একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনের একটি ২২ পৃষ্ঠার ভূমিকা লিখেছিলেন আলী আশরাফ : একুশে ফেব্রুয়ারিবিষয়ক প্রথম নির্মোহ ও নিরপেক্ষ দলিল। একুশের ইতিহাসের ঘটনাপঞ্জি লিখেছিলেন অর্থনীতির ছাত্র চট্টগ্রামের অধিবাসী কবির উদ্দিন আহমদ। পরবর্তীকালে একুশের ভাষা আন্দোলন নিয়ে লাখো পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে, কিন্তু এই বইয়ের এই দুটি রচনার সঙ্গে ওই লাখো পৃষ্ঠার তুলনা চলে না। ওই সংকলনের লেখকদের অধিকাংশই আজ বেঁচে নেই। এখনো আমাদের মধ্যে আছেন আনিসুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী ও চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। মুর্তজা বশীর শুধু চিত্রাঙ্কন করেননি, একটি বেওয়ারিশ ডায়েরির কয়েকটি পাতা’ শীর্ষক তাঁর একটি রচনাও ছিল। আর একটি একুশের নকশা ছিল সালেহ আহমেদের, শিরোনাম ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত সাক্ষর। ওই সংকলনের সকল প্রয়াত ও জীবিত লেখককে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
আলী আশরাফ ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’ শীর্ষক তাঁর প্রবন্ধে লিখেছিলেন :
‘…লীগ নেতারা ঘোষণা করলেন “উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা”। স্বৈরাচারী লীগ শাসন পাকিস্তানের অন্যান্য ভাষাভাষী জনগণের ভাষাগুলোকে উপেক্ষা করে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রে বিশেষ মর্যাদা দিতে চাইলেন।
‘এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেই অতীতের সেই ভাষার লড়াই আবার জেগে উঠল নতুনভাবে নতুন শক্তিতে। সে লড়াই একটা বিশেষ গৌরবময় রূপ ধারণ করেছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু বিভাগোত্তরকালের ইতিহাসই নয়, এ পবিত্র দিনটি আমাদের দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পুরো ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।’
১৯৫৩-তে এই অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণীটি প্রকাশ করা ছিল ঘোরতর রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। সেই ঝুঁকি নিয়েই তারা সেদিন তা করেছিলেন। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং বাজেয়াপ্ত করে তার সমস্ত কপি। আমার আব্বা মোহাম্মদ সুলতানের সহায়তায় একটি কপি জোগাড় করেছিলেন।
একুশে ফেব্রুয়ারির মূল কপিটি আমার কাছে ছাড়া আজ আর কোথাও কারও কাছে নেই। গত ৬০ বছরে আমাদের হাজারখানেকের বেশি বই খোয়া গেছে। ওই বইটিকে আমি যক্ষের ধনের মতো আজও আগলে রেখেছি একটি পবিত্র স্মৃতি হিসেবে। আশির দশকে বাংলা একাডেমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারি বইটির একটি কপি কারও কাছে আছে কি না তা জানতে। তারা একটি ফ্যাক্সিমিলি প্রকাশ করার পরিকল্পনা নেন। কোথাও পাওয়া যায়নি। আমার কপিটি থেকেই ফটোকপি করে নেওয়া হয়েছিল।
২৫. আলাউদ্দিন আল আজাদ
সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা শিল্প-সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। কবি, কথাশিল্পী, মননশীল লেখক ও শিল্পীদের সমসাময়িক রাজনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনুপ্রাণিত এবং প্রভাবিত করবেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শিল্প-সাহিত্য আর আগের মতো রইল না। মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পূর্ব বাংলার মুসলমান লেখকদের রচনার বিষয়বস্তুতে নতুন উপাদান যোগ হয় : ইসলাম ও মুসলমান। বিশেষ করে যারা পাকিস্তানবাদী ছিলেন, তাঁদের রচনায়। কিন্তু পাকিস্তানের অনুগত নাগরিক হয়েও নতুন প্রজন্মের অনেকেই পাকিস্তানবাদী ছিলেন না। তাঁরা কেউ ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, কেউ ছিলেন বামপন্থী ধারায় জীবনের জন্য শিল্প’ নীতিতে।
পাকিস্তান ও ভারতের রাজনৈতিক আদর্শ ছিল ভিন্ন; কিন্তু দুই নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের একটি ক্ষেত্রে অভিন্নতা ছিল, তা হলো, দুই রাষ্ট্রই কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের এক নম্বর শত্রু ঘোষণা করে। স্বাধীনতার অল্পকাল পরই ভারত সরকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করে। বহু কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীকে জেলে ঢোকানো হয়। অনেকে আত্মগোপনে চলে যান। কেউবা পূর্ব পাকিস্তানে, কেউবা পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান। পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলেও ব্যাপক হারে কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করে। ১৯৪৭-পরবর্তী কয়েকটি বছর পাকিস্তান ও ভারতে কমিউনিস্টদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। দুই দেশের কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বা অন্যভাবে বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।
নতুন প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে তরুণ লেখকদের মধ্যে আলাউদ্দিন আল আজাদ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তখন তিনি কলেজের ছাত্র। লেখালেখি করে কিছুটা পরিচিতিও পেয়েছেন। ‘৪৭-এর পর কলকাতা থেকে ঢাকায় পালিয়ে এসেছিলেন চল্লিশের দশকের কবি ও কথাশিল্পী গোলাম কুদ্দুস। তিনি ছিলেন শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহদের বন্ধু। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। চুয়াডাঙ্গার অধিবাসী, কিন্তু ‘৪৭-এর পর ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে কলকাতায় থেকে যান। আশির দশকে আমি কলকাতায় তাঁর আহিরিপুকুর লেনের বাসায় তাঁর একটি সাক্ষাঙ্কার গ্রহণ করি। তিনি বলেন, ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি ঢাকায় এসে আত্মগোপন করে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেন। ঢাকার বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা নেপাল নাগ তাকে ওয়ারী এলাকায় এক হিন্দুর পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। নাম পরিবর্তন করে থাকলেও গোয়েন্দা পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেটা টের পেয়ে গোলাম কুদ্দুস পুরানা পল্টনে এক পরিচিত লোকের বাড়িতে এসে ওঠেন। সারা দিন তিনি ঘরে থাকতেন, রাতে বেরিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতেন।