কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে তিনি যখন অনার্সের ছাত্র, তখন ১৯৫১-তে কলকাতায় এক আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে যান। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ছিল কমিউনিস্টবিরোধী। শামসুর রাহমান সে প্রসঙ্গে জানান, ‘শান্তি সম্মেলন শেষ হওয়ার পরেই প্রগতিশীল লেখক আলাউদ্দিন আল আজাদকে প্রেসিডেন্সি জেলে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে কিছুদিন কাটাতে হয়। … প্রগতিশীল চিন্তাধারার জন্যে তাকে পাকিস্তান আমলে দুবার কারারুদ্ধ হতে হয়।’
জীবনের প্রথম দিকে জেলজুলুম সহ্য করেছেন, আজাদের শেষ জীবনটাও দুঃখভারাক্রান্ত। ডায়াবেটিসে ভুগেছেন বহুদিন। একমাত্র ছেলেটিকে সুপ্রতিষ্ঠিত দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর ছাত্ররা অনেকেই রাষ্ট্রের উঁচু পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাদের সহযোগিতা তার প্রত্যাশিত ছিল। চক্ষুলজ্জা ত্যাগ করে দেশের জন্য অনেকের কাছে গেছেন। দু-একবার আমি তাঁর সঙ্গী হয়েছি। কোনো আনুকূল্য পাননি। প্রীতিভাজনদের ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছেন বটে, কিন্তু সে কষ্ট সামান্য কষ্ট। জীবনের শেষ প্রান্তে প্রিয়তম পুত্রকে নিয়ে তিনি যে আঘাত পান, তা পৃথিবীতে যেকোনো পিতার জন্যে সর্বোচ্চ আঘাত। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে অকালে তাঁর ছেলে মারা যান। ওই সময় মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে আমার ফোনে কথা হতো। যখন পুত্রের প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি কেঁদে দিতেন, আমি সইতে না পেরে অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে কোনো অজুহাতে ফোন রেখে দিতাম। পুত্রের মৃত্যুর অল্পদিন পরই তিনিও মারা যান। তবে সন্দেহ নেই, একদিন তার মূল্যবান সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন হবে, রচিত হবে তার জীবন নিয়ে গ্রন্থ।
ব্যাপারটি কাকতালীয়। যা ছিল আমার শৈশবকাল ও কৈশোরের সময়, বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যেরও সেটি শৈশবকাল।দেড়শ বছরের কলকাতার প্রাধান্য থেকে বেরিয়ে এসে এই ভূখণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের আবেগ-অনুভূতি, তাদের স্বপ্ন ও বাস্তব, তাদের হতাশা ও বঞ্চনার কথা তাদের নিজেদের ভাষায় প্রকাশ করার সুযোগ পায়। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে দীর্ঘকাল পিছিয়ে থাকায় তাদের যোগ্যতার অভাব ছিল। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দুর্বল থাকায় কলকাতায় তাদের কেউ জায়গা দেয়নি, মর্যাদা দেয়নি। আত্মপ্রকাশের জন্য একটা ভূখণ্ড চাইছিল তারা, যেখানে ঘটবে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাংস্কৃতিক বিকাশ। সেই ভূখণ্ডটি তারা অর্জন করে ১৯৪৭-এ। ফলে আত্মপ্রকাশ ঘটে একদল কবি, লেখক ও চিত্রশিল্পীর।
যারা পথ নির্মাণ করেন, তাদের দোষ ও দুর্বলতা ক্ষমার অযোগ্য নয়। যে উদ্যানে গোলাপ, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা প্রভৃতি নেই, সেখানে ভাঁটফুল বুনোফুল যা-ই ফুটুক, তাকে কদর না করে উপায় নেই। ১৯৪৮ থেকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত ঢাকা থেকে যেসব গল্প-উপন্যাস-কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর লেখকদের অমূল্য সাহিত্যকর্মের জন্য নয়, অন্য কারণে মর্যাদা প্রাপ্য। তাঁদের তৈরি মেঠো পথটিই ৫০ বছরের মধ্যে সুপরিসর পিচঢালা সড়কে পরিণত হয়েছে।
পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে একটি উপন্যাস বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পায়। সেটি আকবর হোসেনের অবাঞ্ছিত। তাঁর আরেকটি উপন্যাস কী পাইনি। দুটি উপন্যাসই আমাদের বাড়িতে পঠিত হয়েছে, আমিও পড়েছি, অন্যদেরও পড়তে দেখেছি। শিল্পকর্ম হিসেবে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু উপন্যাস দুটি ১৫-২০ বছর খুবই জনপ্রিয় ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে অনেকগুলো সংস্করণ হয়। এবং জনপ্রিয়তার কারণেই ষাটের দশকে অবাঞ্ছিতর কাহিনি অবলম্বনে চলচ্চিত্র হয়েছিল এবং তা জনপ্রিয়ও হয়েছিল। মনে পড়ে আমিও দেখেছিলাম কারও সঙ্গে।
আকবর হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় ষাটের দশকের প্রথম দিকে। তখন আমার কিছু গল্প-কবিতা পত্রপত্রিকায় বেরোচ্ছে। কবি জসীমউদ্দীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাহিত্য সাধনা সংঘ’। প্রতি সপ্তাহে ওই সংগঠনের বৈঠক বসত কমলাপুরে, কোনো দিন জসীমউদ্দীনের বাসভবন ‘পলাশবাড়ীতে, কোনো দিন তাঁর প্রতিবেশী অবাঞ্ছিতের লেখক আকবর হোসেনের বাড়িতে এবং কোনো দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বাঙালি জাতীয়তাবাদী জিয়াউল হকের বাসভবনে। তরুণ ও প্রবীণ ২৫-৩০ জন কবি-সাহিত্যিক সেই রবিবাসরীয় বৈঠকে যোগ দিতেন। লেখকেরা তাঁদের রচনা পাঠ করতেন। তা নিয়ে আলোচনা করতেন অন্যরা। মাঝে। মাঝে ওই বৈঠকে আসতেন অজিত গুহ, জগন্নাথ কলেজের বাংলার অধ্যাপক। তাঁর আলোচনা হতো খুবই বস্তুনিষ্ঠ ও মনোজ্ঞ । সাহিত্যের আসর শেষ হলে কোনো দিন অজিত গুহের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর হাটখোলার বাসস্থান ‘টয় হাউসে’ যেতাম। তিনি ছিলেন অসামান্য সংস্কৃতিমান মানুষ। আমাদের মতো কবিযশোপ্রার্থীদের অকৃপণভাবে উৎসাহ দিতেন।
সাহিত্য সাধনা সংঘের আসরে প্রবীণদের মধ্যে যেতেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, জয়নুল আবেদিন, শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দিন, কবি-গীতিকার আজিজুর রহমান, প্রাবন্ধিক আবদুল হক প্রমুখ। আরেকজন প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন, তিনি হলেন রাচি মানসিক হাসপাতালের সাবেক চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ হোসেন। তিনি ছিলেন নজরুলের চিকিৎসক। আমি ১৯৬৪ সালে সাহিত্য সাধনা সংঘের এক বৈঠকে নজরুলের ওপর একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলাম। সেই কাঁচা রচনাটির ওপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছিলেন অজিত গুহ, আজিজুর রহমান ও মোহাম্মদ হোসেন। নজরুলের অসুস্থতা নিয়ে এবং তাঁর সেই সময়ের অবস্থা নিয়ে ডাক্তার হোসেন বহু মূল্যবান তথ্য দিয়েছিলেন। সম্ভবত ডাক্তার হোসেনের ভায়রা ছিলেন চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শফিকুল আমিন। তিনিও মাঝে মাঝে জসীমউদ্দীনের রবিবাসরীয় বৈঠকে যোগ দিতেন।