বিত্তহীন ও মুসলমান বলে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান কলকাতায় মর্যাদা পাননি। হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ছিলেন বলে ডা. লুৎফর রহমান নামে পরিচিত ছিলেন। উন্নত জীবন, মানব জীবন, মহৎ জীবন প্রভৃতি বইয়ের সাহিত্যমূল্য যতটা, তার চেয়ে বেশি এগুলোর জীবন গঠনে ভূমিকার জন্য। তাঁর লেখাগুলো অনুপ্রেরণাদায়ক, যা একটি অনগ্রসর সমাজে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিতে খুবই প্রয়োজন। তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী ও সমাজসংস্কারক। লুৎফর রহমান সম্পর্কে মাসিক সওগাত মন্তব্য করেছিল :
‘[তাঁর থেকে] অনেক রচনা পাইবার আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যবশত; এত বড় একজন শক্তিশালী লেখককে আমরা হারাইতে বসিয়াছি। বিগত কয়েক মাস যাবত তিনি কঠিন ক্ষয়কাস রোগে আক্রান্ত হইয়াছেন। তাঁহার জীবনের আশা খুব কম। অর্থাভাবে চিকিৎসা হইতেছে না।]
[সওগাত, শ্রাবণ ১৩৩৩] তাঁর উপযুক্ত চিকিৎসা সহায়তার জন্য ‘সনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো হয়েছিল, কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি মুসলমানসমাজ থেকে। নারীমুক্তি আন্দোলননের তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ প্রবক্ত। গঠন করেছিলেন ‘নারী তীর্থ’ নামে একটি সংগঠন। নির্যাতিতা নারীদের আশ্রয়কেন্দ্র ছিল নারী তীর্থ। নারী তীর্থের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লুৎফর রহমান সওগাতে লিখেছিলেন :
‘নারীর সুবিপুল দুর্ভাগ্যের বোঝা, তাহার জীবনের শত দুর্দশার কথা আমরা অবগত আছি। নারীর প্রতি যে অসহ্য রকম অবিচার হইতেছে, ইহার সাহস করিয়া বলিবার প্রয়োজন আমরা অনুভব করিতেছি। নারীকে লইয়া বাঙলার পথে ঘাটে যে রহস্য-লীলা চলিয়াছে, ইহার বিরুদ্ধে এবং নারীর অন্য সকল প্রকার দুঃখের বিরুদ্ধে আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করিলাম।
‘নারী জীবন ব্যর্থ হইয়া যাওয়াতে আমাদের জীবনের কাজও ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। আজ নারী-পুরুষ সবাইকে শক্তি-সাধনায় জাগ্রত হইতে হইবে। দিকে দিকে নারী-জীবনের জয়-সঙ্গীত ধ্বনিত হোক।’
মুহম্মদ নাসিরউদ্দিন লিখেছেন, “দুঃখের বিষয় শারীরিক অসুস্থতার দরুন ও অর্থের অভাবে তিনি “নারী তীর্থ” সংঘটি পরিচালনা করতে পারেননি। … অর্থাভাবে তাহার উপযুক্ত চিকিৎসা হয়নি। অকালে এই মহান লেখক ও চিন্তাবিদের জীবনদীপ নির্বাপিত হইয়াছে।
দুই
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই সংঘবদ্ধ সাহিত্যচর্চার একটি পরিবেশ গড়ে ওঠে ঢাকায়, যেমনটি অনেক আগেই তৈরি হয়েছিল কলকাতায়। ওই সময়ের নতুন লেখকদের বন্ধুচক্রটি বিশেষ ছোট ছিল না। আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আনিসুজ্জামান প্রমুখ। বয়সে ছিলেন চার-পাঁচ বছরের ছোট-বড়।
