কলকাতায় পূর্ব বাংলার মুসলমানদের কিছু প্রকাশনী সংস্থা ছিল। তাদের মধ্যে আইনুল হক খান ও মোহাম্মদ নাসির আলীর নওরোজ পাবলিশিং হাউস সৃজনশীল বই প্রকাশে উদ্যোগী ছিল। তারা ঢাকায় এসে প্রতিষ্ঠা করেন নওরোজ কিতাবিস্তান। মূল অফিস ও বিক্রয়কেন্দ্র ছিল বাংলাবাজারে। পরে নিউমার্কেটে শাখা খোলা হয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের পরিবেশক ছিল নওরোজ কিতাবিস্তান। নওয়োজ পঞ্চাশের দশকে জসীমউদ্দীনের নির্বাচিত কবিতার সংকলন সুচয়নী, কাজী আবদুল অদুদের নদীবক্ষে, আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ী, আবুল ফজলের জীবন পথের যাত্রী, আবুল কালাম শামসুদ্দীনের ত্রিস্রোতা, অজিত কুমার ঘোষের বঙ্গ সাহিত্যে হাস্যরসের ধারা প্রভৃতি প্রকাশ করে।
আরেকটি মানসম্মত প্রকাশনা সংস্থা ছিল রুহুল আমীন নিজামীর স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স। সেখান থেকে বেরোত বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখকদের বই। ইস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্সের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটকের বইগুলোও ছিল মানসম্মত। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ভাষা ও সাহিত্য, রণেশ দাশগুপ্তের উপন্যাসের শিল্পরূপ, শাহেদ আলীর কৃষ্ণপক্ষ, কাজী আবুল হোসেনের বনজ্যোত্স, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের বাবলা প্রভৃতি ইস্ট বেঙ্গল থেকে প্রকাশিত হয়।
অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন তাঁর নিজের বই প্রকাশের জন্য করেছিলেন হাসি প্রকাশনালয় শান্তিনগরে, লেখক কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ করেছিলেন মৃত্তিকা সাহিত্য সদন নয়াপল্টনে, বোরহান উদ্দীন আহমদ ইস্ট বেঙ্গল বুক সিন্ডিকেট পাটুয়াটুলীতে। কবি আহসান হাবীব করেছিলেন কাঠেরপুল লেনে কথা বিতান।
সেকালের ঢাকার বড় বড় প্রকাশনীর মধ্যে ছিল প্রেসিডেন্ট লাইব্রেরি, আদিল ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ইসলামিয়া লাইব্রেরি, ওসমানীয়া বুক ডিপো, কোহিনূর লাইব্রেরি, প্যারাডাইস লাইব্রেরি, আহমদ পাবলিশিং হাউস, লিয়াকত পাবলিশিং কোম্পানি, সরোজ লাইব্রেরি, পাকিস্তান বুক কর্পোরেশন, সোবহানিয়া লাইব্রেরি কপোতাক্ষী, শ্রাবণী, স্টুডেন্ট ওয়েজ, মোহাম্মদী বুক হাউস, আইডিয়াল পাবলিকেশন্স, মখদুমী অ্যান্ড আহসানউল্লাহ লাইব্রেরি প্রভৃতি। গুলিস্তানে ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। সেখান থেকে ইংরেজি ও বাংলা ভালো ভালো বই প্রকাশিত হতো। কবি মঈনুদ্দীনের যুগস্রষ্টা নজরুল, ইব্রাহীম খাঁর ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র প্রভৃতি অক্সফোর্ড থেকে বের হয়।
