নয়া উদ্যোগ থেকে বেরিয়েছে, যার দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছি আমি। পার্থবাবুর সঙ্গেও আমার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব।

গত ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ বিকশিত হয়েছে। এই সময় নতুন নতুন প্রকাশনা সংস্থার আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক, একুশ শতকের মানসম্পন্ন বই প্রকাশের আগ্রহ তাদের। নতুন লেখকদের অপরিণত রচনা যেমন কিছু তাঁরা প্রকাশ করেছেন, অন্যদিকে উন্নতমানের গুরুত্বপূর্ণ বহু বইও তারা বের করছেন। বছর সাতেক আগে যাত্রা শুরু করে প্রথমা প্রকাশন। তাদের অঙ্গীকার মানসম্মত বই রুচিশীলভাবে প্রকাশ করা। বিষয়বস্তু নির্বাচনেও তারা সতর্ক। সৃষ্টিশীল ও মননশীল দুই ধরনের বইই তাঁরা বের করেছেন। প্রথমার কর্ণধার মতিউর রহমান ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে প্রকাশনায় যাননি, যদিও মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করে তিনি ব্যবসাসফলও বটে। আমার নির্বাচিত সহজিয়া কড়চা, অরণ্য বেতার, ঢাকার বুদ্ধদেব বসু, রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন এবং স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বের হয়েছে প্রথমা থেকে। এই ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা। ছাপা, অঙ্গসজ্জা, বাঁধাই প্রভৃতি ব্যাপারে যত্নের পরিচয় সর্বত্র। লেখক হিসেবে সেটা আমার তৃপ্তির বিষয়। প্রথমা থেকে বেরিয়েছে আমার স্যার ফিলিপ হার্টগ এবং কাগমারী সম্মেলন।

ষাটের দশকের শুরুতে একটি রুচিশীল প্রকাশনা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মওলা ব্রাদার্স। তার প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ আতিকুল মওলা ছিলেন বিশিষ্ট ভদ্রলোক। আমার সঙ্গেও তাঁর খুব আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। অপেক্ষাকৃত কম বয়সেই তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর আহমেদ মাহমুদুল হক প্রতিষ্ঠানকে আরও বড় করেন। আমার পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মওলা ব্রাদার্স প্রকাশ করেছে। চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন। কাইয়ুম চৌধুরী।

প্রকাশনাজগৎ বড় হচ্ছে আকারে, গুণগত মানও বাড়ছে, কিন্তু আমাদের প্রকাশকদের মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব। লেখকের সঙ্গে চুক্তি করেন না। রয়্যালটির টাকা ঠিকমতো পরিশোধ করতে গড়িমসি করেন। অনেক ক্ষেত্রে লেখক প্রতারিত হন। কত কপি ছাপাচ্ছেন তা পরিষ্কার করে বলেন না। স্বচ্ছতার অভাব। সকলে নয়া অধিকাংশেরই এই প্রবণতা। এককালে কলকাতার বইতে প্রিন্টার্স লাইনে লেখা থাকত মোট কত কপি ছাড়া হলো। যেমন প্রথম সংস্কারণে ২২৫০ কপি বা ১১৫০ কপি। দ্বিতীয় মুদ্রণ ১২৫০ কপি। নওরোজের নাসির আলী করতেন এবং বর্তমানে প্রথমা প্রকাশনা থেকে মতিউর রহমান নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লেখকের সঙ্গে বই প্রকাশের আগে চুক্তি করেন। রয়্যালটির টাকা চাইতে হয় না, ৩০ চৈত্রের মধ্যে লেখককে পৌঁছে দেওয়া হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে অসচ্ছতা ও অসাধুতা খুব বড় অপরাধী।

বাংলাদেশে আজ সারা বছর ছোট-বড় গ্রন্থমেলা হয় ঢাকায় ও অন্যান্য মফস্বল শহরে। পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ী গ্রন্থমেলা ‘অমর একুশের গ্রন্থমেলা’ মাসব্যাপী হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে। এ এক প্রকাণ্ড সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ ও জাতির বৃহত্তম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বইমেলা লেখক ও প্রকাশকদের ব্যাপার। লেখক ও প্রকাশকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া প্রকাশনাশিল্প ও গ্রন্থজগৎ বিকশিত হতে পারে না। লেখকের কাছে তাঁর বইয়ের প্রকাশক শুধু একজন ব্যবসায়ী নন, প্রকাশক তাঁর বন্ধু ও সহযোগী। লেখক-প্রকাশকের সমন্বিত সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হবে, সাহিত্যের জগৎ তত সমৃদ্ধ হবে।

