‘কথাটি অবশ্য তাঁর নিজের কবিতা সম্বন্ধে তিনি বলেননি।’
জীবনানন্দ দাশ ‘বামপন্থী’ বা প্রগতিবাদী কবি ছিলেন না বটে কিন্তু যাঁরা নিজেদের ওই পন্থী বলে ঘোষণা করতেন বা দাবি করতেন তাঁরা কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল না পড়লেও তিনি পড়ছিলেন বলে শামসুদ্দীন জানতেন।
পঞ্চাশের দশকে শামসুদ্দীন আবুল কালাম পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডিপিআর বা জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক ছিলেন। থাকতেন আজিমপুর কলোনির ফ্ল্যাটে। আমরা থাকতাম কলোনির পাশেই শেখ সাহেব বাজারে। তিনি সুদর্শন ছিলেন। মুখে চমৎকার দাড়ি ছিল। ফ্যাশনের দাড়ি, ধর্মীয় দাড়িনয়। সাহিত্যচর্চাছাড়া চলচ্চিত্রে তার আগ্রহ ছিল। ইতালি গিয়েও তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর একটি প্রজেক্টরও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেছেন। লন্ডনে আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্যারিসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। শামসুদ্দীন ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী। কলকাতা থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর জানাশোনা ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। তাঁর যে সিনেমার ব্যাপারে উৎসাহ রয়েছে, তা শেখ মুজিব জানতেন। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডন যান, তখন শামসুদ্দীন রোম থেকে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আপনি দেশে চলে আসেন। আপনাকে চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের পরিচালক নিয়োগ দেব।’
প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে শামসুদ্দীন ঢাকায় এসেছিলেন। প্রায় এক মাস ছিলেন। লেখকসমাজ থেকে কোনো অভ্যর্থনা পাননি। লেখক-শিল্পীদের মধ্যে প্রভাবশালী যারা তারা যার যার মতো সরকারের আনুকূল্য পেতে ব্যস্ত ছিলেন। বেইলি রোডের গণভবনে এবং ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে কয়েক দিন শামসুদ্দীন গিয়েছিলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাকে কেউ দেখা করার ব্যবস্থা করে দেননি। ঢাকায় কয়েক দিন ঘোরাফেরা করে হতাশ হয়ে রোমে ফিরে যান। সেখানে গিয়ে বাংলাতেই উপন্যাস লিখেছেন কিন্তু দেশের সঙ্গে স্থায়ী দূরত্ব রচিত হয়েছিল শামসুদ্দীন আবুল কালামের।
২৪. পঞ্চাশের নতুন নক্ষত্রমণ্ডলী
তিরিশ ও চল্লিশের দশকের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পঞ্চাশের দশকের পূর্ব বাংলার আধুনিক বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিল্পকলার সৌধ। ওই দুই দশকে যারা শিল্প-সাহিত্যের জগতে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁদের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, মূলধারার বাংলার শিল্প-সাহিত্যের পাশে তাঁদের কাজ দুর্বল ও ম্লান মনে হতে পারে, কিন্তু যে মানেরই হোক, তাঁদের কাজের ঐতিহাসিক মূল্য অবহেলা করার নয়। তাঁদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। কলকাতার লেখক-পাঠকের কাছে তাদের কদর ছিল না। পূর্ব বাংলার নতুন প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের নব্য আধুনিকদের কাছেও তারা গণ্য হয়েছেন প্রাচীনপন্থী হিসেবে। পঞ্চাশের আধুনিকেরা তিরিশ ও চল্লিশের লেখকদের চেয়ে খুব যে বেশি ভালো লিখেছেন, তা নয়। তবে পঞ্চাশে কয়েকজন শক্তিশালী আধুনিক লেখকের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের মধ্যে শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মূলধারার সঙ্গে সংযুক্ত থেকেই পূর্ব বাংলার শিল্প সাহিত্য নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। নতুন রাষ্ট্রে শিল্পী-সাহিত্যিকেরা নতুনভাবে আত্মপ্রকাশে প্রয়াসী হন। তাতে দুটি ধারাই ছিল : একটি পাকিস্তানবাদী বা মুসলিম জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িক ধারা, অন্যটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা। প্রথম কয়েক বছর পাকিস্তানবাদীদের আধিপত্য ছিল খুব বেশি। তাঁদের চিন্তাধারা ছিল প্রাচীনপন্থী বা মধ্যপ্রাচ্যপন্থী। অধিকাংশ তরুণ লেখক তাঁদের নীতি আদর্শের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেননি। তাঁদের আগ্রহ ছিল আধুনিকতার প্রতি। বিষয়বস্তুর জন্য তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের দিকে না তাকিয়ে নিজের দেশের মাটি ও মানুষের সুখ-দুঃখের কথাই বিবেচনায় আনেন। তবে তাঁদের রচনা দুর্বলতা মুক্ত নয়, বিশেষ করে ভাষা ও রচনাশৈলীর বিচারে।
চল্লিশের শেষ এবং পঞ্চাশের অনেকগুলো বছর পাকিস্তানবাদীরা পাকিস্তানের পাকভূমি এবং ইসলামের ইতিহাসের গৌরবগাথা রচনায় সমস্ত শক্তি ক্ষয় করেন। তাঁদের অনেকের রচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে আজান, নামাজ, ঈদ, শবে বরাত, হজ, জাকাত প্রভৃতি এবং মুসলিম ইতিহাসের খ্যাতিমান পুরুষদের জীবনকাহিনি প্রাধান্য পায়। অবশ্য পাকিস্তানবাদীদের অনেকের বেশ কিছু মননশীল প্রাবন্ধিক রচনা রয়েছে, সেগুলো খুবই সাবলীল গদ্যে রচিত ও বস্তুনিষ্ঠ; কিন্তু পাকিস্তানবাদীদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার অভাব ছিল প্রকট। পাকিস্তানবাদী কবি ও কথাশিল্পীদের রচনায় কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের কথাও অনুপস্থিত। তা ছাড়া বিষয়বস্তু যা-ই হোক, তাদের ভাষা ও রচনাশৈল্পীও সেকেলে এবং শিল্পকর্ম হিসেবে তা মূল্যহীন। পঞ্চাশে অনেক ইসলামী পন্থী কবি ফররুখ আহমদের মতো জোর করে বা অকারণে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। তা করে তারা মুসলমান। পাঠকদের মন জয় করতে চেয়েছেন বটে, কিন্তু তার পরিবর্তে তাঁরা পাঠকের বিরক্তি সৃষ্টি করেছেন। পঞ্চাশের নতুন পাঠকশ্রেণিরও আগ্রহ ছিল আধুনিক রচনার প্রতি– প্রাচীনপন্থী আবর্জনা নয়।