আজাদ ছিলেন বহুমুখী সৃষ্টিশীল প্রতিভা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ প্রভৃতি তিনি দুহাতে লিখবেন। তার প্রথম উপন্যাস তেইশ নম্বর তৈলচিত্র প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। পরবর্তী তিন বছরে প্রকাশিত হয় তাঁর তিনটি উপন্যাস : কর্ণফুলী, শীতের শেষ রাত বসন্তের প্রথম দিন এবং ক্ষুধা ও আশা। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও কবিতার বই বের হয় একটু দেরিতে। প্রথম কাব্য সংকলন মানচিত্র ১৯৬১-তে এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ ১৯৬২-তে। পঞ্চাশের দশকে এবং ষাটের শুরুতে প্রকাশিত তার দুটি নাটক– মরক্কোর জাদুকর এবং ইহুদির মেয়ে প্রশংসিত হয়েছিল। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ শিল্পীর সাধনা তাঁর মননশীলতার পরিচয় বহন করে। ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত রচিত আজাদের সাহিত্য সম্ভারের পরিমাণ প্রচুর।
শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ এবং তাদের বন্ধুরা পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের সাহিত্যের যে ভিত্তি স্থাপন করেন, তার ওপরই নির্মিত হয়েছে আধুনিক বাংলাদেশের সাহিত্যের সৌধ।
আশির দশকের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ কবি হতে গিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যজগতকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেন। এক দলকে তার পাশে নিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা দেন, অন্যদের করেন নানাভাবে অসম্মান। আজাদ শিক্ষা। মন্ত্রনালয়ে যুগ্মসচিব পদমর্যাদায় উপদেষ্টা বা এ ধরনের কোনো পদে ছিলেন। সুতারাং সরকারি পক্ষে তাঁর না থেকে উপায় ছিল না। তার ফলে তিনি তাঁর প্রথম দিকের বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাঁর সেই বন্ধুরাও ক্ষুদ্রতামুক্ত ছিলেন না।
২৬. পথ নির্মাণ করেছেন যারা
এক একজন লেখক কোন ভাষায় লিখলেন, কী লিখলেন, কেমন লিখলেন, সেটাই বিবেচ্য। তিনি কোন ধর্মমতাবলম্বী, তিনি আস্তিক না নাস্তিক, সেটা তাঁর সাহিত্য বিচারের সময় কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। লেখক কোন দেশের নাগরিক, জাতিসত্তার দিক থেকে তিনি কী– সেটাও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তিনি কোন ধর্মাবলম্বী তা বড় ব্যাপার নয়। কাহলিল বা খলিল জিব্রান মূলত আরবি ভাষার প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও মরমি কবি। শেষ জীবনে তিনি ইংরেজিতেও লিখেছেন। তাঁর পরিচিতি তিনি আরবি সাহিত্যের লেখক। জাতীয়তার প্রশ্ন যদি আসে, তিনি একজন লেবানিজ। নাগরিকত্বের দিক থেকে দেখলে তিনি একজন আমেরিকান। তাঁর অশ্রু ও মৃদুহাসি আরবি ভাষায় রচিত, তা পরে আ টিয়ার অ্যান্ড আ স্মাইল নামে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। মূলত ইংরেজিতে রচিত তাঁর দ্য প্রফেট, দ্য ফোররানার, দ্য স্যান্ড অ্যান্ড ফোম প্রভৃতি। লেবাননের আরবি সাহিত্যের লেখক হিসেবেই তার পরিচিতি। আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন, বাস করতেন নিউইয়র্কে। ইংরেজি ভাষায় লিখলেও ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে কাহলিল জিব্রান উল্লিখিত হন না। তিনি মুসলমান না খ্রিষ্টান, সে প্রশ্ন কেউ তোলে না। একই কথা একালের ঔপন্যাসিক সালমান রুশদি সম্পর্কেও প্রযোজ্য। তিনি একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান লেখক। জন্ম তাঁর মুম্বাইতে হলেও পশ্চিমেই থাকেন এবং লেখেন সব সময়ই শুধু ইংরেজিতে, কোনো ভারতীয় ভাষায় নয়। তিনি মুসলমান পিতামাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন বলে তাঁর আসল নাম ‘আহমদ সালমান রুশদি’। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনি তাঁর ফতোয়া দিয়ে রুশদির মুসলমান পরিচয়কে বিশ্বব্যাপী বড় করে তোলেন। তা না হলে তিনি আধুনিক ইংরেজি ভাষার একজন লেখক হিসেবেই শুধু পরিচিতি পেতেন। প্রেম চাঁদ উর্দু ও হিন্দি ভাষার ভারতীয় কথাশিল্পী, তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী কি না তা কোনো বিবেচনার বিষয় নয়।
বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। এ ভাষার ইতিহাস লেখকেরা কোনো দিন লেখেন না মুকুন্দ রায়, ভারতচন্দ্র, ঈশ্বর গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র হিন্দু কবি কথাশিল্পী, এ কথাও কেউ কখনো লেখেন না যে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-ব্রাহ্ম কবি। কিন্তু যখন আলাওল, মীর মশাররফ বা নজরুল বা জসীমউদ্দীনের নাম আসে, তখন তাদের ধর্মীয় পরিচয়টি অবধারিতভাবে উল্লেখ করা হয়। অন্যান্য ইসলাম ধর্মাবলম্বী কবি-সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে তো বটেই। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার শিকড় বঙ্গীয় সমাজে অনেক গভীরে। গোবিন্দচন্দ্র দাস একেবারে নির্ভেজাল পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের কবি, তিনি পশ্চিমবঙ্গের কেউ নন, কিন্তু শুধু তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে পশ্চিমবঙ্গ তাঁকে স্বীকার করে। তিনি মুসলমান হলে তাঁকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ আলোচনা-গবেষণা করত না। এদিক থেকে পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশ অনেক বেশি উদার। এখানকার সাহিত্যসমাজ বাংলা ভাষার যেকোনো কীর্তিমানকে নিজের বলে মনে করে। সে কারণেই শামসুর রাহমানের জন্মমৃত্যু বার্ষিকীতে কলকাতায় এক ছটাকও লেখালেখি হয় না, কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখকে নিয়ে এখানে নাচানাচির শেষ নেই।
ওখানকার একশ্রেণির কবি-সাহিত্যিক বাংলাদেশের বাজার ধরার জন্য বাংলাদেশকে চুটিয়ে প্রশংসা করেন, তবে তা করেন ঢাকায় এসে। দেশে ফিরে গিয়ে এখানকার প্রধান লেখকদের সম্পর্কেও দুই লাইন লেখেন না। আমাদের একশ্রেণির লেখক, সাংবাদিকের মধ্যেও একধরনের হীনম্মন্যতা ও দাস্যমনোবৃত্তি বাসা বেঁধেছে। তারা মনে করেন, কলকাতায় গিয়ে কল্কে পেলেই জীবন ধন্য। নির্ভেজাল জাতীয়তাবোধ বিকশিত হলে, স্বাজাত্যচেতনা অম্লান থাকলে এমনটি হতো না। জর্জ বার্নার্ড শ, জেমস জয়েস ইংরেজি সাহিত্যেরই দিকপাল, কিন্তু আইরিশরাই তাদের মনে করে নিজের মানুষ। জয়েসকে নিয়ে আইরিশদের যে অহংকার, ব্রিটিশদের ততটা নয়।