একুশের বইমেলায় শুধু লেখক-প্রকাশকের সম্পর্ক নয়, লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদশিল্পী এবং পাঠকের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ ঘটে। মতবিনিময় হয়। সাহিত্যজগতের জন্য এর প্রভাব ইতিবাচক। আমাদের পেশাদার ও অপেশাদার প্রকাশকদের অনেকের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠায় গ্রন্থজগৎ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। তবে এ শিল্পকে আরও শক্তিশালী করতে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে লেখক, প্রকাশক ও সরকারকে একত্রে বসে আলোচনা করে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০টি ভাষার একটি। একজন লেখক হিসেবে চাইব একদিন বাংলা সাহিত্যও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০টি সাহিত্যের মধ্যে গণ্য হবে।

৩০. পথিকৃৎ প্রকাশক

আমাদের সাহিত্যসমাজে এ রকম একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ বলে তেমন কিছু ছিল না। বিশেষ করে, ১৯৪৭ এর আগে তো কিছুই ছিল না। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ১৯৫০ থেকে ‘৭১ পর্যন্ত দুই দশকে বাংলাদেশে একটি ভালো প্রকাশনা জগৎ গড়ে ওঠে। শুধু তা-ই নয়, বর্তমান। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে মুদ্রণ ও প্রকাশনার সূচনা দেড় শ বছর আগে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। তবে সেই প্রকাশনা জগৎ কলকাতার মতো সমৃদ্ধ ছিল না। কলকাতার পুস্তক প্রকাশনার বয়স আরও ৫০ বছর বেশি। তা ছাড়া যেহেতু কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী, তাই সরকারি প্রয়োজনে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় আধুনিক মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্প বিকশিত হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ। পূর্ববঙ্গের ঢাকা নগরী কলকাতার থেকে কয়েক শতাব্দী পুরোনো হওয়া সত্ত্বেও ছিল অবহেলিত এবং সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত। দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকা সব কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হতো বড় বড় ছাপাখানা থেকে। গুরুত্বপূর্ণ বইপত্রও বের হতে থাকে আধুনিক প্রেস থেকে। সেসব বইপত্রের ছাপা-বাঁধাই ছিল আন্তর্জাতিক মানসম্মত। বাস্তব কারণেই ঢাকার প্রথম ৫০-৬০ বছরের প্রকাশনার মান উন্নত ছিল না।

পঞ্চাশের দশকে আমাদের নিকট ও দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজনের অন্তত জনা পনেরোর ছাপাখানা, বাঁধাইখানা ও প্রকাশনা ব্যবসা ছিল। পঞ্চাশের দশকের প্রথম। দিকে আমি আমার বাবার সঙ্গে চকবাজার, ইসলামপুর, জিন্দাবাহার, তাঁতীবাজার, পাটুয়াটুলী, বাংলাবাজার, পাতলাখান লেন থেকে ফরাশগঞ্জ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রেসে গিয়েছি। ছোট ট্রেডল মেশিন হোক বা ফ্লাট মেশিন হোক, কাগজ ছাপা হতে দেখতে আমার খুব ভালো লাগত। সেখানে অনেক ট্রেডল মেশিন মেশিনম্যান পা দিয়ে চালাতেন। ফ্লাট মেশিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলত, তবে কাগজটা মেশিনম্যান হাতে ধরিয়ে দিতেন। মনোমেশিন ও লাইনো সম্ভবত এখন উঠে গেছে। ওগুলোতে অপারেটর টাইপ করলে মেশিনেই কম্পোজ হয়ে যেত। অফসেট মুদ্রণযন্ত্র অনেক পরে এসেছে।

উনিশ শতকের শেষ ৪০ বছরে ঢাকায় অন্তত ৪০টি ছাপাখানা ছিল। ওইসব ছাপাখানার প্রায় সব কটিই ছিল ছোট, একসঙ্গে ডিমাই আকারের দুই বা চার পৃষ্ঠা ছাপা হতো। পরে একটু বড় প্রেসে একসঙ্গে ডিমাই বা ক্রাউন আকারের আট পৃষ্ঠা পর্যন্ত ছাপা সম্ভব হতো। এক শ সোয়া শ বছর আগের মুদ্রিত বই দেখে এ ধারণা পাওয়া যায়।

