সাহিত্যচর্চা ও সমাজকল্যাণে নূরুন্নেছার একজন যোগ্য উত্তরসূরি দৌলতন নেছা খাতুন, যাকে আজ আমাদের সাহিত্যসমাজ একেবারেই ভুলে গেছে। তার জন্ম ১৯২২ সালে বগুড়ার সোনাতলায় তাঁর বাবার কর্মস্থলে। তাঁর বাবা ইয়াছিন আলী রেলওয়েতে চাকরি করতেন। তিনিও লেখালেখি করতেন। তার স্বর্গোদ্যান, হীরার ফুল, জীবনতারা নামে কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছিল।
সেকালের প্রথামতো শৈশবে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয়। মাত্র আট বছর বয়সে ডাক্তার হাফিজুর রহমান নামক এক চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর সহযোগিতায় ১৯৩৮ সালে তিনি ম্যাট্রিক, ১৯৪০ সালে আইএ এবং ‘৪২ সালে বিএ পাস করেন। লেখাপড়ায় ছিল তাঁর অদম্য আগ্রহ। সংসার সামলে ১৯৫৯-এ তিনি সমাজকল্যাণে এমএ করেন।
দৌলতন নেছা শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না, রাজনীতিতেও ছিল তাঁর আগ্রহ। রাজনীতিতে তাঁর শুরু তিরিশের দশকে কংগ্রেসী রাজনীতি দিয়ে। ওই সময় একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনে অংশ নিয়ে। একজন মুসলমান মেয়ের জন্য সেটা খুব ছোটো ব্যাপার ছিল না। ১৯৫৪-র নির্বাচনে যে কয়েকজন মহিলা যুক্তফ্রন্টের টিকিটে নারীদের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের একজন দৌলতন নেছা। তার এলাকা ছিল রংপুর দিনাজপুর। মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১১ মাস কারাবাস করেন। ১৯৫৫ সালে তাঁকে পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৫৮-তে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর তিনি রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকেন। এর মধ্যে তার জীবনে নেমে আসে এক বিপর্যয়। স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ১৯৬৪-তে। একমাত্র ছেলে ছিলেন সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। তিনিও মারা যান। ষাটের দশকে তিনি থাকতেন ঢাকার র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যেত। তিনি ছিলেন শ্যামলা, বেঁটে-খাটো এবং মাথায় চুল ছিল পাতলা। বাংলা একাডেমিতে তিনি কখনো আসতেন। ষাটের দশকে ঝরণা নামে তার একটি বই বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছিল।
১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন কুড়িগ্রাম গাইবান্ধা থেকে। ওই সময় নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা ও সংরক্ষণের বিধান রেখে তিনি যৌতুকবিরোধী আইন প্রণয়নের খসড়া সংসদে উত্থাপন করেন।
আজীবন দৌলতন নেছা বাল্যবিবাহ ও যৌতুকের বিরোধিতা করেছেন। ওই বিল উত্থাপনের সময় সংসদে তিনি বলেন :
‘বিবাহের সময় যৌতুকের দাবি আজ অতিশয় ব্যাপক ও ভয়াবহ আকার ধারণ করিয়া বিরাট জাতীয় সমস্যার রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। ইদানীং এই প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা হইতেছে এবং জনগণ ব্যাপকভাবে ইহার অবলোপ দাবি করিতেছেন। যৌতুক সামাজিক পাপ। ইহা স্বামী-স্ত্রীর প্রেমপূর্ণ সম্পর্কের মূলে আঘাত করিতেছে এবং দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরাট হুমকি দেখা দিয়াছে।’
নারী প্রগতির জন্য দৌলতন নেছা অবিরাম কাজ করেছেন। তবে তাঁর কর্মক্ষেত্র ঢাকার মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজ নয়, উত্তরবঙ্গের অবহেলিত অঞ্চল। তিনি তিরিশের দশকে গাইবান্ধা মহিলা সমিতি গঠন করেন। ১৯৭০ এর দশকে তিনি সেখানে এক মহিলা সংস্থার সভানেত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকারের এক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বেইজিংয়ে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে যোগদান করেন।
দৌলতন নেছার সাহিত্যকর্মের পরিমাণ অল্প নয়। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাস পথের পরশ ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি পুনর্মুদ্রিত হওয়া প্রয়োজন। কথাশিল্পী শামসুদ্দীন আবুল কালামের মন্তব্য, দৌলতন নেছার পথের পরশ এক জীবনালেখ্য; এই প্রচেষ্টা পথের দাবীর চেয়েও উৎকৃষ্টতর বলে আমার মনে হয়েছে।’ কথাটি নিঃসন্দেহে অতিরঞ্জিত। শরৎচন্দ্রের পথের দাবীর সঙ্গে পথের পরশের কোনো তুলনা হয় না শিল্পকর্ম হিসেবে, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের একটি চিত্র তাতে পাওয়া যায়। অনেক ছোটগল্পও লিখেছেন তিনি। রোমন্থন’ শীর্ষক ছোটগল্পের ভাষা :
‘প্রভাতের দিকে একটু তন্দ্রা এসেছিল নাজমার। দূর থেকে ভেসে আসা কান্নার করুণ শব্দে তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। সেই সঙ্গে অস্পষ্ট কলরবও কানে এসে পড়ল। লোটনকে কি পাওয়া গেল!
‘দরজা খুলে আঙ্গিনায় বেরিয়ে আসতেই বাইরে থেকে ভোলা চেঁচিয়ে বলল, লোটনের শাড়ী নাকিন খালের পানিতে ভাইসা উঠছে বুজী। লোক নামছে খালে খোঁজনের লাইগা। আপনে বাঁশের মইটা বাইয়া ছাপড়ার ওপরে উঠলে দেখবার পাইবেন। আমি ওহানে যাইতাছি। রুদ্ধ কণ্ঠে কেঁদে উঠল জয়তুন।
‘পাথরের মতো স্থির দৃষ্টি নিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নাজমা। জয়তুনের কান্নার শব্দে ফিরে তাকাল।
‘জয়তুন নাজমার হাত ধরে আকর্ষণ করে বলল, আহ বুজী উপরে উইঠা দেহী। মই বেয়ে ছাপড়ার উপরে উঠে অদূরে খালের উপর দৃষ্টি পড়তেই শেলের মতো নাজমার কানে বেজে উঠল ললাটনের সেদিনের সেই আর্তচীৎকার,
‘বুজী গো বুজী…
‘সবে সন্ধ্যাবাতি দিচ্ছিল নাজমা সেদিন, পিঠে কার কোমল করস্পর্শে ফিরে দেখে লোটন একটু বিস্মিত হয়ে নাজমা বলল,– এমন ভর সন্ধ্যেবেলা তুই যে লোটন,