আমার নিজের প্রকাশক-ভাগ্য মন্দ নয়। আমার জার্মানির জার্নাল বইটির প্রথম সংস্করণ আমি নিজের টাকায় করেছিলাম। প্রচ্ছদ করেছিলেন সৈয়দ লুফুল হক। ছাপা-বাঁধাই বিশেষ ভালো হয়নি। বইটি কিঞ্চিৎ জনপ্রিয় হওয়ায়, প্রথম সংস্করণের বারো শর মতো কপি কয়েক মাসে শেষ হয়ে যাওয়ায়, দ্বিতীয় সংস্করণ– সামান্য পরিবর্ধিত সংস্করণ–কন্টিনেন্টাল পাবলিশার্স নামক এক নতুন প্রকাশক বের করেন। দ্বিতীয় সংস্করণের প্রচ্ছদ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। প্রচ্ছদটি ছিল ভিন্ন ধরনের চমৎকার কাজ। এ সংস্করণ আরও তাড়াতাড়ি শেষ হয়। তখন কয়েকজন বিশিষ্ট প্রকাশক ভ্রমণকাহিনিটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের আগ্রহ দেখান। মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা আমাকে অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ এক চিঠি দিয়ে বইটি তাকে দিতে অনুরোধ জানান। তাঁকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তাঁর দাবি উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তৃতীয় সংস্করণের পর থেকে যত মুদ্রণ হয়েছে, সবই মুক্তধারা থেকে বেরিয়েছে কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদসহ। আমার প্রথম প্রবন্ধের সংকলন যুদ্ধ ও মানুষের মূর্খতা-ও মুক্তধারা প্রকাশ করে চিত্তরঞ্জন সাহার আগ্রহে। আমার রবীন্দ্ররাজনীতি নামে একটি বইয়েরও প্রকাশক মুক্তধারা। প্রতিটি নতুন বই বেরোলে বা নতুন সংস্করণ হলে চিত্তদা সৌজন্য কপির সঙ্গে আমার জন্য মিষ্টি ও ফলমূল পাঠাতেন।
আমি খুবই বিরলপ্রজ কবি, তিন মাসে ছয় লাইন লিখি। আমার রাশি রাশি গদ্য লেখার ভিড়ে সেই পদ্য খুব কম পাঠকের চোখেই পড়ে। তবে আমার বিরল সৌভাগ্য যে বাংলাদেশের সেরা কবিরা আমার কবিসত্তাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ তাঁদের সম্পাদিত সাময়িকীতে খুব গুরুত্ব দিয়ে একসময় আমার কবিতা প্রকাশ করেছেন। শামসুর রাহমান ও মান্নান সৈয়দের আগ্রহে প্রকাশিত হয়। আমার প্রথম কবিতার বই বিকেলবেলা। নামটি তাঁদের দুজনেরই খুব পছন্দ হয়। বিকেলবেলা বিষয়টির সঙ্গে অর্থবহ অসামান্য প্রচ্ছদ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। তখন কম্পিউটার আসেনি, সুতরাং হাতে আঁকা শিল্পকর্ম। তখন নিউমার্কেটের বিখ্যাত বইয়ের দোকান ছিল ‘নলেজ হোম’। তার মালিক এ এম খান মজলিশ ছিলেন খুবই সজ্জন-ভদ্রলোক। সেখানে প্রতিদিনই রাত নয়টা পর্যন্ত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা হতো। নলেজ হোম বের করেছিল বিকেলবেলা। ছয় শ পঞ্চাশ কপি ছেপেছিল। তা বিক্রি হতে তিন-চার বছর লেগেছে। প্রকাশকের জন্য আমার কষ্ট হয়। তারপরও খান মজলিশ সাহেব একদিন আমাকে একটি খামে পুরে চার শ টাকা দিলেন। আমার প্রয়োজন ছিল বলে টাকাটা আমি নিই, তবে না নেওয়াই উচিত ছিল। আমার বই প্রকাশিত হওয়ায় আমি নাম করেছিলাম; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন প্রকাশক। আমার দ্বিতীয় কবিতার বই দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা প্রকাশিত হয় স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে। প্রকাশক মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ। তিনিও খুবই ভালো মানুষ। অত্যন্ত ভদ্র-নম্র। এই বইয়েরও একরঙা প্রচ্ছদ করেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী।
উনিশ শতকের কবি গোবিন্দচন্দ্র দাসের ওপর আমার দুটি বই : গোবিন্দচন্দ্র দাসের ঘর-গেরস্থালি এবং গোবিন্দচন্দ্র দাস। প্রথমটির প্রকাশক ছিলেন নতুন, দ্বিতীয়টির প্রকাশক বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি রয়্যালিটির টাকাটা একবারেই দিয়ে দেয়। আমার মওলানা ভাসানীর প্রামাণ্য জীবনী মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রকাশকও বাংলা একাডেমি। প্রায় হাজার পৃষ্ঠার ওই বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে হাক্কানী পাবলিশার্স। হাক্কানীর স্বত্বাধিকারী গোলাম মোস্তফা বের করেন আমার আরও বই। তার মধ্যে প্রবন্ধ সংকলন বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও রয়েছে। হাক্কানীর অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর তৃতীয় সংস্করণ বের করেন ওসমান গনি তাঁর আগামী প্রকাশনী থেকে। আগামী আমার আরও বই প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে রয়েছে ভাসানী কাহিনী এবং সৈয়দ আবুল মকসুদের কবিতা। আমার আরও কয়েকটি বই তাঁর প্রকাশনী থেকে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। দেরি হচ্ছে আমার কারণেই।
একজন প্রকাশকের কথা আমার মনে পড়ে। তিনি নওরোজ কিতাবিস্তানের আবদুল কাদির খান। তিনি প্রকাশ করেছিলেন আমার গবেষণাগ্রন্থ হরিশ্চন্দ্র মিত্র-ঢাকার সাহিত্য ও সংবাদপত্রের পথিকৃৎ। এটির অর্থবহ প্রচ্ছদ করেছিলেন খ্যাতিমান শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী। বইটি দুই বাংলায়ই প্রশংসিত হয়েছিল একটি অনুসন্ধানী কাজ হিসেবে। গবেষক অধ্যাপক অরবিন্দ পোদ্দার, ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে, প্রাবন্ধিক শিবনারায়ণ রায় প্রমুখ তারিফ করে লিখেছিলেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকার অন্যতম প্রধান প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান ছিল নওরোজ কিতাবিস্তান। শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক মোহাম্মদ নাসির আলী ছিলেন তার অন্যতম মালিক। দুটি শাখা ছিল, একটি বাংলাবাজারে, অন্যটি নিউমার্কেটে। কাদির খান দুই জায়গাই বসতেন। রয়্যালিটির টাকা পরিশোধে তাঁর কার্পণ্য ছিল না।
একসময় আহমদ পাবলিশিং হাউস ছিল বড় প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকেও আমার কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণকাহিনি পারস্যের পত্রাবলি এবং প্রবন্ধসংকলন চিন্তা ও চেতনা। সত্তরের দশক থেকে মেছবাহউদ্দীন আহমদ তাঁর বাবার কাজ দেখাশোনা করতেন। লেখকদের সঙ্গে তাঁদেরও সম্পর্ক ছিল বিশেষ আন্তরিকতাপূর্ণ। জিন্দাবাহার ছিল আহমদ পাবলিশিংয়ের প্রধান কার্যালয়।