যারা বলেন ঢাকায় আগে কিছুই ছিল না, যা হয়েছে সবই একাত্তরের পরে, তাঁদের অবগতির জন্য দেড় শ বছর আগের কয়েকটি ছাপাখানার নাম উল্লেখ করছি। সেকালের ছাপাখানার মালিকেরা ছিলেন একালের চেয়ে অনেক বেশি বাঙালি জাতীয়তাবাদী। তাঁদের ছাপাখানাগুলোর নাম থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

কয়েকটি ছাপাখানার নাম : বাঙ্গালা যন্ত্র, আদর্শ যন্ত্র, সুলভ যন্ত্র, শীতল যন্ত্র, ভারত যন্ত্র, আৰ্য্য যন্ত্র, মোহাম্মদী যন্ত্র, সাঈদী যন্ত্র, গিরিশ যন্ত্র, আজিজিয়া যন্ত্র, গোপীনাথ যন্ত্র, গেন্ডারিয়া যন্ত্র, ইসলামিয়া যন্ত্র, ইস্ট বেঙ্গল যন্ত্র, নূতন যন্ত্র, সুদর্শন যন্ত্র, ওরিয়েন্টাল প্রেস, ভারত সুহৃদ (প্রেস ও প্রকাশনা), আশুতোষ যন্ত্র প্রভৃতি। সেকালে প্রেস না লিখে বলা হতো যন্ত্র।

ঢাকার প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয় ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৬০ সালে স্থাপিত হয় বাঙ্গালা যন্ত্র। এই ছাপাখানা থেকে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও কবি প্রাবন্ধিক হরিশ্চন্দ্র মিত্রের কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটকের অনেকগুলো বই মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। উনিশ শতকের শেষ দিকে ঢাকার প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, দীনবন্ধু মিত্র, হরিশ্চন্দ্র মিত্র, কালীপ্রসন্ন ঘোষ ছিলেন অগ্রগণ্য। বড় প্রকাশকের মধ্যে স্টুডেন্ট লাইব্রেরি, মওলা বক্স, ওয়াহেদ বক্স প্রভৃতির নাম করা যায়। কালীপ্রসন্ন ঘঘাটের ‘অঞ্জলি’ (১৮৯২) কাব্যের প্রকাশক ছিলেন ওয়াহেদ বক্স। তার কয়েকটি প্রবন্ধ গ্রন্থও ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়।

উনিশ শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে ঢাকা থেকে অনেকগুলো ‘উপন্যাস প্রকাশিত হয়, যদি সেগুলোকে আদৌ উপন্যাস বলা যায়। আদিনাথ ঘোষের হেমলতা উপন্যাস বাঙ্গালা যন্ত্র থেকে ১৮৮৪-তে প্রকাশিত হয়। আর্জুমান্দ আলীর প্রেম দর্পণ-এর প্রকাশক ছিলেন গোপীনাথ বসাক, প্রকাশিত হয় ১৮৯১ সালে। হারাণচন্দ্র ঘোষের উপন্যাস সরলা (১৮৭৬) প্রকাশ করেন মওলা বক্স। প্রকাশক সরলা এবং আরও কয়েকটি বইয়ের পেছনে বিজ্ঞাপনে বলেছিলেন : ‘এই সকল পুস্তক ঢাকা পাটুয়াটুলী আমার নিকট তত্ত্ব করিলে প্রাপ্ত হইবেন। ক্রেতাগণ নগদ মূল্যে অধিক পুস্তক ক্রয় করিলে যথেষ্ট কমিশন দেয়া হইবে।’ দেখা যায়, দেড় শ বছর আগেও বেশি টাকার বই কিনলে বেশি পরিমাণ কমিশন দেওয়া হতো।

১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম একটি আলাদা প্রদেশ হলে ঢাকার প্রকাশনাশিল্প বিস্তৃত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিকশিত হতে থাকে। শতাব্দীর প্রথম দিকেই বাংলাবাজার বইয়ের দোকানে ভরে যায়। যদিও তাতে পাঠ্যপুস্তকই বেশি। কলকাতায় যা ছিল কলেজ স্ট্রিট, ঢাকায় তা-ই যেন বাংলাবাজার। কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ, রংপুর প্রভৃতি জেলা শহরেও প্রকাশনী সংস্থা ছিল ‘৪৭-এর আগে।

