১৯৪৮ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কিছুদিন পুরানা পল্টনে এক বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। রেডিও পাকিস্তান ঢাকার সহকারী বার্তা সম্পাদক ছিলেন। তাঁর এক অবাঙালি বাবুর্চি ছিল। তাকে নিয়ে একদিন ঠাঠারিবাজারে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক বাড়ির জানালায় গোলাম কুদ্দুসকে দেখতে পান। তখন দাঁড়িয়ে কোনো কথা না বলে, না দেখার ভান করে তিনি বাজার করে আসেন। বাসায় এসে ওয়ালীউল্লাহ তাঁর কাজের লোকটির হাতে একটি চিরকুট দিয়ে গোলাম কুদুসের কাছে পাঠান। চিরকুটে লেখা ছিল :
‘আপনি আমার চাকরের সঙ্গে এক্ষুনি আমার বাসায় চলে আসতে পারেন। খুব নিরাপদ আস্তানা। যতদিন খুশি থাকতে পারেন। আমি অবিবাহিত।’
অনিশ্চিত পরনির্ভর জীবনে বন্ধুর এই আহ্বান বিধাতার আশীর্বাদের মতো। মুহূর্ত দেরি না করে গোলাম কুদ্দুস ওয়ালীউল্লাহর বাসায় চলে আসেন। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর ওয়ালীউল্লাহর বন্ধুবান্ধবরা আসতেন। আড্ডা চলত অনেক রাত অবধি। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেই ছিলেন তার বন্ধু। একদিন আসেন পুলিশের একজন ডিআইজি। পেশাগত দক্ষতা থেকে তিনি বুঝতে পারেন গোলাম কুদ্দুস একজন আত্মগোপনকারী বাম নেতা। তাঁর সম্পর্কে তিনি ওয়ালীউল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন। তাঁদের কথাবার্তা কানে যেতেই গোলাম কুদ্দুস পরদিনই অন্য জায়গায় চলে যান।
গোলাম কুদ্দুস এ সম্পর্কে আমাকে যা জানান, তা এ রকম : ‘পুরান ঢাকায় কারও বাড়িতে এক রাত রইলাম। তার পরদিন পার্টির এক কর্মী আমাকে নিয়ে যায় ঢাকার পাশেই মালিবাগ নামক এক শহরতলির গ্রামে। সেই মালিবাগ গ্রামে গাছপালা-জঙ্গল ছিল প্রচুর। সেখানে এক টিনের ঘরে থাকতেন এক তরুণ লেখক। নিজেই রান্না করে খেতেন এবং প্রচুর পড়াশোনা করতেন। আমি যাওয়ায় তিনি পেলেন একজন সঙ্গী। সেই তরুণের নাম আলাউদ্দিন আল আজাদ। কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় কর্মী।’
গোলাম কুদ্দুস জানান, মালিবাগ থেকে হেঁটে আজাদ শহরে ঢাকা কলেজে যেতেন। (বর্তমান ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস নয়) বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। বিভিন্ন মানুষ থেকে বই ধার নিয়ে আসতেন। বাংলা, ইংরেজি গল্প-কবিতার বই প্রচুর পড়তেন। মার্ক্সবাদী সাহিত্য নিয়ে আমার সঙ্গে তাঁর আলোচনা হতো।
আমি গোলাম কুদ্দুসকে বললাম, আপনি যে মালিবাগ গ্রামের কথা বলছেন এখন আর তা কোনো গ্রাম নয়, শহরতলিও নয়, অতি ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা মহানগরীর একটি এলাকা।
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে গোলাম কুদুসের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল কবি ও কথাশিল্পী হিসেবে। বাম রাজনীতিতে বেশি জড়িয়ে পড়ায় তাঁর লেখালেখির ক্ষতি হয়। তাঁর দুটি কবিতার বই প্রশংসিত হয়েছিল। একটি বিদীর্ণ এবং অপরটি ইলা মিত্র। নাচোল আন্দোলনের ইলা মিত্রকে নিয়ে কবিতা লিখে ডান-বাম সব শ্রেণির পাঠকেরই প্রশংসা অর্জন করেন। তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে বন্দী, মরিয়াম, একি শূঙ্গে প্রভৃতি রয়েছে। ঢাকায় থাকলে এবং সাহিত্যচর্চা ভালোভাবে চালিয়ে গেলে গোলাম কুদ্দুস