‘আমার মায়ের অনেক বই ছিল। আমি চুপি চুপি সেইসব বই পড়তাম। তা থেকেই আমি জীবন ও প্রেম সম্পর্কে সচেতন হই। বাবার একজন হিন্দু কেরানি আমাকে খোকাখুকু ও শিশুসাথীর গ্রাহক করে দেন। আমার কবিতা লেখার পেছনে বাবার প্রেরণা ছিল।
‘বাবার বদলির চাকরির জন্য কোনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারতাম না। তাই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেছি। রাজশাহী এসে মিশন স্কুলে ভর্তি হলাম, তখন মেমসাহেবের সংস্পর্শে এসে আমার মনে অনেক আধুনিক চিন্তাধারার সৃষ্টি হয়। বাড়িতে তখন ভীষণ কড়া পর্দা। আমার বড় বোনকে স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে পর্দায় আব্রু করা হয়েছে। আমার বেলা সেটা সম্ভব হতে দেইনি।
‘শুরুতে আমি কেবল কবিতাই লিখতাম না, শান্তি, দীপক ও সবুজ বাংলা প্রভৃতি পত্রিকায় আমার বেশ কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে।
‘দেশ বিভাগের পূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মানসী ও মর্মবাণী, উদয়ন, বসুমতি, প্রদীপ, কিষাণ, অগ্রগতি, সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, আজকাল, দীপালি, জয়ন্তী, বঙ্গলক্ষ্মী, উত্তরায়ণ, গুলিস্তান, যুগান্তর, মোয়াজ্জিন, আনন্দবাজার [পত্রিকা], বেগম, নবশক্তি, নবযুগ, স্বাধীনতা, নায়ক, সত্যযুগ, পুষ্পপত্র ইত্যাদি পত্রিকায় আমার লেখা বের হয়েছে।’
মাহমুদা খাতুন ছিলেন অতি শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু ভেতরে তিনি ছিলেন দ্রোহী। সমাজে প্রচলিত নারীর অবরোধ প্রথা তিনি মেনে নেননি। অল্প বয়সেই বেরিয়ে আসেন তিনি সেই কারাগার থেকে। সাহস করে যোগাযোগ স্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামের সঙ্গে। দুই শ্রেষ্ঠ কবির আশীর্বাদ ও অনুপ্রেরণা তিনি পান। পরিচয়-এ প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে সিদ্দিকা রবীন্দ্রনাথকে একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন, প্রাপ্তি স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লেখেন :
কল্যাণীয়াসু,
আমার শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত এবং দুর্বল। যথাসাধ্য সকল কাজ থেকে নিষ্কৃতি নেওয়ার চেষ্টা করছি।
তোমার কবিতাটি পরিচয়-এর সম্পাদকের কাছে পাঠাই, আশা করি তারা ছাপাবেন, কিন্তু সম্পাদকীয় বিচারবুদ্ধির ওপর আমার কোনো হাত নেই এ কথা নিশ্চিত জেনো। দেখেছি তারা অনেক সময় অনেকের ভালো লেখাকেও বর্জন করে।থাকেন; তার পরিচয় পেয়েছি।
ইতি ৩ আশ্বিন, ১৩৪২ শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গিয়ে দেখাও করেন। সে কথা তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন :
‘… বিশ্বকবির পায়ে হাত দিয়ে সেলাম করলাম। আমি সেলাম করে উঠলে দুহাত ঊর্ধ্বে তুলে চোখ বন্ধ করে বহুক্ষণ ধরে কি প্রার্থনা সারলেন। আমি অবাক হয়ে দেখছি তাঁর সর্বদেহ থেকে আলোক বিকিরণ হতে লাগলো। তার পরে তিনি পাশে বসিয়ে গল্প করতে আরম্ভ করলেন, “তোমরা যে পর্দা থেকে বাইরে এসেছ এই আমি আশ্চর্য হয়েছি। দ্যাখো সূর্যের কিরণ না পেলে যেমন গাছপালা বড় হয় না, ফল-ফুল ভালো দেয় না, মানুষও তেমনি বাইরের আলো-বাতাস ছাড়া পূর্ণ হতে পারে না। পদ্ম পঙ্ক থেকে ঊর্ধ্বে উঠেই সূর্যের কিরণ লাভ করে, না হলে সে লাভ করতে পারত না। আর এখানেই তার সার্থকতা।”
নাসিরউদ্দিন লিখেছেন, ‘বাল্যকালে কবির বিবাহ হয় কিন্তু তার বিবাহিত জীবন খুব স্বল্পকাল স্থায়ী। তিনি স্বামীগৃহে যাননি, বিবাহিত জীবন উপভোগ করেননি। সকলে তাঁকে চিরকুমারী বলেই জানে। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা তাঁর পিতার সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন।’
সিদ্দিকা ছিলেন সমাজসচেতন রোমান্টিক কবি। ১৯৩০ সালে সওগাত-এ প্রকাশিত একটি কবিতায় তিনি বলেন :
বসন্ত উৎসব আজ হয়ে গেছে শেষ
পড়ে আছে বাসি ফুল-মালা,
রিক্ত ভূষা উদাসিনী ধরণীর বুকে
জাগে শুধু বুক ভরা জ্বালা।
[বসন্ত বিদায়]
১৯৬০-এ প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই মন ও মৃত্তিকা। ওই কাব্য সম্পর্কে কলকাতার দেশ লিখেছিল :
‘কবিতাগুলির শীতল স্বভাব, ছন্দের কোমল মাধুর্য মনকে পরিষ্কৃত করে, বক্তব্যে কোথাও অস্পষ্টতা নেই। স্বচ্ছ, সুন্দর একটি ভাবাবেশ প্রতিটি কবিতায় পরিব্যাপ্ত।’
সংগ্রামী মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে সিদ্দিকার কোনো কোনো কবিতায় :
রাজপথ বেয়ে চলে উদ্দাম মিছিল
হৃদয়ে হৃদয়ে তার পদধ্বনি বাজে।
বাঁচার মতো বেঁচে ওঠো,
মানুষের অধিকার মানুষের দাবি
সবচেয়ে বড়।
বাংলাদেশে অনেক সামান্য মানুষের, যাদের তেমন কোনো ঐতিহাসিক ভূমিকা নেই, জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী ঘটা করে পালিত হয়। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার যদি থাকত সুযোগ্য ও বিত্তবান ছেলেমেয়ে, তাহলে তিনি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতেন না। তাঁর তৃতীয় কবিতার বই অরণ্যের সুর প্রকাশিত হয় ১৯৬৩-তে। শুধু কাব্যচর্চা নয়, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করতেও তিনি সমাজসেবামূলক কাজ করতেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি ছিলেন ঢাকার শ্রদ্ধেয়া মহিলাদের একজন।
প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত মুসলমান নারী কবি-সাহিত্যিক পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিলেন অল্প কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন খোদেজা খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলায় মাস্টার্স, খোদেজা খাতুনের জন্ম ১৯১৭ র ১৫ আগস্ট, মৃত্যু ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০। কর্মজীবনের শুরু বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে, শেষ জীবনে ছিলেন রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ এবং ইডেন গার্লস কলেজের অধ্যক্ষা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি বিভিন্ন সাহিত্য সংস্কৃতি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রথম জীবনে কবিতার চর্চাও করেছেন, তবে তিনি ছিলেন মূলত গদ্যলেখক, ১৯৭৭ থেকে ৮৫ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সভানেত্রী।