১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বছর দুইয়ের মধ্যেই ঢাকায় একটি বড় প্রাণবন্ত প্রকাশনাজগৎ গড়ে ওঠে। কলকাতা থেকে বহু মুসলমান ছাপাখানার মালিক ও বই প্রকাশক ঢাকায় এসে নতুন করে নতুন রাষ্ট্রে ব্যবসা শুরু করেন। কয়েকটি বড় আধুনিক প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। পাঠ্যপুস্তক ও সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনায়ও আসে নতুন গতি।

উপনিবেশ-পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিশীল প্রকাশনা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু। এটি ওয়ালীউল্লাহদের পারিবারিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কমরেড পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়। যার ঠিকানা ছিল ৬২, সুভাষ এভেন্যু, ঢাকা। এটি ছাপা হয়েছিল সে সময়ের সবচেয়ে আধুনিক ছাপাখানা নবাবপুরের নারায়ণ মেশিন প্রেস থেকে। তখন ঢাকায় ব্লক তৈরির ভালো কারখানা ছিল না বলে কলকাতা থেকে প্রচ্ছদের ব্লক করে আনা হয়েছিল। ১৯৪৮-এর শেষ দিকে লালসালু প্রকাশিত হয়। তখন ওয়ালীউল্লাহ ঢাকা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের সম্পাদক ছিলেন। তাঁর অগ্রজ সৈয়দ নসরুল্লাহ আমাকে বলেছেন, লালসালু প্রকাশের পর পরই ওয়ালীউল্লাহ করাচি বেতার কেন্দ্রে বদলি হয়ে গেলে তাঁদের কমরেড পাবলিশার্স বন্ধ করে দেওয়া হয়।

কলকাতায় পূর্ব বাংলার মুসলমানদের কিছু প্রকাশনী সংস্থা ছিল। তাদের মধ্যে আইনুল হক খান ও মোহাম্মদ নাসির আলীর নওরোজ পাবলিশিং হাউস সৃজনশীল বই প্রকাশে উদ্যোগী ছিল। তারা ঢাকায় এসে প্রতিষ্ঠা করেন নওরোজ কিতাবিস্তান। মূল অফিস ও বিক্রয়কেন্দ্র ছিল বাংলাবাজারে। পরে নিউমার্কেটে শাখা খোলা হয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের পরিবেশক ছিল নওরোজ কিতাবিস্তান। নওয়োজ পঞ্চাশের দশকে জসীমউদ্‌দীনের নির্বাচিত কবিতার সংকলন সুচয়নী, কাজী আবদুল অদুদের নদীবক্ষে, আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ী, আবুল ফজলের জীবন পথের যাত্রী, আবুল কালাম শামসুদ্দীনের ত্রিস্রোতা, অজিত কুমার ঘোষের বঙ্গ সাহিত্যে হাস্যরসের ধারা প্রভৃতি প্রকাশ করে।

আরেকটি মানসম্মত প্রকাশনা সংস্থা ছিল রুহুল আমীন নিজামীর স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স। সেখান থেকে বেরোত বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখকদের বই। ইস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্সের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটকের বইগুলোও ছিল মানসম্মত। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ভাষা ও সাহিত্য, রণেশ দাশগুপ্তের উপন্যাসের শিল্পরূপ, শাহেদ আলীর কৃষ্ণপক্ষ, কাজী আবুল হোসেনের বনজ্যোত্স, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের বাবলা প্রভৃতি ইস্ট বেঙ্গল থেকে প্রকাশিত হয়।

অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন তাঁর নিজের বই প্রকাশের জন্য করেছিলেন হাসি প্রকাশনালয় শান্তিনগরে, লেখক কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ করেছিলেন মৃত্তিকা সাহিত্য সদন নয়াপল্টনে, বোরহান উদ্দীন আহমদ ইস্ট বেঙ্গল বুক সিন্ডিকেট পাটুয়াটুলীতে। কবি আহসান হাবীব করেছিলেন কাঠেরপুল লেনে কথা বিতান।

