‘আইজ দিনভোর মায়ে আমারে ঘরে বন্ধ কইরা রাখছিল বুজী।
‘কেন রে?
‘মুখ নীচু করে লোটন বলল, তোমার কাছে আইতে দিব না তাই। সহালে ইসকুলে তাই আইতে পারি নাই বুজী।’
দৌলতন নেছা কতটা নারী প্রগতিবাদী ছিলেন, তা তাঁর আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগের একটি লেখা থেকে বোঝা যায়। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে তিনি লিখেছিলেন :
‘চিরকালই দেখা গেছে ধর্মের অনুশাসনের নামে মানুষকে যত সহজে অবনমিত করা যায় আর কোন শক্তি তা পারে না। তাই দেখা গেছে ধর্মের নামে ও ধর্মের দোহাই দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধর্মের বুকে এমন অনেক জিনিস জমা হয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অঙ্গ নয়। হয়ত কোন প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি করেছে মানুষকে আয়ত্তে রাখার জন্য অথবা কোন সমষ্টিগত শক্তি করেছে নিজেদের ক্ষমতাকে সমাজের বুকে কায়েমী রাখার জন্য।
‘পাশ্চাত্য দেশের নারী আন্দোলনের ধারাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে আমাদের দেশের নারী আন্দোলনের গতিও একই ধারায় পরিণতির পথে এগিয়ে, চলেছে। সময়ের পার্থক্য আছে কিন্তু গতির পার্থক্য নাই। আমাদের দেশেও ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষ নারী জাতির অগ্রসরণের পথে বার বার বাধা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তবুও সমস্ত বাধা-বিপত্তি ঠেলে নারীর অগ্রসরণ অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। যদিও এখনও করবার রয়েছে তাঁদের আরও অনেক।
‘এই সেদিনও ভারতে ধর্মের অনুশাসন থেকে হিন্দু মেয়েদের রক্ষা করে সামাজিক অধিকার প্রদান করল রাষ্ট্র–মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার ও বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দিয়ে।
‘মুসলিম সমাজে এখনও বহু প্রকার আইন আছে যা ধর্মের অনুশাসন থেকে মুক্তি পেয়ে রাষ্ট্রের আওতায় আসা দরকার। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় পুরুষের বহুবিবাহ রদ। নারীর পক্ষ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার ইত্যাদি।
‘আজ মুসলিম নারী সমাজকে এইসব অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্যোগী হয়ে নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে।’
[‘পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলনের গতি’]
দৌলতন নেছার উপন্যাস, ছোটোগল্প ও প্রবন্ধ নিবন্ধের বইগুলোর মধ্যে রয়েছে বধূর লাগিয়া, নাসিমা ক্লিনিক, করমপুরের ছোট বউ, সমাজকল্যাণ প্রভৃতি। সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ১৯৭৭ সালে ‘নূরুন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী স্বর্ণপদক’ দেওয়া হয়।
দৌলতন নেছার সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রজন্মের অনেক নারী সাহিত্যচর্চা ও সমাজসেবা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁদের কারও থেকে তাঁর অবদান কম নয়। নানা কারণে তিনি আজ বিস্মৃত। বাংলা একাডেমির সংক্ষিপ্ত জীবনীমালা সিরিজে দৌলতন নেছা খাতুনের একটি জীবনী প্রকাশিত হয়েছে বেশ আগে। লিখেছেন গোলাম কিবরিয়া পিনু, যিনি তাঁরই এলাকা গাইবান্ধার মানুষ। পথনির্মাতাদের ভুলে যাওয়া ভালো না। ১৯৯৭ সালের ৪ আগস্ট দৌলতন নেছা মারা যান।
২৮. মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগস্ট, জাতীয় দিবস ২৩ মার্চ, একুশে ফেব্রুয়ারি, জিন্নাহর জন্ম-মৃত্যুদিন প্রভৃতি উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। আজিমপুর কলোনির সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, আজিমপুর লেডিস ক্লাব, কিংবা বাংলা একাডেমি বা পাকিস্তান কাউন্সিলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তিও হতো। তাতে একজন স্বনামধন্য কবির উপস্থিতি ছিল অবধারিত। হালকা মোটাসোটা, বেঁটে খাটো ওই মহিলা কবির নাম মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। তাঁর কাঁধে থাকত ঝোলানো একটি কাপড়ের ব্যাগ। তাতে দু-চারখানা বই বা খাতা। তার মুখে স্মিত হাসি। কথাবার্তায় গভীর মমতা। তিনি ছিলেন মৃদু হাস্যরসিক। এক মমতাময়ী মাতৃমূর্তি। প্রবীণদের তিনি ছিলেন আপা এবং আমাদের বয়েসী তরুণদের তিনি ছিলেন সবারই খালাম্মা। ষাটের দশক পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ও খ্যাতিমান মহিলা কবি। স্বাধীনতার পরে তিনি আড়ালে চলে যান। সমাদর ছিল না বলে জীবনের শেষ আট-দশ বছর তিনি সভা-সমাবেশে আসতেন না। ১৯৭৭ সালে তিনি নীরবে নিভৃতে ৭১ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
১৯৩০-এর দশকের শুরুতে কবি হিসেবে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার আত্মপ্রকাশ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পসারিনী প্রকাশিত হয় ১৯৩২-এ। এই বই সম্পর্কে সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের মন্তব্য : বাংলা ভাষায় মুসলিম (মহিলা) কবির ইহাই প্রথম প্রকাশিত আধুনিক কবিতার বই। এতে তিনি প্রকৃতি, প্রেম ও বিরহ নিয়ে কতকগুলো কবিতা লিখেছেন।’
প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাননি সিদ্দিকা। বাড়িতেই উচ্চশিক্ষিত বাবার কাছে এবং গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠ নিয়েছেন। আর পাঠ নিয়েছেন তিনি প্রকৃতি থেকে। মাহমুদা খাতুন তার আত্মকথায় লিখেছেন :
‘আমি যখন মিশন স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ি, সেই সময় কবিতা লিখতে শুরু করি। বারো কি তেরো বছর বয়সে আমার প্রথম কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয়।
‘ছোটবেলা থেকে আমি মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম। মায়ের মৃত্যুর পর কোনো শাসন ছিল না বলেই আমার এক কৃষাণী বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতাম বনে জঙ্গলে, পুকুর ধারে, বাড়ির পেছনে ছিল বিরাট আমবাগান। সেখানকার পাখির ডাক, বুনোফুল আমাকে মুগ্ধ করত। দুই-এক লাইন করে কবিতা লিখতাম। সেই সময় আমার গৃহশিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত আনোয়ারা গ্রন্থের লেখক মজিবর রহমান। তিনি আমার কবিতা লেখায় উৎসাহ দিতেন।