পঞ্চাশের দশকের একজন শক্তিশালী ছোটগল্পকার ও সম্পাদকের নাম আহমদ মীর, আজ তিনি বিস্মৃত। তার আসল নাম মহিউদ্দিন আহমদ। হুগলীর অধিবাসী। পঞ্চাশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বহু মুসলমানের মতো তিনিও পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। তার কয়েকটি গল্প অসামান্য। তাঁর গল্পগ্রন্থ লাল মোতিয়া বেরিয়েছিল ষাটের দশকে, কিন্তু গল্প লিখে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন পঞ্চাশের দশকেই। তাঁর ‘ধোবিয়া তালাও’ গল্পটি আমার কাছে আছে। চমৎকার গল্প।
মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তান সরকারের তথ্য বিভাগ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পাক জমহুরিয়াত পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন। ওই পত্রিকায় আমার প্রথম লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। আমার সেদিনের আনন্দের কথা পৃথিবীর কোনো মানুষকে বোঝাতে পারব না। পঞ্চাশের দশকে স্পন্দন নামে একটি মাসিকপত্র তিনি প্রকাশ করেছিলেন। আমার আব্বা তার গ্রাহক ছিলেন। তারপর তিনি বের করেন একটি পাক্ষিক রম্য পত্রিকা রমনা। সেটিরও আমরা গ্রাহক ছিলাম। সেকালে একটি পত্রিকার নতুন সংখ্যাকে অমূল্য সম্পদ মনে হতো। এক লেখা কয়েকবার পড়তাম।
মহিউদ্দিন আহমদ ওরফে আহমদ মীরের আরেকটি পরিচয় তিনি ছিলেন ‘বার্ডস অ্যান্ড বুকস’ নামের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মালিক। আধুনিক সব বই তিনি প্রকাশ করতেন। চমৎকার তার প্রকাশনার মান। গেটআপ, ছাপা, বাঁধাই সুন্দর। তিনি কিছুদিন চাকরি করেছেন মার্কিন পরিক্রমা নামক একটি পত্রিকায়। মার্কিন ছোটগল্পকার এডগার এলান পোর অনেকগুলো গল্পের তিনি অনুবাদ করেন। সেগুলো তাঁর প্রকাশনা থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশ করেন। তাঁর ওই অনুবাদ বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে একটি সময় মহিউদ্দিন আহমদ একটি অতি ভালো গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছেন।
চার
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তিত হয় ১৯৬০ সালে। দ্বিতীয় বছর ১৯৬১ সালে কবিতায় আহসান হাবীব, উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ছোটগল্পে মবিনউদ্দীন আহমদ, নাটকে নূরুল হোসেন, গবেষণা প্রবন্ধে মুহম্মদ আবদুল হাই এবং শিশুসাহিত্যে বেগম হোসনে আরা পুরস্কৃত হন। মবিনউদ্দীন আহমদ আজ বিস্মৃত। যে লেখক আহসান হাবীব, ওয়ালীউল্লাহ প্রমুখের সঙ্গে পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, তাঁর নিশ্চয়ই পাঠযোগ্য সাহিত্যকর্ম থাকবে। সেকালে এখনকার মতো দলীয় রাজনীতির ব্যাপার ছিল না বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানে। তা থাকলে সত্যেন সেনের মতো কমিউনিস্টের বই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হতো না সামরিক শাসক মোহাম্মদ আইয়ুব খানের আমলে।
আজ বাংলাদেশের সাহিত্যে মবিনউদ্দীনের নামনিশানা নেই। তাঁর এভাবে হারিয়ে যাওয়ার কারণ খুবই সহজ। তিনি বিত্তবান ছিলেন না। কোনো প্রভাবশালী পুত্র-কন্যা রেখে যাননি। তিনি কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন না অথবা যুগ্ম সচিবের ওপরের পদে চাকরি করেননি।
যদি থাকত তার প্রভাবশালী পুত্র-কন্যা অথবা কোনো নামীদামি পত্রিকার সম্পাদক তাঁর গুণগ্রাহী, তাহলে ২০১২ সালে তারা ঘটা করে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করতেন। ওসব বাদ দিলেও বাংলাদেশে যদি একাডেমিক পর্যায়ে মৌলিক গবেষণার রেওয়াজ থাকত, তাহলে কেউ তার সম্পর্কে কিছু আলোচনা করতেন। মবিনউদ্দীন কোনো প্রকাণ্ড বড় লেখক ছিলেন না, কিন্তু লেখক তিনি ছিলেন এবং শুধু লেখকই ছিলেন। বেশ কিছু চমৎকার ছোটগল্প রয়েছে তাঁর। তিনি সেই সময় পূর্ব বাংলায় কথাসাহিত্যের চর্চা করেছেন। যখন বড় মাপের লেখক এখানে দু-চারজনের বেশি ছিলেন না।
মবিনউদ্দীন ছিলেন অতি সজ্জন, নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। তিনি যে একজন খ্যাতিমান লেখক, সে রকম কোনো অহংকার তাঁর আচরণে প্রকাশ পেত না। পঞ্চাশের দশকে আমি তাঁকে দেখেছি। তার সঙ্গে আমার আব্বার বন্ধুত্ব ছিল, যদিও আব্বা তার চেয়ে বয়সে কিছু বড় ছিলেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমি তাঁকে দেখেছি পাটুয়াটুলী লয়াল স্ট্রিটে সওগাত অফিসে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের সম্পাদকীয় দপ্তরে। মবিনউদ্দীন চাকরি করতেন ঢাকা জজ কোর্টে। সম্ভবত ছিলেন নিচের পদের কোনো কর্মকর্তা।
মবিনউদ্দীনের জন্ম ১৯১২ সালে মানিকগঞ্জ জেলার পারিল নওয়াদা গ্রামে। তাঁদের পরিবার ছিল গ্রামীণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার। তাঁর এক চাচা ছিলেন ঢাকার সাব-ডেপুটি কালেক্টর। পরিবারের অনেকেই ছিলেন শিক্ষিত। কথাসাহিত্যিক মতীয়র রহমান খান তাঁদেরই পরিবারের সদস্য। মবিনউদ্দীন কলকাতা বঙ্গবাসী বা সিটি কলেজ থেকে চল্লিশের দশকে বিকম পাস করেন। আইকম পাস করেন জগন্নাথ কলেজ থেকে। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যাওয়ায় চাচা-মামাদের অভিভাবকত্বে তিনি বেড়ে ওঠেন। সে জন্য তাকে কষ্ট করতে হয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে একজন গ্র্যাজুয়েট মুসলমান চেষ্টা করলে অনেক কিছুই হতে পারতেন। মবিনউদ্দীন ছিলেন সাহিত্যগত প্রাণ। কোর্টে চাকরি এবং লেখালেখি ছাড়া তিনি আর কিছুই করেননি। সেকালে তাঁর চেয়ে ছোট চাকুরে ঢাকায় বিষয় সম্পত্তি করেছেন। তাঁর সে আগ্রহ ছিল না। কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন ছিলেন তাঁরই এলাকার মানুষ। মঈনুদ্দীনের বাংলাবাজার আলহামরা লাইব্রেরিতেও তিনি সন্ধ্যার দিকে যেতেন। তাঁর কোনো একটি বই আলহামরা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে থাকতে পারে বলে মনে পড়ছে।