উপযুক্ত আরবি-ফারসি শব্দে অমুসলমান পাঠকেরও আপত্তি ছিল না, কিন্তু অপ্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দে রচিত সাহিত্যে মুসলমান পাঠকেরও অরুচি ছিল। বিষয় হিসেবেও নতুন পাঠকদের মধ্যপ্রাচ্য ও ইসলাম নিয়ে আগ্রহ ছিল না। তারা চেয়েছেন সাহিত্যে তাঁদের জীবনের প্রতিফলন ঘটুক, তাঁদের স্বপ্ন ও বাস্তব নিয়ে সাহিত্য রচিত হোক।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিকেরা নতুন রাষ্ট্রে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করার প্রত্যয় নিয়ে লেখালেখি করতে থাকলেও তাঁরা কী রকম একটি ধারা। সৃষ্টি করবেন, সে সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলাম ও মুসলমানত্ব প্রাধান্য পাবে– সে রকম একটি অঘোষিত বা ঘোষিত নীতি তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু অবিলম্বে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠায় লেখকদের একটি বড় অংশ মুসলিম জাতীয়তার পরিবর্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। তারা উপলব্ধি করেন, বাংলা বিসর্জন দিয়ে উর্দুর আধিপত্য স্বীকার করার জন্য তারা পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন দেননি। আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত নতুন প্রজন্মের লেখকেরা রক্ষণশীলতার পরিবর্তে আধুনিকতাবাদের দিকেই ঝুঁকে থাকেন। এসব আধুনিকতাবাদী লেখক-কবিদের কেউই মোটেও পাকিস্তানবিরোধী। ছিলেন না। তারা পাকিস্তানও চেয়েছেন, প্রগতিশীলতাও চেয়েছেন। তাঁরা অপছন্দ করেছেন পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকচক্রের স্বৈরাচারী মনোবৃত্তিকে।
১৯৪৮-এর শেষ দিকে প্রকাশিত হয় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু, শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্পের বই পথ জানা নাই ১৯৪৮-এ এবং অনেক দিনের আশা ১৯৪৯-এ। আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্পগ্রন্থ জেগে আছি এবং ধানকন্যা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের বছরখানেক আগে প্রকাশিত হয়। এসব গল্প উপন্যাসে পাকিস্তানি ভাবধারার কোনো চিহ্ন ছিল না। যে কবির কথা এখন সবাই ভুলে গেছে, সেকালে যথেষ্ট নাম ছিল, আবদুর রশীদ খানের নক্ষত্র মানুষ মন কাব্যগ্রন্থ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অল্প আগে এবং তাঁর বন্দি মুহূর্ত বায়ান্নর শেষ দিকে প্রকাশিত হয়। এসব কবি-কথাশিল্পী পাকিস্তানের অনুগত নাগরিক ছিলেন, তারা মুসলমানিত্ব ও বাঙালিত্ব দুই পরিচয়ই ধারণ করতেন, কিন্তু আধুনিক হওয়ার চেষ্টাও করেছেন। তাঁরা ছিলেন তিরিশের আধুনিক কবিদের দ্বারা প্রভাবিত। তাঁদের উত্তরসূরি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পূর্ব বাংলার কবি-লেখকদের এক নবজীবন দান করে, কিন্তু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এই ভূখণ্ডের কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের দান করে এক নবতর জীবনদর্শন। তাঁদের আর আত্মপরিচয়ে কোনো সংকট বা বিভ্রান্তি রইল না। তারা বাঙালি। ধর্মীয় পরিচয়ে কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ প্রভৃতি।
একুশের ভাষা আন্দোলনের অল্প পরে আমি আমার বাবার সঙ্গে ঢাকায় আসি। তিনি শহীদ রফিকের ওপর দীর্ঘ ১৪ পৃষ্ঠার মতো একটি শোকগাথা লেখেন, সেটা ছাপাতে এসেছিলেন আমাদের এক আত্মীয়ের প্রেসে। সম্ভবত কয়েক মাস ঢাকা শহরে একটি শোকের থমথম পরিবেশ ছিল। ১৯৫৩-র মার্চে আবার ঢাকায় আসি। সেই সময় জিন্দাবাহার লেনের কোনো এক বাঁধাইখানা থেকে আব্বা একটি বই সগ্রহ করেন। বইটি তিনি কাপড় দিয়ে জড়িয়ে আলমারিতে রেখে দিয়েছিলেন। কখনো পড়ার প্রয়োজন হলে তিনি পড়তেন, তারপর ওইভাবেই কাপড়ে মুড়ে কাপড়চোপড়ের নিচে আলমারিতে রেখে দিতেন। বইটি কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। তার নাম একুশে ফেব্রুয়ারি। বিভিন্ন কবি-লেখকের লেখার একটি সংকলন, সম্পাদনা করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। পুঁথিপত্র প্রকাশনীর পক্ষে প্রকাশক ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান।
মোহাম্মদ সুলতান ও হাসান হাফিজুর রহমানের প্রকাশিত ও সম্পাদিত সেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে একটি বই বললে সম্পূর্ণ বলা হয় না। ওই বই থেকে পূর্ব বাংলার আধুনিক সাহিত্যের নবযাত্রার শুরু। ওই সংকলনের যারা লেখক ছিলেন, পরবর্তী দশকে তারাই আমাদের আধুনিক লেখক এবং প্রধান লেখক। কারা ছিলেন তার লেখক? কবিদের মধ্যে ছিলেন শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আনিস চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, জামালুদ্দিন ও আতাউর রহমান। গল্প ছিল পাঁচটি। লেখক শওকত ওসমান (মৌন নয়), সাইয়িদ আতীকুল্লাহ (হাসি), আনিসুজ্জামান (দৃষ্টি), সিরাজুল ইসলাম (পলিমাটি) ও আতোয়ার রহমান (অগ্নিবাক)।
একুশের গান ছিল দুটি। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ এবং তোফাজ্জল হোসেনের একটি গান। তাঁর গানের প্রথম কয়েকটি চরণ এ রকম :
রক্ত শপথে আমরা আজিকে তোমারে স্মরণ করি
একুশে ফেব্রুয়ারি,
দৃঢ় দুই হাতে রক্ত পতাকা উর্ধ্বে তুলিয়া ধরি
একুশে ফেব্রুয়ারি
তোমারে স্মরণ করি।
তুমি হয়ে আছ আমাদের মাঝে চিরজ্যোতি অম্লান
তোমার বক্ষে কত না শহীদ রক্তে করিল স্নান,
কত বীর ভাই সেদিন জীবন করে গেল বলিদান
সেদিন প্রথম ভীরু কুয়াশার জাল গেল দূরে সরি।
ওই বইয়ের গেটআপ বা অঙ্গসজ্জা, মেকআপ আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। ওই সময়ে তার চেয়ে ভালো করার উপায় ছিল না। ক্রাউন আকারের ১৮০ পৃষ্ঠার বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন আমিনুল ইসলাম এবং অঙ্গসজ্জার রেখাঙ্কন করেছিলেন মুর্তজা বশীর। সঙ্গে আরও কোনো কোনো নতুন শিল্পী ছিলেন। বইটি ছাপা হয়েছিল পাইওনিয়ার প্রেস থেকে, যার স্বত্বাধিকারী ছিলেন এম এ মকিত। ব্লক বানিয়ে দিয়েছিল বাদামতলীর নামকরা এইচম্যান কোম্পানি। এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম উল্লেখ করার কারণ, তারা জাতির জীবনে একটি ঐতিহসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন।