‘উঁচু পাঁচিল-ঘেরা অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়ি। গোলা বাড়ির সারি সারি ধানের মরাই এর পাশে মিষ্টি কুল, আম, লিচু, নিম গাছের মেলা। পাঁচিলের ওধারে কাজীর পুকুরের টলটলে পানি। খুব ছোটবেলায় ঘরে যখন মন টিকতো না, গিয়ে হাজির হতাম খামারবাড়িতে, যেখানে এক-এক দুই দুই করে একটানা সুরে জনমজুরেরা ধান মেপে তুলছে, সে জায়গা পার হয়ে চলে আসতাম বড় দীঘির পাড়ে। সেখানে হয়তো জেলেরা জাল গুটিয়ে তুলছে আর তাতে ধরা পড়ে ছটফট করছে ছোট বড় রূপোলী মাছগুলো। বাড়িরই কেউ পাড়ে দাঁড়িয়ে তদারক করছেন মাছ-ধরা।
‘কিন্তু আর একটু বড় হবার সঙ্গে সঙ্গেই চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হতে হলো। খান্দানী-ঘরের রেওয়াজই ছিল এই। এমনকি বাড়ির সদর দরজা মাড়ানও বন্ধ। দেয়ালের ফাটল, ঘুলঘুলী দিয়ে, চোরের মতো লুকিয়ে কখনো দেখতাম পাশের বাড়ির কর্মচাঞ্চল্য, ছোট মেয়েরা খেলা করছে, বৌ-ঝিরা করছে রান্না, বাড়ির গিন্নী ঘুরে ফিরে এসে দেখে যাচ্ছেন ওদের রান্না, ছেলেদের খেলাধুলা।-এমনি সব খুঁটিনাটি ছবি।
‘নিজেদের ঘর-সংসারের কাজের কোন দায়িত্ব নাই। ছোট মানুষ, কী কাজই বা জানি। মাঝে মাঝে ঘরের এলোমেলো জিনিষগুলো ঝেড়ে মুছে গুছাবার চেষ্টা করি। মা হাসেন, বলেন, খুব কাজের হয়েছে মেয়ে আমার! অবসর সময়ে নানাজান কেতাব পড়ান, সব দিন পড়াবারও সময় পান না তিনি। আবার অন্যের কাছে ত’ পড়তে দেন না নানাজান। বলেন, সহি পড়ানো না জানলে, তার কাছে পড়া ঠিক নয়। কোরান-কেতাব গলদ পড়ার চেয়ে না পড়াও ভালো। পড়া খুব ভালভাবেই মুখস্থ করে রাখি। ভুল হোলে নানাজান ভীষণ ধমকানি দেন। স্কুলের পড়াশুনার কোন বালাই নাই। মেয়েরা স্কুলে গিয়ে ইংরেজি, অঙ্ক ইতিহাস পড়বে, একথা তখনকার দিনে কারও কল্পনাতেই আসততা না।
‘অলস দিনে প্রচুর সময়। ভাইয়েরা ওস্তাদের কাছে, তাদের পড়া শেষ করে স্কুলে যায়। বাড়ি থাকলে তাদের সঙ্গে খেলা-ধুলা করি। ঝগড়া করি, মারামারিও যে হোত না তা নয়! খেয়েদেয়ে, বইখাতা নিয়ে ওরা বাড়ির বার হয়। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে উদাস মনে চেয়ে থাকি আমি, তাঁদের গমন-পথের পানে। যতোদূর দেখা যায় চেয়ে দেখি, দৃষ্টির বাইরে গেলে দু-হাতে চোখ মুছি। ভীষণ দুঃখ হয়, একটু আগের ঝগড়ার জন্যে মনে অনুতাপ হয়। আবার কখন ফিরবে ওরা, সেই আসা পথে চেয়ে থাকি। ফিরে এলে, ছুটে গিয়ে ওদের হাত থেকে বই-খাতা নিয়ে তুলে রাখি। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে সযতনে রাধা পোলাও, কোর্মা বাড়তে বসি। ভাইরা হাসিমুখে নিজ নিজ আসনে বসে পড়ে। তাদের সামনে থরে থরে সাজিয়ে দেই, ধুলামাটির রান্না, জাফরানি রং এর পোলাও, টুকরো ইটের কোর্মা, ছোট ছোট কুলের ডিম রান্না, কলাপাতার উঁটার চাকা করে কাটা মাছ ভাজা, এটা-ওটা মিশিয়ে একটা ঘণ্টা, খড়িমাটি গোলার ফিরনী- এমনি সব। ছোটভাইরা, জিভ আর তালুতে আওয়াজ তুলে পরিতৃপ্তির সঙ্গে আহার করে, আর আমরা খুশিতে ডগমগ