বাংলা সাহিত্যে একটি স্থান করতে পারতেন বলে মনে করতেন তাঁর বন্ধু শওকত ওসমান ও কবি আবুল হোসেন। গোলাম কুদ্দুস জানান, আলাউদ্দিন আল আজাদের কিছু ছোটোগল্প কলকাতার লেখকসমাজেও প্রশংসিত হয়েছিল। তাঁর গল্পের সংকলন জেগে আছির কলকাতার পত্রপত্রিকায় প্রশংসামূলক সমালোচনা বেরিয়েছিল। কিছুদিন পরে বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় তাঁর কবিতাও প্রকাশিত হয়। পঞ্চাশের শুরুতেই আজাদ একজন প্রতিষ্ঠিত কবি ও কথাশিল্পী।
আলাউদ্দিন আল আজাদ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। প্রস্তুতি নিয়েই তিনি সাহিত্যসাধনা করেছেন। প্রথম দিকে তিনি কবিতা ও গল্পই বেশি লিখতেন। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই প্রকাশিত হয় আজাদের দুটি ছোটগল্পের। বই : জেগে আছি এবং ধানকন্যা। এই দুই সংকলনের গল্পগুলো তাঁর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে রচিত। সুতরাং, অপরিণত হাতের ছাপ থাকাই স্বাভাবিক; কিন্তু শিল্পকর্ম হিসেবে অবহেলা করার মতোও নয়। তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স এবং ‘৫৪-তে মাস্টার্স করেন। তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং যথার্থ অর্থে একজন ভাষাসংগ্রামী।
একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তপাতের পর পরই ভাষাসংগ্রামীরা রাতারাতি একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। কিন্তু সরকার চায়নি কোনো স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করা হোক ঘটনাস্থলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা শহীদ মিনারটি ভেঙে দেন। প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা দেখে অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র আজাদ লিখেছিলেন। একটি প্রতিবাদী কবিতা :
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ভয় কি বন্ধু,
আমরা এখনো চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো। যে ভিত কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরার মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটিকা ধূলায় চূর্ণ যে-পদপ্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক
ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
চার কোটি পরিবার।
[একুশে ফেব্রুয়ারি]
সংঘবদ্ধ সাহিত্যচর্চায় পঞ্চাশের প্রথম দিকে আজাদ খুবই সক্রিয় ছিলেন। সাহিত্যের সভা-সমাবেশের আয়োজন করতেন এবং সাহিত্য সম্মেলনগুলোতে অংশগ্রহণ করতেন। ওই সময়ে বাম ধারার লেখক হিসেবে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের প্রত্যাখ্যান করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করতে যাঁরা তখন ভূমিকা রাখেন, আজাদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। বিশেষ করে তাঁর পরিচিতি ছিল সমাজ সজ্ঞান লেখক হিসেবে। জেগে আছি এবং ধানকন্যার গল্পগুলোতে সমাজের হতদরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের চিত্রই তিনি এঁকেছেন। ‘কয়েকটি কমলা লেবু’, ‘কয়লা কুড়ানোর দল’, ‘রঙিলা’, ‘সুবসা’, ‘শিষ ফোঁটার গান’ প্রভৃতি গল্পে সর্বহারা মানুষের দুঃখ-বেদনার কথাই বলা হয়েছে। পাকিস্তানি জোশের জ্বরে আক্রান্ত সমাজে এই সমাজসচেতন ধারার রচনার মূল্য ছিল অসামান্য।