স্বাধীনতার পরে নতুন প্রজন্মের প্রকাশক হিসেবে যারা আত্মপ্রকাশ করেন, তাঁদের মধ্যে সাহিত্য প্রকাশের কর্ণধার মফিদুল হক অন্যতম। তিনি নিজেও লেখক। তিনি বের করেন আমার বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ দার্শনিক এবং পথিকৃৎ নারীবাদী খয়রন্নেসা খাতুন। মফিদুল হকের পরিচ্ছন্ন ও রুচিশীল প্রকাশনা। গ্রন্থ প্রকাশই তাঁর একমাত্র কাজ নয়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্যর একাধিক সংস্করণ একাধিক প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে। সর্বশেষ সংস্করণের প্রকাশক বাংলাবাজারের মনন প্রকাশ-এর শাহ আল মামুন। মনন থেকে আমার আরও বই বেরিয়েছে। তার মধ্যে আমার কিছু কলামের সংগ্রহ সহজিয়া কড়চাও রয়েছে।
আমার ভারতের প্রকাশক কলকাতার নয়া উদ্যোগ-এর পার্থশঙ্কর বসু। তিনি নোয়াখালীর গান্ধী মিশন ডায়েরি প্রকাশ করেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস সমগ্রও নয়া উদ্যোগ থেকে বেরিয়েছে, যার দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছি আমি। পার্থবাবুর সঙ্গেও আমার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব।
গত ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ বিকশিত হয়েছে। এই সময় নতুন নতুন প্রকাশনা সংস্থার আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক, একুশ শতকের মানসম্পন্ন বই প্রকাশের আগ্রহ তাদের। নতুন লেখকদের অপরিণত রচনা যেমন কিছু তাঁরা প্রকাশ করেছেন, অন্যদিকে উন্নতমানের গুরুত্বপূর্ণ বহু বইও তারা বের করছেন। বছর সাতেক আগে যাত্রা শুরু করে প্রথমা প্রকাশন। তাদের অঙ্গীকার মানসম্মত বই রুচিশীলভাবে প্রকাশ করা। বিষয়বস্তু নির্বাচনেও তারা সতর্ক। সৃষ্টিশীল ও মননশীল দুই ধরনের বইই তাঁরা বের করেছেন। প্রথমার কর্ণধার মতিউর রহমান ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে প্রকাশনায় যাননি, যদিও মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করে তিনি ব্যবসাসফলও বটে। আমার নির্বাচিত সহজিয়া কড়চা, অরণ্য বেতার, ঢাকার বুদ্ধদেব বসু, রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন এবং স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বের হয়েছে প্রথমা থেকে। এই ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা। ছাপা, অঙ্গসজ্জা, বাঁধাই প্রভৃতি ব্যাপারে যত্নের পরিচয় সর্বত্র। লেখক হিসেবে সেটা আমার তৃপ্তির বিষয়। প্রথমা থেকে বেরিয়েছে আমার স্যার ফিলিপ হার্টগ এবং কাগমারী সম্মেলন।
ষাটের দশকের শুরুতে একটি রুচিশীল প্রকাশনা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মওলা ব্রাদার্স। তার প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ আতিকুল মওলা ছিলেন বিশিষ্ট ভদ্রলোক। আমার সঙ্গেও তাঁর খুব আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। অপেক্ষাকৃত কম বয়সেই তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর আহমেদ মাহমুদুল হক প্রতিষ্ঠানকে আরও বড় করেন। আমার পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মওলা ব্রাদার্স প্রকাশ করেছে। চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন। কাইয়ুম চৌধুরী।
প্রকাশনাজগৎ বড় হচ্ছে আকারে, গুণগত মানও বাড়ছে, কিন্তু আমাদের প্রকাশকদের মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব। লেখকের সঙ্গে চুক্তি করেন না। রয়্যালটির টাকা ঠিকমতো পরিশোধ করতে গড়িমসি করেন। অনেক ক্ষেত্রে লেখক প্রতারিত হন। কত কপি ছাপাচ্ছেন তা পরিষ্কার করে বলেন না। স্বচ্ছতার অভাব। সকলে নয়া অধিকাংশেরই এই প্রবণতা। এককালে কলকাতার বইতে প্রিন্টার্স লাইনে লেখা থাকত মোট কত কপি ছাড়া হলো। যেমন প্রথম সংস্কারণে ২২৫০ কপি বা ১১৫০ কপি। দ্বিতীয় মুদ্রণ ১২৫০ কপি। নওরোজের নাসির আলী করতেন এবং বর্তমানে প্রথমা প্রকাশনা থেকে মতিউর রহমান নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লেখকের সঙ্গে বই প্রকাশের আগে চুক্তি করেন। রয়্যালটির টাকা চাইতে হয় না, ৩০ চৈত্রের মধ্যে লেখককে পৌঁছে দেওয়া হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে অসচ্ছতা ও অসাধুতা খুব বড় অপরাধী।
