‘(বাগড়ার অর্থ : শুকনো তালপাতা)! এমনি করে, শরতের বিকালে, জানালার গরাদ ধরে চেয়ে থাকতাম স্তব্ধ নীল আকাশের নীচে বিস্তৃত মাঠের পানে। সবুজ বনানী আর সুনীল আকাশ একসঙ্গে মিশে আছে মনে হয়। নীচে বিলের পানি দুধ নদীর মতো দেখায়। অলস গতি কৃষকেরা লাঙ্গল কাঁধে মাঠ থেকে ফেরে। রাখাল বালকেরা বটের ছায়ে বসে কড়ি খেলে। গরুগুলো এলোমেলোভাবে এখানে-সেখানে চরে ফেরে, ঘাস খায়। খেলায় রত রাখালেরা মাঝে মাঝে চেয়ে দেখে, গরুগুলো ঠিক আছে কি-না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, খেলা ছেড়ে উঠে পড়ে রাখাল-বালক, পাঁচনবাড়ি দিয়ে গরু তাড়িয়ে গাঁয়ের পথ ধরে ওরা। কাক, শালিক, বকের সারি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে বসে তাদের আশ্রয়স্থল বটবৃক্ষের শাখায়। নানা সুরের নানা কণ্ঠের কিচির-মিচির, কা, কা, ওয়াক-বক শব্দে মুখরিত করে তুলে চারদিক। আঁধার ঘনিয়ে আসে ধীরে ধীরে, কালো যবনিকায় ঢেকে ফেলে সব-কিছু।’
কীভাবে তিনি প্রতিকূলতার মধ্যে লেখিকা হয়ে উঠলেন সে কথা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বলেছেন নূরুন্নেছা খাতুন। তাঁর হৃদয়গ্রাহী ভাষায় কথাশিল্পী হয়ে ওঠার কথা :
‘এতো অবরোধের মধ্যে মানুষ হয়েও কেমন করে সাহিত্যের দরবারে নিজের স্থান খুঁজে নিতে পেরেছিলাম, সে কথা জানতে নিশ্চয়ই অনেকের আগ্রহ হচ্ছে। সেই আশা-আগ্রহ ভরা সাধনার দিনগুলোর কথাও আজ বলবো। আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েদের শিক্ষালাভের পথে কোনই বাধা নেই, তাই অতো যুগ আগে বাংলার গ্রামের, অভিজাত-পরিবারের মেয়েদের পক্ষে লেখাপড়া শেখার চিন্তাও যে কতো। অসম্ভব ছিলো, তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। কিন্তু বাল্যের কোন একদিনে, যে প্রেরণা আমি নিজের মধ্যে অনুভব করেছিলাম, তারই জন্যে আর শুভানুধ্যায়ীদের উৎসাহে, বাংলা-সাহিত্যের দরবারে কিছু পেশ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
‘দেখতে দেখতে কোন ফাঁকে কেমন করে যেন কেটে গেলো কটা বছর। বড় বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বোনটি ব্যস্ত পুতুলের বিয়ে নিয়ে। আর ছোট ভাইগুলো? তারা থাকতো, মাষ্টার সাহেবের সামনে ঘাড় হেঁট করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে বসে, নয় তো খেলায় মেতে উঠতো লাটু, আর ডাংগুলি নিয়ে। দেখতাম, কর্মচঞ্চল বাড়িতে সবাই আপন আপন কাজে ব্যস্ত। আমিই একা, একান্ত একা। বাড়ির অবসরপ্রাপ্ত বুড়ি ঝিটা, গোয়ালঘরের এক কোণে বসে গন্ধকে পাট কাঠির মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে দেশলাই তৈরী করছে এক মনে। ছুটে যেতাম তার কাছে। দুহাতে তার গলা জড়িয়ে বলতাম, একটা গল্প বলো না ঝি-মা!