সেকালের ঢাকার বড় বড় প্রকাশনীর মধ্যে ছিল প্রেসিডেন্ট লাইব্রেরি, আদিল ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ইসলামিয়া লাইব্রেরি, ওসমানীয়া বুক ডিপো, কোহিনূর লাইব্রেরি, প্যারাডাইস লাইব্রেরি, আহমদ পাবলিশিং হাউস, লিয়াকত পাবলিশিং কোম্পানি, সরোজ লাইব্রেরি, পাকিস্তান বুক কর্পোরেশন, সোবহানিয়া লাইব্রেরি কপোতাক্ষী, শ্রাবণী, স্টুডেন্ট ওয়েজ, মোহাম্মদী বুক হাউস, আইডিয়াল পাবলিকেশন্স, মখদুমী অ্যান্ড আহসানউল্লাহ লাইব্রেরি প্রভৃতি। গুলিস্তানে ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। সেখান থেকে ইংরেজি ও বাংলা ভালো ভালো বই প্রকাশিত হতো। কবি মঈনুদ্দীনের যুগস্রষ্টা নজরুল, ইব্রাহীম খাঁর ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র প্রভৃতি অক্সফোর্ড থেকে বের হয়।

যেগুলোর নাম আমি স্মৃতি থেকে উল্লেখ করলাম, তার বাইরে বাংলাবাজার ও নিউমার্কেটে আরও সৃজনশীল প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান ছিল। পাঠ্যবইয়ের প্রকাশনী ছিল বহু– ঢাকা ও অন্য জেলা শহরে। সুতরাং, নিঃসন্দেহে বলা যায়, ষাটের দশকে তো বটেই পঞ্চাশের দশকেই বাংলাদেশে একটি প্রাণবন্ত প্রকাশনী জগৎ গড়ে ওঠে। তারাই আমাদের আজকের আধুনিক প্রকাশনীর অগ্রপথিক। তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

৩১. বাংলাদেশের প্রকাশনাজগৎ ও প্রচ্ছদশিল্প

আমার দুবার নিউইয়র্কে ‘মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট’ বা মোমা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। মোমা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পকলা জাদুঘরের একটি। শ্রেষ্ঠ আধুনিক শিল্পীদের শিল্পকর্ম সেখানে স্থান পেয়েছে। বহুতলবিশিষ্ট ওই জাদুঘর ভবনের সম্ভবত দোতলায় একটি বিভাগ আছে, সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে প্রচ্ছদশিল্প। সেগুলোও দেখেছি। বইয়ের প্রচ্ছদপটও যে শিল্পকর্ম, তা বইটির যারা পাঠক তাঁরাও সহজে খেয়াল করেন না। অবশ্য সব বইয়ের সব প্রচ্ছদই শিল্পকর্ম নয়। কোনো কোনো বইয়ের প্রচ্ছদ, যা বড় শিল্পীদের আঁকা, তা নিঃসন্দেহে শিল্পকর্ম।

বাংলা বইয়ের সমালোচনা ও পুস্তক-পরিচিতি যারা লেখেন পত্র-পত্রিকায়, তাঁরা একটি কথা প্রায়ই বলেন, বইটির প্রচ্ছদপট ও অঙ্গসজ্জা আকর্ষণীয়/আকর্ষণীয় নয়। ছাপা-বাঁধাই সুন্দর/মোটামুটি। এই কথা লেখার অর্থ কী? রচনার বিষয়বস্তুই আসল। কিন্তু বই যেহেতু একটি বস্তু শুধু নয়, একটি পণ্য এবং বেচা-কেনা হয়, তাই ক্রেতাকে আকর্ষণ করতে পারে এমনভাবে পণ্যটিকে পরিবেশন করলে তার উপযোগিতা বেশি।

সৌন্দর্যবোধ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই একটি সুন্দর বস্তু হাতে নিয়ে তার আনন্দ। সে জন্য মনোরম প্রচ্ছদে শোভিত একটি বই পাঠকের মন কাড়ে। বাংলা ভাষার বইপত্রে, বিশেষ করে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটকের বইয়ের প্রচ্ছদ উনিশ শতকে মোটেই আকর্ষণীয় ছিল না। লেটারিং বা অক্ষর সাজিয়েই প্রচ্ছদ করা হতো। কুড়ি শতকের প্রথম দিক থেকেই নোবেল-নাটকের প্রচ্ছদ শিল্পীদের দিয়ে আঁকানো শুরু হয়। প্রথম দিকের গল্প-উপন্যাসের প্রচ্ছদে নারীর ছবি, কখনো নারী-পুরুষের ছবি প্রায় আশি ভাগ ক্ষেত্রে থাকতই।