বাংলাদেশে আজ সারা বছর ছোট-বড় গ্রন্থমেলা হয় ঢাকায় ও অন্যান্য মফস্বল শহরে। পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ী গ্রন্থমেলা ‘অমর একুশের গ্রন্থমেলা’ মাসব্যাপী হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে। এ এক প্রকাণ্ড সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ ও জাতির বৃহত্তম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বইমেলা লেখক ও প্রকাশকদের ব্যাপার। লেখক ও প্রকাশকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া প্রকাশনাশিল্প ও গ্রন্থজগৎ বিকশিত হতে পারে না। লেখকের কাছে তাঁর বইয়ের প্রকাশক শুধু একজন ব্যবসায়ী নন, প্রকাশক তাঁর বন্ধু ও সহযোগী। লেখক-প্রকাশকের সমন্বিত সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হবে, সাহিত্যের জগৎ তত সমৃদ্ধ হবে।
একুশের বইমেলায় শুধু লেখক-প্রকাশকের সম্পর্ক নয়, লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদশিল্পী এবং পাঠকের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ ঘটে। মতবিনিময় হয়। সাহিত্যজগতের জন্য এর প্রভাব ইতিবাচক। আমাদের পেশাদার ও অপেশাদার প্রকাশকদের অনেকের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠায় গ্রন্থজগৎ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। তবে এ শিল্পকে আরও শক্তিশালী করতে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে লেখক, প্রকাশক ও সরকারকে একত্রে বসে আলোচনা করে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০টি ভাষার একটি। একজন লেখক হিসেবে চাইব একদিন বাংলা সাহিত্যও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০টি সাহিত্যের মধ্যে গণ্য হবে।
৩০. পথিকৃৎ প্রকাশক
আমাদের সাহিত্যসমাজে এ রকম একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ বলে তেমন কিছু ছিল না। বিশেষ করে, ১৯৪৭ এর আগে তো কিছুই ছিল না। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ১৯৫০ থেকে ‘৭১ পর্যন্ত দুই দশকে বাংলাদেশে একটি ভালো প্রকাশনা জগৎ গড়ে ওঠে। শুধু তা-ই নয়, বর্তমান। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে মুদ্রণ ও প্রকাশনার সূচনা দেড় শ বছর আগে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। তবে সেই প্রকাশনা জগৎ কলকাতার মতো সমৃদ্ধ ছিল না। কলকাতার পুস্তক প্রকাশনার বয়স আরও ৫০ বছর বেশি। তা ছাড়া যেহেতু কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী, তাই সরকারি প্রয়োজনে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় আধুনিক মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্প বিকশিত হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ। পূর্ববঙ্গের ঢাকা নগরী কলকাতার থেকে কয়েক শতাব্দী পুরোনো হওয়া সত্ত্বেও ছিল অবহেলিত এবং সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত। দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকা সব কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হতো বড় বড় ছাপাখানা থেকে। গুরুত্বপূর্ণ বইপত্রও বের হতে থাকে আধুনিক প্রেস থেকে। সেসব বইপত্রের ছাপা-বাঁধাই ছিল আন্তর্জাতিক মানসম্মত। বাস্তব কারণেই ঢাকার প্রথম ৫০-৬০ বছরের প্রকাশনার মান উন্নত ছিল না।