ওই সময় ওয়ালীউল্লাহ গুলশানে একটি একতলা বাড়ি কেনেন। তাঁর পরিকল্পনা। ছিল তিন-চার বছরের মধ্যে দেশে ফিরে আসবেন এবং শুধু লেখালেখিতেই জীবনের শেষ বছরগুলো ব্যয় করবেন। এর অল্পকাল পরেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার। সপক্ষে ইউরোপে জনমত গঠনে তিনি বিরামহীন কাজ করেন। পাকিস্তান সরকার তাঁকে চাকরিচ্যুত করায় তিনি তখন বেকার। দেশের জন্য তাঁর উদ্বেগের অন্ত ছিল না। নিজের আর্থিক অনটন। মানসিক চাপ সইতে না পেরে একাত্তরের ১০ অক্টোবর তিনি মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান।
ন্যাশনাল বুক সেন্টারের ডিরেক্টর হিসেবে সরদার যে ঘরে বসতেন, সেটি ছিল একটি সুপরিসর কক্ষ। তিনি ছিলেন মজলিসি প্রকৃতির মানুষ। নিজেকে তিনি একজন অফিসার মনে করতেন না। তাঁর গায়ের বর্ণ ছিল কালো। লম্বা গড়ন। চুল পেছনের দিকে আঁচড়াতেন। সব সময় পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন। তাঁর ঘরে কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা বসত। প্রায় প্রতিদিন। আমিও কোনো দিন যেতাম। যা মাইনে পেতেন, তার অনেকটাই কবি-সাহিত্যিকদের চা-শিঙাড়া-বিস্কুট খাইয়ে খরচ করতেন। সেই জয়েনউদ্দীন অবসর গ্রহণের পর নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। কাঁঠালবাগান ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ছিল তাঁর বাড়ি। শেষ দিনগুলো তাঁর সেখানেই একাকী কাটে। ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৬ তিনি মারা যান।
জয়েনউদ্দীনের জন্ম গ্রামের প্রান্তিক কৃষক পরিবারে। পাবনা জেলার কামারহাটি গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর হিসাবে ১৯১৮ সালে, যদিও ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটে অন্য সাল আছে। ১৯৪০ সালে পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে তিনি বছরখানেক পড়েছিলেন, কিন্তু কারও বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষাজীবনে ইতি টেনে সেনাবাহিনীতে হাবিলদার ক্লার্ক হিসেবে যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পান। কিছুদিন পাকিস্তান অবজারভার-এ কাজ করেন বিজ্ঞাপন বিভাগে। পঞ্চাশের দশকে আমি যখন তাঁকে দেখি, তখন তিনি দৈনিক সংবাদের বিজ্ঞাপন বিভাগের ম্যানেজার।
পঞ্চাশের দশকে আমাদের বাড়িতে দুটি সাময়িকী যেত। তার নাম সেতারা ও শাহীন। এক কপি করে নয়, যেত একটা বান্ডিল। তাতে থাকত ১০টি কপি। আব্বা সেগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পুশিং সেল করতেন। কয়েক মাসের টাকা জমা হলে জয়েনউদ্দীন গিয়ে নিয়ে আসতেন। ওই উপলক্ষে এক বেলা তাঁর সান্নিধ্য পেতাম। ১৯৬২তে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেওয়ার আগে জীবিকার জন্য সরদারকে নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হয়েছে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আইয়ুব সরকার ন্যাশনাল বুক সেন্টার (জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা করলে ১৯৬৪তে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয় গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে। পরে হয়েছিলেন পরিচালক।