যেগুলোর নাম আমি স্মৃতি থেকে উল্লেখ করলাম, তার বাইরে বাংলাবাজার ও নিউমার্কেটে আরও সৃজনশীল প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান ছিল। পাঠ্যবইয়ের প্রকাশনী ছিল বহু– ঢাকা ও অন্য জেলা শহরে। সুতরাং, নিঃসন্দেহে বলা যায়, ষাটের দশকে তো বটেই পঞ্চাশের দশকেই বাংলাদেশে একটি প্রাণবন্ত প্রকাশনী জগৎ গড়ে ওঠে। তারাই আমাদের আজকের আধুনিক প্রকাশনীর অগ্রপথিক। তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
৩১. বাংলাদেশের প্রকাশনাজগৎ ও প্রচ্ছদশিল্প
আমার দুবার নিউইয়র্কে ‘মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট’ বা মোমা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। মোমা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পকলা জাদুঘরের একটি। শ্রেষ্ঠ আধুনিক শিল্পীদের শিল্পকর্ম সেখানে স্থান পেয়েছে। বহুতলবিশিষ্ট ওই জাদুঘর ভবনের সম্ভবত দোতলায় একটি বিভাগ আছে, সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে প্রচ্ছদশিল্প। সেগুলোও দেখেছি। বইয়ের প্রচ্ছদপটও যে শিল্পকর্ম, তা বইটির যারা পাঠক তাঁরাও সহজে খেয়াল করেন না। অবশ্য সব বইয়ের সব প্রচ্ছদই শিল্পকর্ম নয়। কোনো কোনো বইয়ের প্রচ্ছদ, যা বড় শিল্পীদের আঁকা, তা নিঃসন্দেহে শিল্পকর্ম।
বাংলা বইয়ের সমালোচনা ও পুস্তক-পরিচিতি যারা লেখেন পত্র-পত্রিকায়, তাঁরা একটি কথা প্রায়ই বলেন, বইটির প্রচ্ছদপট ও অঙ্গসজ্জা আকর্ষণীয়/আকর্ষণীয় নয়। ছাপা-বাঁধাই সুন্দর/মোটামুটি। এই কথা লেখার অর্থ কী? রচনার বিষয়বস্তুই আসল। কিন্তু বই যেহেতু একটি বস্তু শুধু নয়, একটি পণ্য এবং বেচা-কেনা হয়, তাই ক্রেতাকে আকর্ষণ করতে পারে এমনভাবে পণ্যটিকে পরিবেশন করলে তার উপযোগিতা বেশি।
সৌন্দর্যবোধ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই একটি সুন্দর বস্তু হাতে নিয়ে তার আনন্দ। সে জন্য মনোরম প্রচ্ছদে শোভিত একটি বই পাঠকের মন কাড়ে। বাংলা ভাষার বইপত্রে, বিশেষ করে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটকের বইয়ের প্রচ্ছদ উনিশ শতকে মোটেই আকর্ষণীয় ছিল না। লেটারিং বা অক্ষর সাজিয়েই প্রচ্ছদ করা হতো। কুড়ি শতকের প্রথম দিক থেকেই নোবেল-নাটকের প্রচ্ছদ শিল্পীদের দিয়ে আঁকানো শুরু হয়। প্রথম দিকের গল্প-উপন্যাসের প্রচ্ছদে নারীর ছবি, কখনো নারী-পুরুষের ছবি প্রায় আশি ভাগ ক্ষেত্রে থাকতই।
উনিশ শতকের ক্ল্যাসিক লেখকদের গ্রন্থাবলি প্রায় সবই আমাদের বাড়িতে ছিল। তার মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রমেশচন্দ্র দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের বইয়ের এখনকার মতো হাতে আঁকা প্রচ্ছদ দেখিনি। রবীন্দ্রনাথেরও প্রথম দিকের বইতে অক্ষর বিন্যাস করেই প্রচ্ছদ করা হতো। উনিশ শ বিশের দশক থেকে প্রচ্ছদশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, দোলনচাঁপা প্রভৃতির প্রচ্ছদ হাতে আঁকা বটে, কিন্তু খুব যে আকর্ষণীয়, তা বলা যায় না। নজরুলের অধিকাংশ বইয়ের প্রকাশনা মানসম্মত নয়। শুধু তার গুলবাগিচা বইটি তুলট কাগজে সুন্দর ছাপা।