বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তা থাকায় আমাদেরও সে রকম হওয়ার কথা। নির্মলেন্দু গুণ আমাদেরই কবি, পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের কেউ নন। তা যে নন তা গুণের উপস্থিতিতে আমি নিজেই কলকাতায় একবার প্রমাণ পেয়ে এসেছি। কয়েক বছর আগে নির্মল এক লাখ টাকার পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠানটি ছিল চমৎকার, উপস্থিতিও ছিল ভালো। কিন্তু না পুরস্কারদাতারা শ্রোতারা কারোই গুণের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে বিশেষ ধারণা আছে বলে মনে হলো না। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বাংলাদেশের কেউ নন, সম্পূর্ণ পশ্চিমবঙ্গের বা ভারতীয় লেখক, যদিও তার রচনার সঙ্গে বাংলাদেশের পাঠকদের পরিচয় যথেষ্ট। লেখকের জাতীয়ত্ব ও নাগরিকত্বের পরিচয়টি বড়, তাঁর ধর্মবিশ্বাস নয়।
বাংলা সাহিত্যের মূলধারার হিন্দু লেখকেরা বাঙালি মুসলমান লেখকদের আলাদা সারিতে রাখার পক্ষপাতী, যেমন অনেক আগে একসময় ভোজসভায় হিন্দু-মুসলমান। উচ্চবর্ণের হিন্দু ও নিম্নবর্ণের হিন্দু আলাদা সারিতে বসতেন। এ ক্ষেত্রে নজরুলই প্রথম ব্যতিক্রম। কবিজীবনের শুরুতেই নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ এক অনুষ্ঠানে তার পাশে বসান। ব্যাপারটি প্রতাঁকে পরিণত হয়। বাংলা কাব্যে নজরুলের অবস্থান রবীন্দ্রনাথের পাশেই। রবীন্দ্রযুগের প্রধানতর একজন কবি জসীমউদ্দীন। তাঁকেও ‘পল্লীকবি’, ‘মুসলমান কবি’, ‘পূর্ব বাংলার কবি’ এ রকম নানা অভিধায় ঠেলে দিয়ে বাংলা কবিতার মূলধারা থেকে সুকৌশলে সরানোর নানা অপচেষ্টা হয়েছে। কৌশলীরা আপাতত কিছুটা সফল হলেও চূড়ান্ত বিজয় জসীমউদ্দীনেরই হবে, কারণ তিনি ‘খাঁটি বাংলা ভাষার কবি। তিনি মৌলিক কবি, পশ্চিমের আধুনিক কবিদের অনুকরণ করে আধুনিক কবি’ হওয়ার চেষ্টা তিনি করেননি।
১৯২০, ৩০ ও ‘৪০-এর দশকে নজরুল ছাড়াও বেশ কয়েকজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী লেখকের আবির্ভাব ঘটে, যাঁদের রচনা যথেষ্ট পরিশীলিত নয়, কিন্তু তাঁরা আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক লেখক। তাঁরা বাঙালি মুসলমানসমাজের সংকীর্ণতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার প্রভৃতি বিষয়কে আঘাত করে লিখেছেন। সৃষ্টিশীল ওই লেখকদের সব রচনা শিল্পকর্ম হিসেবে বড় কিছু নয়, কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। সেগুলো পাঠ করে বড় লেখকেরা যদি তাদের দুর্বলতাগুলোকে এবং গুণগুলোকে ধরিয়ে দিতেন, তাহলে তারা উৎসাহিত হয়ে হয়তো অপেক্ষাকৃত ভালো লিখতেও পারতেন। তাতে বাংলা সাহিত্য উপকৃত হতো। কিন্তু তারা পেয়েছেন শীতল অবজ্ঞা। অনেকের মধ্যে সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু কোনো আনুকূল্য না পাওয়ায় তাঁদের কোনো অগ্রগতি হয়নি।
মুসলমান লেখকদের অনেকেই বহুদিন ইসলাম ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পড়ে থেকে শক্তি ক্ষয় করেছেন। বাংলার পলি মাটিতে তাদের পা দুটি ছিল, কিন্তু তাদের চোখ ও মন ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির দিকে। বিশের দশকে অনেক মুসলমান তরুণ কবি-সাহিত্যিক যশোপ্রার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলেন নজরুল। তারা যে বাঙালি এই আত্মপরিচয় নিয়েও তাঁদের সব দ্বিধা কেটে যায়। পাকিস্তানি জোয়ারে অনেক মুসলমান তরুণ ভেসে গেলেও, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুই দশক আগে থেকেই একটি অসাম্প্রদায়িক ক্ষীণ ধারা মুসলমান লেখকেরা সৃষ্টি করেন। সর্বহারা ও শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ পেয়েছে কারও কারও রচনায়। তাঁরা কোনো দিক থেকেই কোনো আনুকূল্য পাননি। বামপন্থী কবি হিসেবে অকালপ্রয়াত সুকান্ত ভট্টাচার্য স্বীকৃতি পান। কিন্তু তারও আগে যশোরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার অধিবাসী আশরাফ আলী খান জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন এবং শ্রমজীবী ও সর্বহারাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ১৯২০-২১ সালে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। বহু পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেও জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে পারেননি। দারিদ্র্যের যন্ত্রণা সইতে না পেরে ১৯৩৯ সালে আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তাঁর কংকাল একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তাঁর কবিতায় কাব্যগুণের অভাব কোথায়–
ওগো রাজপথ কোথা পেলে এত গভীর মায়ের স্নেহ?
তোমার বুকের স্নেহ-সুধা হতে বঞ্চিত নয় কেহ;
ধনীরা চালায় গাড়ি-ঘোড়া ওই বুকের উপর দিয়া,
দুখীরা ঘুমায় দুই বাহু ‘পরে ক্ষীণ দেহ এলাইয়া;
যেই অভাগার দাঁড়াবার স্থান জগতে কোথাও নেই;
তুমি দাও তব বিশাল বক্ষে যত্নে তাহারে ঠাঁই।
আশরাফ আলী খান ইকবালের উর্দু কাব্যগ্রন্থ শেকোয়ার বাংলায় অনুবাদ করেন। তাঁর ওই তর্জমার তারিফ করেছেন নজরুল। এ ধরনের মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন দরিদ্র, কিন্তু চিন্তাচেতনায় ছিলেন প্রগতিশীল।
বাঙালি মুসলমান আত্মঘাতী ও বিস্মৃতিপ্রবণ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আশরাফ আলী খানের যেমন ঠাঁই হয়নি, যথেষ্ট সাহিত্যকর্ম তার নেই, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সাংবাদিকতায় তাঁর যে দান, তা-ও স্বীকৃতি পায়নি। বঙ্গীয় মুসলমানদের দৈনিক পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনায় যারা পথিকৃৎ, আশরাফ আলী তাঁদের একজন। আজ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগ রয়েছে। সেগুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের কজন আশরাফ আলীর নামটি জানেন? ১৯২৮-২৯ সালে তিনি ছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ছোলতান-এর সম্পাদক। বিশের দশকে মুসলমানদের একটি ইংরেজি দৈনিক ছিল দ্য মুসলমান। সম্পাদক ছিলেন মজিবর রহমান। কুড়ি শতকের প্রথম দিকের বাঙালি মুসলমানের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তাচেতনার ইতিহাস রচনার জন্য দৈনিক ছোলতান, দ্য মুসলমানের সাহায্য নেওয়া অপরিহার্য। আমি দ্য মুসলমান ঘেঁটেছি কিন্তু দৈনিক ছোলতানের কপিগুলো দেখার। সুযোগ পাইনি। উল্লেখযোগ্য যে, ছোলতান নামে একটি সাপ্তাহিকও ছিল, যা সম্পাদনা করেছেন মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। দৈনিক ছোলতানেরও প্রধান পরিচালক ছিলেন তিনি। পথনির্মাতাদের ভুলে যেতে নেই।