উনিশ শতকের ক্ল্যাসিক লেখকদের গ্রন্থাবলি প্রায় সবই আমাদের বাড়িতে ছিল। তার মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রমেশচন্দ্র দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের বইয়ের এখনকার মতো হাতে আঁকা প্রচ্ছদ দেখিনি। রবীন্দ্রনাথেরও প্রথম দিকের বইতে অক্ষর বিন্যাস করেই প্রচ্ছদ করা হতো। উনিশ শ বিশের দশক থেকে প্রচ্ছদশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, দোলনচাঁপা প্রভৃতির প্রচ্ছদ হাতে আঁকা বটে, কিন্তু খুব যে আকর্ষণীয়, তা বলা যায় না। নজরুলের অধিকাংশ বইয়ের প্রকাশনা মানসম্মত নয়। শুধু তার গুলবাগিচা বইটি তুলট কাগজে সুন্দর ছাপা।

প্রচ্ছদের প্রশ্নে বরং জসীমউদ্‌দীনকে ভাগ্যবান বলা যায়। তাঁর রাখালীর প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন নজরুলের বন্ধু দীনেশরঞ্জন দাশ, পরবর্তী সংস্করণের প্রচ্ছদ আঁকেন নন্দলাল বসু। নকশী কাঁথার মাঠ, রঙিলা নায়ের মাঝি, পদ্মাপার, মাটির কান্না, গাঙের পাড়, পল্লীবন্ধু প্রভৃতি প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন জয়নুল আবেদিন। যাঁদের দেখেছি, সখিনা, সুচয়নী প্রভৃতির প্রচ্ছদ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। মোস্তফা মনোয়ারসহ অন্যান্য খ্যাতিমান শিল্পী জসীমউদ্‌দীনের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। কোনো কোনো প্রচ্ছদকে শিল্পকর্মই বলা যায়।

পৃথিবীর মহান শিল্পীদের অনেকেই তাদের ঘনিষ্ঠ অনেকের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। পাবলো পিকাসোও প্রচ্ছদ এঁকেছেন তাঁর ব্যস্ততম জীবনে। প্রাচ্যের পিকাসো বলে খ্যাত ভারতের মকবুল ফিদা হুসেন প্রথম জীবনে বহু বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন কিছুটা জীবিকার প্রয়োজনে। বইপত্রের প্রচ্ছদ এঁকে কিছুটা রোজগার করেছেন। খুব বড় বড় রাজনৈতিক নেতারও কিছু আনুকূল্য পেয়েছেন। কংগ্রেসের সমাজবাদী নেতা ড. রায়মোহন লোহিয়ার বইয়ের প্রচ্ছদও তিনি এঁকেছেন। যেমন ভারত ভাগের ওপর লেখা লোহিয়ার গিলটি মেন অব ইন্ডিয়া’স পার্টিশন-এর অর্থবহ প্রচ্ছদ হুসেনের আঁকা।

চল্লিশের দশক পর্যন্ত ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাহিত্যের বইয়ের প্রচ্ছদপট আকর্ষণীয় ছিল না। এখানে দক্ষ প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন না। ১৯৪৬ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কমরেড পাবলিশার্স নামে কলকাতায় একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। কমরেড পাবলিশার্স থেকেই তিনি বের করেন আহসান হাবীবের প্রথম কবিতার বই রাত্রিশেষ। এর প্রচ্ছদ করেন জয়নুল আবেদিন। প্রচ্ছদ, মুদ্রণ, বাঁধাই প্রভৃতি ছিল উন্নতমানের। ওয়ালীউল্লাহ নিজে ছিলেন রুচিশীল মানুষ। তিনি চেয়েছিলেন নির্বাচিত সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশক হতে। তাঁর নিজের উপন্যাস লালসালু তিনি কমরেড পাবলিশার্স থেকে প্রকাশ করেন, তবে তা কলকাতা থেকে নয়, ঢাকা থেকে ১৯৪৮-এর শেষ দিকে। লালসালুরও প্রচ্ছদ করেছিলেন জয়নুল আবেদিন। বস্তুত লালসালুই উপনিবেশ-পরবর্তী পূর্ব বাংলার প্রথম আধুনিক প্রকাশনা।

