‘…যদিও আমাদের বঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের আদি পুরুষগণ আরব, বাগদাদ বা পারস্য দেশ হইতে পূর্বে এদেশে আসিয়াছিলেন, কিন্তু এই বঙ্গের ফল, জল, আকাশ-বাতাস, ঔষধি-বনস্পতি প্রভৃতির সহিত যুগযুগান্তর ধরিয়া আমরা পরিচিত। এই বঙ্গের বাণীই আমাদের জন্মদিন হইতে আরম্ভ করিয়া শেষের দিন পর্যন্ত নিয়ত কর্ণকুহরে ধ্বনিত হইতেছে, কিন্তু আমাদের সম্প্রদায়ে এমন অনেকে আছেন, যাঁহারা পরম সত্যকে অস্বীকার করেন। পঞ্চনদ তীরবাসী সকলেই পাঞ্জাবী, বিহারের সকলেই বিহারী, কিন্তু বাঙ্গালার সন্তান যাহারা তাহারা কেবলমাত্র ধর্মান্তরের জন্যই বাঙালী নহেন, ইহার ন্যায় আশ্চর্যজনক অযৌক্তিক কথা আর আছে কি না জানি না। আমাদের ভ্রাতৃবৃন্দের জননী জায়া দুহিতাগণের মনে বঙ্গবাণীর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধাভক্তি যদি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে থাকে, তবে তাহা অচিরে কি মঙ্গল ও কল্যাণকে যে আমাদের করায়ত্ত করিয়া দিবে, তাহা একমুখে বলিয়া শেষ করা যায় না।
মোসলেম মহিলা সম্মেলনের সভানেত্রীর অভিভাষণে নূরুন্নেছা বলেছিলেন :
‘আমরা হচ্ছি পর্দানশীন মোসলেম রমণী। সাহিত্যে আমাদের পুরুষদেরই একটু দাঁড়াবার স্থান মেলে না, আমরা তো কোন দূরে পড়ে আছি।…
‘দূর চিরদিনই দূর থাকে না। সাধনায় তা নিকট হয়ে আসেই আসে।… এখন নিজের নিজের চেষ্টায়, বিদ্যায় ও জ্ঞানের উজ্জ্বল জ্যোতির ভেতর দিয়ে, অশেষ বাধাবিঘ্ন মাড়িয়ে, নিঃশব্দে খানিকটা এগিয়ে যাওয়াই হচ্ছে আমাদের প্রধান কর্তব্য।
‘স্ত্রী-শিক্ষা– এটা নিশ্চয়ই আজকাল আমাদের অপরিহার্য জিনিসের মধ্যে হয়ে পড়েছে। আর এইটিই আমাদের রুগ্ণ সমাজে নাই বললেই চলে। তার ফলে আমাদের জাতীয় জীবন সকল রকমে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
অসামান্য মহিলা ছিলেন নূরুন্নেছা খাতুন। তাঁর অবদানের জন্য যে স্বীকৃতি তিনি দাবি করেন, তা তিনি পাননি। তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়েছে বিপরীত। পরিবার থেকে উৎসাহ পেয়েছেন, মুসলমান সাহিত্যসমাজ থেকে ততটা পাননি। তবে নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ তাঁকে ‘বিদ্যাবিনোদনী’ ও ‘সাহিত্য সরস্বতী’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে।
দুই
প্রতিকূল সময়ে নিজের পথ নিজে করে যারা এগিয়ে যান, তাঁদের মর্যাদা আলাদা, ইতিহাসে তাঁদের একটি আসন প্রাপ্য। নারী-শিক্ষা, বাঙালিত্ব, নারী প্রগতি, সমাজসংস্কার প্রভৃতি প্রশ্নে নূরুন্নেছা খাতুনের মতামত খুবই স্পষ্ট। সাহিত্যের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সওগাত-এ প্রকাশিত তাঁর প্রথম গদ্য রচনা ‘আমাদের কাজ’-এ তিনি বলেন :
