আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে অকাট্য যুক্তিদানকারী মন্ত্রী মহোদয়কে যদি ওই সম্মেলনের কোনো শ্রোতা অনুরোধ করতেন যে আপনার বক্তৃতাটি আপনি আরবি অক্ষরে আমাদের লিখে দেন, তাহলে তিনি তা পারতেন কি? যা হোক, শুধু বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপও নেন। ১৯৫০ সালে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় পূর্ব বাংলার কয়েকটি জেলায় ১০টি কেন্দ্র খুলে সেখানে আরবি হরফে লেখা বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু হয়। সরকারি সূত্র জানায়, প্রত্যেক শিক্ষাকেন্দ্রে। ২৫ থেকে ৩৫ জন ছাত্র ৬ মাসের জন্য শিক্ষাগ্রহণ করতে আরম্ভ করেন। এই পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৪৯ সালে ৩৫ হাজার টাকা মঞ্জুর করে এবং ১৯৫০-এ তা বাড়িয়ে করা হয় ৬৭ হাজার ৭৬৪ টাকা। নতুন রাষ্ট্রে যেখানে অতি জরুরি ব্যাপারে অর্থের ছিল অভাব, সেখানে আরবি হরফে বাংলা লেখার জন্য এই অর্থের অপচয় ছিল অপরাধের শামিল। শিক্ষার্থীদের জন্য আরবি হরফে বাংলা ভাষার বইও ছাপা হয়েছিল। আরবি হরফে বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল।
[দ্রষ্টব্য : পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, পৃ. ২৫৭-৫৮]
আরবি প্রচলনের এই জোরজবরদস্তিমূলক চেষ্টার প্রতিবাদ করেছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটিরও একজন সদস্য ছিলেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, “উর্দু হরফের সাহায্যে বাংলা শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে অর্থ অপব্যয়ের কী মানে থাকতে পারে? আশ্চর্যের কথা,এর সঙ্গে পূর্ববঙ্গ সরকারের কোনো সম্পর্ক নাই। এই অর্বাচীন ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার এক লক্ষ টাকা ব্যয় করবেন। আমার আশঙ্কা হয় এটা বন্ধ না করা হলে সরকারি টাকার অপব্যয় করা হবে।
[ একই সূত্র, পৃ. ২৫৭-৫৮]
সরকারকে সমর্থন দেওয়ার মতো মানুষও ছিলেন পূর্ব বাংলায় অনেক। ১৯৪৯ সালের ২ এপ্রিল, চট্টগ্রামে ‘কেন্দ্রীয় সাহিত্য পরিষদ বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের বিষয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। আবুল ফজলের সভাপতিত্বে সেই অনুষ্ঠানে আজাদ সম্পাদক মুজিবর রহমান খাঁ বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক বিরাট ভৌগোলিক ব্যবধান রহিয়াছে, … আমাদের পরস্পরের নিকটতম হওয়ার জন্য প্রয়োজন ঐক্য, মিলন, সংহতি এবং তমদ্দুনিক যোগাযোগ। ইহার জন্যই আরবী বর্ণমালা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
[আজাদ, ৮ এপ্রিল ১৯৪৯]
নৈতিক বল থাকলে সরকারি চাকরি করেও স্বাধীন মতামত দেওয়া সম্ভব। সেই বিভ্রান্তির সময় সরকারি কলেজের শিক্ষক মোহাম্মদ ফেরদাউস খান The Language Problem of Today শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। ভাষাতত্ত্ব তার বিষয় নয়, তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। তিনি তাঁর ওই পুস্তিকায়, যা প্রকাশিত হয় জানুয়ারি ১৯৪৯-এ, বলেছিলেন, আরবি ও রোমান অক্ষরের চেয়ে বাংলা শ্রেষ্ঠ।
ফেরদাউস খানের এই মতামত সরকারি নেতা ও গোয়েন্দা বিভাগের লোকদের দৃষ্টিতে পড়ে। সরকারের বাইরের আরবিপন্থীদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার মধ্যে একজন বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আবুল কাসেম। তিনি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান এবং শিক্ষাসচিব এফ এ করিম ফেরদাউস খানের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর ভাষায়,’জনাব এফ এ করিম তার দফতরে আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই তিনি কিছুটা রুষ্ট স্বরে বললেন, “আপনি দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করছেন। পাকিস্তান সরকার বাঙলা ভাষার জন্য আরবি হরফ চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন আর আপনার পুস্তকটি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল ব্যবহার করছে।” আমি জবাব দিলাম, হরফ সমস্যার উপর যে তাত্ত্বিক গবেষণা আমি চালিয়েছিলাম বইটিতে তা-ই লিপিবদ্ধ করেছি। কোনো রকম রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তাতে নেই। আমাকে বিদায় দেওয়ার আগে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমাদের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী, যিনি বাঙলাভাষী তিনি নিজেও আরবী হরফ গ্রহণের সুপারিশ করে যাচ্ছেন। আপনার সাবধান থাকা উচিত। আমার ভয় হচ্ছিল, কারণ তিনি আমার জবাবদিহি দাবি করবেন। তিনি তেমন কিছুই করলেন না বরং Farsight ছদ্মনামে The Script Question শীর্ষক একটি পুস্তিকা রচনা করে আমার যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করলেন।
[মোহাম্মদ ফেরদাউস খান, জীবনের ঘাটে ঘাটে, ২০০১, পৃ. ৮৬-৮৭]
এর কিছুদিন পর ১৭ অক্টোবর ১৯৪৯, শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল রহমান চট্টগ্রাম সফরের সময় সার্কিট হাউসে ফেরদাউস খানকে দেখা করতে বলেন। তিনি লিখেছেন, আমি বুঝেছিলাম তিনি কী বলতে চান। আলাপের শুরুতেই তিনি বললেন, “হরফ সম্পর্কিত আপনার লেখাটা আমি পড়েছি, তবে আমি আপনার সাথে একমত নই।” আরবী হরফের পক্ষে তিনি তার যুক্তি পেশ করলেন, আমি আমার মন্তব্য তুলে ধরলাম, রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত আমাদের আলোচনা চলছিল তবে কোনো সময়ই তিনি উম্মা প্রকাশ করেননি। বিদায়ের সময় আমাকে বললেন, “দেখা যাচ্ছে এ বিষয়ে আমরা একমত হতে পারছি না, তবে আপনাকে একটা। অনুরোধ জানাব কীভাবে আরবী হরফ বাঙলার জন্য গ্রহণ করা যায়, সে সম্পর্কে আমাকে লিখে জানাবেন।” আমি জবাব দিয়েছিলাম তা জানাব,তবে শর্ত থাকবে যে এই ব্যাপারে আমার নাম যেন জড়ানো না হয়। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তাকে লিখে জানিয়ে দিলাম আর সেটি পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন এবং আমাকে কেন্দ্রীয় সরকারের কয়েকটি শিক্ষা কমিটিতে সদস্য করে নিয়েছিলেন।