পঞ্চাশের দশকে আমাদের নিকট ও দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজনের অন্তত জনা পনেরোর ছাপাখানা, বাঁধাইখানা ও প্রকাশনা ব্যবসা ছিল। পঞ্চাশের দশকের প্রথম। দিকে আমি আমার বাবার সঙ্গে চকবাজার, ইসলামপুর, জিন্দাবাহার, তাঁতীবাজার, পাটুয়াটুলী, বাংলাবাজার, পাতলাখান লেন থেকে ফরাশগঞ্জ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রেসে গিয়েছি। ছোট ট্রেডল মেশিন হোক বা ফ্লাট মেশিন হোক, কাগজ ছাপা হতে দেখতে আমার খুব ভালো লাগত। সেখানে অনেক ট্রেডল মেশিন মেশিনম্যান পা দিয়ে চালাতেন। ফ্লাট মেশিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলত, তবে কাগজটা মেশিনম্যান হাতে ধরিয়ে দিতেন। মনোমেশিন ও লাইনো সম্ভবত এখন উঠে গেছে। ওগুলোতে অপারেটর টাইপ করলে মেশিনেই কম্পোজ হয়ে যেত। অফসেট মুদ্রণযন্ত্র অনেক পরে এসেছে।
উনিশ শতকের শেষ ৪০ বছরে ঢাকায় অন্তত ৪০টি ছাপাখানা ছিল। ওইসব ছাপাখানার প্রায় সব কটিই ছিল ছোট, একসঙ্গে ডিমাই আকারের দুই বা চার পৃষ্ঠা ছাপা হতো। পরে একটু বড় প্রেসে একসঙ্গে ডিমাই বা ক্রাউন আকারের আট পৃষ্ঠা পর্যন্ত ছাপা সম্ভব হতো। এক শ সোয়া শ বছর আগের মুদ্রিত বই দেখে এ ধারণা পাওয়া যায়।
যারা বলেন ঢাকায় আগে কিছুই ছিল না, যা হয়েছে সবই একাত্তরের পরে, তাঁদের অবগতির জন্য দেড় শ বছর আগের কয়েকটি ছাপাখানার নাম উল্লেখ করছি। সেকালের ছাপাখানার মালিকেরা ছিলেন একালের চেয়ে অনেক বেশি বাঙালি জাতীয়তাবাদী। তাঁদের ছাপাখানাগুলোর নাম থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
কয়েকটি ছাপাখানার নাম : বাঙ্গালা যন্ত্র, আদর্শ যন্ত্র, সুলভ যন্ত্র, শীতল যন্ত্র, ভারত যন্ত্র, আৰ্য্য যন্ত্র, মোহাম্মদী যন্ত্র, সাঈদী যন্ত্র, গিরিশ যন্ত্র, আজিজিয়া যন্ত্র, গোপীনাথ যন্ত্র, গেন্ডারিয়া যন্ত্র, ইসলামিয়া যন্ত্র, ইস্ট বেঙ্গল যন্ত্র, নূতন যন্ত্র, সুদর্শন যন্ত্র, ওরিয়েন্টাল প্রেস, ভারত সুহৃদ (প্রেস ও প্রকাশনা), আশুতোষ যন্ত্র প্রভৃতি। সেকালে প্রেস না লিখে বলা হতো যন্ত্র।
ঢাকার প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয় ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৬০ সালে স্থাপিত হয় বাঙ্গালা যন্ত্র। এই ছাপাখানা থেকে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও কবি প্রাবন্ধিক হরিশ্চন্দ্র মিত্রের কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটকের অনেকগুলো বই মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। উনিশ শতকের শেষ দিকে ঢাকার প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, দীনবন্ধু মিত্র, হরিশ্চন্দ্র মিত্র, কালীপ্রসন্ন ঘোষ ছিলেন অগ্রগণ্য। বড় প্রকাশকের মধ্যে স্টুডেন্ট লাইব্রেরি, মওলা বক্স, ওয়াহেদ বক্স প্রভৃতির নাম করা যায়। কালীপ্রসন্ন ঘঘাটের ‘অঞ্জলি’ (১৮৯২) কাব্যের প্রকাশক ছিলেন ওয়াহেদ বক্স। তার কয়েকটি প্রবন্ধ গ্রন্থও ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়।