মন্তব্য করে, একটুও মজা না, বিচ্ছিরি রান্না সেজ-বুবুর। অন্যটি বলে, না বিচ্ছিরি রান্না মেজ-বুবুর, সেজ-বুবুর রান্না খুব ভালো। ব্যস, বেধে যায় ঝগড়া! আর যদি তোকে খেতে বলি কোন দিন। সেজ-বুবু বলে, আমিও খাওয়াবো না খোকনকে আর। অর্থাৎ, ছোটর সঙ্গে বাধে আমার ঝগড়া, মেজর বাধে তার ছোটর সঙ্গে। সেই সব ঝগড়া-বিবাদ ভুলতেও বেশি সময় লাগে না। পরক্ষণেই ভাইয়েরা গোলা বাড়িতে গিয়ে আম, জাম, পেয়ারা কুল যে সময়ের যা ফলমূল পেড়ে নিয়ে আসে কেঁচড় ভরে, আমরা মহাআনন্দে হাত-পা ছড়িয়ে খেতে বসে যাই ভাইবোনে মিলে। মধুর স্মৃতি-বিজড়িত দিনগুলো মানুষের জীবনে আর ফিরে আসে না। খুঁজে পাওয়া যায় না সেই হাসিকান্না ভরা আনন্দময় শৈশব-জীবনের ফেলে-আসা হারিয়ে-যাওয়া দিনগুলো।
[ছোটবেলার জীবন, মৃত্তিকা, ১৯৬১]
এক অতি সংবেদনশীল মন ও শিল্পীর চোখ ছিল নূরুন্নেছা খাতুনের। দেশাত্মবোধ জেগেছিল তাঁর মধ্যে শৈশবেই। তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর স্মৃতিকথায়। তাঁর ভাষায় :
‘কতো অতীত দিনের কাহিনী শুনতাম আব্বাজানের কাছে। শুনতাম, আমার এই মাতৃভূমি মুর্শিদাবাদের বুকে, তরুণ সিরাজের ভাগ্য বিড়ম্বনার করুণ ইতিহাস। বাংলার বীর নবাবদের বীরত্বকাহিনী। আবেগ-আপ্লুত মন বিদ্বেষে শিউরে উঠতো, মীরজাফরের উমিচাঁদের দলের বিশ্বাসঘাতকতার আলেখ্যে শিশুপ্রাণ ক্ষোভে রোষে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠতো ক্ষণে ক্ষণে। সান্ত্বনা পেতে চাইতো ধুলামাটির খেলার মধ্যে, কাটাকুটি আর গেরুয়া মাটি দিয়ে তৈরী হ’তো গড়, কেল্লা, কামান, বন্দুক। মাথার কাঁটা দিয়ে খোঁড়া সরু নালার ওপারে ইংরেজ আর এ পাশে নবাবী ফৌজ। শুরু হতো যুদ্ধ। গুঁড়িয়ে একাকার হোয়ে যেত ওপারে ইংরেজদের দুর্গগুলো। শিশু-মন ভরে উঠতো আত্মতৃপ্তিতে।’
৭০-৮০ বছর আগে একজন বাঙালি নারীর নিসর্গ প্রেম যে অসাধারণ চিত্ররূপময় ভাষায় বর্ণিত হয়েছে, তা ভাবলে অবাক লাগে। এত সুন্দর প্রকৃতির। বর্ণনা খুব কম বাঙালি লেখকই দিতে পেরেছেন। সেই পঞ্চাশের দশকে নূরুন্নেছা খাতুন লিখেছেন :
‘বীরভূমের লাল-মাটির শেষে আবার মুর্শিদাবাদের চন্দনের মতো সাদা কোমল ধুলোর রাজ্য শুরু। ছোটবেলায় ওপারের জানালাটা ঘেঁষে বসে, প্রকৃতির বুকে ছয় ঋতুর আনাগোনা দেখা যেন আমার এক রকম নেশার মত ছিলো। শরৎ, হেমন্ত, শীত পার হয়ে আবার যখন চৈত্র-বৈশাখের দিনগুলো ফিরে আসততা, কেন জানি, আমার মনটা অকারণে খারাপ হয়ে যেতো। খড়কুটো ধূলিমাটি উড়িয়ে বওয়া শুকনো বাতাস, কাকের একটানা ডাক, আকাশের বুকে-ওড়া চিলের তীব্রতীক্ষ করুণ কান্নার সুর, শুকনো তাল-পাতার উদাস সুরের বাজনা বাজানো,– শুনি আর চেয়ে চেয়ে দেখি। মনটা উদাস ব্যথায় ভরে ওঠে। জীবনের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো, আর অনাবশ্যক বেঁচে থাকার সার্থকতা কী?– এই মনোভাব নিয়ে, শেষের বেশে সজ্জিত পাতার দল, রিক্ত মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিসর্জন দিচ্ছে তাদের অবহেলিত প্রাণ। দেখতে দেখতে মনে হোত, কি যেন হারিয়ে গেছে, পালিয়ে গেছে কারা যেন! এখনও মনে পড়ে, আমরা ছোটরা, ক্লান্ত গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণে এই মন-উদাস-করা দিনগুলোর নাম দিয়েছিলাম, বাগড়া বাজা দিন।