‘সমাজের উন্নতি করতে হলে তার প্রথম সোপন হচ্ছে সাহিত্যের সাধনা।…
‘সর্বক্ষণ এই ভাবটা আমাদের অন্তরে পোষণ করতে হবে যে “বাঙ্গালী” শব্দের উপর আমাদের প্রতিবাদী হিন্দুর যে পরিমাণ অধিকার, তার চেয়ে আমাদের দাবি অনেকাংশে বেশি অর্থাৎ কিনা, প্রকৃত বাঙালী বলে পরিচয় দিতে হলে হিন্দুর চেয়ে আমরাই বরং দু’পা এগিয়ে যাব। আমাদের সর্বক্ষণ মনে থাকা দরকার যে-ভারতের অর্ধেক সংখ্যক মোসলমান আমার এই বাঙ্গলা দেশেরই সন্তান।
‘আমাদের জন্মগত অধিকারে অনাস্থাই আমাদের সমাজকে এক রকম কোণঠাসা করে রেখেছে, একে গজাতে দিচ্ছে না। এখন আর বাঙ্গালা শিখবার ভয়ে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে সঙ্কুচিত হলে চলবে না। বুক ঠুকে এগিয়ে দাঁড়িয়ে এখন জোর গলায় বলতে হবে- আমি বাঙালী আর এই বাঙ্গালা সাহিত্যই আমার সাহিত্য।
‘জাতীয় জীবনকে গড়ে তুলবার একমাত্র উপায় হচ্ছে জ্ঞানচর্চা। আমাদেরকে এই পথ অবলম্বন করতেই হবে। … আমাদের দেহ-মনের জড়তা ও আড়ষ্ঠতা দূর করতে হবে। স্বকীয় চেষ্টায় এখন একটু ত্রুটি হলেই পতঙ্গের মতো পদদলিত ও নিষ্পেষিত হয়ে মরতে হবে।’
[‘আমাদের কাজ’, মহিলা সওগাত, ভাদ্র ১৩৩৬]
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে একজন স্বশিক্ষিত মুসলমান নারী, যিনি এই বক্তব্য দিতে পারেন তিনি সামান্য নারী নন, তিনি নিঃসন্দেহে অসামান্য। যখন নূরুন্নেছা এই কথা বলছেন, তখন রোকেয়া জীবিত। তার এই বক্তব্যে তিনটি বিষয় পাওয়া যায়। এক, সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের উন্নতি ঘটানো সম্ভব, দুই. বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ শুধু নয় সারা ভারতের অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানের বাসভূমি বাংলাদেশ, সুতরাং বাঙালিত্বের দাবিদার বাঙালি মুসলমানেরই বেশি। মুসলমানের চেয়ে তার বাঙালি পরিচয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মুসলমান পৃথিবীর দেশে দেশে বহু জাতির মধ্যে রয়েছে, কিন্তু বাঙালি মুসলমান শুধু বাংলাদেশেই এবং তারাই এই ভূখণ্ডে সংখ্যায় বেশি। সুতরাং, বাঙালিত্বের দাবিদার বাঙালি মুসলমানেরই বেশি। এবং সেই দাবি যদি বাঙালি ছেড়ে দেয় মুসলমানিত্বকে ধরে রাখতে গিয়ে তা হলে তা হবে তার জন্য আত্মঘাতী। এই বিষয়টি তখন সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান পুরুষ ভেবে দেখেননি।
তৃতীয় যে বিষয়টির ওপর নূরুন্নেছা গুরুত্ব দিয়েছেন তা হলো জ্ঞানচর্চা এবং বাঙালি মুসলমানকে সেই পথ অবলম্বন করতেই হবে। বাঙালি মুসলমান নারীদের এবং পুরুষদেরও ‘দেহ-মনের জড়তা ও আড়ষ্ঠতা দূর করে আত্ম-উন্নতির চেষ্টা করতে বলেছেন। আত্ম-উন্নতির চেষ্টা না করলে পোকামাকড়ের মতো ‘পদদলিত ও নিষ্পেষিত হয়ে মরতে হবে, সে কথা সোজাসুজি বলেছেন।