পঞ্চাশের দশকে ঢাকার অনেক প্রকাশকের বইয়ের প্রচ্ছদ করেন শিল্পী কাজী আবুল কাশেম। ওই দশকেই ঢাকা আর্ট স্কুল থেকে কয়েকজন শিল্পী বেরিয়ে যান। কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীরসহ অনেকেই প্রচ্ছদশিল্পে দক্ষতা দেখান। পঞ্চাশের দশকে নতুন লেখকদের বেশ কিছু চমৎকার প্রচ্ছদ-শোভিত বই প্রকাশিত হয়।

ষাটের দশকে অনেক গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকের বইয়ের চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন আমাদের প্রধান শিল্পী জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানসহ অনেক শিল্পী। তাঁদের আঁকা প্রচ্ছদ উন্নতমানের শিল্পকর্ম হিসেবে গণ্য করা যায়। শেষের দিকে কাইয়ুম চৌধুরীর লেটারিংয়ে একঘেয়েমি এসেছিল, কিন্তু তাঁর ষাট ও সত্তরের দশকের কাজ অপূর্ব। সত্তর ও আশির দশকে নতুন প্রজন্মের কয়েকজন দক্ষ প্রচ্ছদশিল্পীর আবির্ভাব ঘটে।

শিশুতোষ রচনায় শিল্পীর কাজ বেশি। ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে অসামান্য কাজ হতে থাকে। শিশুদের ছড়া ও গল্পের বইতে ইলাস্ট্রেশন মনোমুগ্ধকর না হলে তা শিশুদের আকর্ষণ করে না। বাংলাদেশে শিশুসাহিত্যের বইগুলোর অধিকাংশই সুদৃশ্য ও অলংকার-শোভিত। শিশুরা বইয়ের ছবি দেখে ছবি আঁকা শেখে। নিউইয়র্কের মোমায় আমি দেখেছি, বড় শিল্পীদের আঁকা ছবি দেখে দেখে শিশুরা ছবি আঁকা শিখছে।

উভয় বাংলার বাঙালি প্রচ্ছদশিল্পীদের মধ্যে আমার নিজের অনেকটা অনধিকারী বিবেচনায় সত্যজিৎ রায়ই শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পী। তবে তিনি চলচ্চিত্রে ব্যস্ত থাকায় নিজের বই ছাড়া অন্যের বইয়ের প্রচুর সচিত্রণ করার অবকাশ পাননি। তাঁর লেটারিং কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত শিশুতোষ বইগুলোর প্রচ্ছদ ও সচিত্রণ অভিনব। ঢাকা থেকে চমঙ্কার সচিত্ৰণসহ শিশুদের বই প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রামের রুচিশীল প্রকাশনা বইঘর থেকে প্রকাশিত হতো শিশু-কিশোর পত্রিকা টাপুর টুপুর, যার প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন দৃষ্টিনন্দন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর নিজের বই যেমন দুই তীর, চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদোর প্রচ্ছদ নিজেই আঁকেন। তিনি ছিলেন শৌখিন চিত্রশিল্পী। বিমূর্তের দিকেই তার ঝোঁক। তার তরঙ্গভঙ্গের প্রচ্ছদ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। চমৎকার কাজ।

নতুন যুগের প্রযুক্তি কম্পিউটার আসায় আমাদের প্রকাশনাশিল্প উপকৃত হয়েছে, দ্রুততম সময়ে বইয়ের মুদ্রণ সম্ভব হচ্ছে, ঝলমলে প্রচ্ছদ করাও সম্ভব হচ্ছে অতি অল্প সময়ে; কিন্তু প্রচ্ছদশিল্পে সৃষ্টিশীলতা থাকছে না। পনেরো আনা কাজ যন্ত্র করছে, শিল্পীর ভূমিকা গৌণ। ষাট ও সত্তরের দশকে আমাদের প্রচ্ছদশিল্প যে উচ্চতায় গিয়েছিল, সেখান থেকে উচ্চতর জায়গায় যেতে তো পারেইনি, বরং নিচে নামছে। যদিও প্রতিভাবান প্রচ্ছদশিল্পী এখনো আছেন আমাদের কয়েকজন। প্রচ্ছদশিল্পকে একুশ শতকের উপযোগী করতে হলে কম্পিউটার-নির্ভরতা নয়, আমাদের নির্ভর করতে হবে শিল্পীদের সৃষ্টিশীলতার ওপর।

Exit mobile version