সাহিত্য সাধনা সংঘের সাহিত্য আলোচনার চেয়ে কম আকর্ষণীয় ছিল না তাতে পরিবেশিত নাশপানি। জসীমউদ্দীনের কৃপণতা সম্পর্কে নানা সত্যমিথ্যা গল্প প্রচলিত আছে, কিন্তু তাঁর বাড়িতে অনুষ্ঠিত সাহিত্যের বৈঠকে যারা যোগ দিতেন, তাঁদের তিনি অকৃপণভাবে আপ্যায়িত করতেন। যেদিন আকবর হোসেনের বাড়িতে বৈঠক হতো, সেদিন খানাপিনার আয়োজন থাকত পর্যাপ্ত। তিনি চাকরি করতেন অ্যাকাউনট্যান্ট জেনারেলের অফিসে। চাকরি ছাড়াও তাদের পারিবারিক অবস্থা ছিল ভালো। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী মহকুমার কেয়া গ্রামে। তাঁর সঙ্গে আমার এতটাই ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল যে একবার মধ্য-৬০-এ তিনি আমাকে তাদের গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন। চার-পাঁচ দিন ছিলাম সেখানে। তাঁর বৃদ্ধ বাবা ও ছোট ভাই নূরুদ্দীনের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠতা জন্মে। তাঁদের সঙ্গে আমি গ্রামবার্তা প্রকাশিকার সম্পাদক-প্রকাশক কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বাড়িতে যাই। হরিনাথের এক নাতি, তাঁর ছোট ছেলের সঙ্গে কথা হয়। কাঙালের গানের কিছু বই আমাকে উপহার দেন। স্মরণীয় যা তা হলো, যে মেশিনে দেড় শ বছর আগে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা মুদ্রিত হতো, সেটি দেখতে পাই। ছোট ট্রেডল মেশিনটি তখনো চালু ছিল। অল্পসল্প ছাপার কাজ তাতে হতো। কাঙালের নাতির তা থেকেই খুব কষ্টে জীবিকা নির্বাহ হতো।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আমি মাস তিনেক জসীমউদ্দীন ও আকবর হোসেনের প্রতিবেশী ছিলাম। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ তুলে নিলে প্রথমেই আমি তাঁদের দুজনের সঙ্গে দেখা করি। তারা পরামর্শ দেন কোনো রকমে ঢাকার বাইরে যেতে। পূর্ববর্তী তিরিশ ঘণ্টার নারকীয়তার পর অস্পষ্ট অবস্থায় পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তা বোঝার সাধ্য কারোরই ছিল না। যা হোক, আকবর হোসেনের আরও কয়েকটি উপন্যাস পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রকাশিত হয়, যেমন মোহমুক্তি, ঢেউ জাগে প্রভৃতি। তত দিনে নতুন যুগের কথাশিল্পীদের আবির্ভাব ঘটেছে।
তিন
আমাদের শৈশব-কৈশোরে বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে যাদের সক্রিয় দেখেছি, তাঁদের প্রায় সবাই আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন। এ প্রজন্মের কেউ তাঁদের নামটিও জানেন না, তাঁদের লেখার সঙ্গে পরিচয় তো নেই-ই। একটি বনে কত উদ্ভিদই জন্মে কিন্তু টিকে থাকে অল্প, বৃক্ষে পরিণত হয় আরও অল্প কয়েকটি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পনেরো-আনা’ প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘মরার পরে অল্প লোকেই অমর হইয়া থাকেন, সেইজন্যই পৃথিবীটা বসবাসযোগ্য হইয়াছে। ট্রেনের সব গাড়িই যদি রিজার্ভ গাড়ি হইত তাহা হইলে সাধারণ প্যাসেঞ্জারদের গতি কী হইত?… জীবন বৃথা গেল। বৃথা যাইতে দাও। অধিকাংশ জীবনই বৃথা যাইবার জন্য হইয়াছে। এই পনের আনা অনাবশ্যক জীবনই বিধাতার ঐশ্বর্য সপ্রমাণ করিতেছে।’
শিল্প-সাহিত্যজগতের গৌণদের নিয়ে ভাবতে গেলে রবীন্দ্রনাথের কথাটিকে দামি মনে হয়। তাঁর ভাষায়, ‘জীবন বৃথা গেল। যাইতে দাও। কারণ, যাওয়া চাই। যাওয়াটাই একটা সার্থকতা। নদী চলিতেছে –তাহার সকল জলই আমাদের স্নানে এবং পানে এবং আমন-ধানের ক্ষেতে ব্যবহার হইয়া যায় না। তাহার অধিকাংশ জলই কেবল প্রবাহ রাখিতেছে। আর কোনো কাজ না করিয়া কেবল প্রবাহরক্ষা করিবার একটা বৃহৎ সার্থকতা আছে।’ কোনো জাতির শিল্প-সাহিত্যের জগৎটিও প্রবহমান নদীর মতো। শুধু অল্প কয়েকজন প্রধান তাঁকে প্রাণবন্ত রাখতে পারেন না, সজীব রাখতে গৌণদের ভূমিকাই বেশি।
১৯৫৫-তে আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ি প্রকাশের আগে আরও অনেকে তাঁদের গল্প-উপন্যাসের বই প্রকাশ করেছেন। কবিতার বইও বেরিয়েছে কারও কারও। সেকালে দুজন বেদুইন ছিলেন, একজন বেদুইন সামাদ এবং আরেকজন বেদুইন শমসের। উভয়েরই লেখনী-নাম, আসল নাম ছিল অন্য। বেদুইন সামাদ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলায় আসেন। তিনি অনেকগুলো উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস বেলাশেষে, পথে যেতে যেতে এবং নিষ্পত্তি প্রকাশিত হয় মধ্য-৫০ বা ওই দশকের শেষে। মোটের ওপর তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
বেদুইন শমসের ছিলেন আইনজীবী, ফরিদপুরের অধিবাসী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কয়েক বছরে প্রকাশিত হয় তাঁর কয়েকটি উপন্যাস : রিকশাওয়ালা, বেঈমান, বুড়িগঙ্গার বুকে, কাঁটা ও ফুল প্রভৃতি। দুই বেদুইনই সেকালে বিভিন্ন সাময়িকীতে লিখতেন। তবে উভয়েই কর্মজীবনে ঢাকার বাইরে থাকায় মূলধারার লেখকদের সঙ্গে ছিল তাঁদের অনতিক্রম্য দূরত্ব। সে কারণেই তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগেই হারিয়ে যান।
সরদার জয়েনউদ্দিনের আদিগন্ত, শামসুদ্দীন আবুল কালামের আলমনগরের রূপকথা, আবদুল গাফফার চৌধুরীর চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান পঞ্চাশের প্রথম দিকেই প্রকাশিত হয় এবং কথাশিল্পী হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠা পান। পরে অবশ্য তাঁরা আরও পরিণত উপন্যাস লিখেছেন। তাঁদের রচনার বিষয়বস্তু ইসলাম তথা পাকিস্তানি ধ্যানধারণা নয়, দেশের সাধারণ মানুষ।
পঞ্চাশের দশকে ছোটগল্প লিখে যারা খ্যাতি অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ষাট ও সত্তরের দশক পর্যন্ত খ্যাতি ধরে রাখতে পেরেছিলেন, অনেকেই হারিয়ে যান। কেউবা লেখাই ছেড়ে দেন। ওই দশকে যারা ছোটগল্পকার হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ সাবের, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মিরজা আবদুল হাই, সুচরিত চৌধুরী পাঠকসমাজে সমাদৃত হয়েছিলেন।