উনিশ শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে ঢাকা থেকে অনেকগুলো ‘উপন্যাস প্রকাশিত হয়, যদি সেগুলোকে আদৌ উপন্যাস বলা যায়। আদিনাথ ঘোষের হেমলতা উপন্যাস বাঙ্গালা যন্ত্র থেকে ১৮৮৪-তে প্রকাশিত হয়। আর্জুমান্দ আলীর প্রেম দর্পণ-এর প্রকাশক ছিলেন গোপীনাথ বসাক, প্রকাশিত হয় ১৮৯১ সালে। হারাণচন্দ্র ঘোষের উপন্যাস সরলা (১৮৭৬) প্রকাশ করেন মওলা বক্স। প্রকাশক সরলা এবং আরও কয়েকটি বইয়ের পেছনে বিজ্ঞাপনে বলেছিলেন : ‘এই সকল পুস্তক ঢাকা পাটুয়াটুলী আমার নিকট তত্ত্ব করিলে প্রাপ্ত হইবেন। ক্রেতাগণ নগদ মূল্যে অধিক পুস্তক ক্রয় করিলে যথেষ্ট কমিশন দেয়া হইবে।’ দেখা যায়, দেড় শ বছর আগেও বেশি টাকার বই কিনলে বেশি পরিমাণ কমিশন দেওয়া হতো।
১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম একটি আলাদা প্রদেশ হলে ঢাকার প্রকাশনাশিল্প বিস্তৃত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিকশিত হতে থাকে। শতাব্দীর প্রথম দিকেই বাংলাবাজার বইয়ের দোকানে ভরে যায়। যদিও তাতে পাঠ্যপুস্তকই বেশি। কলকাতায় যা ছিল কলেজ স্ট্রিট, ঢাকায় তা-ই যেন বাংলাবাজার। কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ, রংপুর প্রভৃতি জেলা শহরেও প্রকাশনী সংস্থা ছিল ‘৪৭-এর আগে।
১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বছর দুইয়ের মধ্যেই ঢাকায় একটি বড় প্রাণবন্ত প্রকাশনাজগৎ গড়ে ওঠে। কলকাতা থেকে বহু মুসলমান ছাপাখানার মালিক ও বই প্রকাশক ঢাকায় এসে নতুন করে নতুন রাষ্ট্রে ব্যবসা শুরু করেন। কয়েকটি বড় আধুনিক প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। পাঠ্যপুস্তক ও সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনায়ও আসে নতুন গতি।
উপনিবেশ-পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিশীল প্রকাশনা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু। এটি ওয়ালীউল্লাহদের পারিবারিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কমরেড পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়। যার ঠিকানা ছিল ৬২, সুভাষ এভেন্যু, ঢাকা। এটি ছাপা হয়েছিল সে সময়ের সবচেয়ে আধুনিক ছাপাখানা নবাবপুরের নারায়ণ মেশিন প্রেস থেকে। তখন ঢাকায় ব্লক তৈরির ভালো কারখানা ছিল না বলে কলকাতা থেকে প্রচ্ছদের ব্লক করে আনা হয়েছিল। ১৯৪৮-এর শেষ দিকে লালসালু প্রকাশিত হয়। তখন ওয়ালীউল্লাহ ঢাকা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের সম্পাদক ছিলেন। তাঁর অগ্রজ সৈয়দ নসরুল্লাহ আমাকে বলেছেন, লালসালু প্রকাশের পর পরই ওয়ালীউল্লাহ করাচি বেতার কেন্দ্রে বদলি হয়ে গেলে তাঁদের কমরেড পাবলিশার্স বন্ধ করে দেওয়া হয়।