মবিনউদ্দীন মূলত ছোটগল্পই লিখতেন। একটি উপন্যাসও তার আছে। তাঁর ছোটোগল্প সংকলনগুলোর মধ্যে রয়েছে কলঙ্ক (১৯৪৬), সাহানা (১৯৪৮), হোসেন বাড়ির বউ (১৯৫২), ভাঙা বন্দর (১৯৫৪), কুদরত খার ভিটে (১৯৫৫), মুখচর (১৯৫৬), বুনো শয়তান (১৯৫৬) প্রভৃতি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর অনেক লেখাই অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। ১৯৭৮ সালে যখন তিনি মারা যান, তখন নতুন যুগের কেউ তাঁকে চেনে না। দুই লাইন মৃত্যুসংবাদ কোথাও বেরিয়েছিল বলে মনে পড়েনি। কেউ শোক প্রকাশ করেনি।
মবিনউদ্দীনের ‘সন্তান’ শীর্ষক একটি ছোটোগল্প পড়ে ভালো লেগেছিল বলে এখনো মনে আছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের জীবনের দুঃখ-সুখ-দ্বন্দ্ব, তাদের হতাশা প্রভৃতি তাঁর লেখার বিষয়বস্তু। তার হোসেন বাড়ির বউ বইটি তিনি আমার আব্বাকে উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর শৈল্পিক গুণাগুণ সম্পর্কে এখন বলতে পারব না। তবে পঞ্চাশের দশকে তিনি যথেষ্টই পঠিত ছিলেন এবং খ্যাতিমান ছিলেন। ষাটের দশকের প্রজন্ম থেকে উপযুক্ত মর্যাদা না পেয়ে আড়ালকেই বেছে নেন মবিনউদ্দীন আহমদ তাঁর জীবনের শেষ দুটি দশক। তাঁর উত্তরসূরিরা জানেন না যে তাঁদের পথনির্মাতাদের তিনি একজন।
সরদার জয়েনউদ্দীনের গল্পের বই নয়ান ঢুলী প্রকাশের মুহূর্তটির আমি একজন সাক্ষী, সে কথা আগে উল্লেখ করেছি। তার গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা অনেক। সত্তরের দশকে হাতিরপুল বাজারে একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা। তিনি কাঁচাবাজার করতে গিয়েছিলেন চটের থলে নিয়ে। অনেক দিন পরে দেখা বলে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা বললেন। একপর্যায়ে তিনি প্রায় অনুরোধের মতো বললেন, ‘আমার অনেক সূর্যের আশা উপন্যাসটি কষ্ট করে হলেও পড়বেন।’ তাঁর ওই কথা আমার বুকে বাজে। লেখক কেন তার পরবর্তী প্রজন্মের একজনকে তাঁর একটি বই পড়তে অনুরোধ করবেন? তাঁর অনুরোধের আগে কেন আমি তাঁর উপন্যাসটি পড়িনি, তা ভেবে নিজের প্রতিই আমার ক্ষোভ হয়।
সরদার জয়েনউদ্দীন অবহেলা করার মতো কথাশিল্পী নন। তাঁর অবদান অস্বীকার করা অথবা তাঁকে অবহেলা করা অপরাধের শামিল। যখন তিনি জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন, তার দ্বারা উপকৃত হয়েছে এ দেশের প্রবীণ ও নতুন প্রজন্মের প্রায় সব কবি-সাহিত্যিক। প্রত্যেকের বই বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর সম্পাদিত কেন্দ্রের সাময়িকী বইতে প্রশংসামূলক সমালোচনা করিয়েছেন। আমার কোনো কোনো বইয়েরও আলোচনা বেরিয়েছে বই পত্রিকায়।
একটি সময় সত্তরের দশকে কোনো কারণ ছাড়াই জয়েনউদ্দীন বাংলাদেশের লেখকসমাজ থেকে অবহেলিত হতে থাকেন। খ্যাতিমান সবাই তখন আখের গোছাতে অতি ব্যস্ত। এখন কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না, যারা শেখ মুজিবের সরকার থেকে সুবিধা নিয়েছেন সাড়ে তিন বছর, জিয়া সরকার তাদের বঞ্চিত করল না। জিয়া মামলা-মোকদ্দমা ঠুকে দিলেন আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে। অনেকেই জেলের ভাতও খেলেন তার সময়ে। কিন্তু আওয়ামী কবি-শিল্প-সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীদের কোনো অসুবিধা হলো না। প্রাপ্তিযোগে বিশেষ ঘাটতি দেখা গেল না। ওই সব সুবিধাবাদিতা দেখে জয়েনউদ্দীনের ঘেন্না জন্মে থাকবে। তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। স্বনামধন্য লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তার ধারণা প্রকাশ পেয়েছে কুমিল্লার লেখক-অধ্যাপক তিতাস চৌধুরীকে লেখা একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে। ১৩৯০ বঙ্গাব্দে লেখা ওই চিঠিতে সরদার লিখেছিলেন :
‘ঢাকার লোকজন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পেশাদার বুদ্ধিজীবীদের কার্যকলাপ দেখে-শুনে মনে ঘেন্না ধরে গেছে। শুধু তাই নয়, নিজের মনটার প্রতিও কেমন যেন অবিশ্বাস জন্মে গেছে। মাঝে মাঝেই মনে হয় আগের সেই সহজ-সুন্দর অপরকে সহজে ভালোবাসবার মনটা বুঝি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল। এ ভাবনার রশি আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে, তাই সভা-সমিতি, যাকে মনে হয় গলাবাজীর আসর, ওসব জায়গায় আমি যাই-ই না। অর্থাৎ স্বনির্বাসিত জীবনযাপন করি।’
[তিতাস চৌধুরী, দেখা অদেখার স্মৃতি, পৃ. ১৮২]
একজন কথাশিল্পী জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে কতটা বেদনা থেকে এমন। কথা বলতে পারেন। সরদার ছিলেন সহজ-সুন্দর সাদা মনের মানুষ। সহজেই সব। বয়সের ও সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশতে পারতেন। এখন বায়তুল মোকাররম। জাতীয় মসজিদের উত্তর দিকের যেখানে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি, সেখানে একটি দোতলা বাড়ি ছিল। পুরোনো বাড়ি। পরিত্যক্ত সম্পত্তি। চমৎকার একটি উঠানও ছিল। সেটি ছিল ন্যাশনাল বুক সেন্টার। মনে পড়ে সেখানেই ১৯৬৯ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে একটি সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার প্রধান কবি-সাহিত্যিক শিল্পী প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন নওরোজ কিতাবিস্তানের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, শওকত ওসমান, জয়নুল আবেদিন ও জয়েনউদ্দীন। সেদিন। ওয়ালীউল্লাহ একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দেশের সাহিত্যসমাজ আমাকে এতটা ভালোবাসে, আমি জানতাম না। এতকাল বিদেশে রয়েছি, তবু তাঁরা আমাকে মনে রেখেছেন। আমার লেখা পড়েন। এর পরে আর বিদেশে থাকা যায় না। যত শিগগির সম্ভব আমার স্ত্রী ও আমি দেশে চলে আসব। ছেলে-মেয়ে থাকবে প্যারিসে।