খোদেজা খাতুনের এক ভাই কে এম শমসের আলী কবি হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। তিনিও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন, তাঁরও রয়েছে অনেকগুলো কবিতার বই : আলিঙ্গন (১৯৩৩), সাক্ষর (১৯৪৯), সুরের মায়া (১৯৪৭), রসনার কবি (১৯৬১) প্রভৃতি।
খোদেজা খাতুনের গদ্য কবিত্বময়। স্বাধীনতার আগে আমরা তাঁকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পেয়েছি। স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন তিনি। তিরিশের দশকে ইডেন কলেজের ৩৬ জন ছাত্রীর মধ্যে মুসলমান মেয়ে ছিলেন চারজন। তাঁদের একজন। তিনি, আর একজন দর্শনের অধ্যাপিকা আখতার ইমাম।
তাঁর কবিতার বই বেদনার এই বালুচরে (১৯৬৩), গল্পগ্রন্থ সাগরিকা (১৯৫৯), রূপকথার রাজ্যে (১৯৬৩), শেষ প্রহরের আলো (১৯৬৯) প্রভৃতি এবং প্রবন্ধগ্রন্থ সাহিত্য ভাবনা প্রভৃতি। তাঁর একটি রম্যরচনা গ্রন্থের নাম অরণ্য মঞ্জুরী (১৯৭১)।
তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ নম্বর বাংলোর আবাসিক ছাত্রী ছিলেন। তাঁর ভাষায় :
‘১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ সন পর্যন্ত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন যাপন করেছি। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত কাটিয়েছি ওই বাংলোতে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা, বিশেষ করে আবাসিক ছাত্রী সংখ্যা এতই নগণ্য ছিল যে, কেবলই ছাত্রীদের জন্য কোন আবাসিক হল ছিল না। তখন ছাত্রদের জন্য মাত্র তিনটি হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হল তিনটির নাম ছিল ঢাকা হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও জগন্নাথ হল। ছাত্রীরা নিজেদের সুবিধামতো যে কোন হল-এ সংযুক্ত হতে পারত। আবাসিক ছাত্রীদের বেলায়ও তাই, তবে তারা অবস্থান করত ওই দশ নম্বর বাংলোতে, যার নাম ছিল ইউনির্ভাসিটি উইমেন্স রেসিডেন্স। তখন আবাসিক ছাত্রী সংখ্যা ছিল আট জন; পরে হয়েছিল বারো জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি ক্লাসে সর্বমোট পঞ্চাশ জনেরও কম ছাত্রী পড়ত।
‘দশ নম্বর বাংলো অর্থাৎ ঢাকা ইউনির্ভাসিটি উইমেন্স রেসিডেন্স ছিল তৎকালীন একমাত্র বিখ্যাত ছাত্রীনিবাস, যাকে অনেকেই বলত সাইনোসিওর অব অল আইজ। ওই বাড়ি সম্বন্ধে এই মন্তব্যটি অন্তত তখনকার দিনে খুব চালু ছিল। মনোরম ভঙ্গিতে তৈরি ছিল সেই বিল্ডিং। ভারি চমৎকার ছিল তার পরিবেশ। ব্রিটিশ আমলে সাহেবদের থাকবার জন্য তৈরি হয়েছিল এই সুদৃশ্য বাংলো। অট্টালিকার ভেতরে দু’পাশে দুটো ফায়ার প্লেস এবং তার উপর দিয়ে ছাদের উপর পর্যন্ত দুটো চিমনি ছিল বিলাতি প্যাটার্নে। বাংলোতে সম্মুখভাবে লম্বা বারান্দার দু’পাশে বৃত্তাকার বরান্দা ঘিরে সবুজলতার নীল ফুল ফুটে থাকত, ফুলসমেত হালতার টব ঝুলানো ছিল। বিরাট এলাকাজুড়ে ছিল দশ নম্বর বাংলোর চৌহদ্দি প্রাচীর। প্রাচীরের পাশে সমান্তরালভাবে ছিল দীর্ঘকায় বিলাতি পাম-ট্রি; সকালের রোদ তার মাথায় চিকন মসৃণ পাতায় পাতায় পড়ে ঝিকমিক করত। সামনের কাঁটাতারের বেড়া ঘিরে ছিল ঝুমকোলতা আর মেহেদির বেড়া। কাঁটাতারের বেড়ার দু’প্রান্তে দুটি বড় গেট। বাড়িটির একপাশে ছিল অশোক, বকুল, শিরীষ, চেরি আর কৃষ্ণচূড়ার বড় বড় গাছ, ফুল ফোঁটার সময় এলে তাদের দিক