‘ফোকলা মুখে, একরাশ হাসি হেসে ঝি-মা বহুবার-শোনা সেই একই বাঙমা বেঙমীর গল্প বলতো, কিংবা শোনাতো জীয়ন-কাঠি মরণ-কাঠির কথা। কিন্তু তাতে কি আর তখন মন ভোলে?– শৈশব ছাড়িয়ে তখন পা দিয়েছি বাল্যে। মন চায় নতুনত্ব। নতুন কিছু জানতে শিখতে মন তখন উৎসুক ছিল। অনুযোগ শুনে বুড়ো-ঝি মুখ ভার করে বলতো, তাহলে আর কোন কিস্সা শোনাই বলো? তোমার ভাইয়েদের কাছে শোনো গে, ওরা সব নেকাপড়া করে, অনেক নতুন নতুন গল্প জানে।
‘অনুসন্ধিৎসু মন এবার একটা পথ খুঁজে পেলো। কোথা থেকে আকস্মিক একটা আলোর রশ্মি এসে পড়ে কোন এক অজানা জগৎকে চোখের সামনে উদ্ভাসিত করে তুললো। মনে হলো, তাইতো, ঠিকই তো। এবার থেকে বই-ই তো আমার সঙ্গী হতে পারে। কতো দেশের কতো মানুষের নতুন নতুন গল্প শোনাতে পারে। ওরা- বইরা আমার।’
নূরুন্নেছা খাতুনের শৈশবস্মৃতি এত লম্বা লম্বা উদ্ধৃতির মাধ্যমে উপস্থাপিত করার কারণ, এ কালের পাঠকের তাঁর সম্পর্কে তো নয়ই, তাঁর রচনাশৈলী সম্পর্কেও ধারণা নেই। তিনি আজ একজন বিস্মৃত মানুষ। অথচ তার যে অবদান তাতে তিনি হারিয়ে যাওয়ার মতো লেখিকা নন। শৌখিন লেখিকা তিনি ছিলেন না, ছিলেন কমিটেড লেখক। সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্যই তিনি কথাশিল্পী হওয়ার ব্রত গ্রহণ করেন। জন্ম মুর্শিদাবাদের এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারে। বাবা খোন্দকার হাবিবুস সোবহান ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বাল্যবিবাহের বিরোধী ছিলেন। তাঁর বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সে, সে কালের জন্য সেটা বেশি বয়স। স্বামী কাজী গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন আইনজীবী। শ্বশুরবাড়িতে সাহিত্যচর্চার উৎসাহ পান। বাড়িতেই বাংলা ও ইংরেজি ভাষা রপ্ত করেন।
১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় নূরুন্নেছার প্রথম উপন্যাস স্বপ্নদ্রষ্টা। একটি সামাজিক উপন্যাস হিসেবে এটিকে উপেক্ষা করা যাবে না। ভাষা পরিমার্জিত রচনাশৈলী সাবলীল। ১৯২৫-এ প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস আত্মদান, বলা হয়েছিল ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। অন্য দুটি উপন্যাস বিধিলিপি ও নিয়তি। ফিকশন ছাড়াও প্রাবন্ধিক রচনাও রয়েছে তার, যেমন ‘মোসলেম বিক্রম ও বাংলার মোসলেম রাজত্ব (১৯১৬)। তাঁর একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস জানকী বাঙ্গ।
নূরুন্নেছা প্রথম বাঙালি মুসলমান ঔপন্যাসিক, যিনি ছিলেন সাহিত্যে নিবেদিতা এবং একই সঙ্গে সমাজসেবা ও নারী জাগরণের একজন কর্মী। পিছিয়ে থাকা মুসলমানসমাজের কল্যাণে তিনি কাজ করলেও তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। মুসলিম জাতীয়তাবাদে নয়, তিনি ছিলেন বিশ্বাসী বাঙালি জাতীয়তাবাদে। ১৯৩১ সালে মুন্সিগঞ্জে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের ১৬তম অধিবেশন হয়। সেখানে নূরুন্নেছা ‘বঙ্গ সাহিত্যে মুসলমান’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং সেটি শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সেই প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন :