‘হিন্দুস্থানের জাতীয়তাবোধ দৃঢ়তর করিবার জন্য হিন্দুস্থানি সরকার সমগ্র হিন্দুস্থানে এক ভাষা, এক বর্ণমালার নব হিন্দুস্থান গড়িতে অগ্রসর হইতেছে। আজ সমগ্র পাকিস্তানবাসী নিজেদের সাহিত্যকে আরবি অক্ষরে রূপান্তরিত করিতে চাহে। জাতি চাহে পর্বতের ন্যায় মজবুত ভিত্তিতে তাহাদের তমদ্দুনের প্রতিষ্ঠা। ইহাই জাতীয় আন্দোলন। আরবি অক্ষরে বাংলা বর্ণমালাকে রূপান্তরিত করিলে। বাংলাসাহিত্যের ক্ষতির তুলনায় লাভ হইবে শতগুণ বেশি।]
[আজাদ, ৯ এপ্রিল, ১৯৪৯]
এই জাতীয় লেখকের সততার পরিচয় পাওয়া যেত যদি তারা নিজেরা আরবি অক্ষরে বাংলা সাহিত্য রচনা করে দেখিয়ে দিতেন। তাঁরা সেই ব্যাপারে উপদেশ দিচ্ছেন যে বিষয়ের তারা চর্চা করেন না। তাঁদের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বাংলা সাহিত্যের লক্ষ কোটিগুণ ক্ষতি হতো।
০৪. আরবি, রোমান, বাংলা!
দীর্ঘ পরাধীনতার পর নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রটি কীভাবে গড়ে তোলা যায়, রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর কীভাবে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব, সে ব্যাপারে শিক্ষিত সমাজ আত্মনিয়োগ না করে, একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত ভাষাকে কীভাবে বিকৃত ও তছনছ করা যায়, তাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন একশ্রেণির উচ্চশিক্ষিত কবি-সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। যে সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ নিরক্ষর, যাদের দুই বেলা দু-মুঠো অন্নের সংস্থান করাই কঠিন, সেই সমাজে একটি নিতান্ত অনাবশ্যক ব্যাপারে মাথা ঘামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। তারা নিজেরা ছিলেন বিভ্রান্ত মানুষ, জনগণকেও বিভ্রান্ত করতে থাকেন।
যে ভাষার কবি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান, সে ভাষাভাষীর কোনো রকম হীনম্মন্যতা থাকার কথা নয়। সে ভাষার ভাব প্রকাশের ক্ষমতা অপার এবং তা যে লিপিতেই লেখা হোক, তা বৈজ্ঞানিক। বাংলার আগে যেসব ভাষার কবি-সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, সেগুলো হলো ফরাসি, জার্মান, নরওয়েজিয়ান, স্প্যানিশ, পোলিশ, ইতালিয়ান, ইংরেজি, সুইডিশ ও ডাচ। এসব ভাষার কাতারে স্থান পায় বাংলা। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও যে ভাষায় একজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র ও নজরুল ইসলাম আছেন, সে ভাষার মানুষের তো অহংকারের সীমা থাকার কথা নয়। সে ভাষার সংস্কার করা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই।
আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তন অথবা রোমান অক্ষরে বাংলা লেখার চিন্তা কারও মাথায় আসাটাই স্রেফ দুর্বুদ্ধি। ব্যক্তিবিশেষের দুর্বুদ্ধি হলেও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু যখন প্রস্তাবের পেছনে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি থাকে বা বিশেষ মতলব কাজ করে, তখন তা অতি নিন্দনীয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই নিন্দনীয় কাজটিই করেছেন একশ্রেণির প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিক এবং তাঁদের তাঁবেদার লেখক ও শিক্ষাবিদ।
পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হলেও তার একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক সত্তা ছিল-পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চল বা কেন্দ্র থেকে তা হাজার মাইল দূরে। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান বা সীমান্ত প্রদেশ পাশাপাশি ও অবিচ্ছেদ্য। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশও মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান ছিল এমন এক স্বতন্ত্র ভূখণ্ড, যার অধিবাসীদের ৯৯ ভাগ বাংলা ভাষায় কথা বলে। যে বাংলা ভাষার রয়েছে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। বাংলা সাহিত্য পৃথিবীর উন্নত সাহিত্যগুলোর একটি। বাংলা ভাষা বাঙালির গর্বের ধন। সে ভাষা নিয়ে ছেলেখেলা চলে না।
আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে একদিকে ছিল ধর্মীয় আবেগ (বরং বলা ভালো অর্থহীন ভাবাবেগ), অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতির খোঁড়া যুক্তি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১৫ মাসের মধ্যে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দেশের কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচিতে ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪৮। সম্মেলন উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। তিনি একজন বাঙালি। তিনি পাকিস্তানের শিক্ষাকে ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন এবং বাংলা। ভাষায় আরবি হরফ প্রচলনের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন, তার দ্বারা আঞ্চলিক ভাষাগুলির সংরক্ষণের কাজ সাধিত হবে। তা ছাড়া আরবি বর্ণমালা পাকিস্তানের। বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষাগত সামঞ্জস্য বিধানেও সহায়তা করবে।
[বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, দ্বিতীয় সংস্করণ, ঢাকা, ১৯৬৯, পৃ. ২৪৬]
শুধু একেবারে কথার কথানয়,মিশনারি উদ্দীপনানিয়ে শিক্ষামন্ত্রীশিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামীকরণ এবং বাংলা ভাষাকে আরবীকরণে অব্যাহত চেষ্টা চালাতে থাকেন। এবং তাঁকে সমর্থন করার মতো শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক বাংলার মাটিতে যথেষ্টই ছিলেন। দুই মাস পরে, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯, যখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন চলছে, তখন পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান শিক্ষা-উপদেষ্টা বোর্ডের দ্বিতীয় অধিবেশন। সেখানেও ফজলুর রহমান জাতীয় সংহতির যুক্তিতে আরবি হরফের পক্ষে ওকালতি করেন। দৈনিক আজাদে তাঁর ভাষণের যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তাতে তিনি বলেন, সহজে এবং দ্রুত যে হরফের মারফত ভাষা পড়া যায় সেই ভাষাই সবচাইতে ভালো। তিনি বলেন, কোন হরফটা ভালো তা। ঠিক করার পূর্বে একবার বিভিন্ন প্রদেশের হরফের বিচার প্রয়োজন। সিন্ধুর ভাষা হচ্ছে সিন্ধি, কিন্তু তার হরফ আরবি। পশ্চিম পাঞ্জাবের ভাষা উর্দু হলেও তার হরফ “নাস্তালিক”। সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের ভাষা পশতু হলেও হরফ বহুলাংশে আরবি। তার মতে,বাংলায় বহু সংযুক্ত অক্ষর এবং এর স্বরবর্ণের নানা চিহ্ন থাকায়। তা টাইপরাইটিং বা শর্টহ্যান্ডে ব্যবহার করা যায় না। আরবি হরফই সহজ। দ্রুত লিখন ও পঠনের পক্ষে সুবিধাজনক বলে আরবিকেই পাকিস্তানি ভাষার (বাংলাসহ) হরফ করা উচিত। আরবি হরফ প্রবর্তিত হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নিরক্ষরতা দূর করার পথ সহজ হবে।