শহীদ সাবের ছিলেন চল্লিশের দশকের বাম ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পরে কমিউনিস্ট পার্টির একজন কর্মী হিসেবে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের নজরে পড়েন এবং পঞ্চাশের প্রথম দিকে কয়েকটি বছর বিনা বিচারে কারাগারে কাটান। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেন। ১৯৫৫-তে প্রকাশিত হয় তাঁর ছোটগল্প সংকলন এক টুকরো মেঘ। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমি যখন বংশাল রোডের সংবাদ অফিসে তাঁকে দেখেছি, তখন তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। টেবিলে বসে আপনমনে লেখালেখি করলেও কথাবার্তা বিশেষ বলতেন না। অনেকগুলো বছর সংবাদই ছিল তাঁর ঘরবাড়ি। সংবাদ যেন একটি পরিবার এবং সেই পরিবারের একজন স্থায়ী সদস্যের মতো ছিলেন শহীদ সাবের। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে তিনি সংবাদ অফিসেই ছিলেন। পরবর্তী তিন-চার দিনে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও তিনি সংবাদেই থেকে যান। ৩০-৩১ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সংবাদ অফিস জ্বালিয়ে দেয়, ভেতরে তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে একজন চরম নিরীহ মানুষ মারা যান। শহীদ সাবেরের কবিতাও বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
হাসান হাফিজুর রহমান সংগঠক হিসেবে ছিলেন অসামান্য। অন্যকে লেখায় উৎসাহ দেওয়ায় ছিলেন অদ্বিতীয়। ছিলেন অসামান্য বন্ধুবৎসল। গল্প-কবিতা-নিবন্ধ লিখতেন। পঞ্চাশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে রচিত তাঁর আরও দুটি মৃত্যু গল্পটি প্রশংসিত হয়েছিল। গল্পকার হিসেবে সাইয়িদ আতীকুল্লাহর হাত ছিল ভালো। পঞ্চাশ ও ষাটে কয়েকটি গল্প লিখে তিনি একজন আধুনিক গল্পকার হিসেবে পরিচিতি পান, কিন্তু একপর্যায়ে লেখা ছেড়ে দেন। কিছুই যখন লিখছেন না, চাকরি করছিলেন ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তার, অথচ লেখার শক্তি আছে। আমরা প্রায়ই আড্ডা দিতাম, যদিও তিনি ছিলেন অত্যন্ত নীরস প্রকৃতির মানুষ। স্বাধীনতার পরে আমি তাঁকে লেখার জন্য পীড়াপীড়ি করি। আমি তখন সময় নামে একটি সাহিত্যপত্র প্রকাশ করছিলাম। তার প্রথম সংখ্যায় তাঁকে একটি লেখা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। তিনি অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি বললাম, একটা কবিতা অন্তত দিন। তিনি দিলেন একটি কবিতা। কেউ কেউ প্রশংসা করল। সেই যে তিনি কবিতা লেখা শুরু করলেন, আমৃত্যু শুধু কবিতাই লিখলেন। অনেকগুলো কবিতার বইও বের হলো। তাঁর কবিতায় রসের লেশমাত্র ছিল না। শেষ জীবনে সংবাদে কাজ করেছেন এবং ক্যানসারে মারা যাওয়ার আগে প্রেসক্লাবেই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতেন।
আতীকুল্লাহর শেষ গল্পটি আমি তাকে অনুরোধ করে লিখিয়ে ত্রৈমাসিক নাগরিক-এ ছেপেছিলাম উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের পরে। তাঁকে দিয়ে শেষ গল্প আমি লিখিয়েছি এবং প্রকাশও করেছি, এবং তাঁর প্রথম কবিতাও আমি অনুরোধ করে লিখিয়ে আমার পত্রিকায় ছেপেছি। আতীকুল্লাহকে দিয়ে চাপ দিয়ে লেখানোর কারণ তার পড়াশোনা ছিল। আধুনিক সাহিত্য কী তা তিনি বুঝতেন। কিন্তু কবিতা লিখতে গিয়ে পণ্ডশ্রম করে শক্তি ক্ষয় করেন, সাহিত্যের কোনো উপকার করতে পারেননি।
বাংলাদেশে ছোটগল্পের একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। যথেষ্ট ভালো লিখছিলেন অনেকেই। তবে নিষ্ঠাসহকারে চর্চা অব্যাহত রাখতে পারেননি তাঁরা। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ভাষা ভালো ছিল। বাহুল্যবর্জিত ও মার্জিত। চট্টগ্রামের সুচরিত চৌধুরীর গল্পের স্বাদ ছিল আলাদা। তাঁর গল্পের বই আকাশে অনেক ঘুড়ি ভালো লেগেছিল। মিরজা আবদুল হাই কয়েকটি চমৎকার গল্প লিখেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির সূত্রে তাঁকে তকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে থাকতে হয়েছে, যে জন্য বাংলাদেশের মূলধারার লেখকদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। সত্তর ও আশির দশকে তার সঙ্গে আমার কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়। তাঁর একটি গল্প ‘মেহেরজানের মা’ পড়ে সত্যজিৎ রায় প্রশংসা করেছিলেন এবং বলেছিলেন এটি ছবি করার উপযুক্ত। আমাদের কোটারিবিশিষ্ট সাহিত্যজগতে দলছুট মিরজা আবদুল হাই জায়গা করে নিতে পারেননি। অবহেলিত থেকেই মারা যান।
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মহিলা কথাশিল্পী ছিলেন হাতে গোনা। নূরুন নাহার নামের একজন ছোটগল্পকারের দেখা পাওয়া যায় ‘৪৭-এর পরে। সম্ভবত তিনি থাকতেন চট্টগ্রামে, তবে শুনেছি তিনি ছিলেন টাঙ্গাইলের বাসিন্দা। তিনি ছিলেন কলকাতা লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের ছাত্রী। বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে পঞ্চাশের দশকে তাঁর খুবই খ্যাতি ছিল। সমাজের আনুকূল্য পাননি। ঢাকার বাইরের লেখকেরা মূলধারা থেকে প্রায়ই পান অবহেলা। তিনিও অবহেলায় আজ হারিয়ে গেছেন। অথচ তিনি সামান্য লেখিকা ছিলেন না।
নূরুন নাহারের একটি কবিতার বই অগ্নি ফসল প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম থেকে। পঞ্চাশের দশকেই প্রকাশিত তাঁর ছোটগল্পের বই বোবা মাটি যথেষ্ট নাম করেছিল। সম্ভবত মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। নূরুননাহারের বই নিয়ে চৌধুরী ছোট একটি আলোচনা লিখেছিলেন। নূরুন নাহারের দুটি উপন্যাসও বেরিয়েছিল পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে। সেগুলো জাঙ্গালের মেয়ে এবং রূপালী হৃদয়ের তীরে। আজ আমাদের অনেক মহিলা কথাশিল্পী রয়েছেন। তাঁদের পথ যারা তৈরি করেছিলেন প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে তাঁদের ঋণ অস্বীকার করা যায় না।