তরুণ লেখকদের মধ্যে ছাত্র হিসেবে মেধাবী এবং লেখক হিসেবে নিষ্ঠাবান ছিলেন আজাদ। তিনি আড্ডায় সময় দিতেন কম, লেখালেখিতে সময় দিতেন বেশি। সে জন্য অল্প বয়সেই তাঁর বেশ কয়েকটি বই বেরিয়ে যায় এবং তিনি অল্প সময়ে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। শামসুর রাহমান তাঁকে আখ্যায়িত করতেন ‘সাব্যসাচী সাহিত্যস্রষ্টা” বলে। রাহমান তার স্মৃতিকথা কালের ধুলোয় লেখাতে বলেছেন :
‘আলাউদ্দিন আল আজাদ আমাদের কালের বিরল এক প্রতিভাবান সব্যসাচী সাহিত্যস্রষ্টা। … আমরা যারা পঞ্চাশ দশকের লেখক বলে চিহ্নিত তাদের মধ্যে আলাউদ্দিন আল আজাদ শুরু থেকেই একজন নামজাদা লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।’
প্রায় সব বয়সী এবং বন্ধুপ্রতিম আজাদ সম্পর্কে রাহমানের ধারণা ছিল খুবই উঁচু। সমসাময়িকদের মধ্যে খ্যাতির প্রশ্নে যে অসূয়া থাকা স্বাভাবিক, তিনি ছিলেন তা থেকে মুক্ত। আজাদ সম্পর্কে রাহমানের বক্তব্য তাঁর প্রমাণ। তিনি লিখেছেন :
‘আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখনী কখনো আলস্য পোহায়নি; জনপ্রিয়তা, প্রতিষ্ঠা, নানামুখী সাফল্য তাঁকে আত্মতুষ্টির মোহে আটক রাখতে পারেনি। তিনি লিখে গেছেন অনবরত, এখনও লিখে চলেছেন, প্রশংসিত হচ্ছেন বিজ্ঞ সমালোচক এবং উৎসাহী পাঠক-পাঠিকা মহলে। ঈর্ষাযোগ্য তাঁর সাহিত্য রচনার ক্ষমতা। গোড়ার দিকে তাঁর জীবনযাত্রার পথ পুষ্পময় ছিল না, অভাবের কাটার খোঁচা তাঁকে খেতে হয়েছে বারবার। কিন্তু প্রতিভার উজ্জ্বলতা যার সত্তাকে লালন করে, কোনও বাধা, কোনও অভাব কিংবা বহুরূপী প্রতিকূলতা তাঁর অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করতে পারে না। তাই আজাদ রূপকথার নায়কের মতো অভাবের রাক্ষসটিকে সাধনার ক্ষুরধার অস্ত্রের আঘাতে বধ করে গোছানো, নিরাপদ, ঝলমলে সংসাররূপী রাজকন্যার সঙ্গে সুখী জীবনযাপন করছেন।
আজাদের সঙ্গে শামসুর রাহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না। উভয়ের জীবনযাপনের ধরনও ছিল ভিন্ন। রাহমান ছিলেন অবৈষয়িক, অরাজনৈতিক সাদাসিধা মানুষ। শেষ জীবনে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে দূরত্ব রচিত হয়েছিল। সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং সে সম্পর্কে বলতে গেলে দীর্ঘ আলোচনা করতে হয়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক যখন শিথিল, সেই সময়ও শামসুর রাহমান আজাদ সম্পর্কে লিখেছিলেন :
‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আলাউদ্দিন আল আজাদ কস্মিনকালেও স্থবিরতাকে মেনে নেবেন না; কারণ তিনি আমাদের একজন প্রধান লেখকই নন, একজন অত্যন্ত সচেতন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষও। আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তিনি তোলেন না বলেই জানি। তিনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন তুখোড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ অনার্স এবং এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। পিএইচডি করেছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দেশের শিক্ষা বিভাগের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেছেন ডক্টর আলাউদ্দিন আল আজাদ। তবে ভবিষ্যৎ তাকে কুর্নিশ করবে এ দেশের একজন প্রতিভাবান লেখক হিসেবেই।’