নিষ্ঠার সঙ্গে সাহিত্যচর্চা করেছেন জয়েনউদ্দীন। ১৯৬৭ সালে তাঁর অনেক সূর্যের আশা আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পায়। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে। আদিগন্ত (১৯৫৯), পান্না মতি (১৯৬৪), নীল রং রক্ত (১৯৬৫), বেগম শেফালী মীর্জা (১৯৬৮) প্রভৃতি। গল্পগ্রন্থ বীরকন্ঠীর বিয়ে (১৯৫৫), খরস্রোত (১৯৫৫), বেলা ব্যানার্জির প্রেম (১৯৬৮) প্রভৃতি।
২৭. বিদ্যাবিনোদিনী বৃত্তান্ত ও দৌলতন নেছা
বেগম রোকেয়া ভাগ্যবান। এখন বাংলাদেশ, ভারত ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশে অতিপরিচিত নাম। তাঁর অবদান অসামান্য। কিন্তু মৃত্যুর পর অনেক দিন তিনি বিস্মৃতই ছিলেন। এমনকি কোথায় তাঁর কবর, সে খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি কেউ। তাঁর সন্তানসন্ততি থাকলে নিশ্চয়ই নিতেন। তাঁর সম্পর্কে যাঁরা আলোচনা করেছেন, তাঁরাও জানতেন না কোথায় রোকেয়া সমাহিত। কলকাতা থেকে কিছু দূরে সোদপুরের কাছে পানিহাটিতে তাকে কবর দেওয়া হয়। বহুদিন পর পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের সময় তাঁর কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলার নারী জাগরণে রোকেয়ার অবদান অবিস্মরণীয়। কিন্তু অনেক দিন তাঁর সম্পর্কে মানুষ বিশেষ জানত না। তিরিশের শেষের দিকে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ রোকেয়ার একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশ করেন। জীবনীটি সুখপাঠ্য। সেটি প্রকাশের পরও রোকেয়াকে নিয়ে আগ্রহ খুব অল্প মানুষেরই ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে জনশিক্ষা পরিচালক (ডিপিআই) নিযুক্ত হন প্রখ্যাত রসায়নবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ কুদরাত-ই খুদা। তিনি শামসুন নাহার মাহমুদের রোকেয়া জীবনী নবম-দশম শ্রেণিতে পাঠ্য করেন। তাঁর জীবনী স্কুলপাঠ্য করায় রোকেয়ার পরিচিতি সাধারণের মধ্যে ব্যাপকতা পায়। রোকেয়ার প্রতিষ্ঠার পেছনে ড, খুদা ও শামসুন। নাহার মাহমুদের অবদান সবচেয়ে বেশি, যদিও তাঁদের স্বীকৃতি নেই। এবং বর্তমানে রোকেয়ার খ্যাতি এতই বেশি যে তাঁর সমসাময়িক আরও যেসব নারী সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন, তাঁরা আড়ালে পড়ে গেছেন।
এখন কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে কে নারী আর কে পুরুষ, এ প্রশ্ন কেউ তোলেন । সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন নারী কবি-কথাশিল্পীরা। বাংলা সাহিত্যেও অনেক প্রধান কবি-সাহিত্যিক নারী। বাঙালি-আমেরিকান ঝুম্পা লাহিড়ী, যিনি ইংরেজি ভাষায় গল্প-উপন্যাস নিয়ে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন, তিনি নারী কি পুরুষ তা নিয়ে কেউ ভাবেন না। বাংলা সাহিত্যে মহিলাদের অবদান বিরাট। তবে বাঙালি মুসলমান লেখিকাদের আবির্ভাব দেরিতে। সেই পথ যারা তৈরি করেছেন, অশেষ প্রতিবন্ধকতা অগ্রাহ্য করে তারা চিরস্মরণীয়। স্বাধীনতার আগে দু-একবার বাংলা একাডেমিতে দেখেছি নূরুন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনীকে। তখন তিনি বৃদ্ধা। কী রকম সামাজিক অবস্থায় সাহিত্যজগতে তার প্রবেশ, সে সম্পর্কে তিনি তাঁর শৈশবস্মৃতিতে অতি প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছেন। তাঁর ভাষাতেই তাঁর কথা নিবেদন করি, যদিও উদ্ধৃতি দীর্ঘ না করে উপায় নেই :