[একই সূত্র, পৃ. ৮৭]
নৈতিক মনোবল ও সৎ-সাহস থাকলে কাউকে খুব বেশি সাহসী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সেদিন প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদেরা যে সাহসের অথবা দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে পারেননি, একজন তরুণ প্রভাষক তা দিয়েছেন। সেদিন যদি আরবিপন্থীদের প্রতিহত করা না যেত, তাহলে আজ আমাকে এই রচনাটাও লিখতে হতো আরবি হরফে অথবা উর্দুতে।
আরবি হরফপন্থীরা কখনো আশা ছেড়ে দেননি। এমনকি বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তপাতের পরেও তাঁদের অপতৎপরতা অব্যাহত থাকে। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়ে আসেন মালিক ফিরোজ খান নূন। তিনি ছিলেন পাঞ্জাবের অধিবাসী এবং মানুষ হিসেবেও অপেক্ষাকৃত সজ্জন ছিলেন, তবে বাঙালি জাতি সম্পর্কে তাঁর বিশেষ ধারণা ছিল না। তাঁর পত্নী ভিকারুন নিসা নূন বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। ফিরোজ খান নূনও আশা পোষণ করতেন যে আরবি অক্ষরে বাংলা লিখলে ভালোই হয়। কিন্তু বাংলায় গভর্নর থাকা অবস্থায় তিনি সমালোচনার মুখে পড়বেন এই ভয়ে বিশেষ কিছু বলেননি। বরং পরিস্থিতি আঁচ করে ঢাকায় বলেন, একটি জাতির উপর কোনো ভাষাই চাপাইয়া দেওয়া যায় না।… জোর করিয়া আরবী হরফ প্রবর্তন ভ্রমাত্মক হইবে।’
[ সংবাদ, ১৩ চৈত্র ১৩৫৯]
তাঁর স্বদেশে ফিরে গিয়েই তিনি সুর পাল্টান। লাহোরে গিয়ে তিনি যা বলেন, তা ছিল আর এক চাল। বাঙালীরা যদি আরবী হরফে বাংলা লিখিতে রাজী থাকেন, তাহা হইলে বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইলেও তাহার আপত্তি থাকিবে না।
[আজাদ, ১৬ চৈত্র ১৩৫৯]
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলা ভাষার শতকরা ৯০টি শব্দই ফারসি, উর্দু ও আরবি, এমনকি পাঞ্জাবি ভাষা হতে উদ্ভূত।’
তার এই প্রবল পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ হওয়া উচিত ছিল বাঙালি পণ্ডিতদের থেকে। তা কেউ না করলেও বাংলা ভাষার একজন তরুণ শিক্ষক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রতিবাদ করেন তাঁর এক নিবন্ধে। তিনি বলেন, আমরা জনাব নূন ও তার পেটোয়াদের চ্যালেঞ্জ করছি যে, কোনো মুসলমান ও বিদ্বান বাংলা লেখকের রচনা থেকে অন্তত দশ ভাগ আরবী, ফারসী শব্দ বার করে দিতে। [সাপ্তাহিক যুগের দাবী, ১১ এপ্রিল ১৯৫৩]। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রভাষক। তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘নূন সাহেবের এই অপচেষ্টার সহায়ক হচ্ছে কতকগুলি বিশ্বাসঘাতক ও এঁটো পাতাভোজী মীরজাফর ও মুষ্টিমেয় কয়েকজন ধর্মান্ধ অথচ কাণ্ডজ্ঞানহীন লোক।
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে একাত্তরে পাকিস্তানি আলবদর বাহিনীর হাতে শাহাদাতবরণ করতে হয়।
০৫. সাহিত্যপুরস্কার
অনেক উন্নত দেশেই সাহিত্য একাডেমি, একাডেমি অব লেটার্স, একাডেমি অব সায়েন্সেস প্রভৃতি রয়েছে। সেগুলো সেসব দেশের কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান সরকার শিল্প-সাহিত্যের উন্নয়নের লক্ষ্যে লেখক-বিজ্ঞানী-বুদ্ধিজীবীদের জন্য ওই জাতীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৫৪-র সাধারণ নির্বাচনের আগে এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট যে ২১ দফা অঙ্গীকার করে, তার ১৬ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল : ‘যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলা একাডেমির পুরোনো যে তিনতলা ভবন, যার নাম ‘বর্ধমান হাউস’, সেটি ছিল পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর (তখন বলা হতো প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী) সরকারি বাসভবন। তিনতলাটি তখন ছিল না। ওটি করা হয়েছে আশির দশকে, যখন ভবনটির সংস্কার করা হয়। ওটি মোটেই কোনো বিলাসবহুল বাড়ি নয়; কিন্তু রাজনীতির স্বার্থে বিরোধী নেতারা সেটাকেই ‘বিলাসের বাড়ি’ আখ্যা। দেন। যা হোক, যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ১৯৫৬ র ডিসেম্বরে যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার বাংলা একাডেমি উদ্বোধন করেন। ওই বছর একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন যৌথভাবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ও শহীদ বরকতের মা।
একালে অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হবে, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নেই; জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের দ্বারাই এটি প্রতিষ্ঠিত। বিশেষ করে, তখনকার প্রধান বিরোধী দল বাঙালি জাতীয়তাবাদী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অবদান সবচেয়ে বেশি। তার সঙ্গে ছিলেন বাম-প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর নেতারা।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী যুক্তফ্রন্টের উত্থানে মুসলিম জাতীয়তাবাদী ওরফে পাকিস্তানবাদীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য মহফিল’ নামের একটি সংগঠন ১৯৫৮-র মে মাসে চার-দিনব্যাপী একটি সাহিত্য-সম্মেলনের আয়োজন করে চট্টগ্রামে। তার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন। ওই সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন জনৈক মৌলভী আবদুর রহমান এবং সম্পাদক মৌলভী নূরুল ইসলাম চৌধুরী।