থেকে চোখ ফেরানো যেত না। অন্য পাশে ছিল কাঠবাদাম, কুল, তেঁতুল আর জারুল গাছ। পেছনে কিচেন হাউস আর সারভেন্টস কোয়াটারস ছিল। সামনে বিরাট লন। অর্ধচন্দ্রাকার পিচঢাকা রাস্তা। বাংলোর সম্মুখভাগ দিয়ে ইন ও আউট দু’ধারের দু’গেটে শেষ হয়েছে। এই রাস্তার দুপাশ দিয়ে অজস্র ফুলের সমারোহ নিয়ে ফুলগাছিগুলো সবাইকে যেন স্বাগত জানাত ফোঁটা ফুলের হাসিমুখ বাড়িয়ে। মালী নমি সমস্ত দিন ফুলগাছগুলোর যত্ন নিত। শীতের বিকালের মরসুমি ফুলের এবং অন্যান্য ফুলের সুরভিত স্মৃতি এখনও সুদূর থেকে অনেক স্মৃতির সঙ্গে বিজড়িত হয়ে ভেসে এসে মনকে আকুল করে। রঙবেরঙের ডালিয়া, এস্টার, পপি, হলিহকস, ক্রিসেনথিমাম, টিউলিপ, কর্নফ্লাওয়ার, সূর্যমুখী, অপরাজিতা, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ দেশি-বিদেশি আরও কত কী ফুল; সেসব ফুলে ঘেরা সেই কমনীয় দিনগুলো দশ নম্বর বাংলোসমেত কোথায় গেল? জীবনের তারুণ্যের দিন, বসন্তের দিন, সৌন্দর্যের দিন, আনন্দের দিনগুলো যে এভাবেই কেটেছে। এই শহরের আকাশে বাতাসে সেদিন রঙধনুর রঙ ছড়ানো ছিল। শত শত সূর্য উদয়ের পথে ছড়িয়ে ছিল আশার আলোর ফুলঝুরি। তাই এক সূক্ষ বেদনাবোধের আবেগে বলতে ইচ্ছে হয়, “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না, রইল না, সেই যে আমার নানারঙের দিনগুলি!”…
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই ছিল দশ নম্বর বাংলো। প্রায় সময়ই ক্লাসের ঘণ্টা শুনে তবে আমরা ক্লাসে ছুটতাম বাংলো থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাড়িতে সে সময় ছিলেন মরহুম মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রতি ঈদপর্বে ড. শহীদুল্লাহ, ড. হাসান, ড. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং আরও অনেক শ্রদ্ধেয় প্রফেসর আবাসিক ছাত্রীদের সাদর আমন্ত্রণ জানাতেন। সেই সব স্নেহসিঞ্চিত মুহূর্তগুলো জীবনের অক্ষয় সম্পদ।
[স্মৃতিময় এসএম হল, সলিমুল্লাহ হল, প্রাক্তন ছাত্র সমিতি পুনর্মিলনী, ২০০৩ স্মরণিকা]।
ষাটের দশকে শিক্ষকতায় আসেন অনেক নারী। স্কুলগুলোতে তো ছিলই, বিভিন্ন সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও আধ্যাপিকা ছিলেন কেউ কেউ। তাঁরা ছিলেন প্রগতিবাদী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপিকা আখতার ইমাম ছিলেন সবার শ্রদ্ধার মানুষ। ইংরেজি, বাংলায় দর্শন বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতেন। তাঁর প্রকাশিত বইও রয়েছে দর্শন বিষয়ে।
২৯. লেখক ও প্রকাশক
কোনো বইয়ের পাঠকের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু লেখকের, বইটির প্রকাশক ও মুদ্রক থাকেন আড়ালে। কিন্তু বস্তুতপক্ষে কোনো বইয়ের লেখকের সঙ্গে প্রকাশকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটি ভালো বই পাঠকের হাতে স্যুচারুরূপে পৌঁছে দিতে মুদ্রক ও প্রকাশকের অবদান যে কত বড়, তা খুব কম পাঠকই বইটি পড়ার সময় বিবেচনা করে থাকেন। কোনো লেখকের প্রকাশক-ভাগ্য ভালো হওয়াটাও নিয়তির কথা। খুব বড় লেখকও প্রথম জীবনে যোগ্য প্রকাশকের থেকে অবহেলা পান। সেটা দুঃখজনক কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। প্রকাশককে আর্থিক ঝুঁকি নিতে হয়। যেখানে অর্থনৈতিক ঝুঁকির প্রশ্ন, সেখানে সতর্কতা অবলম্বন না করে উপায় নেই।